সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
07-July,2023 - Friday ✍️ By- শুক্লা রায় 569

গুগল পে/শুক্লা রায়

গুগল পে
শুক্লা রায়

চায়ের দোকানে জমজমাট আড্ডা। ঘন ধোঁয়ায় ধূমায়িত পরিবেশ। বটতলার এই নিচটায় একসময়ে আমরা ক'জন নরক গুলজার করতাম। পরে একটা বাঁশের চাংড়া পেতে কয়েকটা কাচের গ্লাস আর কেটলি নিয়ে হঠাৎ করেই নীরেন কাকা চায়ের দোকান খুলে বসল। আসলে নানান রোগভোগে কাকার শরীরটা ঠিক জুতের নেই। বহনের কাজ করতে পারে না তেমন। লোকে হাজিরায় নিতে চায় না। দল বেঁধে কাজ করার সময় গ্রুপের লোকজনও রাগ করে। ওর কাজ এগোয় না, সমান হাজিরা দিলে লস হয় সবার। কত আর লোকের গঞ্জনা শুনবে। কাকি নাকি বলেছিল, 'তুমি চায়ের একটা দোকান দাও, চলুক না চলুক, চেষ্টাটা কর। আর আমি একাই কাজ করি।' তা দোকান দুয়েক দিনের মধ্যেই বেশ জমজমাট হয়ে গেল। খুব বেশি দোকানপাট নেই। জায়গাটা ফাঁকাই। কিন্তু লোকে যা দু'একটা খুচরো জিনিসপত্র কিনতে আসে, এলেই একটু আড্ডার জায়গা খোঁজে। চায়ের দোকানটা হওয়াতে সবার সুবিধাই হল। সকালটা ছেলে-পিলেদের দখলে। বিকেল হলেই বুড়োরা সব জমিয়ে বসে। বিড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে গরম চায়ের গন্ধ আর খুকখুক কাশির এক অপূর্ব কনসার্ট।
লোকে তো শুধু চা খেতেই আসে না, একটু গপ্প-সপ্প করতেও আসে। নাতির সর্দি জ্বর দিয়ে শুরু হয়ে আজকালকার ছেলেদের জ্ঞানগম্যির অভাব থেকে শুরু করে মায় রাজনীতি এবং পাটের দাম সবকিছু নিয়েই  জবরদস্ত আলোচনা করে তবেই বাড়ি ফেরা। তা কাকা ধীরে ধীরে সব আয়োজন পোক্ত করেছে। মাটিতে বাঁশের শক্ত খুঁটি পুঁতে তার উপর কাঠের তক্তা ফেলে শক্ত করে বেঁধে একটা বেঞ্চই তৈরি করে ফেলল। ক্রমে ক্রমে জায়গাটা পুরো নীরেনকাকার দখলে। চায়ের দোকানের সাথে তাল রেখে অবশ্য একটা ভাগা পান-সুপারীর দোকানও গজিয়ে গেল। এ হেন নীরেন কাকা আর খুব দুবলা পাতলাও থাকল না। দু' পয়সা হাতে আসছে বোঝা যায়। গায়ে গতরে বেশ মাংস গজিয়ে গেল। কাকিও এখন দোকানে। কাকুর সঙ্গে হাতে হাতে সাহায্য করে। এখন আর রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে রোয়া বোনা, ধান কাটার মাঠে কাজ করার বালাই নেই। দোকানেই কাকুর সঙ্গে থাকে। বিকেলটাতেই বেশি চাপ। বিনোদনের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের চা দোকানটাই আড্ডার পোক্ত জায়গা এখন। আমি আফিস ফেরৎ বেশিরভাগ দিন একটা চা খেয়ে তবেই বাড়িমুখো হই। মানসি খুব রাগ করে তবু অভ্যাস বদলাই না। আসলে সেই অল্প বয়স থেকে কাকুর দোকানে বসি। তখন একরকম ছিল। সময় পাল্টেছে। চাকরি বাকরি করি, কাকু আমাকে বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখে। নিজে লেখাপড়া জানে না। আমাদের কাছে ছেলেকে নিয়ে দুটো মনের কথা বলে আরাম পায়। আমরাও সময়ে সময়ে দুটো ভালো পরামর্শ দিই । এ ব্যাপারে কাকু আমাদের ভরসা করে, আমাদেরও ভালো লাগে।
তা সেদিন দোকানে যেতেই বলল, 'আচ্ছা সতীশ, এই গুগল পে টা কী বলতো?' এখন মোটর বাইক নিয়ে শহরের ছেলে-টেলে কিছু ঢোকে, প্রায়ই বলে গুগল পে আছে? না থাকলেই বেরিয়ে চলে যায়।'
আমি জ্ঞান দেবার সুযোগটা মিস করলাম না। এক কাপ চা নিয়ে বসে ধীরে সুস্থে গুগল পে-র সুবিধাগুলো বোঝালাম। আর কাকুর শুধু একটাই কথা, 'বাবা, এতসব নিয়ম-কানুন কিছুই বুঝি না। টাকা-পয়সা চোট হবে না তো?'
