চা-ডুবুরি : পর্ব-৪
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^
দুষ্টচক্র
ফেরার
পথে সুবর্ণর মনে পড়ে ঘরে আজ রান্না নেই কিছুই। গতকাল দুপুর অবধি ঠিক ছিল
ডে-ডিউটি সেরে বিকেলের ট্রেনে শিলিগুড়ি যাবে। সেইমতো তূর্ণাকে জানিয়েছিল।
ফাগুকেও মানা করে দিয়েছিল আসতে। ফাগু মালি হলেও দুবেলা রান্নার কাজটা
বেশ চালিয়ে দেয়। এ মাসে একদিনও বাড়ি যাওয়া হয়নি। ইচ্ছে করলে যাওয়া
যেত না তা নয়। কিন্তু কাজের চাপ সামলে হুড়োহুড়ি করে গিয়েই আবার ফিরে
আসায় শরীরের ওপর ধকল যায় খুব। তাই কদিন সি.এল নেবে ভেবেছিল। বাবার
শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। সুগার বেড়েছে। ইদানীং মনে রাখতেও পারছেন না প্রায়
কিছুই। গেলে ডাঃ সমাজদারের কাছে নিয়ে গিয়ে অন্তত চেক আপটা করানো যেত।
গতবছর শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স কমে যাওয়ায় যখন নার্সিং হোমে ভর্তি
করতে হয়েছিল তখনই ডা: সমাজদার বলেছিলেন সোডিয়াম ডেফিসিয়েন্সির জন্য
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়াটা খুব ন্যাচারাল এই বয়সে। ডিমেনশিয়া বা
অ্যালজাইমার পেশেন্টদের মেন্টাল সাপোর্টটা ভীষণ জরুরি। তূর্ণার একার পক্ষে
যেটা অসম্ভব। নিজেকে এক এক সময় খুব অপরাধী মনে হয় সুবর্ণর। ছেলের
ভবিষ্যতের কথা ভেবে তূর্ণার কাঁধে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়াটা বোধহয় উচিত
হয়নি। এছাড়া উপায়ও যে ছিল না। চা-বাগানের মত প্রত্যন্ত জায়গায়,ডাক্তার
নেই, ওষুধ পত্তর নেই, এমারজেন্সি তে চট করে মুভ করার মত পরিকাঠামো নেই,
কোন ভরসায় বাবাকে এখানে রাখা যায়। স্বার্থপরের মতো দেখালেও সবদিক বিচার
করেই এটাই করতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে।
শনিবার দুপুর
অবধি সব ঠিক ছিল যাবে। হঠাৎ করে বিকেলে ফ্যাক্টরি অ্যাসিস্টেন্ট মিস্টার
পাঠকের ফোন, 'সুবর্ণবাবু, এইমাত্র খবর পেলাম আমার মিসেস খুব অসুস্থ।এক্ষুণি
বেরোতে হচ্ছে। আপনি যদি কাইন্ডলি তির্কীবাবুকে ডেকে ইভনিং শিফটটা একটু
অ্যাডজাস্ট করে নেন, তাহলে নাইটে আমার জায়গায় ডিউটিতে এলে খুব ভাল হত।
বড়সায়েবকে সব বলে দিয়েছি। দরকার পড়লে উনি আপনাকে একটা এক্সট্রা লিভ... '
'ঠিক আছে, ঠিক আছে..বুঝেছি...আপনি যান..." বলে বিরক্তিতে ফোনটা কেটে দেয় সুবর্ণ।
এই
নিয়ে তিন শনিবার হলো। উইক-এন্ডে নানা বাহানায় নাইট-শিফট কেটে বেরিয়ে
