তোর্সার ঘর বাড়ি//চতুর্থ পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
--------------------------------------
রাঙ্গা
রাঙ্গা ঘোট বাড়ি, টবে টবে পানি গে/ দারুণ ফেনা বাড়ালো কেনে.../বাভনের
বেটির বিভা হচে../ সোন রূপার ঝালরগে, / সেই বিশ ঝারির জল/ খাবে না বিলাইবে
গ।....'
...গঙ্গা নিমন্ত্রণ। সবার আগে নমিতা। আহা! এ
তল্লাটে আজ কেউ কাজের বাড়িতে যায়নি। বলে এসেছে সব। এইতো কদিন আগেই নমিতা
অনলের বাচ্চাটার মুখে প্রসাদ দিল। ঐযে ওদের জিউ ঈশ্বর, দেওতা ভগবান সব ঐ
মদন মোহন বাবা। বুকের মধ্যে বসে থাকেন তিনি। আহা, মাথাটা একদিকে কাত, কি
অপূর্ব সুরের বাঁশি শোনে যেন ওরা। শুধু কি ওরা, ঐ যে মিত্তিরদের বাড়ির
মিনি, পুনুর জন্মদিন হল তো স্কুল যাওয়া বন্ধ। হলুদ দিয়ে স্নান। স্নানের জল
রোদে রাখা, দুব্বো ঘাসের গুছি যত্নে দেওয়া জলে তা আবার নিয়ম কি! বাচ্চার মা
হলুদে হাত দেওয়ার অধিকারী না। মিত্তিরদের সেজ ঘরের জেঠিমা ঐ একটা দিনের
জন্য মিনিকে আর পুনুর জন্মদিনে পুনুকে বাটা হলুদ আর তেল মাখায়, তারপর
গঙ্গা গঙ্গা। মুখে উচ্চারণ ও করবে স্নানের সময়,ওরাও। বেশ মজায় উঠোনে পিঁড়ির
উপর দাঁড়িয়ে মাথায় জল ঢালা তারপর নতুন জামা, সঙ্গে মা, চলল মদন মোহন বাড়ি।
ওখানেও জল টলটল বৈরাগী দিঘি। এইতো দিঘির শহর। মনে মনে ঈশ্বরের আশিস ভাবে
ওরা। দিঘির জলে এতোল বেতোল সাঁতরে যাওয়ার সাধ হলেও সময় কোথায় নমিতা, সরলার
মেয়ে শাকির... দুটিতে ভাব ও বড় ই। এইতো চলেছে জলে, হাতে প্রদীপ জ্বালা, কত
কি যে সাজিয়েছে! বাতাসা পান তো আছেই, হলুদ সিঁদুর কিচ্ছু বাদ যায়নি। ওরা
বলে অতিথি এলে গুয়া পান যে দিতেই হয়। আর সব নদীই তো গঙ্গা। জলের কি ভাগ হয়
নাকি, তাইতো জলের কাছে বলে আসা ভাল থাইক্য, ভাল রাইখ্য গ, আমাগ
কইন্যেরে। তিত্তিরীর মেয়ে শমি ঐতো শ্মশানের পাশের প্রাথমিক ইস্কুলে পড়েছে।
হাই স্কুলে মিত্তির বাড়ির ছোট ব উদিমণি ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঐ... এইট
পাশ। ব্যস্, অনেক পড়া পড়ছে, দাও বিয়া নাগাও।'আর পইরব্যার লাগবেনা।' বুড়ী
দিদিমাও বলে। তিত্তিরীর কষ্ট হয়। আহা, মেয়েটাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল
ছোট বউদি। সব শুনে বউদির মন খারাপ হয়েছে,বলেওছে বেশ রেগে...'তোদের আবার
বিয়া! ঐতো ঘরে বসে বরকে খাওয়াবি, কয়দিনের মধ্যে দেখিস ওও যাচ্ছে লোকের
বাড়ি বাসন মাজতে, কোলে ছাওয়াল ট্যাঁ ট্যাঁ করছে। এইতো তোদের
সম্বল।কিস্যু হবেনা। মেয়েটার ইচ্ছাকেও দাম দিলিনা।'-- কি ক ইর্ ব, ঐযে ওর
