ভাস্কর্যের আঁতুরঘর/৪
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর/পর্ব-৪
মৈনাক ভট্টাচার্য
---------------------------------
রামকিঙ্কর বেইজের ভাস্কর্য ‘যক্ষ-যক্ষী’
হালকা গরমের জ্যোৎস্না রাত, শান্তিনিকেতনের রতনপল্লীর বাসিন্দা হৃষীকেশ চন্দ ফিরছেন কর্মস্থল শ্রীনিকেতন থেকে। হঠাৎ তিনি দেখলেন পাকুড় গাছের তলায় রাস্তার উপর কেউ একজন যেন হামাগুড়ি দিচ্ছে। চলছেন আবার থামছেন আবার চলছেন। নিশ্চয় কোন সমস্যায় পড়েছেন নয়তো এভাবে চলবেনই বা কেন? সাইকেল থেকে নেমে কাছে গিয়ে দেখেন এ যে বাড়ির লাগোয়া প্রতিবেশী কিঙ্করদা। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে উদ্ধারের ইচ্ছে প্রকাশ করতেই রামকিঙ্করের সেই সপ্রতিভ হাসি- ‘ আরে বাপু কোন অসুবিধে-টসুবিধে নয় গো, এই একটু আলোছায়ার খেলা স্টাডি করছি আর কী। কী মজার ব্যাপার দেখো-’ বলে হৃষীকেশবাবুকে নানা ভাবে সব ব্যাখ্যা করতে লেগে গেলেন। এই যার সরলতা কে বলবে নির্মাণ ও স্থিতিতে তিনিই নিজস্ব দেশ ও সমাজ থেকে ছেঁকে নেওয়া এক সংশ্লেষিত রূপের উদ্ভাবন করেছেন। গতি ও আবেগের সমন্বয়ে প্রথাগত মৌলিক ইউরোপীয় আঙ্গিক ও প্রকরণের বিচ্যুতি ঘটিয়েছেন। তাই তো তাঁর শিল্পে সাধারণ মানুষ, প্রকৃতি এত প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারে। শিল্পী গনেশ পাইন খুব আফশোষ করতেন রামকিঙ্কর তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার স্বীকৃতি পেয়েছেন বটে, কিন্তু ‘আচার্য’ অভিধার আয়ত্বের সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। রামকিঙ্করের শিল্পে পাশ্চাত্যের প্রভাব প্রসঙ্গে সমালোচকেরা দুটি আন্দোলনের অবদান সব সময় স্বীকার করেছেন — কিউবিজম এবং এক্সপ্রেশনিজম। একটু ভাবলেই বোঝা যায় কিউবিজমের জ্যামিতিক রীতি-প্রকরণ ও এক্সপ্রেশনিজমের চিত্তে পর্যবসিত সত্যের প্রতিফলন সবটাই কিন্তু রামকিঙ্কর ব্যাবহার করেছেন একদম নিজের আঙ্গিকে। শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাকরণ বারবার ভেঙেছেন একেবারে ভারতীয় ধারায় । তিনি যে ভারতীয় ভাস্কর্যে বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির দিশা দেখিয়েছেন এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তাই এই একুশ শতকের আধুনিক দিল্লি শহরে কোন পথ চলতি বিদেশি পর্যটক হয়তো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ভবনের সামনে অপলক দৃষ্টিতে থমকে দাঁড়ান ইমারৎ স্থপতির নির্মাণ বৈচিত্রে নয়, প্রায় একুশ ফুটের অতিকায় ‘যক্ষ ও যক্ষী’র ভারতীয় অর্থ উপাসক দেবদেবীকে দেখে। পাথর কেটে গড়া এ ভাস্কর্যের প্রতীকটা আসলে