নানারঙের_গানগুলি/৪
শৌভিক কুন্ডা
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
আমরা
যারা পাঁচ সাড়ে পাঁচ দশক পার করে,কেউ কেউ এমনকি ছ নম্বর দশকটিকেও ছুঁয়ে
ফেলবো ক'দিন পর, তাদের কাছে পুজোর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে পুজোর গান।
হ্যাঁ, প্রচলন যদিও আরও বেশ কয়েক বছর আগেই, কিন্তু ছয় বা সাতের দশক জুড়ে
পুজো মানেই যেমন পাড়ার উৎসব, যেমন নুতন জামা-জুতো, ঠিক তেমনই পুজোয় রিলিজ
হওয়া রেকর্ড ছাড়া শারদ উৎসব সম্পূর্ণ হত না।
মনে
পড়ে না, আজও নূতন হয়ে থাকা গাঁয়ের বধূ বা রানার, কিংবা অবাক পৃথিবী ? সেই
মন্দ্র স্বরের ভাষ্য "রানার গ্রামের ডাক হরকরা, রাতের পর রাত ক্লান্তিহীন
মানুষের সুখ দুঃখের খবরের বোঝা বয়ে সে পৌঁছে দেয় দূরে, দূরে। কিন্তু তার
খবর কে রাখে?" এর পরেই সুরে বেজে ওঠে রানারের চলা। সলিল চৌধুরীর সুরারোপ
সুকান্ত ভট্টাচার্য্যর কবিতায়, আর সে সুর আমাদের মননে আঘাত হানতে থাকে
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠ বেয়ে। অথবা সে সময় দিয়েই যূথিকা রায় যে গাইলেন,
"এমনই বরষা ছিলো সেদিন"! প্রণব রায়ের কথায় সুর বসিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত।
এ
সবই "পুজোর গান" হয়ে এসেছিলো আমার জন্মেরও বেশ কিছু আগ দিয়ে। শুরু অবশ্য
১৯১৪তে, 'শারদীয়া' নামে, গ্রামোফোন কনসার্ট থেকে। সে বছর গেয়েছিলেন
মানদাসুন্দরী , কৃষ্ণভামিনী, বেদানা দাসী, অমলা দাস প্রমুখ। সেসব গান আমি
শুনি নি। শুনি নি এরও পর কে.মল্লিকের আগমনী গান। শোনা কথা, তাঁর আসল নাম
ছিলো মহম্মদ কাশেম। হিন্দুসমাজের বাধা আসতে পারে, বিক্রি না হতে পারে
ইত্যাদি ভাবনায় নাকি রেকর্ডে ঐ কে.মল্লিক নাম ব্যবহার করা হয়েছিল।
আমার
অন্যতম প্রিয় গানগুলোর একটি "আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি" র গীতিকার হলেন
শ্যামল গুপ্ত। এ গানটি আমার অনুরোধে অনুজ বন্ধু সৌরজ্যোতি ঘোষ(টুটুল)কে কত
অনুষ্ঠানে কতবার যে গাইতে হয়েছে। কেবল অনুষ্ঠানেই বা কেন, ঘরোয়া আড্ডাতেও
এমনকি, বহু বহুবার। যোগাযোগ নেই অনেক দিন হ'ল। তবু, আজকের ব্যস্ত সরকারি
আধিকারিক টুটুলেরও নিশ্চয়ই সে কথা মনে আসে অবসরে!
এই
গানটির সুরসৃষ্টি নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত। শ্যামল গুপ্ত গানটি লিখে সুর
করবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে। সত্যি মিথ্যা জানা নেই,
তবে এই সুরারোপ করতে গিয়ে মানবেন্দ্রকে নাকি প্রচুর ভাবতে হচ্ছিল। ভাবনা
মাথায় নিয়েই সেই বিখ্যাত গারস্টিন প্লেসের অফিসে মানবেন্দ্র নাকি এক সুনসান
অবসরে একটি পিয়ানোর আওয়াজ শুনতে পান! যে সুরের উৎস কোথা থেকে, কেউ জানে না
(সে যুগের অনেক কুশলীর মুখেই গারস্টিন প্লেসের বাড়িটি সম্পর্কে এ জাতীয়
আরও গল্প শোনা গেছে)! তো সেই ভৌতিক /অলৌকিক পিয়ানো মূর্ছনা থেকেই নাকি আজও
বিখ্যাত হয়ে রয়ে যাওয়া গানটির সুরজন্ম!
প্রিয়
গানের কথা বলতে গিয়ে ইতিহাস থেকে অনেকটা সরে এসেছি। বিখ্যাত কৃষ্ণচন্দ্র
দে তথা কানা কেষ্টরও বাংলা গানে জনপ্রিয়তার আঙিনায় পা রাখা ১৯১৭তে শারদীয়
রেকর্ডেরই মাধ্যমে। তার আগে এসে গেছেন কে.এল.সায়গল, আঙুরবালা, পংকজ কুমার
মল্লিক। ঔ ১৯১৭তেই গ্রামোফোন কোম্পানি পুজোর গানের লিরিকসহ একটি পুস্তিকা
বের করে 'শারদীয়া' নামে। রেকর্ডের সাথে বিনামূল্যে বইটি বিতরণ করা হয়েছিলো।
এর পর কলম্বিয়া, মেগাফোনও এই পথ অনুসরণ করে।
১৯৩৮ সালে 'শারদীয়া'র গীতিকারদের নাম তালিকায় পাচ্ছি কাজী নজরুল, হিমাংশু দত্ত,আব্বাসউদ্দীনদের।
১৯৫৩
সালে এইচএমভি ঐ 'শারদীয়া' বইটির নাম পালটে দিয়ে 'শারদ অর্ঘ্য' করে। এই
বইটি সাতের দশকে আমিও চোখে দেখেছি। এবং সে সময় দিয়ে বয়সে কচি, কিন্তু বেড়ে
পাকা আমরা 'শারদ অর্ঘ্য' থেকে গানগুলোর বাণী মুখস্থ করে ফেলতাম!