দাঁড়াবার জায়গা/পর্ব-চার
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
আমাদের
স্কুলে বড় মাপের ছুটি ছিল বছরে দুটো। একটা ছিল পুজোর ছুটি, অন্যটা
আম-কাঁঠালের ছুটি। আজকাল আম-কাঁঠালের ছুটি বলে কিছু নেই বোধহয়। এখন
গ্রীষ্মের ছুটি। আমরা যে আম-কাঁঠালের ছুটি বলতাম সেটা বড়দের মুখে শুনে
শুনে। স্কুলে কিন্তু গ্রীষ্মের ছুটিই বলা হতো। আসলে, আমরা যাঁদের ‘বড়’
হিসেবে পেয়েছি তাঁরা প্রায় সকলেই পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চল থেকে আগত
উদ্বাস্তুদের প্রথম প্রজন্মের মানুষ। তাঁরা আমাদের বাবা, কাকা, জ্যাঠা
ধরণের। তাঁদের সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে তথা গ্রাম বাংলায় স্কুল ছিলো প্রায়ই
টোল গোছের। সেসব স্কুলের সামান্য পরিকাঠামো এবং পরিচালন ব্যবস্থাও ছিলো
খুবই ঢিলেঢালা। তো, সেসব স্কুলে যাঁরা পড়েছেন তাঁরা আম-কাঁঠালের ছুটি
পেয়েছেন ছাত্র জীবনে। গ্রাম বাংলায় আম-কাঁঠালের গাছ যেমন প্রচুর ছিলো,
তেমনই সেসব গাছে গ্রীষ্মকালে ফলনও হতো প্রচুর। আর, গ্রামীণ জীবনে তাঁরা
গ্রীষ্মাবকাশে পূর্ণ ছুটি উপভোগ করতেন। সম্ভবত, হোমওয়ার্কের হুজ্জোতি ছিলো
না। আমাদেরও কিন্তু হোমওয়ার্কের যন্ত্রণা ছিল না। সেই গ্রীষ্মাবকাশের তুমুল
ছুটিতে স্কুল শিশুরা চরম স্বাধীনতা ভোগ করত। নানা গ্রামীণ খেলাধুলো থেকে
শুরু করে সব ধরনের দুষ্টুমি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তাদের কাছে গরমের ছুটি
ছিলো আম-কাঁঠালের ছুটি। সেসময় আম-কাঁঠাল পেকে উঠত। আম-কাঁঠাল সহযোগে ফলার
ছিল নিত্যদিনের অভ্যাস।
আমরা
অবশ্য ততটা স্বাধীনতা, সেরকম অবকাশ পাইনি। ফলে, আমাদের কাছে গ্রীষ্মের
ছুটি মোটেই আম-কাঁঠালের ছুটি ছিল না। মনে আছে, সেবার ক্লাস ফোর। গ্রীষ্মের
ছুটি শুরুর ঠিক আগের দিন হেড মাস্টার যদুবাবু আমাদের বললেন, ‘তোরা কিন্তু
স্কুলে আসবি। তোদের বৃত্তি পরীক্ষায় বসতে হবে। রোজ সকাল দশটা থেকে তোদের
পড়াব’। তো, আমাদের ছুটির বারোটা বেজে গেল। আর, যদুবাবুর এই নির্দেশ পালন
করতেই হবে। কারণ, প্রায় প্রতিদিনই বাবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় যদুবাবুর।
সেদিন সন্ধ্যায় বাবা ঘরে ফিরেই বললেন, যদুবাবুর সঙ্গে দেখা হল। তোদের তো
রোজ দশটা থেকে ক্লাস করতে হবে। মা শুনে বললেন, ছুটিতে আবার স্কুল! বাবা
বললেন, যদুবাবু বললেন, ওদের বৃত্তি পরীক্ষায় বসাবেন। এসব কথোপকথনের মধ্যেই
আমি আর শ্যামা মার্বেল নিয়ে ঘরের মেঝেতে খেলতে শুরু করি। বাবা জোর এক ধমক
দিয়ে নির্দেশ দেন, পড়তে বস। সারাদিন শুধু খেলা!
