পইলা সাঞ্ঝির কথা/৪
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৪
শুক্লা রায়
+++++++++++++
গচুকুন্না
~~~~~
সক্কাল সক্কাল সুন্দরমণির বাড়ি ছুটতে হল বসমতীকে। দই পেতেছিল। হাঁড়ির মুখ খুলে দেখে এখনও টলটল করছে জলের মতো। নিরুপায় হয়ে রসবালার কাছে এসেছিল ওর কাছে যদি থাকে। রসবালার কাছেই শুনল সুন্দরমণি দই পেতেছে, এতদিনে দই লেগেও যেতে পারে। বাড়ি গিয়ে ডাকতেই বের হল। রবিনের নাম ধরেই ডাকল প্রথমে, সুন্দরমণি বেরিয়ে বলল -
"নাই দি বাড়িত, চাক পাড়েছে, নরেশমামা ঘরের আলি বান্দেছে আজি।"
বসমতী দইয়ের কথা বলতেই ঘরের এক কোণ থেকে পাটের তৈরি শিকে থেকে দইয়ের হাঁড়িটা এনে প্রথমে বসমতীকে দেখাল -
"দেখেক দি কেমন দই বান্দিসে, খমখমা।" ঠিক তাই। দইটা দারুণ লাগছে।
"কতখান আছে তে?"
"এককেজি দি, এক পোয়া এক পোয়া করি চাইর দিন দুধ থুসুং।"
বসমতী দইয়ের হাঁড়ি হাতে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। রাস্তায় দেখে কালাচানের মা দাঁড়িয়ে। ওখানে একটু দাঁড়ায়।
"কি দেখিস দি আস্তার ভিত্তি?"
ওকে দেখে কালাচানের মা একটু আক্ষেপ করে,
"না কোইস মাই, হামার মানষিটার কোনোই আক্কেল নাই, নয়া মানষিটা আন্দির ঢুকিবে, একেনা ভাল-মন্দ আনি না দিলে হয়! সাকালে কনু, তে কছে আতোরটা ঘুরি দিয়া পচ করি এলায় আসিম, ভাত আন্দিতে তো সেই বেলা।"
বসমতী এবার টেনে টেনে বলে -
"বৈশাখত হইসে বিয়াও, এলাও নয়া আচে?"
"না হয় মাই, নয়া মানষিটাক আনিয়ায় অত চাপ দেওয়া যায়? আস্তে আস্তে হামার মানষি হৌক। হাতা ছুন্নি একখান নয়া কিনিলেও না মাঞ্জিতে মাঞ্জিতে কান্তাইত বইসে, তেমন মানষিটাও। এদ্দিন তো মুইয়ে করলুং, এলা গারাগারির সময়টাত মোকো না হাজিরা যাবার নাগিবে। হামাক কি বসি নইলে চলিবে?"
"বাউ কোটে, কালাচন?"
"উয়ায় মিনতি ঘরের বাড়ি গেইসে কালি সইঞ্জাত, উয়ার বোনু একেলায় পায় না অতলা জমি গারির। নিজের আছে ফির বন্ধক নিসে এইবার, তে ওঠে গেইল কোনেক মজর দিবার।"
ছাওয়াটা ভালো আছে ভেবে বসমতী খুশি হয়।
বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই দেখে কান্তেশ্বরের মেজাজ সপ্তমে। কি হয়েছে বোঝার আগেই দেখে রসবালা হন হন করে ওদের বাড়ি আসছে, হাতে বড় দস্তার গ্লাসে বোধহয় কাঁচা দুধ। ওকে দেখে ফিস ফিস করে বলে -
"দি, দাদা এখেরে সেই রাগ হইসে, সামানে মাথা ঝাড়েছে, বাছুরে দুধ খায়া নিসে আর হিদি হালকাদোর সোমায় হয়া গেইসে!"
বসমতি রাগের কারণ বুঝল এবার। কোনোভাবে গলার দড়ি আলগা হয়ে গেছে আর সেই সুযোগে বাছুর চলে গেছে মায়ের কাছে। সে তো গরু কান্তেশ্বর নিজেই বাঁধে রোজ, বসমতী মাঠ থেকে এনে খড়ের গাদায় বেঁধে রাখে, কান্তেশ্বর ঘরে ঢুকিয়ে ঠিক করে বাঁধে। রাগ আর কাকে দেখাবে! রসবালা দুধ এনেছে দেখে কান্তেশ্বরের মুখে হাসি ফুটল। দুধ দই সব জোগাড় হয়ে গেছে যখন সবাই হাতে হাতে পূজার জিনিস নিয়ে চলল। কান্তেশ্বর একটা ধোয়া ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরে নিয়েছে আর কোমরে একটা লাল নতুন গামছা। খালি পায়ে হাতে পূজার জিনিসপত্র নিয়ে ট্যাঙ্গস ট্যাঙ্গস করে আগে আগে হাঁটছে। রসবালা বসমতীর পিছন পিছন। নতুন বাঁধানো আলগুলো বাদ দিয়ে একটু ঘুরপথে কিছুটা পুরোনো শক্ত আলের উপর দিয়ে হেঁটে ওরা নিজের জমিতে পৌঁছল। রসবালা যেতে যেতে প্রশ্ন করে -
"কোলাগিলা কোটে ধুপালেন দিদি।"
বসমতী সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়, "গোয়ালি ঘরত।"
"কয়টা ঝুকি পাকিসে?"