যাওয়াটা পাঠকের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। বৌ এর অসুখটা যে শ্রেফ ভাঁওতা,
সেটা অনেক পরে বুঝেছিল সুবর্ণ।
ব্যাপারটা আবিস্কার
করেছিল আসলে সুমন্ত। সুবর্ণর ছেলেবেলার বন্ধু। বয়সে যদিও কিছুটা বড়। তবু
চা-বাগানের চৌহদ্দির ভেতর যেটা মোটেই ম্যাটার করে না। দাদা বা ভাইয়ের
বন্ধুও নিজের বন্ধু হয়ে ওঠে। কাকু হয়ে যায় দাদা। দাদার বৌ কখনো মাসি।
কখনো পিসি। চা -বাগানে বাবুদের "বাসালাইন" বা কোয়ার্টার ক্যাম্পাসে কখনো
এমন অঘটন ঘটেই যায়। কেননা পাশের বাড়ির মেয়ে যাকে ছোট থেকে পিসি বলে ডেকে
এসেছে তাকে বিয়ে করে নিল কিনা সামনের বাড়ির দাদা। তেমনি খেলার মাঠে
বয়সে বড় দাদাকেও নাম ধরে ডেকে বন্ধু করে ফেলা যায়। বছর পাঁচেকের বড়
সুমন্ত সেভাবেই হয়ে ওঠেছিল খুব কাছের বন্ধু। মাঝে পড়াশোনার জন্য কখনো
শিলিগুড়ি কখনো জলপাইগুড়ি থাকতে হয়েছিল সুবর্ণকে। সুমন্ত তখন মালবাজারে
হস্টেলে থেকে পড়ত। অন্য কোথাও থাকার মত সংস্থান ছিল না ওর। যোগাযোগ
সাময়িক ছিন্ন হলেও ছুটিতে বাগানে এলেই দেখা হত। আড্ডা হত। সাইকেলে বা
হেঁটে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া হত। ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, ক্রিকেট। আড়ালে
আবডালে সিগারেট। সুমন্তরা তিন ভাই। বড় দুই দাদা-ই ভাল চাকরি করে। বাইরে
থাকে। এক দিদির ভাল বিয়ে হয়ে গেছে। কেবল সুমন্তরই পড়াশোনা তেমন এগোলো না
দেখে ওর বাবা রিটায়ামেন্টের পর ম্যানেজারকে বলেকয়ে ওকে বাগানে ঢুকিয়ে
দেয়। সেই থেকে ও বাগানের 'বাবু'। ডেজিগনেশান 'বাগান-বাবু' বা ফিল্ড
সুপারভাইজার। সারাদিন বাগানে বাগানে ঘুরে ও শ্রমিকদের কাজ দেখে। পাতা ওজন
রেকর্ড করে। বিকেলে অফিসে ফিরে সেদিনকার ফিল্ডের যাবতীয় তথ্য তৈরি করে
ম্যানেজারকে দেয়। ম্যানেজারের নির্দেশ মতো পরদিনের "কামজারি" বা
ওয়ার্ক-ডিপ্লয়মেন্ট লিখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে এক একদিন রাত
হয়ে যায়। বাগানে সারাদিন নানা মানুষের সঙ্গে ওর মেলামেশা। এছাড়া
বাবুদের স্টাফ ইউনিয়নের নীলপাহাড়ির ইউনিট সেক্রেটারি সুমন্ত ঘোষাল ।
কাজেই স্কূপ -নিউজ গুলো ও-ই পায় বেশি।
একদিন একটা
প্রিমিয়াম হুইস্কি এনে সুবর্ণকে ডেকে পাঠায় সুমন্ত। সঙ্গে জলঢাকার তরতাজা
ঝিলা মাছ ভাজা। সান্ধ্যকালীন বরাদ্দ দু-পেগ সুমন্তর সান্ধ্য আহ্নিকের মতো।
নির্জনে সেই 'কারণ-সাধনা'য় সচরাচর সে দোসর নেয়না কাউকে। শুধু কাজের
