শালসিঁড়ি-৩৯
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
চুপচাপ গজরাজ আর মেনকা পৌঁছে গেল ছয় নখের হাতির পায়ের ছাপ কাছে। হাতির পায়ের ছাপটি বুনো শুয়োরের তণ্ডুর চাষে নষ্ট হয়ে গেছে। তবে দণ্ডীটি বোঝা যাচ্ছিল। হরিণঝোড়া নদীকে ডান হাতে রেখে নদীর পশ্চিম পাড় ধরে উত্তর দিক বরাবর চলে গেছে দণ্ডীটি। কিছুটা উত্তরে গিয়ে দণ্ডী ডান দিকে বাঁক নেয়। হাতি দুটি এত নিঃশব্দ হাঁটছিল যে পাশের গাছে বসে থাকা পাখি পর্যন্ত উড়ছে না। রমণীয় পাখি সব গাছের ডালে বসে রমনে ব্যস্ত। কেউ চঞ্চু চঞ্চু চুমু দেয়। কেউ চঞ্চু দিয়ে গলায় ডানায় আদর করে। কেউ আবার পিঠে ওঠে বসে। আবার কেউ সরাসরি পিঠে বসতে গেলে ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় পাখি। ভালোবাসা না থাকলে যে বিশ্ব বিজন বিভূঁই, ভালোবাসা জীর্ণ কালোশিরিষ পাতার মতো - হলুদ।
হাতিতে ওঠার সময় কার্ত্তিক বলে দিয়েছিল যে আর মুখে শব্দ না করলে ভালো হয়। বনে মানুষের কথা বলার শব্দ অপ্রাকৃতিক এবং অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যায়। নিজেরা কথা বললে বনের কথা শোনা যাবে না। শব্দহীন পথ চলার জন্য মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল দুটি হাতি আর ছয় জন মানুষ যেন সবুজে বিলীন যাচ্ছে। আশঙ্কার লীন তাপ বিকাশদের ঘর্মাক্ত করে দিয়েছে। সারাদিনের ঘমের গন্ধ আর হাতির গন্ধ মিলেমিশে বিকাশরা পুরো বুনো হয়ে উঠেছে। পাখিরা ডাক দেয় না সতর্কীকরণের। ওরা গান গায় মিলনের। তা নাহলে এতক্ষণে ময়ূরের ডাক হিল্লোলিত করত বন।
হরিণঝোড়া দোমুখা হল হরিণঝোড়া ও কাঁকড়াঝোড়া নদীদুটির মিলন স্থল। এই নদীগুলো উৎস এই বন। এই নদীতে বরফ গলা জল আসেনা, কিন্তু সারা বছর জল থাকে। ভাগ্যিস এরা কাবেরী গোদাবরী কৃষ্ণার মতো লম্বা নয়। তাহলে মানুষের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজেদেরকে মাঝে মধ্যে পুকুর করে নিতে হত। হরিনঝোরা কাঁকড়াঝোরা ময়নাঝোরা ঠান্ডাঝোরা বুধারুঝোরা মাংরাঝোরা ইত্যাদি শত শত ঝোরা হলো শালসিঁড়ির শিরা উপশিরা। এই ঝোরার জল, জল নয় শালসিঁড়ির রক্ত। পরিষ্কার এবং পবিত্র। শালসিঁড়ি মূল মূলোরোম দিয়ে যে জল ধরে রাখে মাটিতে, সেটা ছাড়ে সারা বছর অল্প অল্প করে। এই ঝোরাগুলো তিস্তা জলঢাক্কা তোর্সা রায়ডাকের মতো নয়। বড় নদীগুলোর অবস্থা উত্তরবঙ্গের বুনো হাতির মতো। চলার পাথে কত বাঁধা, শরীরে কত আঘাত…
পরিষ্কার জল দ্যাখে বিকাশের জল তেষ্টা পায়। কার্তিকে বলতে যাবে হাতিটিকে বাসানোর জন্য, তখন কার্ত্তিক হাতের লাঠি দিয়ে ইশারায় একটা পিপল গাছের ডাল দ্যাখায়। লাঠিটাকে ঠোঁটে আর চিবুকে লাগায়। মানে চুপ বা সাবধান বা দুটোই হতে পারে।
বিকাশ দ্যাখে পিপল গাছের গায়ে প্রায় নয় ফুটের উপরে হাতির পিঠ ঘষার মাটি লেগে আছে। তার আরও পাঁচ ছয় ফুট উপরে পিপল গাছের একটা ডাল ভেঙে নিয়ে গেছে হাতি। বনের গভীর নীরবতায় বিকাশের হৃদয় নাচনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ডিব ডিব শব্দ শুনে কার্ত্তিক যেন আরো সতর্ক হয়ে ওঠে। গছের ফাঁকে দেখা যায় দোমুখার চওড়া চর। দুটি নদীর মিলন স্থলে প্লাবন ভূমিতে দুটি ময়ূর পেখম খুলে নাচছে। নদীর জলে মাটিতে পাঁচ ছয়টা ময়ূরী ঘুগলি ঝিলুক ইত্যাদি খুঁজছে। যে ময়ূরের নাচ মানুষের মন ভোলায় সেই নাচ কে কী ভাবে অবজ্ঞা করছে এই পাষাণী ময়ূরীগুলো। ময়ূরগুলোর কোনো হেলদোল নেই হাতিগুলোকে দেখেও। হাতিগুলো আর এখন হাতি নয় ওরা যেন বনের সুজন।
