মায়াপথের মীড়-৪/সৌগত ভট্টাচার্য
মায়াপথের মীড়/৪
সৌগত ভট্টাচার্য
রাজাভাতখাওয়া স্টেশন। তখন সদ্য বিকেল লেগেছে স্টেশনের সাইনবোর্ডের গায়ে। আমি লাইনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়। আমার মতো আরো গুটি কয়েক প্যাসেঞ্জার অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য। কিছুক্ষণ পর হেলতে দুলতে ট্রেনটা এল। প্রায় ফাঁকা ট্রেনে উঠে বসলাম। পুরো ট্রেন তাই চেয়ারকার, জনহীন ট্রেনের কামরার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দেখা যাচ্ছে। ট্রেন ছেড়েছে কিছুক্ষণ হলো। জানলার ধারে একটা সিট বসে আছি। পরের দিন দোল পূর্ণিমা, সহযাত্রীরা অনেকেই দোল উপলক্ষ্যে বাড়ি ফিরছে। হ্যামিল্টনগঞ্জে ট্রেনটা দাঁড়িয়েছে। প্ল্যাটফর্মে বেশ ভিড়। তার মধ্যে দেখি একজন ভদ্রলোক একজন ভদ্রমহিলা ও তার নয় দশ বছরের একটি মেয়ে বেশ কয়টি ব্যাগপত্তর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ওঠানোর জন্য বেশ কয়েকজন এসেছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি মামাবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরছে।
ব্যাগপত্র নিয়ে তারা ট্রেনে উঠে গেল। বেশ কিছু লোক ট্রেনে ওঠায় কামরা ভরে গেছে। ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করল। দেখছি, আমার থেকে একটু দূরে তারা তিনজন পাশপাশি বসে আছে। সামান্য ট্রেন এগোতেই হ্যামিলটন থেকে ওঠা সেই মহিলা ট্রেনের কামরায় উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক করতে লাগল। ভদ্রলোক চুপ করে বসে আছে, মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে মাকে দেখছে। দেখি আঁচল থেকে কী সব বের করছে, কামরার এদিক যাচ্ছে ওদিক যাচ্ছে। এবার আমার সামনে এসে বলল, "চা খাওয়াও..." আমি অপ্রস্তুত হয়ে তাকাই। সে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি মহিলাকে ডাকছে চলে আসার জন্য সে আমার সামনে দাঁড়িয়েই আছে। অস্বস্তি হচ্ছে। জানলার বাইরে তাকাই। মহিলা আমার সামনে এসে বলে গেল, "উ মোবাইলে কথা বলতে পারে আর এককাপ চা খাওয়ালেই যত দোষ।" ট্রেন চলছে বাইরে বিকেলের গায়ে সন্ধ্যা ঢলে পড়ছে ক্রমশ, চা বাগানের ছায়া বৃক্ষদের হয়ত সন্ধ্যার চা খাওয়ার সময় হয়েছে।
আমার দৃষ্টির বাইরে মেঘহীন বসন্তের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ নিশ্চয়ই বাইরে উঠেছে, চোখের সামনে ট্রেনের জানলা দিয়ে সে চাঁদ দেখতে পাই না। বাইরে শুধুই অন্ধকার! না অন্ধকার বলা ভুল। জোছনার আলো ছড়িয়ে আছে। সেই মহিলা চাওয়ালাকে ডেকে এক কাপ চা নিয়েছে। আমিও চা নিয়েছি। ফাঁকা ট্রেনে এখন আর ফাঁকা নেই সব সিটে যাত্রী বসে আছে। ভদ্রলোক আর কিশোরী মেয়েটি একটা সিটে চুপচাপ বসে আছে, তারা চা খাচ্ছে না। মহিলার চা খাওয়া হলে চা ওয়ালা টাকা চাইতে গেলে, সেই মহিলা চাওয়ালার হাতে কয়েকটা পুরানো লটারি দিয়ে দেয়। তখন আর বুঝতে অসুবিধা হয় না তার কিছু একটা সমস্যা আছে। ভদ্রলোক চাওয়ালাকে ডেকে টাকা মিটিয়ে দেয়। মহিলা এবার একবার এর পাশে কখনও ওর পাশে বসে পড়ছে, কোনো প্যাসেঞ্জারের থেকে চা খেতে চাইছে, বিড়বিড় করে