বাধ্য
হয়েই বই খাতা নিয়ে পড়ার ভান শুরু আমাদের। আমাদের মাঝে লণ্ঠনের মায়াবী
আলো। যে মৃদু আলোয় রহস্যময় হয়ে ওঠে সমগ্র ঘর। সব কেমন ছায়া ছায়া। আমরা ঘাড়
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজেদের সিলুয়েট দেখি অবাক বিস্ময়ে। বাইরে তখন ঝিরঝিরে
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। স্বপ্নে পাওয়া গানের মতো একটা হালকা আওয়াজ, রিন রিন করে
যেন বাজতে থাকে। তাতে অদ্ভুত এক মদিরতা সারা শরীরে একটু একটু করে ছড়িয়ে
পড়ে। কান খাড়া করে বৃষ্টির আওয়াজ শুনি। বুকের ভেতরে কেমন একটা হু হু করা
অনুভূতি। এই সময়ে মাকে বুকে জাপটে ধরতে প্রাণটা আঁকুপাকু করে। অথচ, মা এখন
রান্নাঘরে ব্যস্ত। আমাদের অস্থিরতা কাটে না। বইয়ের পাতায় আমাদের চোখ থাকে
না প্রায়ই। বরং আমরা দু-ভাই বোন মৃদু আওয়াজে গল্পে মজে যাই। তারই মধ্যে
বারান্দা থেকে আওয়াজ আসে, পড়ার আওয়াজ নেই কেন রে! সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুলে
দুলে পড়তে শুরু করি। এই অভিনয় আমাদের দীর্ঘকালের অভ্যাস। সাধারণত কেউ
আমাদের ধরতে পারে না। তবে, কখনও কখনও যে ধরা পড়িনি তাও নয়। ফিসফিস করে
দুচার কথা ছিলো রোজকার ঘটনা। কখনও কখনও ধরা পড়ে গেলে বকাঝকা নিয়ে আমরা
কোনোদিনই বিব্রত হইনি। ওসব গায়ে মাখিনি বা মনেও রাখিনি কখনও। এখন ভাবি,
আমাদের মন বস্তুটা আদৌ ছিল কি!
ফিরে
যাই বৃত্তি পরীক্ষার জন্য আমাদের অতিরিক্ত ক্লাসের প্রসঙ্গে। আমাদের ক্লাস
ফোরের বইতে একটা লেখা ছিলো ‘মেছো মাকড়সা’। সেই লেখাটা পড়তে খুব ভালো
লাগতো। সবটা মনে নেই এত বছরের ব্যবধানে। তবে, ওই লেখাটায় ছিল ‘মেছো
মাকড়সার’ শিকার ধরার একটা ব্যাপার। তো, যদুবাবু আমাকে বললেন, রিডিং পড়
তো। দেখি কেমন পড়তে পারিস। আমি ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দুহাতে পাতাখোলা
বইটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। হঠাৎ তীব্র এক ধমক আছড়ে পড়লো ক্লাস ঘরে। সেই
ধমকে আমরা সকলেই প্রবল ভাবে কেঁপে উঠলাম। বলির পাঁঠার মতো অবস্থা তখন
আমাদের। যদুবাবু বললেন, কী বললি? মাকড়সা? অ্যাঁ, মাকড়সা? শুয়োর, পিটায়া
পিঠের ছাল তুলবো। মাকড়সা! মাকড়সা! ওই, দূর হ। তোদের পড়তে হবে না’। বলে
তিনি হাঁপাতে লাগলেন। আমরা সকলেই মাথা নিচু করে আছি। আমি দাঁড়িয়ে, অন্যরা
যেখানে বসেছিলো সেখানেই বসে। ঘরের ভেতরে আক্ষরিত অর্থেই তখন পিনড্রপ
সাইলেন্স। আমাদের প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু। যেন, ঘরের ভেতরে
কয়েকটা গোখরো সাপ ফোঁস ফোঁস করছে। খানিক পরে আমার হাত থেকে বইটা কেড়ে
নিলেন যদুবাবু। তিনি নিজেই এবারে পড়তে শুরু করলেন, ‘মেছো মাকড়োশা...’!
