গুডরিকসের লিজ রিভার চা বাগানে/গৌতম চক্রবর্তী
গুডরিকসের লিজ রিভার চা বাগানে
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো দুই সপ্তাহ ধরে বাগিচা সফরের টাটকা স্বাদ নিতে ফিল্ড ওয়ার্কে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই ২০২০ সালে করোনার সময়কালে মার্চ মাসে এ রকমই একটি শনি এবং রবিবার মালবাজার সার্কিটের বাগানগুলিকে নিয়ে কাজ করবার সময়কালে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল এবারের লেখা সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই। জলপাইগুড়ি থেকে গুডরিকসের লিজ রিভার বাগানে ফিল্ড ওয়ার্ক করার কাজে রওনা দেবার সময়ই পরিকল্পনা করেছিলাম গুডরিকসের আর একটি বাগান ডেঙ্গুয়াঝাড় হয়ে যাব। কারণ তার আগের দিনই লোকাল চ্যানেলে দেখেছিলাম বাগিচা শ্রমিকদের বিক্ষোভের খবর। ম্যানেজার জীবন চন্দ্র পান্ডের সঙ্গে আমার পরিচিতি অনেকদিনের। কিন্তু তিনিও ফোন ধরেন নি। তাই সবিশেষ কৌতূহল ছিল বিষয়টা কি তা নিয়ে। অনুমতি নিয়ে অফিসে ঢুকলাম। দেখলাম বাগানের অফিসের বিভিন্ন দেওয়ালে লাগানো হয়েছে পোস্টার। তাতে ইংরেজি, বাংলা সহ বিভিন্ন ভাষায় লেখা রয়েছে নো মাস্ক, নো ওয়ার্ক। বাগানের সিনিয়র ম্যানেজার জীবন চন্দ্র পান্ডেকে অফিসেই পেয়ে গেলাম। জানালেন, সরকার প্রথমে বলেছিল ১৫ শতাংশ শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে। পরবর্তীকালে তা বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছে। তাই ২৫ শতাংশ শ্রমিক দিয়েই ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগানে কাজ শুরু হয়েছে। তবে শ্রমিকদের অভ্যাস সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করা। তারা বাড়িতে বসে থাকতে চায় না। তারা চাইছে নিয়ম মেনে সব শ্রমিক মিলে একসঙ্গে কাজ করতে। কিন্তু এখন আইন অনুযায়ী কাজ করানো হচ্ছে।
অফিসের বড়বাবুর কাছ থেকে গোপনীয়ভাবে জেনেছিলাম ফার্স্ট ফ্লাশের এই সময়কালে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা না করে বাগান বন্ধ করা সম্ভব না। যেহেতু সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতে হয় তাই এভাবে লকডাউন করা যেতে পারে না। কিন্তু শ্রমিকেরা ঘেরাও করে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কারণে বাগানে লকডাউন করতে চাপ দেয় এবং তাদের মাস্ক এবং সাবান দেওয়ার দাবি জানায়। সেই ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশ্বাস দেওয়া হয়। চা বাগানে বেশ কিছুটা দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করতে দেখলাম মহিলা শ্রমিকদের। মুখে মাস্ক এবং হাতে গ্লাভস পরে চা পাতা তুলছেন তাঁরা। আবার চা পাতা ওজন করার জায়গায় গিয়ে চোখে পড়লো সেখানেও সামাজিক দূরত্ব মেপে হাতে গ্লাভস আর মুখে মাস্ক পড়ে কাজ করা হচ্ছে। যদিও কথা বলে বুঝতে পারলাম বাগানের শ্রমিকরা চাইছে ২৫ শতাংশ নয়। সকল শ্রমিকদের কাজে ডাকা হোক। সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে হাতে গ্লাভস আর মুখে মাস্ক লাগিয়ে কাজ করুক। তাতে শ্রমিকদের ঘরে শুরু হওয়া অর্থের সংকট অনেকটা কমে যাবে। গাড়িতে সবুজ গালিচার মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে ভাবছিলাম কথাটার মধ্যে তো ১০০% যুক্তি আছে। আবার পাশাপাশি চিন্তা করলাম চা শ্রমিক পরিবারের বহু সদস্য কাজের স্বার্থে ভিন রাজ্যে বসবাস করছে। লকডাউন এর এই সময়ে তারা বাংলায় ঘরে ফিরেছে। ফলে তাদের সফর ইতিহাস সম্পর্কে সমীক্ষা করা একান্তই প্রয়োজন। তাছাড়াও বাগান বন্ধ করলে শ্রমিকদের বেতনের ব্যবস্থা সরকার না করলে এলাকায় অসন্তোষ এবং উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। সেই বিষয়টিতেও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা একান্তই প্রয়োজন।