দিমা, যায়বার ই না দেয়। কামাই ক ইর্ তি ক ইর্ তি নাম কাটা গেছে চ ইল্যা।
যাইকগ্যা। তুমি কিন্তু আইস গ। গঙ্গা নেমন্তন্নে। আমাদের কিন্তুক ঐসব কাড
মাড নাইগ। ছোটবউদি একটু হেসে উঠে গিয়েছিল ঘরে।
* * *
বিকেলে
টেনে নিয়েছিল ভাঁজ করে রাখা পরিষ্কার কাপড়টা। মিনিকেও সাথে নিয়েছে। নতুন
কেনা তাঁতের লাল শাড়িটা সেজ জাকে দেখিয়ে প্যাকেট নিয়ে বেরোয় ছোট বৌ।- হুঁ:
পার ও বটে! আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচিনা। ক্যান ওদের ঐ চরের বিয়ায় যাওয়া,
কে মাথার দিব্যি দিছে তোমাকে যাওনের?...উত্তর দেয়না ছোটবৌ। মিনি একটু একটু
বোঝে এখন। মার এই কুলুপ আঁটা মুখ,শক্ত চেহারা যত দেখে কেমন যেন লাগে। মা
কেমন নিরীহ নিরীহ মত। সবাই দাঁতের তলে রাখে, তাও কাজ গুটোয় ঘরে বাইরে। অফিস
যাওয়ার আগে,ফিরে এসেও। চুলায় আগুন দেয়,সন্ধের রান্না বাঁধা তার। দিনে করে
না, সময় পায় না বলে বাবুয়ানির খোঁটা, বিবিগিরির যাবতীয় মুখনাড়া এ বাড়ির
মানুষের যেন অধিকারে দাঁড়িয়েছে। পিষতে থাকা গুচ্ছের কড়া কথা একজনকেই বলে
এরা। সহ্যের এই বিরাট প্রতিমাকে মিনিতো ছোট, বোঝেনা। মাকে খুব ভালোবাসবে,
না এ বাড়ির মানুষদের এইযে ওকে আগলে রাখা, পুনুকে চোখে চোখে শাসন করা...কাকে
মাথায় তুলে রাখবে বোঝেনা।দ্বন্দ্বে পড়ে ওর ছোট্ট মন। মাকে খুব ভালবাসতে
ইচ্ছে করে, মায়া হয়। সামনের বিরাট মাটির চত্বরে সন্ধের তোর্সা বাঁধের দিক
থেকে ভেসে আসা হাওয়াটুকু মিনিকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। মেয়ের হাত ধরে গটগটিয়ে
শাড়ির প্যাকেটখানা নিয়ে বেরিয়ে যায় ছোট বৌ। শির শির করছে ঠান্ডা। নদীর জল
রাতের কালো আলোয় যেন অন্য সৌন্দর্য। তাকিয়ে থাকে মিনি ওর মায়ের মতই। সবাই
হই হই করে ওঠে। আশীর্বাদ সারে ছোট বৌ। ততক্ষণে নিয়ম কানুনের সাজ সাজ রব।
মিনি পুনু ঢুকে গেছে। ঘরের ভিতর ইলেকট্রিক নেই, হ্যাজাক জ্বলছে। আলো হয়ে
আছে। বাইরে সবুজ লতানে কুমড়ো ডগা, লাউ ডগা দুলছে নদীর হাওয়ায়। নদীটাও
নিমন্ত্রণ পেয়ে ঘরে এসে উঠতে চায় যেন। ডাগর ডোগর চিকন মেয়ে...ঠিক নমিতা
কিংবা সরলার মেয়েটার মত। ঘরের পুরুষ ও কাজে হাত লাগিয়েছে, অবাক কান্ড।
ত্রিপল খাটিয়েছে একখানা। আলো বেঁধেছে, ব্যাটারীর। গান বাজছে আবার।
ব্যবস্থা সব অনলের। ওর সঙ্গে সঙ্গে বেশ তৎপর হয়েছে উঠতি বয়সী নতুন
ছেলেরা,ঘরে বসে থাকা লোকগুলোকে দেখলে মনে হয়' ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা...'
