একান্নবর্তী-৪/গৌতম কুমার ভাদুড়ি
একান্নবর্তী/৪
গৌতম কুমার ভাদুড়ি
মনের মানুষ
একই শহরে, একেবারেই সামান্য দূরত্বে বেড়ে উঠেছি আমরা, কিন্তু মণিদীপাদির সঙ্গে আমার কোনও পরিচয় ছিল না। এমনকি স্টেট লাইব্রেরিতে এত যেতাম, এত বইপত্তর নিয়ে ছুটোছুটি করে বোঝাতে চাইতাম সবাইকে – দেখো দেখো এমন পড়ুয়া ছেলে পাবে না কোথাও, কিন্তু মণিদীপাদিকে কোথাও পেলাম না কোনদিনই। নাম শুনতাম বন্ধুদের মুখে, খুব নাকি পড়াশোনায় ভাল, খুব নাকি ভাল গান গায়, লেখালিখিও করে নানান পত্রিকায়। তো সাহস থাকলে আসুক না আমার সামনে! আমি কী বাঘ না সিংহ নাকি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব এম এর সেভেন্থ পেপারের কোনও টপিক নিয়ে? যে কারণেই হোক, শহুরে প্রতিবেশিনী হওয়া সত্বেও মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস আমার কাছে অধরাই ছিলেন, বিশেষত চাকরি জীবনেরও অনেকটা সময় আমার বাইরে থাকার কারণে। অবশেষে কোচবিহারে ফিরে আসবার পর আমার দায়িত্ব পড়েছিল সব স্কুলের হেড টিচারদের সঙ্গে মিটিং করে স্কুলগুলোর যাবতীয় অ্যাকাউন্ট আমাদের ব্যাঙ্কে নিয়ে আসা। আমাদের কাজটা শুরু হয়েছিল সুনীতি একাডেমি দিয়ে, আর সেসময়েই হেড মিস্ট্রেস তাঁর পরিচয় খোলসা করে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হলেন – মণিদীপা ম্যাডাম।নিজে থেকেই তিনি আমাদের অনেক কাজ তাঁর অফিস স্টাফদের দিয়ে করিয়ে দিলেন এবং বেশ আপ্যায়নও করলেন দেশের মাটির ম্যানেজার বলে। সে এক মনে রাখবার মতো অভিজ্ঞতা বটে।
ভালোই হল। কথায় কথায় উঠেছিল লেখালিখির কথা। তখন নানান কাগজে, উত্তরবঙ্গ পত্রিকার এ পাতায় ওপাতায় নানা কারণে সুনীতির হেডমিস্ট্রেসএর নাম-ছবি এত ছেপে বেরোচ্ছিল যে আমরা তো হতবাক। সুনীতি একাডেমির সে সময়ে খুব ভালো রেজাল্ট হচ্ছিল বলেই ওরকম হাঁকডাক। তো এই সুবাদে আমিও ব্যাঙ্কে খুব পজিশন আদায় করে নিলাম যে এরকম একটি স্কুলকে কাস্টমার করে আনতে পেরেছি। হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে যে আমার খুবই বন্ধুত্বের সম্পর্ক এটা প্রচারে আমি তখন মহাব্যস্ত। মণিদীপাদি তখন খুবই প্রতিষ্ঠিত কবি,লেখিকা, মাঝে মাঝেই বেশ নামী কাগজে তাঁর লেখা বেরোয়। আমারও সামান্য পরিচিতি (বিনয়বিহীন) ততদিনে হয়েছে লেখার জগতে,ব্যাঙ্কের হাউজ ম্যাগাজিন বাদ দিলে সেটা আক্ষরিক অর্থেই সামান্য, কিন্তু আমার ভাবখানা এমন ছিল যে আমরা দুজন যেন প্রায় সমান ওজনের। এর একটা সুবিধে হল যে আমি স্কুল ভিজিটের নাম করে যখন তখন বেরিয়ে পড়তে পারতাম, কারণ হাই ভ্যালু কাস্টমারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলাটা আমার ডিউটির মধ্যেই পড়ে এবং বাড়তি একটা