অন্তহীন আকাশের নীচে/৪
অন্তহীন আকাশের নীচে
দেবপ্রিয়া সরকার
পর্ব ৪
------------------------------
ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে সকাল থেকে। মার্চ মাস পড়ে গেলেও এখনও বাতাসে ঠাণ্ডার আমেজ রয়েছে। এমনিতে বীরভূম জেলায় গরম বেশি পড়ে। লম্বা গরমের স্পেল ভোগ করার আগে এই কটাদিন একটু আরামের। কাল স্বয়ংদ্যুতি জেগেছিল অনেকক্ষণ। ওস্তাদ রশিদ খানের বন্দিশ শুনতে শুনতে শেষরাতে তন্দ্রা নেমেছিল চোখে। এই নিয়ে পাঁচবার ফোন করে ফেলেছে ভিক্টর। ছ’নম্বর ফোনটা আসার আগে তৈরি হয়ে নিতে হবে। ঝটপট বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল সে। স্নান সেরে কোনও রকমে ইনস্ট্যান্ট নুডলস গলায় ঢেলে স্বয়ংদ্যুতি হস্টেল থেকে বেরিয়ে এল।
ডিপার্টমেন্টের সামনে ছোটখাটো একটা জটলা। অনির্বাণ স্যারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ছাত্রছাত্রীরা। সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে কাছাকাছি যেতেই শুনতে পেল স্যার বলছেন, তোমরা সকলে তৈরি তো? আমাদের গেস্টরা চলে এসেছেন। আমি আর রিজওয়ান ওঁদের টুরিস্ট লজ থেকে আনতে যাচ্ছি। ঠিক সকাল দশটায় শুরু হবে আমাদের প্রথম সেশন। কিছু অফিসিয়াল ফর্ম্যালিটি শেষ করে আমরা ঢুকে যাব ডিসকাশনে আর একদম শেষে হবে ইন্টার্যাকশন। তোমাদের অনেক সৌভাগ্য আজ ডঃ রাঠোর, ডঃ সিংদের সঙ্গে ‘ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি ফ্রম অ্যানসিয়েন্ট টু মর্ডান’ টপিক নিয়ে ইন্টার্যাক্ট করার গোল্ডেন অপরচ্যুনিটি পাচ্ছ। এই সুযোগ লুফে নাও।
অনির্বাণ স্যারকে ভীষণ রকম উত্তেজিত দেখাচ্ছে। ভারত বিখ্যাত ইতিহাসবিদদের নিয়ে এত বড় মাপের সেমিনার আয়োজন করতে দম লাগে। স্যারের উত্তেজনা চারিয়ে গিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও। নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় আধঘণ্টা পরে শুরু হল সেমিনার। একটা পিকক ব্লু রঙের চুড়িদার-কুর্তি পরেছে স্বয়ংদ্যুতি। সঙ্গে হালকা ছিমছাম সাজ। ভিক্টর শত চেষ্টা করেও চোখ ফেরাতে পারল না তার দিক থেকে। লেকচারে কম, তার মন বেশিটা পড়ে রইল স্বয়ংদ্যুতির কাছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস দিয়ে আরম্ভ করে আলোচনার বাঁক ঘুরল ইউরোপিয়ান এবং আমেরিকান হিস্ট্রির দিকে। তারপর ইসলামিক ইতিহাস ছুঁয়ে তা আবার ফিরে এল ভারতের মাটিতে। প্রথম সেশনটা ভারী ভাল লেগেছে স্বয়ংদ্যুতির। অনেক অজানা বিষয় নোট করে রেখেছে ডায়েরিতে।
দ্বিতীয় পর্বে রিজওয়ান উত্থাপন করেছিল ভারতে ইসলামি শাসনের প্রবেশ এবং বৌদ্ধধর্মের ওপর তার প্রভাবের বিষয়টি। নালন্দা, বিক্রমশীলা থেকে শুরু করে, সম্রাট অশোক, অতীশ দীপঙ্কর, হিউয়েন সাঙ, পণ্ডিত শীলভদ্র সকলেই এলেন আলোচনায়। ছাত্রছাত্রীদের করা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে চলে এল মৌর্য, গুপ্ত, কুশান, সুলতানি ও মোঘল সাম্রাজ্যের কথা। ইংরেজ রাজত্বে বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের কার্যকলাপের বিষয় নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করল সুনেত্রা, অর্ণব, রাজদীপ্তরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথাও উঠে এল একে একে। প্রফেসর বিজয় রাঠোর বিশেষভাবে বলছিলেন রাজপুত রাজাদের কথা। উঠল জয়পুর রাজ্যের শেষ রাজা বিখ্যাত পোলো খেলোয়াড় সোয়াই দ্বিতীয় মান সিং এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে তাঁর সহচর্যের প্রসঙ্গ।
এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে স্বয়ংদ্যুতি আলোচনা শুনছিল। কিন্তু জয়পুরের মহারাজা এবং তাঁর স্ত্রীদের বিষয় উত্থাপিত হতেই নড়েচড়ে বসল সে। প্রফেসর রাঠোর তাঁর ব্যরিটোন কণ্ঠে বলে উঠলেন, রাজা মোট তিনবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। রানীদের মধ্যে সবথেকে আলোচিত ছিলেন মহারানী গায়ত্রী দেবী, মহারাজার তৃতীয় স্ত্রী এবং পূর্ব ভারতের কোচবিহার রাজ্যের রাজকন্যা। আ ভেরি বিউটিফুল অ্যান্ড এডুকেটেড লেডি ইনডিড। বিখ্যাত ভোগ ম্যাগাজিনের সেরা দশজন সুন্দরী মহিলার তালিকায় নাম উঠেছিল তাঁর। পরবর্তী কালে চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারি এবং স্বতন্ত্র পার্টির হাত ধরে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ এবং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মতানৈক্যের কথা খুবই চর্চিত একটি বিষয়। আর ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল এঁরা দু’জনেই ছিলেন আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং গুরুদেবের বিশেষ স্নেহধন্যা।
স্বয়ংদ্যুতি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল। ফ্ল্যাশব্যাকের মতো টুকরো টুকরো কিছু ঘটনার দৃশ্য ফুটে উঠছে মনের চোখে। টাইম ট্র্যাভেল করে সে যেন আচমকাই প্রবেশ করেছে ছোটবেলায় বহুবার দেখা এক রাজপ্রাসাদের অন্দরে। দিদার হাত ধরে দিদি অরুন্ধতী আর সে এসেছে রাজবাড়ি দেখতে। বিরাট বড় সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ। কতরকম গাছগাছালি আর সুন্দর চোখ ধাঁধানো রাজপ্রাসাদ! দেওয়ালে ঝোলানো ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে দিদা এক এক করে নাম বলে যাচ্ছেন রাজা, রানি, রাজপুত্র এবং রাজকন্যাদের। স্বয়ংদ্যুতির ছবির প্রতি আকর্ষণ নেই। তার বরং ভাললাগছে দিদার বারণ অগ্রাহ্য করে রাজবাড়ির বিশাল বারান্দা দিয়ে ছুটোছুটি করতে। দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ পা হড়কে পড়ে গেল সে। কপাল থেকে টপটপ করে রক্ত ঝড়ছে। ছুটে এসে তাকে কোলে তুলে নিল দিদা। তারপর...
-স্বয়ংদ্যুতি! এই স্বয়ংদ্যুতি! কী রে? কোথায় হারিয়ে গেলি?
ভিক্টরের ডাকে সম্বিত ফিরল স্বয়ংদ্যুতির। সে বিহ্বলভাবে বলল, সেমিনার কি শেষ হয়ে গেল? ডঃ রাঠোররা চলে গেলেন?
-আরে! কী হল তোর? লেকচার শেষ করে স্যাররা তো এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন। তুই দেখিসনি? কোথায় ছিল মন? ইতিহাসের আলোচনা শুনতে শুনতে তুইও কি প্রাগৈতিহাসিক যুগে পৌঁছে গিয়েছিল নাকি রে?
-বাজে বকিস না। সবটাতেই তোদের ইয়ার্কি!
- ওকে, চিল! ইয়ার্কি নয়, সিরিয়াস। ম্যাডামের মন কোন্ গভীর ভাবনায় ডুবে ছিল সেটা এ’অধম জানতে পারে কি?
-প্রফেসর রাঠোরের বক্তব্য শুনে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। সেগুলো নিয়েই ভাবছিলাম, তেমন কিছু নয়।
-পুরনো কথা? সেটা কীরকম?
-ছোটবেলায় আমাদের মামাবাড়ি যাওয়া, ছিমছাম সুন্দর রাজনগর ঘুরে দেখা, ডাব্বুদাদার সঙ্গে সাগরদিঘির পাড়ে বেড়ানো, আর দিদার হাত ধরে দেবীবাড়ি, মদনমোহন মন্দির, রাজবাড়ি দেখতে যাওয়ার দৃশ্যগুলো আচমকাই ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ফিরে এল আমার চোখের সামনে। কত্তদিন হয়ে গেল ওখানে যাইনা! আমরা আজকাল বড্ড বেশি সেলফ-সেন্টারড হয়ে গিয়েছি রে। শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবতে ভাবতেই দিন চলে যায়। চেষ্টাই করিনা সেইসব মানুষগুলোর খবরাখবর রাখার, যাদের সঙ্গে একসময় অনেক অনেক আনন্দের মুহূর্ত কাটিয়েছি।
স্বয়ংদ্যুতির বিষণ্ণতা ছুঁয়ে গেল ভিক্টরকেও। সে পরিবেশটা হালকা করার জন্যে বলল, আগে কখনও বলিসনি তো তোর মামাবাড়ি রাজরাজরার দেশে!