এতক্ষণে বুঝে গেছি তাঁর ক্রোধের কারণ কী। কিন্তু শব্দটা যে ‘মাকড়সা’ আমি
একরকম নিশ্চিত। কিছুদিন আগেই বিএ ক্লাসের ছাত্রী দিদির কাছে শিখেছি এই
উচ্চারণ। আমাদের বাড়িতে প্রচুর মাকড়সা দেখি প্রায় রোজই। বাড়িতে সকলেই
প্রাণীটিকে মাকড়সা বলে। আমি শুনে অভ্যস্ত। সাহস করে বলে ফেলি,
‘মাস্টারমশাই, মাকড়সাই তো’। যদুবাবু চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে একবার
তাকালেন। মাথাটা ফের বইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়লো। তিনি বইয়ের পাতায় চোখ রাখলেন।
ফের মুখটা তুললেন। চশমাটা একবার খুলে ফের পরলেন। নাকের ওপরে চশমার
মাঝখানের অংশটা ডানহাতের তর্জনী দিয়ে খানিকটা ঠেলে দিলেন। এবারে বইয়ের
পাতায় চোখ রেখে প্রায় দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, মাকড়োশা। সবাই বল, মাকড়োশা,
বল। সবাই চিৎকার করে ওঠে, মাকড়োশা। মাস্টারমশাই বলেন, আবার বল। সকলে গলা
ফাটিয়ে চিৎকার করে, মাকড়োশা। আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। আমি যে সকলের
সঙ্গে ‘মাকড়োশা’ বলিনি সেটা টের পাননি তিনি।
এসবের
মধ্যেই নেমে এলো প্রবল বর্ষণ। যদুবাবু প্রবল বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
আমরাও উঠে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, কাল আসবি না। আবার পরশু।
যদুবাবু
ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই আমরা হইহই করে বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম।
তুমুল বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে যেন। ঝম ঝম করে শব্দ হচ্ছে। স্কুলঘরের টিনের চাল
বেয়ে জল নামছে ঝরঝর করে। স্কুল ঘরটা ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির। আমরা সেই ‘এল’-এর
ভাঁজের কাছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। কখনও দুহাত বাড়িয়ে দিচ্ছি
বৃষ্টিকে ছুঁতে। এভাবে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে দুলাল জামা খুলে দৌড়ে নেমে
গেলো স্কুলের মাঠে। আমাদের স্কুলের মাঠ খুবই ছোট, উঠোনের মতো। সেখানে বেশ
জল দাঁড়িয়ে গেছে। বারান্দা ঘেঁষে তীব্র জলের স্রোত। আমরা খাতার পাতা
ছিঁড়ে নৌকো বানাতে থাকলাম। আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন স্কুলের ক্লার্ক।
এতদিনে তাঁর নাম ভুলে গেছি। তিনি প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে আমাদের ছেলেখেলা
দেখছেন। একবারও বাধা দেননি। তাঁর চোখেমুখে তখন কৌতুক খেলা করছিলো। তিনিও
হয়ত কোন জাদুমন্ত্রে নিজের শৈশবে ফিরে গেছেন। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁলেন।
আমরা সবাই খাতার পাতা ছিঁড়তে থাকলে তিনি হাত বাড়িয়ে বললেন, আমাকেও একটা
দে। নিরঞ্জন খাতার একটা পাতা ছিঁড়ে তাঁর হাতে দিলে তিনিও আমাদের সঙ্গে
নৌকো বানাতে লেগে পড়লেন। তারপর সকলেই একে একে নিজের নিজের নৌকো ভাসাতে
থাকলাম। কী বিস্ময় আমাদের চোখে। বৃষ্টির জলের স্রোতে ভেসে যেতে থাকলো
আমাদের সব নৌকো। আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। আমাদের স্কুলের ক্লার্ক
তাঁর নৌকোটা নিয়ে বারান্দা থেকে নিচে নামলেন। তাঁর গায়ের পাঞ্জাবি
মুহূর্তেই ভিজে গিয়ে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেলো। তিনি নির্বিকার। খুব আলতো
ভঙ্গিতে হাতের নৌকোটা ধীরে ধীরে জলে রাখলেন। তারপর ভেসে যেতে থাকা নৌকোর
দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সেদিন তাঁর সঙ্গে আমাদের সকলের কোনও পার্থক্য
ছিলো না, না বয়সে, না পদাধিকারে। এখনও তাঁর সেই সরল মুখটা মনে জেগে আছে
সুস্পষ্ট। তাঁর চোখে ভারী চশমা ছিলো। সে চশমা পুরু কাচের জন্য এমনই ঝাপসা
লাগতো, বৃষ্টির জলে ভিজে তা আরও ঝাপসা হয়ে উঠলো। তাঁর চোখে কি জল দেখেছিলাম
সেদিন? হারিয়ে যাওয়া শৈশবের জন্য বোধহয় তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছিলো। সেদিন
তাঁকে এত আপন মনে হয়েছিলো, যেন আমাদের সাত জন্মের বন্ধু, কত জন্ম
জন্মান্তের খেলার সাথি, পরম সুহৃদ। অথচ, মনে আছে, একাধিকবার তাঁর কাছে ধমক
খেয়েছি। তখন কিন্তু তাঁকে খুব কাছের বলে মনেই হয়নি। আজ বৃষ্টির তোড়ে যেন
সব ভেসে গেছে। ফিরে এসেছে তাঁর ফেলে আসা শৈশব। তাই তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের
বন্ধু, পরম সুহৃদ। বৃষ্টি কেন রোজ হয় না! বড়রা কেন বৃষ্টিতে এমন ভেজে না!
বৃষ্টি কি বড়দের গলিয়ে নরম কাদায় পরিণত করে, যখন জেগে ওঠে অবুঝ শৈশব? জানি
না। তবে, প্রতিদিনই বৃষ্টি হোক, আমার এই কামনা জাগরুক ছিল বহু, বহু বছর।