বলতে বলতে এক দল বুনো শূকর বেরিয়ে আসে পূবদিকের বন থেকে- বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। বুনো শূকরগুলো কালো হলেও বাচ্চা গুলো বাদামী, গায়ে লাইন দিয়ে সাদা সাদা ছিট। তণ্ডু দিয়ে চষে ফেলছে হরিণঝোরার একটা প্লাবন ভূমি। তুলে আনছে দলা দলা কেঁচো- বনের মাটি কী উর্বর। বুনো শূকরের একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটি মদনটাক- জলে ভেসে আসা গাছের শিকড়ের মতো - স্থির। টক করে জল থেকে তুলে নিল একটা বেঙ। জল খেতে বেরিয়ে এলো এক যুগল কাকর হরিণ। কাকর হরিণ কথা কখনো ভালো লাগে না বিকাশের। এ যে সোনার হরিণ, মায়া মৃগ। আমাদের হাতিগুলোকে দেখে লেজ এমন ভাবে নাড়ায় যেন বলে – হাই…। ওরা জল খায় আর ছোট ছোট লাফ দেয়। জলে নেমে আসে একটা সম্বর- বড়শিংঘা হরিণ। অনেকে বারোশিঙা হরিণকে এর সাথে গুলিয়ে ফেলে। আসলে দুটিই আলাদা। তবে এদিকটায় চিতল হরিণ থাকে না। কারণ তিস্তার পূর্ব দিকের এলাকা চিতলদের আবাসস্থল নয়। হরিণ দেখতে দেখতে নেমে আসে এক দল গাউর। গাউরের বাচ্চারা গরুর বাছুরের মতো। সব গাউরের পা সাদা, মনে হয় সাদা মোজা পরানো আছে। হরিণঝোরার জলের যে এমন টান জানা ছিল না বিকাশের।
দোমুখার দুপাশে নদী থেকে এক কিলোমিটার গেলেই শালের বন। সেই শাল বনে মাঝে মধ্যে হেঁটে আসতে হয় শাল গাছ রক্ষা করার জন্য। কিন্তু দোমুখায় বাজার মূল্যে অদামি গাছের প্রাধান্য থাকার ফলে বেশি আসা হয় না এই দিকটায়। তাছাড়া এই দোমুখা বড় দুর্গম। শাল বন থেকে এক কিলোমিটার সেঁতসেঁতে জলা ঘন ঝোপ-ঝাড় আর ঘন বনের ভিতর দিয়ে হাঁটা খুব কষ্ট কর। হাতির পিঠে বসে এই সকল যায়গা টহল করতে সুবিধা হয়। সে সুযোগ ষোল আনা ব্যবহার করে বিকাশ। দেখতে পায় এক অপূর্ব দৃশ্য।
পড়ন্ত গাছের ফাঁকে বিকালে তির্যক আলোক রশ্মি যেন সিনেমাটোগ্রাফ-এর গোল গোল আলোর বলয় আর হরিণঝোরার দোমুখা যেন পর্দা। সেই পর্দায় চলছে শালসিঁড়ির সিনেমা। ময়ূর বুনো শুয়োর মাদনটাক মায়া হরিণ সম্বর গাউর বক পর পর সব কুশীলবরা এসে হাজির হয়েছে। কিন্তু নায়কের যে দেখা নাই। এত মনোরম দৃশ্যও মন কাড়ে না বিকাশের। তার যে নায়কের সন্ধান চাই। কার্ত্তিক আকাশের দিকে লাঠি তাক করে। বিকাশরা দেখতে পায় আরো কিছু বক উড়ে আসছে দোমুখার দিকে। বিকাশের মনে ওরা বক নয় - আশা। কার্ত্তিক নদীর পুব পাড়ে একটা কুম্ভি গাছের তলার দিকে হাতের লাঠি তাক করে। দেখা যায় একটা বেশ বড় চিতাবাঘ। শিকারে বসেছে। ও বুঝতে পারছে না হাতিগুলো ঘরের না বাইরের। ঘরের হাতির পিঠে যে কাঁটা থাকে না। চিতাবাঘের চোখে বিকাশরা তখন হাতির পিঠের কাঁটা। পেটের টানে অবহেলা করে হাতিকে। চিতাবাঘের চোখ কোন দিকে – শুয়োর নাকি গাউরের বাচ্চা। মায়া হরিণ বড় মায়াবি- চট করে কোথায় লুকিয়ে বোঝা যায় না। একটা গাউর মা জল খেতে খেতে মাথা তুলে গন্ধ নিতে থাকে নাসিকা ফুলিয়ে। গাউরের নাসিকা ফোলাতে মনে হল - ঠিক তো কেমন একটা শুকনো মাংসের বিশ্রী গন্ধ ভেসে আসছে। ঠিক ঐ চিতাবাঘের গায়ের গন্ধ হবে হয়তো!