পৌরাণিকতার সঙ্গে ব্যাংকের একটা সাদৃশ্য স্থাপন করে। রামকিঙ্কর আলাপচারিতায় সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যাখ্যা করেছিলেন - “আমার মূর্তির হাতে চক্র দিয়েছি। একটা পিনিয়ন। ওটা আমার কল্পনা, একটা অ্যাডিসন। এ যুগের মেশিন হে। ইন্ডাস্ট্রির প্রতীক। অন্যহাতে টাকার থলে, ব্যাংকের প্রতীক। যক্ষীর এক হাতে ফুল, আর অন্য হাতে ধানের শীষ- কৃষিপণ্য আর সাফল্যের প্রতীক।” দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে আজও বিশ্বের দরবারে শিল্পের অহঙ্কারে উজ্জ্বল রামকিঙ্করের দ্বারপাল এই ‘যক্ষ-যক্ষী’। ভারতীয় ঐশ্বর্যে সচ্ছল পারিবারিক বন্ধনের যাপনচিত্রে ভাই বোনের এক যুগলবন্দীও বলা যায়। রামকিঙ্কর বলতেন- “অনেকে ‘যক্ষিণী’ বলে, আমি ‘যক্ষী’ বানিয়েছি ভাই-বোন। যক্ষিনী তো যক্ষের বউ হে।”
চেকোস্লোভাকিয়ার অতিথি অধ্যাপক শিল্পতত্ত্ববিদ স্টেলা ক্রামরিশ ভারতবর্ষে এসেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে বক্তব্য রাখবেন। ভারতীয় মন্দির ওঁর আলোচনার বিষয়। গুরুদেবের আমন্ত্রণে এলেন শান্তিনিকেতনেও। স্টেলার ভাল লেগে গেল রামকিঙ্করের কাজ। আলাপ হল রামকিঙ্করের সাথে। স্টেলা মাথায় ঢুকিয়ে দিলেন- ‘কিঙ্কর একটা পাহাড় ধরো, কেটে মূর্তি বানাও। তুমি পারবে।’ কিঙ্কর মনে মনে সায় দেয়, ব্যাপারটা তো মন্দ নয়। মেটেরিয়ালের খরচ নেই। শুধু ছেনি আর হাতুড়ি। ১৯৫৪ সাল। প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর পরামর্শে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চিঠি দিলেন। চেয়ে পাঠালেন রামকিঙ্করের ভাবনায় মূল ফটকের দুই পাশে দুটি দ্বারপালের মূর্তির খসড়া। তিন ফুটের প্লাস্টারের ‘যক্ষ-যক্ষী’র ম্যাকেট বানিয়ে পাঠিয়েও দিলেন। ওদের পছন্দও হয়ে গেল। রামকিঙ্করের মন যেন আহ্লাদে ঢলে পড়ল। এবার হবে পাহাড় কাটার সাধ পুরণ। সহজ মনের মানুষ, পাহাড় কাটার খরচও যে পাহাড় প্রমাণ সে খবর উদাস বাউলেরা কোন দিনই বা রেখেছিল। এবার তো পাথর খোঁজা। কাংড়ার বৈজনাথের কাছে কুলুর রাস্তায় মাইল দেড়েকের ভেতরেই পাওয়া গেল কাঙ্খিত পাথর ‘শিবালিক স্যান্ড স্টোন’। কোন অভিজ্ঞতাই তো নেই, ভাকরানাঙাল ড্যামের বিশেষজ্ঞ দিয়ে ড্রিলিং ব্লাস্টিং করে গোটা পাথর পাওয়ার পর সে আর এক গেরো। ট্রেনে করে পাথর নিয়ে যেতে হবে। লাইন যে আবার ন্যারো গেজ সে তো মাথাতেই ছিলনা। সেই পাথরকে খন্ড খন্ড করে আট টুকরো করা হল। রেল কোম্পানির সহযোগিতায় ন্যারো গেজ লাইনের ট্রেনে দুই দিকে দুটো ইঞ্জিন মাঝ খানে সেই পাথর। এর জন্য বদলানো হল ওয়াগনের চেহারা। তার পর পাঠানকোট হয়ে ব্রডগেজ ট্রেনে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে সেই পাথর আনা হল দিল্লিতে। এত ঝঞ্ঝাট করে পাথর আনা হল বটে, কিন্তু কাজ যে আর এগোয় না। দিন যায় বছর যায় হুহু করে জলের মত টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে, কাজ যেই তিমিরের সেই তিমিরেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সরকারী সংস্থা ওরাই বা কি করে। রামকিঙ্করকে সতর্ক করে বার্তা পাঠালেন, ডেটলাইন পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু। ডেটলাইনওয়ালারা তো জানেনা, ফরাসি ভাস্কর রদ্যাঁর ‘নরকের দ্বার’ করতে গিয়েও কত বার এমন ডেটলাইন পেরিয়ে গিয়েছিল, শুধু জানে এই ‘নরকের দ্বার’, এই ‘থিঙ্কার’এর মত কাজ ফরাসী জাতিকে আজও শিল্পের সমৃদ্ধিতে পুষ্ট করে রেখেছে। কত দিন ঘুম ভেঙে মধ্যরাতে রামকিঙ্কর তাকিয়ে থেকেছেন অসমাপ্ত ভাস্কর্যের দিকে, পরদিন সেটাকে ভেঙে ফেলে আবার শুরু করেছেন প্রথম থেকে। কিঙ্করের মাস্টারমশাই কত দিন খোয়াই কোপাই-এর পারে চুপ করে বসিয়ে রেখেছেন তাকে কোন কাজ না করিয়ে; বলেছেন, “কিঙ্কর, চোখ বন্ধ করো। নিজের ভেতর ধ্যানে নিজেকে খোঁজো। পরিপার্শ্ব, প্রকৃতি সব আত্মস্থ করো। তারপর কাজে হাত দাও” সরকারী আইন তো আর জানেনা ডেটলাইন পেশাদার কর্মীর আয়ুরেখা, শিল্পীর নয়। ডেট লাইনের বার্তা পেয়ে রামকিঙ্কর তাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন- “দুর্ মশাই, আমাকে ডেটলাইন দেখাচ্ছেন? আইনের ভয় আমাকে দেখাবেন না। যান, আমাকে জেলে পাঠিয়ে দিন। ভালোই হবে, আমি সেখানে নিশ্চিন্তে অনেক মূর্তি গড়তে পারব। প্রফেশনাল শিল্পীর মতো ওইভাবে সময় বেঁধে দিলে আমি কাজ করতে পারব না।” মহা সমস্যায় পড়লেন কর্তৃপক্ষ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নার শেষ পর্যন্ত রামকিঙ্করকে আশ্বাস দিলেন -“উই আর উইথ ইউ। বাট-ডু সাম থিং।” রক্ষাকর্তা হয়ে উদয় হলেন তার পূর্ব পরিচিত ধীরেন দেববর্মার ছেলে রামকিঙ্করের ছাত্র শিল্পী প্রণব দেববর্মা। গুন্টুর থেকে পেশাদার কার্ভার নিয়ে আসা হল। সঙ্গে সহকারী হিসেবে নিলেন রামকুমার জেঠলিকেও। যারা তিন ফুট ম্যাকেটের থেকে মাপ মিলিয়ে মিলিয়ে একুশ ফুটের পাথর কাটলেন। দেখিয়ে দিতে হল অবশ্যই রামকিঙ্করকে।
১৯৫৫ থেকে ১৯৬৭ বারো বছর সময় নিলেন কাজ শেষ করতে। শেষ হল কাজ। আনন্দের আতিশয্যে শিল্পী যেন তখন আত্মভোলা এক শিশু। চিঠিতে রাধারানিকে জানালেন, -“কাজটা শেষ করলাম। ‘যক্ষী’টা খুব মজার হয়েছে দেখতে, ঠিক তোমার আদলে করেছি গো। তোমার জন্য অনেকগুলি টাকা পেয়েছি। আমাদের বাড়ি ছেড়ে কখনও যাবে না......।’
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