অনলের নৌকৈটা খুঁটোয় বাঁধা। 'ছোট বৌদি, ঠান্ডা লাগি যাবে নে, ঘরে গে বস।'
চমকে ওঠে মিনির মা। ফিরতে হবে, পুনু মিনি দুজনেরই মুখ নড়ছে। অনলের কালো
কুঁদে তোলা শরীরে অনাবৃত ঊর্ধাঙ্গ সামান্য সাদাটে চাদরে ঢাকা।... ওর
ঠান্ডা লাগেনা। ছোটবৌ উদাস হয়। সদ্য পড়া গল্পগুচ্ছের ছিদামকে মনে পড়ে।
চোখ
সরিয়ে নেয়। সামলে নেয়। যেমন সবসময় কথার ফলাকে বাড়িতে উদাসীন চাহনিতে
অবহেলায় সরিয়ে দেয়। ঠিক তেমনই সরাতে জানে সব টান,সবটুকু চোরা আকর্ষণ।
ভিতরের অন্ধকার ছায়া কি কোন অভাবের কথা জানায়...কোন শূন্য কিছু অথবা গুমরে
থাকা মেঘ নামে কি শরীরে!
নমিতা প্লেটে মিষ্টি সাজায়
'কিছুইতো খাবানা জানি, আমরা গরীবতো, কি আর বলি, নাও এ মিষ্টি টুক।
...'ধ্যাৎ, কি বলিসকি! দে, একটা মন্ডা তিন আঙুলে ধরে মুখে পোরে ছোটবৌ।
"এবার ফিরতে হবে রে! দূর তো নয় এই বাঁধ দাঁড়িয়ে আছে বলেই যা একখানা ঢাল
তৈরি করেছে, তা নয়তো এই নদী, তোদের ঘর আমাদের বাড়িঘরের মাঝখানে পড়ে থাকত
কেবল ঐ সাদাটে রাস্তা খান, তাইনারে? ...অনল কথাগুলো প্রশংসার চোখে তাকিয়ে
তাকিয়ে শোনে। 'চলেন ছোটবৌ, পৌঁছা দিই গ। চলরে মিনি...পুনু...'রাত আটটা
পেরিয়ে গেছে কখন। ন'টাতেই এই চর বাসীরা গভীর রাতের সানাই বাজায়। ওদের বিয়ের
কাঁদনা বেণু,কাশি অন্য সুর তোলে। এতো সেই বিসমিল্লার সুরের অন্যপ্রান্তে
বসে মন কেমনের বেসুর বোল তোলে মনে্য প্রান্তে। ছোট বৌ আঁচলে ঘোমটা টানে,
মিনি পুনুর গায়ের জামা ঠিক করে দেয়, ওপরে ওঠার বড় বোল্ডার পাথর ধরে মাঝে
মাঝে ঘাসের শরীরে পা রাখে। উঁচু স্বরে শুধু বলে...তিত্তিরী, চললামরে, ভাল
হোক সব।' কানে আসে গান... এই ওদের যন্ত্র।
'রাঙ্গা রাঙ্গা ঘৈট বাড়ি, টবে টবে পানি গে...'
জল থই থই কালো অন্ধকার...