আমি বিজ্ঞের মতো হাত তুলে অভয় দান করি। বোঝাই। অবশেষে বেশ একটা আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাইক স্টার্ট দিই।
সেদিন অফিস যাওয়ার পথে দেখি দোকান বন্ধ। চিন্তা হল। শরীর-টরির খারাপ করল না তো? বাইকটা একটু থামিয়ে একে তাকে জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা করলাম, কেউ কিছু বলতে পারল না। বিকেলে দেখি দিব্যি দোকান খোলা। দোকানে বসতেই কাকু চা এগিয়ে দিল। আজ হাটবার। আরো কয়েকটা চায়ের দোকান আছে। তবু কাকুর বেঞ্চগুলো ভর্তি। লুঙি অথবা খাটো ধুতি পরিহিত কাঁচা-পাকা চুলো মাথার নানান আকৃতির মানুষে বেঞ্চ দখল। আমি আঙুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে কাপে আস্তে করে চুমুক দিই। এখানে অনেকেই পরিচিত বয়োঃজ্যেষ্ঠ আছেন। তবে সম্মানিত কেউ নন। সবাই অশিক্ষিত গেঁয়ো হাটুরে। উল্টে আমাকেই সবাই সম্মান দেখিয়ে জায়গা ছেড়ে দেয়। অত ভিড়ে বসতে রুচি হল না। বললাম, 'কী কাকা, সকালে দোকান বন্ধ দেখলাম যে!'
এত ব্যস্ততার মধ্যেও হাসিমুখের উত্তর এল,
'গেছিলাম একটু ব্যাঙ্কে। ছেলের সঙ্গে। গুগল পে খুললে নাকি এটিএম লাগে? তা ছেলে সব জানে দেখি। নিয়ে গেল। কাগজ-পত্রে সই দিলাম। বাড়িতেই দিয়ে যাবে নাকি, পিওনের দ্বারায়?'
আমি মাথা নাড়লাম। একটা লোক ছেঁড়া পাঞ্জাবীর পকেট থেকে রুমাল বের করতে করতে বলে, 'কালে কালে কি হইল বলেন তো। ব্যাঙ্কের সামনে দেখি কম্পিটারের দোকান দিছে। আধার কার্ড দিয়ে টাকা তোলার দোকান। খালি দশটা টাকা ফিজ নেয়।'
অনেকেই কথাটায় সায় দেয়। বেঞ্চি সরগরম ছিল আসন্ন লোকসভা ভোট নিয়ে, মুহূর্তে আলোচনা গড়িয়ে যায় আজকালকার যুগের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে।লাইন দিতে লাগে না, আধার কার্ড দিয়ে টিপ ছাপ দিয়েই কেমন হাতে টাকা এসে যাচ্ছে।
মানসির গনগনে মুখটা মনে পড়াতে বাইক স্টার্ট দিলাম।
গুগল পে দেখি ভালোই চলতে লাগল কাকুর। গ্রামের মানুষ আগের মতোই টাকা-পয়সায় লেন-দেন করলেও আমি এখন চা খেলে গুগল পে তেই দাম দিই। আমরা যারা গুগল পে ব্যবহার করি শখে শখেই গুগল পে তে টাকা দিই। তাছাড়া আর একটা সুবিধা পকেট হাতড়ে খুচরো পয়সা খোঁজার ঝক্কি নেই। কাকুর সুবিধা হয়েছে, এখন আর কাউকে ফেরাতে হয় না। আশপাশের ছোট শহর থেকে প্রায়ই বাইকে করে ছেলে-মেয়ের দল ঢোকে। গ্রাম দেখার অছিলায় আসলে অপরিচিত জায়গায় নিরাপদে প্রেম করতে আসে। সবাই বোঝে কিন্তু বলারও তো কিছু নেই। ইদানিং কিছু ছেলে-পিলে নাকি টিটকারি দেওয়া শুরু করেছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই না দেখার ভাণ করে চোখ সয়ে নিয়েছে সবাই। এরাই চায়ের দোকানগুলোতে জলের বোতল, কোল্ডড্রিঙ্কস কেনে।
বেশ চলছিল। 
হঠাৎই একদিন সব পাল্টে গেল। এটিএমে সব টাকা তুলে ছেলে উধাও। অফিস ফেরৎ বাইক থামালাম দোকানের সামনে। দুই একজন উৎসাহী মানুষের জটলা। ভাঙাচোরা স্তব্ধ দোকানটার বেঞ্চ আঁকড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে কাকা। শুকনো খটখটে চোখের বিষণ্ণ চেহারা। কাকি একাই তখনও ইনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri