ভুটিয়াবস্তি
অমিত কুমার দে
জয়ন্তী
তো চিরদিন টানে। সেই কিশোরবেলা থেকে বারবার গেছি। কালীদাদুর সঙ্গে ‘বড়
মহাকালে’ ওঠা আমার জীবনের প্রথম রোমাঞ্চ! তখন আমি ক্লাস সিক্স/সেভেন হয়তো।
গোসানীমারী হাই স্কুলের ভ্রমণে হেডমাস্টারের পুত্র বলে ঢুকে পড়েছিলাম! ঐ
স্কুলের বর্ষীয়ান শিক্ষক কালীদাদু কখনো হাত ধরে, কখনো কাঁধে হাত রেখে কত
গল্প করতে করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। মহাকাল গুহার ছোট্ট গুহামুখে মাথা ঢুকিয়ে
প্রবল ভয় পেয়ে গেছিলাম। ঐ অন্ধকারে ঢুকলে মরে যাব না তো!! কালীদাদুই অভয়
দিয়ে জোর করে ঢুকিয়েছিলেন। কী যত্ন করে গুহা আর তাঁর গায়ে লেগে থাকা পাথর
চিনিয়েছিলেন।
তারপর
জাতীশ্বরদার সঙ্গে জয়ন্তী নদীতে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখা, পাহাড় দেখা! সেও
অন্যরকম! আর বুকের ভেতরে জয়ন্তীকে এঁকে দিয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম জগন্নাথ
বিশ্বাস। তাঁর লেখায় জয়ন্তীকে না-দেখার আগেও দেখে ফেলেছি!
জয়ন্তীর অতীত নিয়ে অজয় রায়-এর একটি লেখা থেকে উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করছে :
“১৮৮৮
সালে এডওয়ার্ড ডালটনের সুপারিশে তখনকার ভারত সরকারের বিদেশ দপ্তর ভুটানের
দেওস্থান নামক অঞ্চলের পূর্ব দিকের ২১.৪৩ বর্গমাইল জায়গাটি ১০০০০ টাকার
বিনিময়ে কিনে নিলে সেই অঞ্চলটির নাম রাখে জৈন্তি/জয়ন্তী ল্যান্ডস। এই ভাবেই
জন্ম নিয়েছিলো ডুয়ার্সে রাণী জয়ন্তী।
জয়ন্তী তখন
গোরা সাহেবদের দখলে। ১৮৯৬ সালে ভূ-তত্ব বিজ্ঞানী এইচ হেডেনের রিপোর্ট
অনুসারে জয়ন্তীর পাহাড় জুড়ে ডোলোমাইট, লিগনাইট,লৌহ তামার আকরিক খোঁজ মেলে।
গোরা
সাহেবরা পাহাড়ের সাথে এখানকার মাটি ও আবহাওয়ার অনুকুলতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে
তুললেন চা বাগান এবং শুরু করল এই এলাকায় চা শিল্পের প্রসার। জয়ন্তী জংগলে
দামী দামী কাঠেও তাদের নজর পড়ে যাওয়ায় নির্বিচারে শুরু হয় বৃক্ষছেদন ফলে
জয়ন্তী বুকেই গড়ে ওঠে এই অঞ্চলের সবচাইতে বড় কাঠের ডিপো। জয়ন্তীর ওপারে
ইউরোপীয়ান চা শিপ্ল জমজমাট হতে শুরু করলে তাদের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়
চা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দিতে। ব্রিটিশ সাহেব তখন এই সমস্যা
থেকে মুক্তি পেতে রেল পথের জন্য আবেদন জানালে কোচবিহারে মহারাজা
নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুর এই আবেদনের সাড়া দিয়ে তিনি কোচবিহারে স্টেট
রেলওয়ে সাথে যুক্ত করলেন ১৯০১ সালে, গিতালদহ-রাজাভাতখাওয়া জং-জয়ন্তী রেল
পথের। বর্ষার মৌসুমে জয়ন্তী নদীর হড়পার মুসকিল আসান করতে ইংল্যান্ডের বুলস্
