পইলা সাঞ্ঝির কথা/৩৮
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৩৮
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সইষ্যা কুড়িয়া ব্যাল
"ছাওয়াটাক চোখুর আগালোত বড় হবার দেখিলি বারে, তাতে বলে বিয়াও নাগি গেল।"
চায়ের কাপটা পাশে নামিয়ে রাখতে রাখতে সুরেন বুড়া বলে। পাশ থেকে মালতীর মামা বলে,
"কী করিবেন তে এলা। চেংরি ছাওয়া খালি ঠ্যাং দিয়ায় বাড়ে কলকল করি কলাগছের নাখান। দেখনদার হইসে, এলা না দিবারে নাগে।"
মালতীর মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে। বলে,
"চেংরি ছাওয়া কী আর হামার বারে! চেংরি ছাওয়া পরের বাড়ি যাবার জইন্যে জনমটা। এলা কুদি কী হয় হোউক, পরের ঘরোত দিবারে না নাগে।!"
সুরেন বুড়া বলে,
"তাও তো তোমরা ভালে জিনিসপাতি এখেনা এখেনা করি বানাইসেন!"
মালতীর মা এবার হাসে। হাসিটা যদিও খুব মলিন। তবু বুক ঠেলে বেড়িয়ে আসা নিঃশ্বাসটাকে সামলে বলে,
"হামা হলি খাটি খাওয়া মানষি বারে। হাতের 'পর খাই। একদিন কামাই না কইল্যে ভাত নাই। হামাক এংকরিয়ায় সইষ্যা কুড়িয়া ব্যাল করির নাগিবে।"
কথাটা ঠিক। সুরেন বুড়া মাথা নাড়ে। বলে,
"আছে না, যেকিনা বাকি থাকিবে হামরা দশে একটা বেবস্তা না ঠিকে করিমু। কি কইস কান্তেশ্বর।"
কান্তেশ্বর বলে,
"ওইটায় না কসং। তোর ছাওয়াটা না হামারো ছাওয়া। সোগায় মিলি উদ্ধার করি দিমো।"
কথার পিঠে কথা চলতে থাকে। ঘরের ভেতর থেকে মালতীর কান্না বাইরে এসে পৌঁছয় না। কারণ ছোটবেলার হাউমাউ কান্নার অভ্যেস বদলে গিয়ে মালতী এখন নিঃশব্দে কাঁদতে শিখে গেছে। বাইরে তাই সবাই নিশ্চিন্তে মালতীর বিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। আলোচনায় ছেদ পড়ে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ঘন্টি শুনে। সবাই একসঙ্গে ঘুরে তাকায়। কান্তেশ্বর আন্তরিক গলায় ডাক দেয়,
"টনেয়া আসিলু? বোইস। হুদিকার খবরাখবর কি ক খানেক।"
ঢোলা পাজামা আর ঘিয়ে রঙের একটা চকচকে খাটো পাঞ্জাবিতে টনেয়াকে দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। বঋস পঞ্চাশের এদিক ওদিক হবে। টনেয়ার আগে বসমতী অবাক গলায় বলে,
"তোমার আরো হিটা ক্যামন নাও তো। দেখিতে মানষিটা না ভালে দ্যাখেছোং, তে টনেয়া মনেয়া নাও আরো ক্যানে।"
তবে টনেয়াকে দেখে মনে হল না যে এই নামে সে একটুও অখুশি। হেসে হেসে টেনে টেনে বলল,
"এইলা আগিলা মানষির কাথা। আগিলা বুড়া-বুড়িলা থুসে বারে। মোর বলে শরীলটা ছিলোয় না। সিন্ডার মতোন হাত পাও। মাথাকেনা এত্তোকোনা আর বলে পেটটায় সার আছিল। ওয় যে কাজাকিয়া মানষিলা ও মতোন নাও থুসে তে ওইটায় চলেছে। ভাল্ নাওখেনা তলে গেইসে।"
"তোর ভাল্ নাও ফির কি তে?"
কান্তেশ্বরের কথার উত্তরে টনেয়া অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
"কেনে, বিনয়? তুই না জানিস কে!"
কান্তেশ্বর লজ্জিত গলায় বলে,
"জানোং তে হয়, তে ফমে নাই।"
এবার সুরেন বুড়া অধৈর্য গলায় বলে,
"থও তো তোমার অত নাওয়ের কিসসাখান। চেংরার বাড়ির খবর কি আনিলু বাপোই?"