ঝপ করে একটা শব্দ হল। কিসের শব্দ বোঝা গেল না। মনে হয় জলে বা ঝোপের মধ্যে কিছু পড়েছে। কুম্ভি গাছের তলায় দেখা যায় না চিতাবাঘের। নদীর জলে নেমে আসে মস্ত একাটা দাঁতাল হাতি। এই প্রথম কার্ত্তিক কথা বলে। মৌনতা ভাঙা নয় এ যেন তপস্যার পর বর লাভ করা। কার্তিকের কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সবাই। মানুষ হয়ে বোবা হয়ে থাকা যে কী কষ্টের এতক্ষণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।
স্যার দাঁতাল।
বিকাশের গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। নদীতে নেমে দাঁতালটি কান দোলানো বন্ধ করে গজরাজকে দেখে। গজরাজ টেবিলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দাঁতালটি আবার কান দোলাতে থাকে। শুঁড় দিয়ে জল তুলে খায়। তার পর একদম ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে পিছনের দিকে তাকায়। একটা চালতা ডাল ভাঙ্গে। আবার ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে আগের পজিশন নেয়। মনে হয় যেন রেম্পে ওঠে শরীরের এদিক ওদিক দেখায়। চালতার ডালটি পিঠের উপর রেখে দেয়। হাতিটিকে দেখে উপস্থিত বন্যপ্রাণীদের ক্রিয়াকলাপের কোনো রূপ পরিবর্তন হয়নি। যে যার মতো আছে।
পালঙ দাঁতের হাতি। - কার্ত্তিক বলে।
কেন?
দেখছেন না দাঁতগুলা কত মোটা আর এক সমান। মাঝখান থেকে দাঁতের মাথা সমান ভাবে বেঁকে উপরের দিকে ওঠে গেছে। এই দাঁতের উপর বসা যাবে শোয়া যাবে- পালঙের মতো। তাই পালঙ দাঁত।
হাতির দাঁতের আবার নানা ধরণ হয় নাকি।
দাঁতাল হাতিকে দাঁত দিকে বেশি ভালো মনে রাখা যায়।
মাঝে মধ্যে তো হাতির দাঁত ভেঙ্গে যায়, তখনো কি চেনা যাবে।
অনুমান করতে পারি আমরা। স্যার একটু লিখবেন। আমাকে বলেছে হাতি পেলে তার বিবরণ লিখে নিয়ে যেতে।
হ্যাঁ বল।
দাঁতাল, সমতল, পালঙ, সমান্তরাল, ভাল্লুকা। তারপর গড়ন- দোহারা। পিঠ –সমতল। লেজ- সের দুম, পুরা। কান – ফুটা নাই, (ভালোকরে দেখে বলে) দেড়-দি ইঞ্চি মোড়া। শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নাই।
হলো।
হ্যাঁ স্যার।
এই যে এত গুলো কথা লেখালে তার মানে কি?
মানে হাতিটির দাঁত দুটি তল এক। দুই দাঁত একই তলে না থাকলে তাল বেতাল বা আকাশ পাতাল হতে পারত।
আকাশ পাতাল মানে?