জায়গায় কারও সাথে লাফরায় জড়ালে সেই অভিযোগ গুলো শেয়ার করতে কিংবা
দাম্পত্যের পলকা সুতোয় নতুন করে চিড় ধরলে কচিৎ সেই দুঃখভার হালকা করতে
সন্ধে নাগাদ ও একমাত্র ডেকে নেয় সুবর্ণকে । এমনিতেই সুবর্ণর তরলে
আসক্তিযোগ কম। তার ওপর ডিউটি থাকলে একেবারেই নয়। সেদিন বোধহয় যেন সব
জেনেবুঝেই বিকেল নাগাদ সুমন্ত ফোন করেছিল সুবর্ণকে, 'আসিস, দারুন সব খবর
আছে। ' ওর উৎফুল্ল ভাব দেখে সুবর্ণ বুঝে যায় অন্তত নতুন করে হয়ত এবারে
আর সাংসারিক কোনও সমস্যা জন্ম নেয়নি।
আসলে
বিয়ের পর ওর একমাত্র সন্তান মেঘা জন্মানোর পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে
সমস্যা সৃষ্টি হয়। সুমন্তর স্ত্রী পায়েল বনেদি অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে।
বর্ধমানে ওদের সাত পুরুষের একান্নবর্তী পরিবার। প্রচুর জমিজমা, শহরে বিরাট
ব্যবসা। কলকাতায় পায়েলের বাবার দু'দুটো ফ্ল্যাট। দাদা এন আর আই। ওদের
বিয়ের সম্মন্ধ এনেছিলেন সুমন্তর বর্ধমানের পিসি। মেয়ে দেখতে গিয়ে
সুমন্তর বাবা স্রেফ গুল মেরেছিলেন, ছেলে চা-বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট
ম্যানেজার, গ্র্যাজুয়েট। ছবিতে চা-বাগান দেখে আর গল্প উপন্যাস পড়ে
চা-বাগান সম্পর্কে পায়েলদের পরিবারে চা-বাগান সম্পর্কে একটা ফ্যান্টাসি
ছিল। তাছাড়া বর্ধমানে সুমন্তর পিসির পরিবারের রেপুটেশন, সুমন্তর বাবার
বাগ্মীতা, আর ছবিতে সুমন্তর কন্দর্পকান্তি চেহারা দেখে রাজি হয়ে যান
পায়েলের বাবা। বেশ জমকালো বিয়ে হয়েছিল সুমন্তর। বরযাত্রী গিয়ে দারুণ
খাতিরযত্নও পেয়েছিল বাগানের মানুষ। কিন্তু বিয়ের পর নীলপাহাড়িতে এসে
শহুরে মেয়ে পায়েলের স্বপ্নভঙ্গ হয়। চা-বাগানের একঘেয়ে জীবনে মানিয়ে
নেয়া অসম্ভব হয়ে উঠতে থাকে। ডুয়ার্সের সবুজ জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা,
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ সহজ সরল সুমন্তর সাথে সুন্দরী,শিক্ষিতা,স্মার্ট
শহুরে মেয়ে পায়েলের ব্যক্তিত্বের সংঘাত ঘটতে থাকে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও
সংঘাত এড়াতে পারে না সুমন্ত। বাবার মিথ্যাচারের জন্য নিজেকে অপরাধী মনে
হয়। সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের মাঝেই জন্ম নেয় মেঘা। সন্তানের ভবিষ্যতের
কথা ভেবে বাবাকে দিয়ে পায়েল সুমন্তকে প্রস্তাব দেয় চাকরি ছেড়ে কলকাতায়