২০২০ সালের মার্চ মাসে বসন্ত সমাগমে উত্তরবঙ্গের চা বাগিচাগুলি নতুন করে শ্বাস নিতে শুরু করেছিল। বৃষ্টি হবার ফলে গাছের আগায় এসেছিল নতুন পাতা। পৌছালাম লিজ রিভার চা বাগানে। বাগরাকোট চা বাগান থেকে বের হয়ে অল্প একটু এগোলেই ডুয়ার্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান লিজ রিভার। গুডরিকস গ্রুপ অফ কোম্পাণীর একটি অন্যতম প্রতিষ্ঠিত এবং ভালো বাগান লিজ রিভার। মালবাজার মহকুমার গুডরিক গ্রুপ লিমিটেডের ‘লিজ রিভার’ চা-বাগানের চা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। বিশ্ব জুড়ে চা পানের অভ্যেস বৃদ্ধির সঙ্গে চায়ের বাজারে নানা দেশের তৈরি চায়ের চাহিদা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে প্রতিযোগিতাও। আপাতত ব্রিটেন, জার্মানি, জাপান, আমেরিকায় চায়ের ব্যবসায় নেমেছে গুডরিকস। সেই গুডরিকস কোম্পাণিরই একটি অন্যতম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান লিজ রিভারে এসেছিলাম ফিল্ড ওয়ার্কে। বাগরাকোট থেকে লিজ রিভার ঢোকার পথে গাছের ছায়ায় দেখলাম চা শ্রমিকদের মৃতসঞ্জীবনী সুধা হাঁড়িয়া পানের আসর। পাশেই বিক্রি হচ্ছে চুনো মাছ ভাজা। শুনশান চা বাগিচার পথ। বাবু শ্রমিকেরা গেছে ওদলাবাড়ি, মালবাজার না হলে শিলিগুড়িতে সাপ্তাহিক হাটবাজার বা বিনোদনের জন্য। চা বাগিচার মন্দির, চা নার্সারি, বাবুদের আস্তানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেলাম দিগন্তবিস্তৃত চায়ের সমুদ্রে। নির্জন চা বাগানের সরু পথ ধরে চলতে চলতে দেখলাম শিরীষ গাছের গুঁড়ির আড়ালে কাঠবেড়ালির লুকোচুরি খেলা। কতরকম পাখির সংগীত প্রতিযোগিতা চলছে তার কোন হিসেব নেই। কোকিলের কুহু কুহু রবে চারিদিক মুখর। কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে কোয়েলের সভা। অবিরাম ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁ পোকারা।
গুডরিক গ্রুপ লিমিটেডের বাগানটি ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘ডি.বি.আই.টি.এ’ র অন্তর্ভুক্ত। বাগানের ম্যানেজারিয়াল স্টাফের সংখ্যা ৮ জন। তাদের বাৎসরিক লক্ষ্য ১০ লক্ষ কেজি সিটিসি চা রফতানি করা। রফতানির জন্য নির্দিষ্ট গুণগত মান বজায় রেখে চা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনে রেনফরেস্ট অ্যালায়েন্সের মতো উপদেষ্টার সাহায্য নেওয়ার কথাও চিন্তা করে গুডরিকস। লিজ রিভার চা বাগানে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৫টি। চা বাগানের আয়তন ১০২৯.৪৩ হেক্টর। এক্সটেনডেড জমি নেই। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদক্ষেত্র ৫২.০৬ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল এবং চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদীক্ষেত্র ৬৩৪.