গঞ্জহাটের আখ্যান/৪
গঞ্জহাটের আখ্যান/৪
সুবীর সরকার
----------------------------
১৬.
ভরা নদীর পারে পারে একা একা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দিন পর গুনেশ্বর গিদালের মাথার ভেতর
চকিত ঘাই মারলো রোকসানা করিমের অদ্ভুত দরদিয়া গলায় শোনা গানটি।কি এক বুকভাঙা
আকুতি এই গানের কথায়, সুরে।গুনেশ্বর গেয়ে উঠলেন গানটি আপন খেয়ালে_
"ও কি নদী রে
ও মোর তিস্তা"
তার চোখ দূরাগত হয়ে উঠলো।তিনি বিমনা হলেন।তার চোখ ভরে উঠলো তীব্র নোনা জলের প্লাবনে।
হায়রে জীবনে জড়িয়ে থাকা এই গানের মায়া জীবনকেই কেমন বুঝি করে ফেলে!
গুনেশ্বর হেঁটে যেতে থাকেন ধরলা নদীর ব্যাপ্ত বিস্তারের পারে পারে।
তার সমস্ত শরীর জুড়ে কি এক আবেগ!মেদুরতা!
তিনি আবার গানেই ডুবে মরেন।আর তার গানের সুর ছড়িয়ে পড়তে থাকে নদী ধরলা পেরিয়ে হয়তো শহর কুড়িগ্রামের দিকে।শুধু গান থাকে। গানের সংক্রমণ থাকে_
"সরিষার ফুল যেমন রে
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে"
১৭.
ইয়াকুব মুন্সীর জোতজমি আর ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে যাওয়ায় একটা সুতীব্র নেশা আছে। পরিক্রমণ জুড়ে জুড়ে কত নুতন পুরাতন মানুষ তাকে সঙ্গ দেয়। হয়তো নিঃসঙ্গতাও! ধান তামাক হিসাব নিকাশ ব্যাপারী গিরি নিয়ে তো আর আস্ত একটা জীবন কাটতে পারে না ইয়াকুব মুন্সীর!
তার ভেতরে একজন বাউদিয়া মানুষ বসে আছে, একজন আগল পাগল মানুষ বসে আছে।ব্যাপারী তাই গঞ্জ হাটের ধুলোয় ধুলোয় বাওকুমটা বাতাসের ক্ষিপ্রতায় জীবনের অন্দরে কিংবা রংদার অন্দরমহলে ঢুকে পড়েন।
আর ধরলা নদীর কুরুয়া পাখির দল বুঝি উড়ে যেতে থাকে কুড়িগ্রাম গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জ ফুলবাড়ী তিস্তা ঘাঘটের দিকে।
সেই কুরুয়া পাখিদের সঙ্গে কি পাটগ্রামের বগা বগীদের দেখা হয়!দেখা হলেও কি কান্নার সুরের মতন গানের সুর ছড়িয়ে পড়তে থাকে জল জঙ্গল জনপদে!ইয়াকুব এত কিছু মগজে গেঁথে নিয়ে হাওয়ায় ভেসে আসা গানের কূহকেই ঢুকে পড়তে থাকে। তাকে অবধারিত ভাবে সঙ্গ দেয় গান_
"ও কি ও মোর সোনার চান্দ
মোক ছাড়িয়া কোনঠে যাবার চান"।
১৮.
দইখোয়া থেকে চাপাগুরী থেকে কালিগঞ্জ থেকে সারারাত ধরে আসা মানুষের ঢল কি বিষাদু বাদ্যকরকে একচুল নড়াতে পারলো!সে তো প্রহরের পর প্রহর ঠায় দাঁড়িয়েই থাকলো এই এত এত মানুষের শরীরের উষ্ণতা আর গন্ধের ভিতর।
বিষাদু তার ঢোলের গায়ে আদরের মতো হাত বুলিয়ে আবার দূরের জনস্রোতের দিকেই চোখ ফেরালো।
এই মেলা এই জুলুস এই জীবনের উত্তাপ ছেড়ে তবে কি সে আবার হাঁটা শুরু করবে লালমনি আদিতমারী ভোটমারি বাউড়া বরখাতা ডিমলার দিকে।
গানের পর গানের আসরে আসরে সে উন্মাদের মতন তার ঢোল বাজাবে, তার ঢোল তো জাদু জানে!
হাটের মানুষ গঞ্জের মানুষ নদীভাঙা মানুষ চরুয়া মানুষ হালুয়া জালুয়া নাইয়া সবাইকে জিনের আছর পরা মানুষে রূপান্তরিত করে ফেলে বিষাদুর ঢোল।
মস্ত এক বাদ্যকরের জীবনে বিষাদু তো আর জানে না জীবনের কোন নির্দিষ্ট ব্যাকরণ!
সে তীব্র এক আবেগ নিয়ে,কান্না নিয়ে, সোনামুখের
হাসি নিয়ে শেষ পর্যন্ত কাঁধে তুলে নেয় তার ঢোল; আর মিশে যেতে থাকে অগণন মানবস্রোতে।
এই দৃশ্য এক নান্দনিকতা এনে দেয়। কিংবা এভাবেই পরিসর জমে ওঠে হয়তো বা!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