চলে যাওয়ার। সেখানে ব্যবসার জন্য সব বন্দোবস্ত করে দেবে পায়েলের বাবা।
রাজি হয়না সুমন্ত। সংঘাত চরমে ওঠে। একদিন ছ'বছরের মেয়েকে নিয়ে ঘর ছাড়ে
পায়েল। প্রথমে বর্ধমান, পরে কলকাতার ফ্ল্যাটে সেটল করে। সেখানে স্কুলে
ভর্তি করে মেয়েকে। মেঘা এখন কলেজে পড়ে। বছরে একবার করে বাবাকে দেখতে চলে
আসে নীলপাহাড়িতে। চলে যাওয়ার পর তের বছরে হাতেগোনা মাত্র বার তিনেক এসেছি
পায়েল সুমন্তর কাছে। একবার ছোট্ট মেঘার বাবাকে দেখার বায়না মেটাতে।
পরবর্তীতে দু'বার ব্যাংক সংক্রান্ত নথিপত্রে সইসাবুদ নিতে। সুমন্ত যদিও
প্রতি বছর 'সালছুটি'তে মেয়েকে দেখতে কলকাতায় যায়। দিদির বাড়িতে ওঠে ।
সেখানে মেয়ে আসে। বাপ-মেয়েতে কদিন আনন্দ করে ও ফিরে আসে বাগানে। মেঘা
নীলপাহাড়িতে এলে কদিনের জন্য আনন্দের হাট বসে সুমন্তর কোয়ার্টারে। সে
কদিন যেন অন্য মানুষ সুমন্ত। বাবার নেশা করা মেয়ের পছন্দ নয় বলে ও আসার
খবর পেলেই খালি বোতল সব মালিকে দিয়ে সরিয়ে ঘরদোর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে
রাখে সুমন্ত। মেয়ে চলে যাওয়ার দিন ওকে নিউ মাল জংশনে তুলে দিয়ে এসেই ফের
ও ডুবে যায় একাকিত্বের বিষাদ সাগরে। আবার হাতে তুলে নেয় বিষের পাত্র।
দু'নম্বর
পেগটায় ধীরেসুস্থে সোডা ঢালতে ঢালতে সুমন্ত রসিয়ে রসিয়ে ওর
এক্সক্লুসিভ খবরের ভান্ড উপুড় করতে থাকে,' নতুন যে ফ্যাক্টরি
অ্যাসিস্ট্যান্ট এসেছে তোর ফ্যাক্টরিতে, ওতো শালার এক নম্বর মেয়েবাজ রে!'
-'তুই কোত্থেকে জানলি?'সুবর্ণ একটু অবাক হয়।
-'আরে
খবর ঠিক জোগাড় হয়ে যায়। ও আগে যে বাগানে থাকতো সেখানকার বাগানবাবুর
সাথে সেদিন ইউনিয়ন অফিসে দেখা। ও-ই বললো। পাঠকের বউ থাকে কলকাতায়। স্কুলে
পড়ায়। এদিকে শিলিগুড়িতে ওর নাকি একটা স্টেপনি আছে।'বলে চোখ টেপে
সুমন্ত।
'মানে? '
'আরে রাখেল-রাখেল, মেয়েমানুষ... '
-'তাই নাকি! তোকে কে বললো? '
-'আরে
এসব খবর যোগাড় হয়ে যায় গুরু। আরো আছে! দেখবি শনিবার হলেই ব্যাটা
বিকেলে কেটে পড়ার তাল করছে। কেন জানিস? স্টেপনির কাছে যাওয়ার জন্য। কোনও
সপ্তাহে স্টেপনির হাজব্যান্ড চলে এসেছে জানলে অন্যদিকে চান্স মারবে। সোজা
গাড়ি নিয়ে চলে যাবে হয় কোনও সিঙ্গিং-বার-এ। নয় কোনও কল-গার্লের ঠেকে।
সিংগিং বার-এ গিয়ে বাবু নাচনেওয়ালী দের সামনে এইভাবে টাকা ওড়ায়, টাকা! "
বলে সুমন্ত দু'হাত দিয়ে টাকা ওড়ানোর ভঙ্গি করে।
' কী বলিস! " সুবর্ণ অবাক হয়,' ওর ফ্যামিলি আছে না!'