* * *
অন্ধকার
বেড়ার ঘর। সকালের রোদে্য ফুলকি বেড়ার জানলার ফাঁক দিয়ে মুখে এসে পড়ে।
পাশের ঘরে পুনু ঠাম্মার সঙ্গে। একটাই মাত্র দেয়ালে ভাগ করা দুটো ঘর।
ঠাম্মার পোক্ত কালচে রঙের খাট। ভালভাবে দুজন ঘুমিয়ে যায়। ঠাম্মার মুখে মিনি
কতবার শুনেছে এ খাট রাজার কাছে পাওয়া। মিনির ছোট ছোট হাতের ছোঁয়া ঐ কালো
রঙে সাঁতার কাটে। পৌঁছয় রাজার ঘর বাড়িতে। ঐ পোক্ত অদ্ভুত খিলানের সামনে।
লাল সুড়কি রঙের বিল্ডিংটার মধ্যে যে কি আছে একদিন বাঁধের এই সামনের রাস্তা
ছেড়ে পুনুর হাত ধরে ছুটবে মিনি ঠিক। কেউ জানবে না। রাতের ঘন অন্ধকারে ঘন
ঘন নি:শ্বাসের শব্দ। বুকের ভিতর সদ্য সন্ধের আর রাতের অল্প আলোয় দেখা জল
ঝক ঝক করে। তির তির করে ঘুম চোখ কাঁপে। বাঁধের এপারে পাকা রাস্তার সঙ্গে
লেগে থাকা মানুষের সমবেয নি:শ্বাস, অন্ধকার ঘুম ঘুম মুখে নিশ্চিন্তির
ছাপ।.....বলহরি...হরি বোল....বল হরি হরি বোল....,রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান
খান। বুক ধক ধক আতঙ্কে জড়িয়ে ধরে মাকে। কান বন্ধ করে দু আঙুলে। সামনের
রাস্তা ধরে মৃতদেহ বাহকেরা চলে যায় তোর্সার কাছে। জন্ম জলে মৃত্যুও যে সেই
জলেই। মা হঠাৎ ই ঘুম ভেঙে মিনির চুলে বিলি কাটেন। ধীরে মিলিয়ে যায় ভয় ঐ
দূরে অস্পষ্ট হতে থাকা হরিধ্বনির মতো।
যেখানে রাতের
হ্যাজাকের আলোয় উৎসবের ঝিলমিল দেখেছে, সেখানেই মৃত্যু মিছিলে একান্তে
কথকতা জড়ায় মাটির সঙ্গে। ছাই ওড়ে নিভন্ত চিতা থেকে। জল ঢেলে সে উষ্ণতার
নিবৃত্তি। আবার জলস্রোত এসে ভাসিয়ে নেয় চরের মাটি,করে তোলে আগের মতো
স্বাভাবিক। প্রতিদিনের ঘড়ায় তোলা জল যেন। ওখানেই সকাল হয় আবার রতু, ঘনা,
ঘঞ্চু, ছবিদের। সেই বন্ধু জলেই প্রাত:কৃত্য, সেই জলেই স্নান। কখনো দু:খের
কাহিনীর সাক্ষী হয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে তোর্সা। রাতের নীরবতা ছেড়ে আকাশের ঐ
পাড়ের ধূসর জঙ্গল ছেড়ে সূর্যটা লাফিয়ে উঠলেই তোর্সার জলে লালচে রঙ। নমিতার ও
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে তোর্সার জল আর আকাশের রঙ দেখে মিত্তির বাড়ির ছোটবৌদির
কপালের টিপ আর অফিস যাওয়ার সময় সে আঁচল, আর গনগনে উনুনের আঁচের সামনের
মুখখানা মনে পড়ে। দেবী পিত্তিমে য্যান। আর দেখ সেজ জেঠিটাকে, বৌদিমণিকে
দাঁতে পিষছে তো পিষছেই। এই যে মনে সঙ্গে মনের ভিতর বাড়ির যোগ এতো মেশামিশি
ভিড়। বাঁধের এপাশে ওপাশে। অনলের মনোযোগ কাল রাতে নমিতাকে ঘিরেছিল বড় বেশি।
নমিতার শরীরে শরীর দিতে দিতে অনল ভাবে আর বলে ওরে তোর্সার গহীন আমার ভরা
ডুবে তোরে কোথায় নেই বল্...ওদের ভাঙা ঘরে চাঁদের আলোর ফুটফুটে ছেলেটা
খাটিয়ার পাশে মাকে খোঁজে। মা তখন বন্যার জল।। হাঙরের অদ্ভুত আদর ঘূর্নী
তুলেছে শরীরে। প্রতিবেশী ঘরে তখনো বিয়ের হ্যাজাক নিভু নিভু। পাশের চরে
জেগে থাকা শ্মশানে তখন রাতের অন্ধকারে দাউ দাউ আগুন। চিতা জ্বলে দমকে দমকে।
নমিতার ভয় করেনা। যেমন ভয় করেনা ছোটবৌদিও কাউকে, ও বোঝে। কোন কথার উত্তর,
ঝামটে ওঠা, ঝগড়া করাই নমিতাদের চরের রীতি রেওয়াজ, কারো ছেলেকে কেউ কিছু
বললে বেধড়ক ঝগড়া শানিয়ে নেয়। অনেকে চুপ চাপ দেখে। অন্যায় রকম গালাগাল
শুনলে মাথা গরম তিত্তিরী বা ওচারী যাকে হাতের কাছে পায় দেয় লাগিয়ে।আর ঝগড়ার
দমক ওঠে এঘর ওঘরে। নেশা করা এই অলস মানুষগুলো সবাইতো অনলের মতো না। অনল
একাই কাঠ ধরে,নৌকো বানায়, লগি তৈরি করে ভাসে কোন দূর। মুখের কোণে চোখের
ইঙ্গিতে...নমি তোরে নিয়া ভাইস্যা পইরব্যার মন চায় যেরে!...আহা! নমির ও তো
সাধ। আর কোলেরটা কি ভাইস্যা আইস্ ছে!... না না ওরে নিমু ক্যান? ওরে
দ্যাখবার এই চর ভরা লোক আছে।...যদি যাই নিরুদ্দেশ যামুনে।...হ: আমি নাই তর
লগে।...তাইলে নিমুনে খুঁইজ্যা মনের মানুষ...