বলব স্যার। আগে হাতিটার কাণ্ড কারখানা দেখি।
হাতিটি জল খেয়ে নিচের দিকে নেমে আসে। মনে হল ও যেন গজরাজের দিকে আসছে। কিন্তু সে নিচের দিকে ঝোড়ার একটা কুঁড়াতে নেমে পড়ল। এখন হাতিটি একদম সামনে। কান ও চোখের মাঝখানে মস্তির তেলের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাতিটি গজরাজ থেকে উচ্চতায় এবং লম্বায় আনেকটা বড় মনে হচ্ছে। গজরাজকে একদমই পাত্তা না দিয়ে শুঁড় দিয়ে জলের ফোয়ারা ছাড়ল। তারপর বসে পড়ল জলে। পুরো শরীর জলের মধ্যে দিয়ে জলের তল থেকে বুঁদ বুঁদ তুলল।
হাতির পায়ের ছাপটা দেখলে হত না? বিকাশ বলে।
স্যার হাতিটা স্নান করছে, ডিস্টার্ব না করলে ভালো হয়। দেখবেন একটু পরে উঠে যাবে।
সময় চলে যায় হরিণঝোরার জলের মতো। হাতির স্নান শেষ হয় না। হঠাৎ দেখা গেল হাতিটি জলের ভিতর পুরো শরীরকে রোল করছে। সেই রোলিঙ্গের জন্য কুঁড়ার জলে যে ঢেউ উঠছে সেগুলো ছলাৎ ছলাৎ করে নদীর পাড়ে লাগছে।
সময় যে চলে যায় কার্ত্তিক। - বিকাশ বলে।
হাতিটি যেন বিকাশের মনের কথা বুঝতে পারে। হঠাৎ ওঠে পরে আর জলের ঝর্ণা নেমে আসে হাতির গা থেকে। স্নানের পর মনে হল ওর গায়ের রঙ হরিনঝোরার পাড়ের ঢালের কালো কচুর ডাঁটির মতো কালো। বনের এই কালো কচুর ডাঁটি যে দেখেনি সে বুঝতে পারবে না এটা কী সুন্দর - কালো! এটাকে কি কৃষ্ণ কালো বলা হয়? বিকাশ জানে না।
এই যা এত সুন্দর স্নান করার পর নদীর পাড়ের এঁটেল মাটি সারা গায়ে ছিটিয়ে দিল! - বিকাশ বলে।
এই গুলো ওদের স্নো পাওডার। হে হে । -কার্ত্তিক হাসে।
হাতিটি বনে ঢুকে যার- নদীর পশ্চিম দিকে। হাতি চলে যেতেই মনে হল সে সব আলো নিয়ে গেছে সাথে। নদীর জল এখন গাছের ছায়াতে কালো। গজরাজ জলে নামতেই একটা গাউর এমন হাঁচি দিল যে প্লাবনভূমি থেকে উড়ে গেল ময়ূর মদন টাক। ঝপাঝপ দৌড় দিল গাউর হরিণ শুকর সব বনের ভিতরে। নদীর পুব পাড়ে গিয়ে কার্ত্তিক বলে -
সাম বইট।
সাম বইট- গণেশ বলে।
পা খোল।
গজরাজ মেনকাও বসে পড়ে এবং পিছনের ডান পা’কে বের করে বেঞ্চের মতো করে দেয়। বিকাশ, তাপস, দেবারু নেমে পড়ে হাতির পিঠ থেকে। এখন আকাশ বিকীর্ণ আলোয় নানা রঙে রঙিন। এই আলোয় কাটেনা গাছের তলায় কালো ছায়া। সাইচ লাইটের কথা মনে হতেই বিকাশের ভিতরে একটা ভয় শির শির করে বেয়ে ওঠে পা থাকে মাথায়। কে জানত সকালে বের হলে রাত হবে হাতির পিঠে পিঠে। সাথে কোন আলো নেই। চতুর্দশী চাঁদ উঠতে আরো অনেক দেরি। বনের তলায় শক্ত কালো মাঠিতে অন্ধকারে হাতির পায়ের ছাপের নখ সঠিকভাবে গোণা বেশ কঠিন। বনে যে দেশলাই আনাও বারণ। তবুও বলে -
কার্ত্তিক দেশলাই আছে?
না স্যার। তাড়াতাড়ি করুন। এই রকম জায়গায় এই সময়ে বেশিক্ষণ নিচে থাকা ঠিক নয়।
দাঁড়াও। একটু দেখতে দাও। কেন কী হবে।
এই সময় সাপেরা বের হয় শিকারে। আর সেই সাপ খেতে আসে শঙ্খিনী বা শঙ্খচূড় সাপ।
গজরাজ শুঁড় দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে। মাহুতরা বলে- সাম বইট… পা খোল…। বিকাশরা তাড়াতাড়ি ওঠে পড়ে হাতির উপরে।
কী হল? বিকাশ জিজ্ঞাসা করে।
গজরাজ কিছু খারাপ বুঝতে পারছে।
ঠিক জানি না। …ফিরে যাব?