'
আরে, ফ্যামিলি তো কলকাতায়। বউ থোড়েই জানে।অবশ্য বউ এর কাছে ও আবার
জেনুইন হাজব্যান্ড। ছুটিতে বাড়ি এলে ভিগি-বিল্লি বনে যায়। ভাজা মাছটিও
উল্টে খেতে পারে না তখন। '
-আগের বাগানে ম্যানেজার কিছু অ্যাকশন নেয় নি? " সুবর্ণ জানতে চায়।
-'
আরে, মাল সেয়ানা। চান্স বুঝে খ্যালে। কোন্ বাগানে নাকি ম্যানেজারকেও
নিয়ে যেত সঙ্গে করে। সে আবার নাকি যেমন 'দারুখোর' তেমনি 'মাগীবাজ'। রতনে
রতন চেনে। বেশ জমিয়ে চলছিল কারবার। শেষে অ্যাসিস্ট্যান্ট দের মধ্যেই কেউ
নাকি মালিককে চুকলি করে দেয়। ব্যস, দুজনেই স্যাকড।'
দু
নম্বর পেগের তলানিতে এসে ঘোর লাগে সুবর্ণর চোখে। ঘোরলাগা চোখে হিসেব
মেলাতে থাকে। নেহাৎ ভিত্তিহীন নয় কথাগুলো। শনিবার হলেই লোকটা ঠিকই উসখুস
করতে থাকে বেরোনোর জন্য।
' আরো নিউজ আছে বস্.. ' বলে তিন নম্বর পেগটা বানাতে শুরু করে সুমন্ত।
-'আরে করছিস কী... আর না...আর দিস না। '
-' আরে খা-তো। বউ নেই, ডিউটি নেই, এত ভয় পাচ্ছিস কেন রে? 'সুমন্তর কথা জড়াতে থাকে।
-' আরে তা না, আসলে বয়স হচ্ছে তো। সহ্য হয় না এখন... '
'দুর শালা... । বয়স আবার কী রে! এখন একটা কথা বলব, শুনে সব বয়স -ফয়স কমে আদ্দেক হয়ে যাবে। '
'কী কথা? ' সুবর্ণ অবাক হয়।
' তোর বস... মিঃ সদানন্দ পাঠক...পাক্কা খিলাড়ি। নিজে তো মস্তি মারছেই, ওদিকে মালও সাপ্লাই করছে, সে খবর জানিস? '
-' মানে! '
-
' বাগানে থাকিস, কিস্যু খবর রাখিস না। খালি অফিস আর বাড়ি। ঘাড় গুঁজে কলম
ঘষে যাস। ওদিকে রোজ রাতে যে নতুন নতুন 'চামকি' আসে ডাইরেক্টর বাংলোয় তা
জানিস? '
- ' মানে! গর্গ এর বাংলোয়? ' নেশা টাল খায় সুবর্ণর।
-'
ইয়েস বস। আই হ্যাভ গট দ্য এক্সক্লুসিভ নিউজ ফ্রম বাংলো চৌকিদার। আর সেই
চামকি-চামেলী দের সাপ্লাই দেয় কে জানিস... তোর ইমেডিয়েট বস সদানন্দ পাঠক ।
ঐ গর্গ শালা বাগানে রাউন্ড দিতে গিয়ে আমার ওপর একদিন তেড়িবেড়ি করতে
গেছিল । এমন কথা শুনিয়েছিলাম যে আর কিছু বলে নি । আমার সঙ্গে পাঙ্গা!