সুযোগ আমি পেতাম সে হল ব্যাঙ্কের গাড়িটা নিয়ে বেরোন। আর একটা দামি গাড়ি নিয়ে বেরোলে স্বভাবতই যা হয় – লোকে ভাবতে লাগল আমি না জানি কী মস্ত পজিশনে আছি। সুনীতির ম্যাডামরা, যাঁরা আগে রাস্তায় মুখোমুখি ধাক্কা খেলেও তাকিয়ে দেখতেন না, তাঁরাই দেখি হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে এমন দহরম মহরম দেখে রীতিমতো এগিয়ে এসে বিকেলের পরেও গুডমর্নিং করছেন, আঃ কী আনন্দ! এরপরে হেডমিস্ট্রেসের পরিচিত হিসেবে আমরা সে স্কুলের অনেককেই বাড়ি গাড়ি কেনবার লোন দিয়ে তাঁদের কতখানি উপকার করতে পেরেছি জানিনা কিন্তু আমাদের টার্গেট ফুলফিল করে মেদিনীপুর বাঁকুড়ায় বদলিটা অন্তত ঠেকাতে পেরেছি। চিন্তা করে দেখলাম, মণিদীপাদির মতো হেডমিস্ট্রেসরা খুব উপকারী প্রাণী হয়ে থাকেন।
অনেকে ভাবতে পারেন, আমরা বুঝি গল্প কবিতা ইত্যাদির কথা খুব আলোচনা করতাম। ধুস্ ।
একদম না। কেবল কোথাও একটা লেখা বেরোলে কায়দা করে সেটা জানিয়ে চলে আসতাম। তবে যে কারণেই হোক, তখন বিভিন্ন সাহিত্য আয়োজনে আমি এক আধটু ডাকও পেতাম, বেশির ভাগই শ্রোতা হিসেবে। একেবারে শেষ পর্যন্ত থাকার অভ্যেস আছে বলে আয়োজকরা আমাকে সস্ত্রীক ডেকে নিতেন, রীতিমতো চিঠি পাঠিয়ে। যেতাম।
তো একদিন এক মজার ঘটনা। এক সাহিত্য আসরে অনেকেই কবিতার ওপরে আলোচনা করছেন, তাঁদের মধ্যমণি হিসেবে মঞ্চে রয়েছেন মণিদীপাদি।সাহিত্যের বিশেষ করে বাংলা কবিতার নানান দিকের কথা বলে তিনি বললেন যে স্বরচিত কবিতা না পড়ে তিনি তাঁর একজন প্রিয় কবির কবিতা সেদিনই প্রকাশিত হয়েছে, সেইটে পাঠ করে শোনাবেন। এটা খুবই রেয়ার ঘটনা। কবিরা সাধারণত কাক যেমন কাকের মাংস খায় না বলে একটা প্রবাদ আছে সম্ভবত পক্ষীকুলে, তেমনি অন্য কবির বিশেষত সমকালীন কবির কবিতা সচরাচর পড়তে চান না, পাছে সময়ের অপচয় ঘটে। আমরা সকলেই এই ব্যতিক্রমী পরিবেশনটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে সেই পাঠ। শেষে ঘোষিত হল যে কবিতাটি গৌতম কুমার ভাদুড়ির। এর আগে অনেকে মৃদুভাবে আমার নামটা শুনেছিল, কিন্তু আমিই যে সেই মহাকবি, আমাকে চাক্ষুষ করে তাঁরা যেন ধন্য হলেন। আমি তো রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠলাম। সেই সাহিত্য আসরেই মণিদীপাদি জানালেন যে পাঁচ বছর আগে পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত আমার একটি কবিতা তাঁর অন্যতম প্রিয় কবিতা বলে সেটিও তিনি কোথায় কোথায় পাঠ করে শুনিয়েছেন। আমার তো তখন বেলুনের মতো অবস্থা, অহংকারে ফেটে পড়ব যেন। ক্ষমতা থাকলে পরদিনই মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস নামে সব লোন মকুব করে প্রতিফলে জেলে চলে যেতেও প্রস্তুত হচ্ছিলাম, কিন্তু পরদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে বহু খুঁজলাম, ওই নামে কোনও লোন নেই, উল্টে এত এত ডিপোজিট দেখে একদম চুপ করে গেলাম, সবই লেখালিখি থেকে পাওয়া টাকা, স্যালারি অ্যাকাউন্ট আর দেখতে হল না।