নমিতার
উপেক্ষার চোখ তখন নদীর ঘোলা স্রোত আগলায়। পাথরে কাপড় ধুপ ধুপ পড়ে। আর
ছেলের কাঁথাকানি কাচে। মাঝে মাঝে ভাবুক মুখে এমন ভাবে সুদূর জলের অতলে
তাকায় মনে হয় সে বলছে, নদী'তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? কোথাও যাওগো...আমারে ল
ও।' ঠিক তখনই পাশে রেদের পিঁড়িতে শুইয়ে রাখা ছেলেটা কেঁদে ওঠে। তোর্সা
ফিরতে বলে ওকে।
গতরাতের চিতা কাঠের পোড়া গন্ধ
বাতাস বয়ে এনে ঢুকিয়েছিল ঘরের উঠোন পেরিয়ে মাচানলতায় ঝুলে থাকা কুমড়ো আর
লাউ ডগায়। সকালের বাতাসেও সে পোড়া গন্ধ নমিতার শরীরে নেমেছে, ছড়িয়ে ছড়িয়ে
এখনো উৎসের দিকে যেতে পারে মন। ফোর ফাইভ পর্যন্ত প্রাথমিকের গন্ডীতে থমকান
মেয়েটা গড় গড় করে উত্তরের আটটা জেলার নাম বলে। সুদূর হিমালয়ের পর্বতমালার
কথা মনে হয়।ওর ই বরফ গলা জলে এ নদীর জন্মকথা বাবার মুখের গল্প শোনা।
তিস্তা,তোর্সা,মহানন্দা,কালজানি,মানসাই,রায়ডাকের সঙ্গে ঐ সুতোর টানেই এ
তোর্সার পাড়। বাবার জলের সঙ্গে মাছের জালের সঙ্গে জীবন জুড়ে আছে,হৈ হৈ করে
ছবির মতো ভাইবোনদের সঙ্গে সঙ্গে তার ভাগ্যের চাকাও ঘুরছে আর
ঘুরছে।...তাড়াতাড়ি শাড়ীর আঁচলে হাত শুকনো করে।ছেলেটাকে ওই রোদে বসেই ভেজা
শাড়ির আঁচল সরিয়ে বুকের দুধ দেয়। ছোট ছোট দুটো হাত আঁকড়ে ধরে শরীর। নমিতার
বুক খালি হয় ঐ পাহাড়ী ঝোরার মতো,বন্যার মতো ঠিক অনলের আদরের মতো।
* * *
সাঁঝবেলায়
ফান্দুয়ার লম্বা কাঁদন বাঁশি বাজে। তিত্তিরীর মেয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি।
এপাড়ার বাঁধের চর ছেড়ে অন্য পাড়ার নদীর কাছে,ছনের ঘরে। সেখানেও সবুজ
দোলে,রোদ ওঠে। নদীর আক্রোশ পড়ে, ডুবিয়ে ছাড়ে, ভেসে যায় গবাদি ছাগলের পাল।
গোরুগুলো উঁচুতে উঠে হাম্বা...আওয়াজ তোলে,...সংসার তবু বাড়তে থাকে, জল আসে
বাঁধ না মানা।হুড়মুড়িয়ে বর্ষা নামে...বড় সুখে চোখ বোজে নতুন বৌ...চোখের জলে
বিদায় বেলায় ও এত সুখ!