-হুম বলিনি, কারণ বলার প্রয়োজন মনে করিনি তাই।
-কোন্ রাজপুরীর রক্ত বইছে স্বয়ংদ্যুতি দেবীর ধমনীতে?
স্বয়ংদ্যুতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, কোচবিহার। শুধু মামাদের নয় ওখানে আমার বাবারও আদি বাড়ি। বাবা ছিল একমাত্র সন্তান। ঠাকুরদা আর ঠাম্মা মারা যাওয়ার পর সেই বাড়ি ফাঁকাই পড়ে থাকত। বাবা চাকরির সুত্রে লখনউ চলে আসার পরপরই বাড়িটা বিক্রি করে দেয়। তাই কোচবিহার গেলে আমরা মামাবাড়িতেই উঠতাম।
-কোচবিহার? একটু আগেই প্রফেসর রাঠোর যাঁর কথা বললেন সেই মহারানী গায়ত্রী দেবীর নেটিভ প্লেস! দ্যাটস ভেরি ইন্টারেস্টিং! আমি কলকাতার ছেলে। এতকাল পশ্চিমবঙ্গের একটা জেলা হিসেবেই কোচবিহারের কথা শুনে এসেছি কিন্তু সেখানকার রাজ ইতিহাস সেভাবে জানার সুযোগ পাইনি। কখনও কিছু পড়া হয়নি কোচবিহারের রাজা এবং তাঁদের রাজত্ব সম্পর্কে।
একটা বাঁকা হাসি হেসে স্বয়ংদ্যুতি বলল, সেদিন তুই তো বলছিলি, আমাদের যতটুকু ইতিহাস জানানো হয় আমরা ততটুকুই জানি। তার বাইরেও কত পুরনো দিনের কাহিনি ছড়িয়ে আছে, সেসব চিরকাল অজানা থেকে যায় বৃহত্তর জনগণের কাছে।
-তাই বুঝি? আমি বলেছিলাম? কবে?
একটা ফিচেল হাসি হাসল ভিক্টর।
-ধবলগিরিতে ইডিয়েট! যখন আমাকে ইউটিউব আর ভ্লগ বানানো নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিলি, মনে নেই?
-ও হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। বলেছিলাম বটে...
ভিক্টরের কথা শেষ হওয়ার আগেই সেখানে এসে হাজির হল সুনেত্রা। বড়বড় চোখ পাকিয়ে বলল, এই যে কপত-কপতি সেমিনার শেষ হয়ে গেলেও, তোমাদের প্রেমিনার এখনও চলছে দেখতে পাচ্ছি।
-সুনেত্রা! হোল্ড ইওর টাঙ। ভাল হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি।
স্বয়ংদ্যুতি প্রতিবাদ করলেও সুনেত্রার কথা শুনে লাজুক হাসি খেলে গেল ভিক্টরের মুখে। সুনেত্রা এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলল, হয়েছে হয়েছে এসব হুমকি আমাকে না দিলেও চলবে। এখন চল বাইরে ফটোসেশন হবে। অনির্বাণস্যার ডাকলেন সকলকে। সুনেত্রার কথা শুনে বেরিয়ে এল স্বয়ংদ্যুতি আর ভিক্টর। অতিথি অধ্যাপকদের মাঝে বসিয়ে ছবি তোলা হল অনেকগুলো। তারপর ফিরে গেল যে যার হস্টেলে।
বিকেলের মরা আলোয় সাইকেল চালাতে চালাতে স্বয়ংদ্যুতির মনে পড়ছিল অনেক কথা। স্মৃতির দেরাজে বন্দি হয়ে থাকা আলো-আঁধারি দিনগুলো কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় হঠাতই জীবন্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছে। বারবার করে তারা চোখের সামনে ভেসে উঠে পথ আগলাচ্ছে স্বয়ংদ্যুতির। হারিয়ে ফেলা কোনও জিনিস আচমকা খুঁজে পেলে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক তেমনই একটা অনুভূতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে স্বয়ংদ্যুতিকে। কতগুলো রঙবেরঙের প্রজাপতি স্বয়ংদ্যুতির অজান্তেই ডানা মিলেছে তার মনের গভীরে। একটা খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে আছে সারা মুখে।
হস্টেলে ফিরে এসে স্বয়ংদ্যুতি ঝটপট ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করল। তারপর অভ্যস্ত হাতে কল লগে গিয়ে ডায়েল করল একটা চেনা নম্বর।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