পরে একদিন মণিদীপাদি নিজেই এলেন, একটা দামী গাড়ি কিনবেন। নিজের টাকাতেই ও’রম দুটো কিনতে পারেন, কিন্তু এক্ষুনি ধনীদের তালিকায় নাম লিস্টেড হোক সেটা চাইছেন না। আমিও উপকার করবার সুযোগ পেয়ে কালবিলম্ব না করে দিলাম স্যাংশান করে। শর্ত একটাই, আমাকেও একদিন অন্তত দু’কিলোমিটার গাড়ি চড়াতে হবে। সেটা আর হয়নি, কিন্তু আমার সে বছরের বিজনেস অ্যাচিভমেন্ট দেখে ধন্য ধন্য রব উঠেছিল খুব।
যে জিনিসটা আমার বিশেষভাবে ভালো লেগেছে এই মানুষটির মধ্যে সে হল,স্কুলের জন্য অভিনব কিছু চিন্তা করা।একবার আমাকেই বললেন, ব্যাঙ্কিং সচেতনতা বিষয়ে স্কুলের মেয়েদের জন্য আমরা কিছু করতে পারি কিনা। সে বছরই ওরকম একটা প্রোগ্রাম ব্যাঙ্ক থেকে চালু করেছিল। সুতরাং আমরা চলে গেলাম স্কুলে।দিনের অর্ধেকটা সময় জুড়ে বক্তৃতা, কুইজ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে মেয়েদের ব্যাঙ্কিং বিষয়ে অনেক কিছু বোঝান হল। অন্য ম্যাডামরাও সারাক্ষণ সেই আয়োজনে উপস্থিত থেকে আমাদের খুব আদরযত্ন করেছিলেন। তাঁদের দেখাদেখি শহরের আরও দুচারটে স্কুল আমাদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা ব্যাঙ্কের খুব সুনামবৃদ্ধিই করেছিল সেসময়।
আবার কোন এক বছরে, সুনীতি একাডেমির প্রাক্তনী হিসেবে পার্বতী বাউলকে সংবর্ধনা দেবার একটা অনুষ্ঠান, সম্ভবত মণিদীপাদিই আয়োজন করেছিলেন, তাতে আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া খুব গর্বের বিষয় ছিল আমার কাছে। আমি সেখানে বক্তৃতাও করেছিলাম, কিন্তু অতগুলো লেখাপড়া জানা ম্যাডামের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলা কী চাট্টিখানি কথা! আমার কেবলই মনে হচ্ছিল যে বাক্যগঠনে ভুল হয়ে যাচ্ছে, এই বুঝি নম্বর কাটা যায়। সব গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হেডমিস্ট্রেস নিজে এগিয়ে এসে আমার বিষয়ে এমন এক মনোমুগ্ধকর ফিরিস্তি দিয়েছিলেন যে আমার সে বক্তৃতা শুনে যারা কিছুই বোঝেনি তারাও খুব হাততালি দিয়েছিল। আর তারপরে সেদিনের মতো স্কুলও ছুটি দিয়ে দেওয়া হল। ম্যাডামরাই নাকি বলেছিলেন যে এরকম বক্তৃতা শোনবার পর ক্লাসে যেতে তাঁদের ইচ্ছেই করছিল না আর। সুতরাং আমার অনারে হেডমিস্ট্রেস সেদিনের মতো ঢং ঢং বাজিয়ে দিলেন, সবাই মহা খুশি। এসব অনেক ঘটনা আছে মণিদীপাদিকে ঘিরে। আর একদিন বলা যাবে। থামি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