গ্লাসগো লিমিটেড নামক কোম্পানি গড়ে তোলে জয়ন্তী নদী ওপর সড়কপথের ব্রিজ
১৯১৬ সালে।
তখনকার জৈন্তির বুকে মানুষের হুড়োহুড়ি।
ডোলোমাইট, রেল, কাঠের ডিপো, চা শিল্প, জয়ন্তী নদীর বোল্ডার সহ ছোট বড় পাথর
বিক্রি নিয়ে জয়ন্তী বাজার তখন গরমা- গরম। প্রচুর লোকের বসতিস্থল হয়ে ওঠে
জয়ন্তী। ১৯৩২ সালে সরকারি ভাবে ডোলোমাইট উত্তোলনের অনুমতি পায় বেঙ্গল লাইম
এবং স্টোন কোম্পানি, আবার দেশ স্বাধীনের পর ১৯৪৭ সালে সরকারি ভাবে ডোলোমাইট
উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয় জয়ন্তী লাইম নামক কোম্পানিকে। প্রাকৃতিক সম্পদে
পরিপূর্ণ এই জয়ন্তী রাজ্যের কোষাগারে অর্থের যোগান দিতো ভালোই।
উত্তর-পূর্ব রাজ্যে যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা জয়ন্তীর বুকের উপর দিয়ে থাকায়
দিবা-রাত্র গাড়ি চলাচলের হুড়কো লেগে থাকত। জনবসতির সাথে এখানে বিভিন্ন
সরকারি বিভাগ নিজেদের অফিস গড়ে তোলে।” (মুখপুস্তিকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)
জয়ন্তী
এখন অনেক ভিড় – তাই তার ধারেকাছেই কোনো নির্জনে থাকতে মন চাইছিল। ফেসবুকে
অজয় রায়-এর ভুটিয়াবস্তির লেখা পড়ে, ছবি দেখে মনে হল – নদীর ওপারে তো
কোনোদিন থাকা হয়নি, যাই তবে।
ব্যাস,
স্টিয়ারিংএ হাত সাঁটল। সঙ্গী পিউ-তন্ময়, ওদের দুটি ছানা – সৃজু আর অরিন,
এবং পপি। ইতিমধ্যে বেশ ক’বার অজয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওও লেখালেখি করে জেনে
বলেছিলাম – বেশ তোমার হোম স্টে-র বারান্দায় বসে জয়ন্তী নদীর হাওয়া খেতে
খেতে তোমার লেখা শুনব! কিন্তু এ যাত্রায় অজয় আমার কাছে অধরা এবং কিছুটা
রহস্যময় হয়ে রইল! শুধু চোখের বাইরে থেকে ঠিকঠাক সব আয়োজন করে দিয়ে গেল!
দেখা দিল না। এবং ঠিক কোথায় আছে তাও জানলাম না! তবে ওর ভাই বিজয় রইল আমাদের
সঙ্গে, খুব আন্তরিকতাতেই। অজয়ের হোম স্টেতে জায়গা না থাকায় ভুটিয়াবস্তিতেই
বিজয়ের নদীমুখো ছিমছাম হোম স্টে আমাদের জন্য বরাদ্দ হল। খাওয়া অজয়ের
‘ডুয়ার্স ইন’-এ।
অজয়ের
লেখাতেই পড়েছিলাম – জঙ্গলসাফারির গাড়িচালক ও গাইড বছর চব্বিশের তরুণ
কিষাণের কথা। জঙ্গলকে সে চেনে, ভালোবাসে। ‘জংগল বয়’ নামেও তাকে অনেকে ডাকে!
অজয়ের কাছে আমার দাবি ছিল – “কোর সাফারিতে এই জংগল বয়-কেই আমার চাই!”
জয়ন্তী ঢুকতেই ফরেস্ট চেকিং পয়েন্টে কিষাণের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নায়কের
মতো চেহারা, ব্যবহারটিও বড্ড মিষ্টি। কথামতো অজয়ের বাড়িতে আমার গাড়ি ঢুকিয়ে
দিলাম। তারপর জিপসিতে করে জয়ন্তী নদীর বালু-পাথরের বুক চিরে আমরা এগোতে
লাগলাম, একটু বাদেই খরস্রোতা জলে নামল জিপসি। রোদ হাওয়ার মিশেলে দারুণ
লাগছে এই ৭০০ মিটার দুর্গম পথের যাত্রা!
১৮ই
নভেম্বর ২০২০তে ভুটিয়াবস্তিতে একটি পুরানো বাড়িকে নতুনভাবে সাজিয়ে নিয়ে
অজয় চালু করেছিল ‘ডুয়ার্স ইন্ হোমস্টে’। ওর লেখা থেকেই জেনেছি এই গ্রামে
৩৩টি পরিবারের বাস; বাড়ি ২৭টি, জনসংখ্যা ১০১, তারমধ্যে ভোটারের সংখ্যা ৭১।
ভুটিয়াবস্তি আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রাম ব্লকের তুরতুরি খন্ড গ্রাম
পঞ্চায়েতের ও বক্সা টাইগার রিজার্ভ এর অন্তর্ভুক্ত একটি ছোট্ট জনপদ। সবুজ
দিয়ে মোড়া সাঁচিফু ফরেস্ট, সিঞ্চুলা পাহাড়ের পাদদেশে এই নিটোল গ্রামটি।
আমরা যে হোম স্টেতে থাকলাম সেটি অজয়ের ভাই বিজয় করেছে, এ গ্রামেরই বিজয় গোহরের বাড়িতে।
পুরো
গ্রামের সকলের ব্যবহার কী যে আন্তরিক। সাড়ে তিনটায় বিজয় রায় জিপসি নিয়ে
হাজির, প্রথমে নিয়ে যাবে ১২ কিমি দূরে চুনিয়া ওয়াচ টাওয়ারে, তারপর
ভুটিয়াবস্তি ওয়াচটাওয়ারে। বুনো রাস্তায় উঠে এসেছে জয়ন্তী নদী। জলের ভেতর
দিয়ে গাড়ির চাকা ঘুরছে। ঘন জঙ্গল। ছমছমে। একটা বার্কিং ডিয়ার একটু দেখা
দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল। একটা ময়ূরও ডানা ঝাপটাল। চুনিয়া নজরমিনারের চারদিকে
চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে ক্লান্ত; কিন্তু তেনারা বাইরে বেরোলেনই না! আসলে এবার
বর্ষার আগেই প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় অরণ্যের ভেতর পর্যাপ্ত জল, প্রচুর ঘাস
লতাপাতা ইত্যাদি। শুধু রাস্তায় হাতির হাগু দেখতে দেখতে পিউ নিজের মনে
প্রশ্ন করল – “ওরা কি পটি করতেই শুধু রাস্তায় ওঠে?”
ভুটিয়াবস্তি
নজরমিনারেও কেউ এলো না তারা! কিন্তু দিন ঢলে যাবার এক অদ্ভুত মেলোডি চুপ
করে শুনলাম। বহুক্ষণ। ঝিঁঝিঁদের সমবেত আওয়াজ ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে অনেক
উঁচু স্কেলে পৌঁছচ্ছে, আবার ধীরে ধীরেই খাদে নেমে আসছে। সামনের গোল জলাশয়ে
গাছেদের সান্ধ্য ছায়া ঘনিয়ে আসছে। মনটা কেমন করে উঠল!
ফিরে
ভুটিয়াবস্তি টহল দিলাম। একটা কালভার্টে বসে এই গ্রামের মেয়ে বিনীতা-র
সঙ্গে গল্প করলাম। ওর বিয়ে হয়েছে শিলিগুড়িতে। বলল – ভুটিয়াবস্তির জন্য মন
কাঁদে সবসময়।
রাতে আমিই একটা অঘটন ঘটালাম। একা একা
হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লাম অর্জুন ছেত্রীর বাড়ি। দাওয়ায় বসে গল্প করতে করতে
ঘড়ির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন – “এই যে আজ আপনার সঙ্গে গল্প
করছি, দুদিন আগে এ সময়েই খেয়েদেয়ে দাদার সঙ্গে কথা বলছিলাম, হঠাৎ একটা
আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখি আপনার ঠিক পেছনের জায়গাটিতে একটি বিশাল দাঁতাল
দাঁড়িয়ে রয়েছে!” আমার মনে হল, এবার ফেরা দরকার। সিগন্যাল না থাকায় কাউকে
ফোনে জানানোও হয়নি। অর্জুন ও তার দাদা অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে আমাকে এগিয়ে
দিতে এলেন। তখন দূর থেকে পপি, তন্ময়, পিউ, ও বাচ্চাদের ভয়ার্ত চিৎকার শুনতে
পেলাম। ওরা আমাকে কোথাও না পেয়ে খুঁজতে বেরিয়েছে। ভেবেছে – হাতি মেরেছে এই
খোঁড়া লোকটিকে, কিংবা চিতাবাঘ তুলে নিয়ে গিয়েছে!