কী সব বলছে। বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জার অস্বস্তিতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছে। লোকজনের আর দাঁড়ানোর জায়গা নেই ট্রেনে। কিন্তু মাঝের ছয়টা সিট খালি। চারপাশে ঠাসাঠাসি করে লোক দাঁড়িয়ে আছে। সেই মহিলা খালি সিটগুলোর ওপর দাঁড়িয়েছে। এবার সে সিটে দাঁড়িয়ে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ শুরু করেছে। যাত্রীরা সবাই হতবাক। ভদ্রলোক অসহায় চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। একটার পর একটা স্টেশন আসছে, নতুন স্টেশনে ট্রেন থামলে নতুন যাত্রী উঠছে। ফাঁকা সিট দেখে বসছে, কিছুক্ষণের মধ্যে সবটা টের পেয়ে উঠে যাচ্ছে। সে সিটে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করেই যাচ্ছে, মাঝে মাঝে গান করছে, যাত্রীদের নানা কথা উপদেশ দিচ্ছে। ট্রেন চলছে। বাইরে জোছনা।
জামা গুঁজে পরা ব্যক ব্রাশ চুল ভদ্রলোক অনেকবার তার স্ত্রীকে থামতে বলেছে, বিরত করার চেষ্টা করেছে। স্বামীকে সে গালাগাল করেছে। ভদ্রলোক আবার নিজের সিটে এসে মাথা নিচু করে বসে পড়েছে। গোলাপি ফ্রক পরা কিশোরী মেয়েটি এবার সিট থেকে উঠে যায় মায়ের কাছে। মেয়েটি বলে, "মা জায়গায় গিয়ে বস।" মেয়েটিকেও খুব করে বকা দেয় মহিলা, "যা নিজের কাজ নিজে কর, তোর বাবার কোনো কাজ নেই তাই তোকে পাঠিয়েছে!" মহিলা দুই সিটে দুটি পা দিয়ে পা ফাঁক করে ব্যায়াম করেই যাচ্ছে। মেয়েটি কান্না কান্না মুখে তার মায়ের হাত ধরে বলেছে "মা চলো বসবে..." বাপ বেটি অসহায় ভাবে তাকিয়ে দেখছে, পুরো ট্রেন তাকিয়ে দেখছে।
আমি চালসায় নামব। উঠে দাঁড়িয়েছি দরজার সামনে। ট্রেন চাপড়ামারির জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। জোছনা লেগেছে জঙ্গলের গায়ে। সবুজ পাতায় হলুদ আলো। কাল দোল পূর্ণিমা। চাঁদ উঠেছে জঙ্গলের মাথায়। বাইরে তাকিয়ে আছি। জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে চারপাশ। হঠাৎ ট্রেনের ভেতরে একটা বেশ সুরেলা গলা। বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। ট্রেনের ভেতরে তাকিয়ে দেখি সিটের ওপর দাঁড়িয়ে সেই মহিলা গান গাইছে, "স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল। দ্বার খোল্, দ্বার খোল্!" অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি... ওর স্বামী একটা ফেরিওয়ালার থেকে একটার পর একটা সানগ্লাস নিয়ে চোখে দিচ্ছে আর তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখছে, আবার আরেকটা সানগ্লাস পরছে। গোলাপি ফ্রক পরা মাথায় ক্লিপ লাগানো কিশোরীটি মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলেই যাচ্ছে "মা চলো না, বসবে চলো মা এরকম করো না..." ওর মা গেয়েই যাচ্ছে... "নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।"
বাপ মা মেয়ের রঙ-বেরঙের সুর-বেসুর লুকিয়ে পড়েছে পূর্ণিমার কোন অসম্পূর্ণ চাঁদের মায়ায়! তারপরও যে জোছনার রঙের মধ্যে লুকিয়ে থাকে একটা অসহায়তা আর মন কেমনের রং।
যে রঙের কোনো শেড কার্ড হয় না!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