না চল, বুনো হাতিটির দণ্ডীটি অল্প দেখি।
গজরাজ জল ছেড়ে পশ্চিম পাড়ে ওঠতে গিয়ে আবার ফোঁস করে ঘুরে যায়। গজরাজ ঘুরতেই সবার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। একটা শংখচূড় সাপ জলে নেমে দুই তিন ফুট মাথা তুলে থেমে আছে। দিনের শেষ বিকীর্ণ সব আলো যেন ওর বুকে টেনে নিয়েছে। বুকটা হলুদ, চিক চিক করছে। মেনকা থেকে দেবারু তাড়াতাড়ি গুলতি বের করে খটাস করে একাটা গোল পাথর ছুঁড়ল শংখচূড়ের ঠিক সামনে। গুলতির পাথর জলের নিচের পাথরে চটাস করে লেগে জল ছিটাতেই শংখচূড়টি পাশে হেলে থাকা একটা কাইঞ্জল গাছে সর সর করে ওঠে পড়ল। গজরাজ আবার বনে ঢুকে যায়।
স্যার চাঁদ উঠতে এখনো অনেক দেরি আছে। এই ঘন বনে বেশি দূর যাওয়া যাবে না।
চল, একটু দেখি বুনো দাঁতালটি কোন দিকে গেছে। এই পাঁচ দশ মিনিটে আর কত দূর যাবে।
গজরাজ বনের অন্ধকারে হেঁটে চলে উত্তর পাশ্চিম দিকে। কিছুদুর যাবার পরে দিক গুলিয়ে যায় বিকাশের।
এখন আমরা কোন দিকে যাচ্ছি?
স্যার উত্তর দিকে।
আমরা কি দণ্ডী ধরে যাচ্ছি?
হ্যাঁ স্যার।
কিন্তু হাতির যে কোন গন্ধ পাচ্ছি না।
স্যার এই হাতি পাওয়া যাবে না।
চলো ফিরে যাই।
পিছে ঘুম। পিছে। গজরাজ ঘুরে না।
স্যার যেই রাস্তায় এসেছে, সেই রাস্তায় যেতে চাইছেনা।
কেন?
বুঝতে পারছি না। মনে হয় শঙ্খচূড় সাপটি আছে বলে বা অন্য কিছু।
কিন্তু ও তো এই বন চিনে না। কি হবে।
দেখি স্যার।
কার্ত্তিক গজরাজকে বলে –যা মাইল। কার্ত্তিক গা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে। গজরাজ নিজের মতো করে মেনকাকে রস্তা দেখিয়ে হেঁটে চলে। রাতচরা পাখিরা ধাতব শব্দ করে ডাকে। দূরে ময়ূর ডাকে বুক চিরে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক যেন ভুলভুলাইয়ার অন্ধকার গলিতে হারিয়ে যাওয়া পরির পায়ের শব্দ। বনের ভিতরে নিচু জলা জমিতে বেঙ ডেকে চলেছে একঘেয়ে। আচ্ছা গজরাজের কি রাস্তা ভুল হয়েছে? হাঁটছে তো হাঁটছে। একঘেমি কাটাতে বিকাশ বলে-
কার্ত্তিক তখন বলছিলে, তাল বেতাল হাতির দাঁত।
একটা দাঁত উপরে একটা নিচে থাকে তখন সেই দাঁত তাল বেতাল।
আর ফেরকা?
দাঁতের মাথা দুটি উল্টো দিকে বেঁকে যায়।
আর চিপা?
হাতির দাঁত দুটির মাথা শুঁড়ের দিকে চেপে আসে। হাতির দাঁত চিপা হলে খুব খারাপ। আমাদের পোষা হাতি হলে তো দাঁতের মাথা কেটে দিই। কিন্তু বুনো দাঁতাল চিপা দাঁতের হলে দাঁতের মাথা বড় হতে হতে একটা দাঁত আর একটা দাঁতের উপর ওঠে যায়। তখন হাতি আর শুঁড় বার করতে পারে না। হাতির খুব কষ্ট হয়।
আর আকাশ পাতাল।
একটা দাঁত আকাশের দিকে আর একটা মাটির দিকে থাকে।
বিকাশ গভীর বনের ভিতরে আকাশ দেখে। চতুর্দশী রতের চাঁদের প্রথম আলো ঢেকে রাখে বৈশখীর কালো মেঘ।