রাতে জয়ন্তী নদী আরো জোরে কথা বলতে লাগল। আধো আধো ঘুমের ভেতর শুধু নদীই বইতে লাগল!
ভোরে
কেউ উঠছে না দেখে একা একা হাঁটতে বেরিয়ে একটা সুনসান জঙ্গুলে পথে চললাম।
একটা হলুদ টকটকে অমলতাস গাছ নেশা ধরিয়ে দিল। মনে হচ্ছে চরাচরে আমি ছাড়া কেউ
নেই! অকস্মাৎ এক ঝাঁক বার্কিং ডিয়ার জঙ্গল চিরে বেরিয়ে এসে আমায় দেখে
হতভম্ব হয়ে গেল, একটু দাঁড়িয়েই দে ছুট! হাতি-হাতি গন্ধ পেয়ে ফিরে আসতে
লাগলাম। গত বর্ষায় পাহাড় ভেঙ্গে নেমে এসে এই পথ তৈরি হয়েছে।
ছটার
মধ্যেই কিষাণ চলে এল জিপসি নিয়ে। তারপর দু’ঘন্টা ধরে বক্সা টাইগার
রিজার্ভের অন্দরে প্রায় দু’ঘন্টার সফর, ৩০ কিলোমিটার জুড়ে। ধোঁয়া ওঠা হাতির
বিষ্ঠা দেখলেও গজরাজের দেখা মিলল না! একটা দুষ্টু ছোট্ট হরিণ লাফিয়ে
ঝাঁপিয়ে, উঁকি মেরে আমাদের পর্যবেক্ষণ করল অনেকক্ষণ! পাশে ভীতু ভীতু তার
মা, বাচ্চাকে ফেলে সে পালাতে পারছিল না! পপিকে ইতিমধ্যে জোঁক ধরল!
একটা কুনকি হাতি বনরক্ষকদের নিয়ে বনটহলে বেরিয়েছে! বনপথে তা দেখেই সৃজু অরিন উচ্ছ্বসিত!
কোর সাফারি সেরে নদীতে নামলাম সৃজু অরিন তন্ময় আমি। জল নয়, যেন শান্তি! সেই স্নান শুধু শরীর নয়, মনকেও ধুয়ে দিল।
ভুটিয়াবস্তি
অদ্ভুত স্নিগ্ধ একটা দিন দিল। ফেরার সময় পেছন ফিরে দেখতে দেখতে কষ্ট
হচ্ছিল। গ্রামটা টিকে থাকবে তো? গ্রামবাসীরা বনজঙ্গল ও তাদের বস্তিকে প্রাণ
দিয়ে ভালোবাসেন। কিন্তু টাইগার রিজার্ভের নিয়মের খাঁড়া ঝুলছে তাদের মাথার
ওপর। ইতিমধ্যেই পাহাড়ভাঙা তীব্র জলস্রোত অনেকের বসত তুলে দিয়েছে এ গ্রাম
থেকে। হারিয়ে গেছে ফরেস্ট অফিস, প্রাইমারি স্কুল। কাজ না থাকায় অনেকে বাইরে
চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। তবু ভুটিয়াবস্তির মানুষেরা এখানেই শান্তি পান। সে
শান্তি চলে গেলে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। বন্যপ্রাণের পাশাপাশি বনের এই
মানুষগুলোর কথাও সরকার বা গ্রীন ট্রাইবুনালকে ভাবতে হবে বৈকি!
কোদালবস্তির
দিকে যেতে যেতে মনে মনে তাদের জন্য প্রার্থনা করছিলাম। ভুটিয়াবস্তি আমাকে
আরো কটা রাত কটা দিন থাকতে দেবে তো? ফিরে এসে দেখব না তো সেখানে আমার
থাকবার জায়গা নেই?!