"সবলায়"
এদিকে গচুকুন্নার সময় চলে এলেও কলা পাকার কোনো নাম নেই। অগত্যা পাকানোর এই ব্যবস্থা।
বসমতী মাঠের দিকে তাকায়, অনেকেই আজকে গচুকুন্না করছে। আজকের দিনটা খুব ভালো নাকি। কান্তেশ্বর নিজে পঞ্জিকা দেখেছে। মাঠজুড়ে জলের শব্দ, মানুষের অস্পষ্ট কোলাহল, আর তার সাথে মিশেছে উলুধ্বনি। জমির এক কোণে একটু উঁচু করে রাখা। সেখানেই পূজার আয়োজন। ভক্তিভরে পূজা শেষ করে কান্তেশ্বর। পুজো সেরে কয়েক গুছি ধান নিজ হাতে বুনে দেয়। তারপরেই যাদের ধান বোনার জন্য বলা হয়েছে সবাই নেমে পড়ে জমিতে।
গচুকুন্না করতেই হয়। নইলে রোয়া বোনা শুরু করে না কোনও গেরস্তই। তামাক বোনার সময়ও তাই। তামাক বোনার সময় একটা মানকচুর বড় পাতা লাগে। যেন ওরকম বড় বড় পাতার তামাক গাছ হয়। ধান বোনার সময় লাগে না। এটা আসলে ভূমি পুজা। পূজা সেরে চাষাবাদ শুরু করা। ধান আর তামাকই যেহেতু প্রধান ফসল তাই এই দুই চাষে গচুকুন্না করে তবে বোনা শুরু হয়। আবার ধান কাটার আগে আগেও একটা পুজো আছে। বাড়ি থেকে পুজো করে মাঠে যাওয়া হয়, মাঠ থেকে ধানের শিষের গোছা কেটে মাথায় করে উলু দিতে দিতে বরণ করে নিয়ে আসতে হয়। এটা হল ধানের 'আগ' নেওয়া। যে মাঠ থেকে সম্বতসরের খাবারটা ঘরে আসে তাকে তো পুজো করে তুষ্ট রাখতেই হয়। বসমতীকে অন্যমনস্ক দেখে রসবালা তাড়া লাগায় -
"নে দি চল, বাড়ির বগলের খোটুটা আজি গারিছি হামরা, সাকাল থাকি বিছন তুলোছোং, আর একটা তুলি দিয়া ভাত চড়াইম। অতিনোক আজি হাজিরা নিসি।"
বসমতী হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে -
"খোরাকী না আটখোরাকী?"
"খোরাকী করে বলে। তে মানষিক একটা খোয়ালে না ভাল করি আন্দির নাগে। কালি হাট থাকি মনভোলা মাছের সুকটা আনি দিসে, দিয়া আসিম, শাক চাকিস এলায়।"
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
গচুকুন্না - ধান বোনার আগে জমিতে গেরস্ত যে পুজোটি করেন।
চাক পাড়া, আলি বান্দা - পুরোনো আল সমান করে আরো মাটি দিয়ে শক্তপোক্ত করা।
আতোর - হালের দাগ, সহজ ভাবে বলা যায় ট্র্যাক।
মজর দেওয়া - সাহায্য করা
ধুপা - কলা পাকানোর পদ্ধতি। মাটিতে গর্ত করে কলার ছড়াগুলো সাবধানে রাখা হয়, উপরে টিন এবং আরো নানা জিনিস দিয়ে ঢেকে দিয়ে একদিক ছোট মুখ রাখা হয়। ওই মুখটা দিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ধোঁয়া দিয়ে দিয়ে কলাটা পাকানো হয়।
খোটু - আলের সীমানা দিয়ে ঘেরা এক একটা জমির অংশ।
আটখোরাকী - না খেয়ে হাজিরা, খোরাকীতে মালিকের বাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