৬১ হেক্টর। উৎপাদনযোগ্য ড্রেন ও সেচযুক্ত ‘প্ল্যান্টেশন এরিয়া’ থেকে প্রতি হেক্টর জমি পিছু ২০৭৩ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। লিজ রিভার চা বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত কাঁচা চা পাতা ৫৪-৫৫ লাখ কেজি এবং ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চা ১১-১২ লাখ কেজি। বহিরাগত বাগান থেকে সংগৃহীত এবং কেনা কাঁচা চা পাতায় প্রস্তুত বিক্রয়যোগ্য চায়ের পরিমাণ দুই থেকে আড়াই লাখ কেজি। তাই প্রায় প্রতি বছর ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত চায়ের প্রকৃতি অনুযায়ী ইনঅৱগ্যানিক সিটিসি চা প্রস্তুত হয় প্রায় ১৩-১৪ লাখ কেজি করে। লিজ রিভার বাগানটি চরিত্রগত দিক থেকে উন্নতমানের বাগান। লিজ রিভার টি গার্ডেন এস,জি,আর,ওয়াই বা এম,জি,এন,আর.ই.জি.এস.-এর সুবিধা পায়। ব্যাঙ্কের কাছে বাগানটি দায়বদ্ধ নয়। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স এবং চা বিক্রয় বাবদ আয় থেকে।
ডুয়ার্স এবং তরাইয়ের বড় চা বাগান যেগুলোকে “সেট গার্ডেন” বলা হয় সেগুলির প্রতিটিতে খুব কম করে ধরলেও ৬০০-১২০০ শ্রমিক কাজ করে। সকালে সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে যে যার মত পাতা তুলতে বাগানে চলে যায়। পরে সকলকে একসঙ্গে পাতার বস্তা কাঁধে নিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। পাতা তোলা চলতে থাকলে এই জমায়েত এড়ানো সম্ভব নয়। তাই প্রশ্ন তৈরি হয় জমায়েতে শুধু মুখে মাস্ক পড়ে করোনা সংক্রমণ আটকানো সম্ভব কিনা। লিজ রিভার চা বাগিচাতে সেদিন রেশন দেওয়া হচ্ছিল। চোখে পড়ল ২ মিটার লম্বা টিন দিয়ে তৈরি একটা পাত্র। কার্যত তাতে করে চাল, চিনি এবং আটা ঢেলে দেওয়া হচ্ছে চা বাগানের শ্রমিকদের থলিতে। বজায় রাখা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব। একই সঙ্গে চোখে পড়েছিল রেশন দোকানের সামনে চুন দিয়ে এক মিটার দূরত্ব বজায় রেখে যাতে গ্রাহকেরা দাঁড়িয়ে থেকে মাল নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে তার জন্য সেখানে গোল দাগ টেনে দেওয়ার ব্যাবস্থা। সেখানেই বাগানের শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা যারা রেশন নিতে এসেছেন তারা ধীর স্থির ভাবে অপেক্ষা করছেন। প্রত্যেকের মুখে মাস্ক। পরিবার পিছু ১৫ কিলো করে চাল আর ১৫ কিলো করে গম দেওয়া হচ্ছিল। করোনা সচেতনতায় চা-বাগানে এই ধরনের সর্তকতা যথেষ্ট প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিল। করোনার সময় রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন রেখেছিল চা-বাগানের মালিকেরা যে বাগান খোলা হোক এবং শুরু হোক কাজ। যদিও তাতে আপত্তি ছিল শ্রমিকদের। কারণ তাদের ভয় ছিল সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার। সব কিছু বিবেচনা করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলে চা বাগানে কাজ শুরু করা যাবে। তবে মেনে চলতে হবে সামাজিক দূরত্ব। হাতে গ্লাভস আর মুখে মাস্ক অবশ্যই পড়তে হবে। স্যানিটাইজেশন মেনে চলতে হবে। বাগানের শ্রমিকদের রোটেশন পদ্ধতিতে কাজ দিতে হবে। কোনভাবেই যেন একদিনে পঁচিশ শতাংশের বেশি শ্রমিককে কাজে ডাকা না হয়। সেই সব নিয়ম মেনে কাজ চালু হয়ে যায় উত্তরবঙ্গের চা বাগিচাগুলিতে। কাজ চালু হয় লিজ রিভার চা বাগিচাতেও। যদিও কিছু কিছু জায়গায় তখনও কাজ শুরু করা যায়নি। কারণ শ্রমিকেরা জানিয়ে দিয়েছিল গ্লাভস আর মাস্ক ছাড়া তারা কোনরকম কাজ করবেন না। কার্যত ডুয়ার্সের চা বাগানে একসময় একটা স্লোগান খুব শোনা যেত “নো ওয়ার্ক, নো পে” সেটাই তখন বদলে গিয়ে হয়ে গিয়েছিল “নো মাস্ক, নো ওয়ার্ক”।