সুমন্ত ঘোষালকে চেনে না! দেব শালাকে কোনদিন সবার সামনে নাঙ্গা করে...।'
খবরটা
জানার পর থেকেই পাঠকের ওপর ভক্তি চটে গেছিল সুবর্ণর। একবার ইচ্ছে হচ্ছিল
সেদিন বলেই ফ্যালে,' মিসেস তো কলকাতায়। আপনি কী এখন ফ্লাইটে কলকাতায়
যাচ্ছেন? ' কিন্তু বাড়ি যাওয়ার প্ল্যানটা ঘেঁটে যাওয়ায় আর রসিকতার মুডে
ছিল না সুবর্ণ। ততক্ষণে চারটে বাজে। তির্কী আসতেই কোয়াটার্সে ফিরে
তূর্ণাকে সব জানায় সুবর্ণ। যেরকম ঝোড়ো প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল তেমনটা না
হলেও খুব ঠান্ডা গলায় তূর্ণা যা বলেছিল তাতে মনে হচ্ছিল চাকরি-বাকরি
ছেড়ে বাড়ি চলে যায়। তূর্ণার যুক্তিপূর্ণ কথাগুলো চিন্তা বাড়িয়ে দেয়,
'
ঠিক আছে তোমার যখন সুবিধে হয় এসো। তোমার অফিস, অন্যের সুবিধে অসুবিধে
এগুলোই তো তোমার কাছে বড়, তাই না! আমাদের কথা না হয় ছেড়েই দাও, বাবার
অসুখের ব্যাপারটাও এখন দেখছি তোমার কাছে সেকেন্ডারি হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
যা ভাল বোঝো করো। শুধু জানিয়ে দিই বাবা কিন্তু আজকাল হুটহাট বেরিয়ে
পড়ছেন। আগে রাস্তা চিনে ফিরে আসতেন। এখন সেটাও পারছেন না। তূর্য দুদিন
ধরে-ধরে নিয়ে এসেছে। ওর স্কুল আছে, চারটে টিউটরের কাছে ছোটে। হঠাৎ বেরিয়ে
গেলে একা আমি কী করব বলতে পারো।তোমার দিদি জামাইবাবু তো ফোন করেই দায়
সারেন। রিটায়ার করে দু'জন অতবড় ফ্ল্যাটে থাকেন। একবার কী পারেন না বাবাকে
নিজেদের কাছে নিয়ে ক'দিনের জন্য রাখতে! বিয়ে হয়ে গেছে বলে কি বাপের
সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক টুকুও ঘুচে গেছে।' সুবর্ণর মুখে কথা যোগায় না।
তূর্ণা একা যা করে চলেছে সেটা আশাতীত। ওর ওপর কোনও কথা চলে না। কিন্তু কী
করবে, কী করা উচিত কিছুই মাথায় আসেনা সুবর্ণর। মাঝে মাঝে মনে হয় বাপের এক
ছেলে হওয়া বড় যন্ত্রণার। আরেক ভাই থাকলে সমস্যা গুলো অন্তত শেয়ার করা
যেতো।
বাইকটা না ঘুরিয়ে
হাইওয়ে ধরে সোজা ধাবার সামনে এসে দাঁড়ায় সুবর্ণ। স্বাদ বদলাতে এখান
থেকেই সে মাঝে মধ্যে খাবার নিয়ে যায়। সেই সূত্রে মালিক ভদ্রলোক বেশ চেনা
হয়ে গেছে। ঢুকলেই খাতিরদারি করে। আজও ব্যতিক্রম হলো না। সুবর্ণকে দেখে
এগিয়ে এসে বলেন,' আসেন স্যার। অনেকদিন পর আসলেন। বসেন।' বলেই ওয়েটারকে
ডাকেন। নেপালি ওয়েটারটি এগিয়ে এসে হেসে সেলাম জানায়।
-'যান,
ভেতর গিয়ে বসুন। ওদিকের একটা কেবিন ফাঁকাই আছে। কী খাবেন ওকে অর্ডার
দিয়ে দিন, ও দিয়ে যাবে। ' বলেই মালিক ভদ্রলোকটি ছেলেটিকে বলেন, 'সাব কো
কেবিন দিখাই দো ভাই। '
-'না, আমি খাব না। প্যাক করে
দিন।নিয়ে যাব।' বসে খেতে ইচ্ছে করছিল না সুবর্ণর। বাড়ি ফিরে মুখ হাত
ধুয়ে আগে একটু চা খেতে পারলে ভাল হতো. ..ভাবতে ভাবতেই ওয়েটার ছেলেটি যেন
মনের ভাবটা বুঝে ফেলে। -'চিয়া পিনে স্যার? মালাই, ইলাইচি দিয়ে-র ,
ইস্পেশল চিয়া। 'এমনিতে ব্ল্যাক টি খেলেও ধাবার এই দুধ-এলাচ দেয়া চা খেতে
ভালই লাগে।
-'হ্যাঁ। চা হলে ভালই হয়। দাও ।'
ছেলেটা
এগিয়ে এসে হেলমেটটা হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে কেবিনের পর্দা সরিয়ে
ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালায়। খুব বেশি খদ্দের নেই আজ ধাবায় কেবিনগুলো প্রায়
ফাঁকা। গুটিকয় ছেলে ছোকরা এককোনে টেবিল দখল করে বিয়ার খাচ্ছে। পাশের ভি.
