আমি এক যাযাবর-৪/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর/৪
শৌভিক কুন্ডা
১৯৯২। জুন,তৃতীয় সপ্তাহ। চলেছি কাঠমান্ডু। অনেকদিনের বান্ধবী যে, দু সপ্তাহ হল সে আমার জীবনভর দায়িত্ব নিয়েছে, সেই আনন্দে, মধুচন্দ্রিমায়। বাস কাঁকরভিটা থেকে, বিকেল ৫টায়। পরদিন ভোর ৬টায় কাঠমান্ডু পৌঁছনোর কথা। বাসটির নাম যে আজীবন মনে রাখবো, রওনা হওয়ার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই প্রথম টায়ার পাংকচারেও তা ভাবি নি; মাত্র দু সপ্তাহের বিয়ে, তাই, সত্যি বলতে দ্বিতীয়, তৃতীয় বারেও না। কিন্তু এই করতে করতে সন্ধ্যে ঢুকে গ্যাছে রাতের ভেতর। কোথাও একটা ডিনার ব্রেক হবে নিশ্চিত, এই ভরসায় সংগের দু প্যাকেট ডালভাজাও শেষ। কখন যে বাস দাঁড়িয়ে গ্যাছে আবার, কেনই বা, প্রথমে খুব খেয়ালও করি নি। কিছু হট্টগোলের আওয়াজ কানে আসাতে সদ্য আলাপ হওয়া বাংলাদেশের তরুণ জিয়ার সাথে নীচে নামলাম। পাথুরে ধূলোর পাহাড়ি বাঁকে হতদরিদ্র পেট্রোল পাম্প একটি। কবেকার কত টাকা যেন পাওনা আমাদের বাসটির কাছ থেকে, সুতরাং পাম্পমালিক বাগে পেয়ে আজ চেপে ধরেছে, পুরো হিসেব না মেটালে চাকা গড়াতে দেবে না! খাওয়া জুটল না সে রাতে, ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়েই গেছি কে জানে! ভোরবেলা ঘুম ভেঙে টের পেলাম,
না, চলছেন বাসবাবাজী! তবে, কন্ডাক্টরের সুধাবচন জানিয়ে দিল, যে হেতু বহৎ দের হয়ে গেছে, সুতরাং বাস আর দাঁড়াবে না পথে, কাঠমান্ডু তখনও ঘন্টা ছয়েক দূর! আগের দিন দুপুরে ভাত খেয়েছিলাম শিলিগুড়িতে, তারপর ওই ডালভাজা! দাঁতে দাঁত চেপে ছিলাম তবু। কিন্তু বেলা এগারোটা নাগাদ সেদিনেরও তৃতীয় পাংকচারে ধৈর্য ভাঙ্গলো আমার। সটান বাসের মাথায় উঠে মালপত্তর নামিয়ে ফেলেছি। সহযাত্রীদের মানা, মধুপর্ণার ভয়মেশানো আকুতি সব পিছে ফেলে হাঁটা শুরু করেছি, অগত্যা মধুপর্ণাও।
জিয়া বেচারা আমাকে আদর্শ মেনে কেন যে সঙ্গ নিলো! কোথায় যাব, কী ভাবে, জানি না। কেবল জানি ও বাসে আমি আর উঠব না। দুপুর শেষ প্রায়, পথও রুখাসুখা, তবু বাঙালের গোঁ হার মানবে না। হাঁটি, বিশ্রাম নিই, আবার হাঁটি। হঠাৎ করেই পেছনপথে গাড়ির শব্দ। ঘুরে দেখি ট্রাক একখানা। হাত তুললাম, দাঁড়ালো। জিয়াও ইতস্তত করছিল, মধুপর্ণার তো কথাই নেই, ভয়ে-ক্লান্তিতে আর গোঁয়ারের গোঁ টি চিনে! ড্রাইভার গাঁইগুঁই করেও তুলে নিতে বাধ্য হলেন। তবে স্পষ্টতই জানিয়ে দিলেন একে পাহাড়ি পথ তায় ভাঙাচোরা, সুতরাং বেশ সময় লাগবে কাঠমান্ডু পৌঁছতে। চব্বিশঘণ্টার ওপরে না খেয়ে আছি জেনে সর্দারজি লেবু-লবনে আপ্যায়িত করেছিলেন, মনে আছে! তারপর পথের ধারের এক ঝুপড়ি তে দাঁড়ও করালেন গাড়ি। রাস্তার পাথরেরই সাইজ চালের, কালো মত ট্যালট্যালে এক পদার্থ, তারও নাম নাকি ডাল,আর থকথকে কালচে সবুজ একহাতা কী যেন! কোনমতে সে সব গিলে ফের যখন ট্রাকে চাপলাম বিকেলের আলো মরে এসেছে।
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতও হব হব, সর্দারজি আশ্বাস দিচ্ছেন আর বেশি দূর নয়, এমন
সময় পৃথিবী কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল! সে জলের তোড় এতই যে ড্রাইভারজী রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাতে বাধ্য হলেন। বৃষ্টি কিছুটা ধরলে চাকা গড়াল ফের, নিশ্চিত হয়ে যখন ধরে নিচ্ছি এবার সত্যি-ই পোঁছনো যাবে, গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। রাত আটটার পর নাকি পারমিটহীন যান আউটার রিং রোড পেরিয়ে কাঠমান্ডু ঢুকতে পারে না। ঘড়ি বলছে তখন রাত সাড়ে এগারো, আর, আমাদের সর্দারজির অবশ্যই সে পারমিট নেই!! মূল শহর তখনো আড়াই কিলোমিটার মত দূরে। টাকা এবং গয়না সমেত(নুতন বিয়ে!) স্যুটকেস, নতুন বৌ, সদ্যপরিচিত ভিনদেশি তরুণ, বৃষ্টি, আপাতভদ্র ট্রাকড্রাইভার - কার কাছে কী গচ্ছিত রেখে কি করি তখন! ফের মনে সাহস এল, আমি না বাঙাল! বৌ এবং স্যুটকেস নিয়ে বৃষ্টির ভেতরই রওনা হলাম। জিয়ার মানা কানে তুলিনি, বলাবাহুল্য। আধঘণ্টারও ওপর সুনসান রাস্তায় হেঁটে একটা গাছ দেখতে পেলাম ঝাঁকরা, আর, দূরে ক্ষীণ এক আলোর সন্ধান! গাছের নীচে মধুপর্ণা আর স্যুটকেস রেখে আমি ছুটলাম আলোর পথযাত্রী! ভাগ্যি আমার, সে আলো নেপাল পুলিশেরই
চেকপোস্টের একটি! আমাদের দুরবস্থার কথা জেনে, তাঁরা ব্যবস্থা করলেন গাড়ির। হোটেল পৌঁছলাম রাত দেড়টায়। ঘর জুটল , কিন্তু অত রাতে স্বাভাবিকভাবেই খাবার কিছুই নেই!!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