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের সঙ্গে এলাম অফিস রুমে। ঝকঝকে অফিসঘর। কিন্তু ছবি তোলায় কঠোরতা। তাই ইচ্ছে থাকলেও ফ্যাকটরির ভেতরে ছবি তুলতে পারলাম না। লিজ রিভার চা বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ১১২ জন। করণিক ১৪ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ১৮ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ১০৮৩। মোট জনসংখ্যা ৭১৮৯। স্থায়ী শ্রমিক ১৫৩৪ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৫১ জন। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক নেই। কম্পিউটার অপারেটর ২ জন। সর্বমোট সাব স্টাফ ১১২। ক্ল্যারিকাল, টেকনিক্যাল শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ৩২। মোট কর্মরত শ্রমিক ১৭৮০ জন। শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৫৪০৯। লিজ রিভার চা বাগানে আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ১০০৬। বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাসের সংখ্যা ৫৩। মোট শ্রমিক আবাস ১০৬৭। বাগানে শতকরা ৯০ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। লিজ রিভার চা বাগানে শৌচাগারের সংখ্যা ৭৮৪। বাগানে বৈদ্যুতিকীকরণ হয়েছে। ব্যক্তিগত মিটারযুক্ত বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া শ্রমিক আবাসগৃহের সংখ্যা ১০০৬।
করোনার প্রকোপে টালমাটাল পরিস্থিতি ক্রমশ বেড়ে চলে উত্তরবঙ্গে। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারের শতাধিক বাগানের প্রচুর শ্রমিক বিভিন্ন রাজ্য থেকে ফিরে আসে চা বাগান এলাকায়। ভিনরাজ্য থেকে যে সমস্ত শ্রমিকেরা নিজেদের চা-বাগানে ফিরেছে সেই মানুষের কোন প্রকার উপসর্গ দেখা দিলে তাদেরকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চা বাগানের শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে রাজ্য সরকার চা বাগানের সমস্ত হাসপাতালগুলিকে কোয়ারেনটাইন সেন্টার করে। লিজ রিভার চা বাগিচার হাসপাতালটিও কোয়ারান্টাইন সেন্টার হয়। রাজ্যে করোনা সংক্রমণ ছড়াতে থাকার ফলে চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায়। চা বাগান মালিকদের কাছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করে অনুরোধ রাখেন শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। লিজ রিভার চা বাগিচা তখন মডেল চা বাগান হিসাবে কাজ শুরু করে। মুখ্যমন্ত্রীর আহবানে সাড়া দিয়ে চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মহল শ্রমিকদের মাস্ক বিতরণের কাজে নেমে পড়লেও সমস্যা তৈরি হয় বিপুল সংখ্যক এন ৯৫ মাস্কের সরবরাহ নিয়ে। চা মালিকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুখ্য উপদেষ্টা অমিতাংশু চক্রবর্তীর নির্দেশে সমস্ত চা মালিকদের সংগঠনগুলি রাজ্য সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী মুখে মাস্ক পড়ে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী প্রদান করেন। পাশাপাশিভাবে রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরকেও শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে মাস্ক দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ পাঠায়।