আই.পি কেবিনটায় পর্দা টানা। পর্দার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি যেতেই মনে হলো কোনও
বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার গোছের দু-তিনজন বসে মৃদু আলো আঁধারিতে
পানভোজনে ব্যস্ত। নিচু গলায় কথা বলছেন সকলেই। কেবিনে ঢুকতেই ছেলেটি চেয়ার
টেবিল ঝেড়ে যত্ন করে বসায়। মিনারেল ওয়াটার এগিয়ে দিয়ে জানতে চায়
কি-কি খাবার প্যাক হবে। অর্ডার নিয়ে ছেলেটি বলে,'তপাই রিল্যাক্স গরনু হোস
স্যার। মো একছিন্ মা চিয়া লাই দিন্দইঞ্ছু।' (আপনি রিল্যাক্স করুন। আমি
এক্ষুনি চা এনে দিচ্ছি।)"
ছেলেটা চলে যেতেই পাশের
কেবিন থেকে টুকরো কিছু কথাবার্তা কানে আসে। কাঁচা চা-পাতার দরদাম নিয়ে কথা
হচ্ছে। খুব নিচু স্বরে কথা বললেও নেশা জড়ানো স্বর মাঝে মাঝেই উচ্চকিত
হয়ে পড়ছিল। কাঁচা পাতার রেট, কোয়ালিটি, ট্রান্সপোর্ট-কস্ট, কথাগুলো শোনা
যাচ্ছিল। আলোচনায় আশপাশের দু'চারটে ভাল গার্ডেনের নামই বারবার উঠে আসছিল
। হঠাৎ করে কারো একজনের নেশা জড়ানো গলা উচ্চকিত হয়ে ওঠে,' নীলপাহাড়ি আব
মেরে কব্জে মে। সুদেশ গর্গ কো মনোপলি অব গয়া।' নীলপাহাড়ির নামটা কানে
যেতেই উৎকর্ণ হয় সুবর্ণ। আড়িপাতা গর্হিত হলেও এই মুহূর্তে সেটাই করতে
হচ্ছে সুবর্ণকে। কাঠের পার্টিশান ঘেঁষে কান পাততেই বেশ কিছু কথা কানে চলে
আসে।
-' উধার মেরা মোহরা ফিট হো গয়া,'-গলাটা চেনা-চেনা ঠেকে।
-' কার কথা বলছেন? ' এই স্বরটা অচেনা।
-' আরে, তুম পহেচানতে হো উনকো..নামটা মোনে নাই.. কি সাম পাঠক। '
-' ও... সদানন্দ.. ও তো এর আগে ব্লু-ভিউ তে ছিল। খুব ভাল করে চিনি। মেয়েবাজির চক্করে আগের চাকরিটা গেল। '
-' হাঁ... হাঁ..সহি বাত। লেকিন ওর থেকেও তো বড়ি রন্ডিবাজ দুসরা একজন বসে আছে উখানে।'
-' কে? সুদেশ গর্গ? '
-'
হাঁ জানেন দেখতেসি ? স্রিফ রন্ডিবাজ হি নহি। শালা এক নম্বর কা হারামি।
দিমক(ঘুণপোকা) কা তরহা চুষ রহা হ্যায় বাগান কো। ইতনা দিন উনকা আপনা
পার্টি কো মাল দেতা থা। উনসে খরিদতা থা ভি। বিচ মে ফাইভ পার্সেন্ট ফিক্সড
কমিশন। শালা,এক নম্বর কা মগর মছ। হর চিজ মে কমিশন খাতা হ্যায়। আব উনকা
দিন গয়া। পাঠক উনকা নশ পকড় লিয়া। খুবসুরত লড়কি সাপ্লাই দিয়ে গর্গ কে
অলরেডি ট্যাকল কোরে নিসে। আব আগে আগে দেখতে যাও হোতা হ্যায় ক্যায়া।
নীলপাহাড়িকা মাল আব ভাগবত পাশোয়ান হি লেগা।' - নামটা শুনেই সুবর্ণ এবার
নিশ্চিত হয়। গলার স্বরটা কেন এতক্ষণ চেনা ঠেকছিল। লোকটা একসময় নীলপাহাড়ি
থেকে কাঁচা পাতা কিনতো। পাতা সাপ্লাইও করত। প্রয়োজনে লেবার পেমেন্টের
সময় টাকা কম পড়লে অ্যাডভান্স টাকা দিয়ে হেল্পও করত। সেসময় ম্যানেজারের
মাথার ওপর এই সুদেশ গর্গ ছিল না। লোকটা এসে ম্যানেজারকে দাবিয়ে রেখে
নিজেই সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। নিজের ইচ্ছে মত যাকে খুশি মাল দিচ্ছে। যার
থেকে ইচ্ছে মাল কিনছে। মাঝখানে লুটে নিচ্ছে বখরা।
-' এত সুন্দর বাগানটা ঐ লোকটাই বরবাদ করে দিচ্ছে।'
আরেক জনের গলা শোনা যায় এবার।
'হোগা
কিঁউ নেহি। মালিককো তো চা-য় কে বারে মে কুছ ভি জানকারি নেহি। সুদেশ কো
উপর ভরোসা করকে বাগান ছোড় দিয়া। উসিকা ভরপুর ফায়দা লে রহা হ্যায় উয়ো
আদমি। মালিক অন্য বিজনেসে দিমাগ লাগায়ে বইসে আছে। বাগান ভিজিটেই আসে
না...। '
-' আমি তো শুনলাম সুদেশ গর্গ নাকি ভয়
দেখিয়ে রাখে মালিককে। পি. এফ, গ্র্যাচুইটি বাকি... বাগানে আসলেই নাকি
লেবাররা মেরে ফেলবে। সেই ভয়ে মালিকও বাগানে আসে না।'
আরেকজনকে
বলতে শোনা যায়, ' এ-তো আমাকে ঐ ডায়ালগটা মনে করিয়ে দিচ্ছে, "আজিব চিজ
হ্যায় ইয়ে মগরমছ,জিতনাভি খিলাও ভুখ নেহি মিটতা' কথাটা শেষ না হতেই
সমস্বরে হাসি শোনা যায়।
কথাগুলোর ভেতর সুমন্তর
সেদিনকার কথাগুলোরই প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পাচ্ছিল সুবর্ণ। লোকগুলোর কথায়
পুরো ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়ে গেল। তার মানে পাঠক লোকটা আরেকটা ঘুণপোকা।
গর্গের সাথে যুগলবন্দী করে নীলপাহাড়ির সর্বনাশ করার ধান্দায় মেতেছে। আর এ
কারনেই হয়ত লোকটা ইদানীং গ্রিন-লিফ ওজন করতে দেয় না কাউকে।
ওয়েমেন্ট-স্কেল এর চাবি নিজের কাছে রাখে। লিফ সেল কিংবা পারচেজ
স্টেটমেন্টে ম্যানিপুলেট করে নিজে হেড অফিসে পাঠায়। যে করেই হোক ম্যানেজার
মিঃ সহায় এর কানে তুলে এই ঘুঘুর বাসা ভাঙতেই হবে।