লিজ রিভার বাগিচাতে ডিসপেনসারির সংখ্যা ১টি। আলাদাভাবে পুরুষ/মহিলা/আইসোলেশন ওয়ার্ডের ব্যবস্থা আছে। মেটারনিটি ওয়ার্ড আছে। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৮টি, ফিমেল ওয়ার্ড ৮টি, আইসোলেশন ওয়ার্ড ৬ টি, মেটারনিটি ওয়ার্ড ৮টি। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারও আছে। বাগিচায় অ্যাম্বুলেন্স, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডাক্তার আছে। ডাক্তারের নাম ড. কে কে ভৌমিক। নার্সের সংখ্যা ২ জন। নার্সরা প্রশিক্ষিত। কম্পাউন্ডার ১ জন। স্বাস্থ্য সহযোগী ১ জন। লিজ রিভার চা বাগানে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার অজয় সাহা ১৯৯২ সালে বাগানে কাজে যোগ দেন। বাগিচায় ক্রেশের সংখ্যা ৩টি। শৌচাগার আছে। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের সরবরাহ করা হয়। সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা হিসাবে আছে ১টি বাস। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব ও খেলার মাঠ আছে । লিজ রিভার টি গার্ডেনে বিগত অর্থবর্ষে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা প্রভিডেন্ড ফান্ড খাতে জমা পড়েছে, কোনও বকেয়া নেই। মজুরি চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া নেই। রেশন বকেয়া নেই। শ্রমিকদের জ্বালানী / ছাতা / কম্বল নিয়মিত সরবরাহ করা হয়। গ্র্যাচুইটি বাবদ বরাদ্দ অর্থ নিয়মিত দেওয়া হয়। বছরে গড়ে ৫৫ জন শ্রমিক গ্র্যাচুইটি পেয়ে থাকেন।
কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর তথা সিইও অরুণ এন সিংহের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় জানা গিয়েছিল গুডরিকস চিন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলির বাজারেও তৈরি চা নিয়ে হাজির হয়েছে। লক্ষ্য সার্বিকভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ওই চায়ের বাজার ধরা। সেই কথা মাথায় রেখেই উত্তরবঙ্গে তৈরি চায়ের কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে নতুন করে লগ্নি করেছে সংস্থা। এর ফলে কারখানাগুলির উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়বে বলে দাবী কোম্পানির। আধুনিক চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রথাগত চায়ের পাশাপাশি প্যাকেটজাত চায়ের উৎপাদনেও নজর দিচ্ছে গুডরিকস এবং দু'বছরে তা ২৫ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে তারা। এখন বছরে ৮০ লক্ষ কেজি প্যাকেটজাত চা তৈরি হয়। তা বেড়ে হবে এক কোটি কেজি। ব্যবসার বিপণনেও ১০ কোটি টাকা খরচ করা হবে। এখন গুডরিকস গোষ্ঠীর হাতে ১৭টি চা বাগান আছে। এর মধ্যে ১২টি ডুয়ার্সে, দার্জিলিঙে ৩টি, ২টি আসামে। আসামে আরও দু-একটি বাগান কেনার ইচ্ছে গুডরিকসের। বছরে গড়ে ৪০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দেয় গুডরিকস। বাগিচা থেকে যখন বেড়িয়ে আসছিলাম তখন নতুন পাতা আর সবুজ গালিচা জুড়ে ছিল শুধুই মন মাতাল করা গন্ধ। শীতকালে দীর্ঘদিন যাবত চা বাগিচা বন্ধ থাকে। গাছের পাতা থাকে না বলে উৎপাদন হয় না। বাগানের রং তখন থাকে কেবলমাত্র ধূসর। শীতের শেষে চা বাগানের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হয়। ফিরছিলাম যখন তখন চারিদিকে সবুজ পাতা। ফার্স্ট ফ্লাশের সময় সবুজ কার্পেট বিছানো ডুয়ার্সের চা-বাগানে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এবং দামী চা পাতার জন্য এই সময়ের দিকেই তাকিয়ে থাকে চা শিল্পমহল। স্বাদে এবং গন্ধে চায়ের বাজারে প্রথম ফ্লাশের কদর এবং দাম দুটোই বেশি। মার্চ মাসে প্রথম ফ্লাশের পাতা তোলা হয়। হায়! ফিরে আসার সময়ও তো বুঝতে পারিনি সেই বছরের জন্য আমার সেটাই শেষ বাগিচা সফর। লকডাউনে চা বাগিচার ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শোনাবো পরের লেখাতে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