টনেয়া ঘটক এবার সাইকেলটাকে বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে রেখে গুছিয়ে বসে। তারপর মালতীর বাপের দিকে তাকিয়ে বলে,
"মোক কিন্তুক ঘটক বিদায়খান কনেক ভাল করি দিবার নাইগবে বারে। মেলা ঘুরোছোং পাত্রের বাড়ি। মনে কর মোর কাথাতে উমরা হেটে ছাওয়াটাক আগাছে।"
মালতীর বাপ একটু বিব্রত হাসে। তারপর ব্যস্ত গলায় বলে,
"হুটা না হয় বারে। তোমার কাথাতে না তামাল্লায়। তে কী চাছেন তোমরা ফির?"
সুরেন বুড়া এবার অসন্তুষ্ট গলায় বলে,
"বিয়াওখানে এলাং নাগিল না তাতে এখেরে ঘটক বিদাইখান নাগেছেকে। তোমার এখেরে খুব কাথা বারে। দেখেছেনকে মানষিলার কোনোয় নাই। তাও চান। ঘটকগিরি যায় তায় সুযোগ পায় না। তোমরা করেছেন, তোমার পুন্য হছে আর কত চান ফির?"
টনেয়া এবার নিজেকে সামলে নেঋ। বলে,
"কাথা না ঠিকে বারে। না চাং কোনো। হুটা মুই কাথার কাথা কনু একটা। মাইটা না উদ্ধার হলে মোরো মনটাত আলন্দ।"
মালতীর মা এবার ভাইবৌকে হাঁক পাড়ে,
"কোটে গেলু কইনা মাই। এত্তি বিরাখেনে। ওয় ঘটকটা আইচ্চে। এককাপ চাহা বানে আনেক। হোটে খোকোমতি কইনার মতোন না নইস ঘরটাত।"
কান্তেশ্বর ঘটককে আবার জিজ্ঞেস করে,
"কী খবর-বাত্রা তে। আল্লাপ সাল্লাপ কী হইল কনেক ক।"
টনেয়া একটু থামে। হয়ত নিজেকে একটু গোছায়। তারপর মুখে একটা সিরিয়াসভাব এনে শুরু করে
"কাথা না ওইলায় রে দা। কনেক জোগোত-জাগাত যাবেন। জাগাখানও দেখিবেন আর আল্লাপ-পরিচয় ও হবে। বরণের দিন বোদায় মসঙে খোয়াবে। বিয়াত মাছে করিবে উমরাও।"
কান্তেশ্বর ধমক দিয়ে বলে,
"তোমার ওইল্লা খাবারের কাথা মুই না শুনোং। আর কী কইসে হুলা ক।"
টনেয়া হয়ত আর একটু সিরিয়াস হল এবার। গলাটা খাঁকারি দিয়ে শুরু করল। কেমন দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে,
"কী কী নিগাবেন হুলা না তোমরা জানেন বাহে। পাঁচ কাপড়া, পান গুয়া, মিষ্টি-মাষ্টা। হিলা তো আর কোবার কাথা নাহয়। এই চেংরার বাপ কয়া পেটাইসে, আগমণির টাকা কিছু দিয়া আইসেন। উমরাও বাজার-ঘাট করিবে তো। আন্দনের খরচাটা উমরা কিছু আগমণির টাকা থাকিয়ায় না করিবে!"
তারপর একটু থামে। ততক্ষণে মালতীর মামি আরো সবার জন্য চা নিয়ে ঢোকে। চা দিতে দিতে মালতীর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
"হ, হোটে মাই কান্দেছে দিদি।"
শুনে মালতীর মায়ের মুখটাও করুণ হয়ে ওঠে। উদ্গত চোখের জল লুকোতেই হয়ত মুখটা অন্যদিকে ঘুরায়। টনেয়া একটু ওদিকে দেখে নিজেও হয়ত মনমরা হয়ে যায়। কিন্তু তার কাজ তাকে করতেই হবে। সেজন্য আবার খুব সহজ গলায় বলতে থাকে,
"টাকা কিছু দিলেই হবে। বাকিটা বিয়ার দিন দ্যান। আর সাইকোলখানও বিয়াতে না দিবেন!"
ছেলে আশীর্বাদের দিন মালতীর বড় মামা, ওর বাবা, কাকা, কান্তেশ্বর, সুরেন বুড়াসহ আর দুই একজন লোক বাড়ি থেকে রওনা দেয়। কান্তেশ্বর একটা বাজার করার ব্যাগে ধুতি, পাঞ্জাবি, সাদা উত্তরীয়, গেঞ্জি একটা আন্ডার প্যান্ট আর একটা ঘড়ি গুছিয়ে নিয়েছে। যাওয়ার আগে মালতীর বড় মামি বলে,
"পান-গুয়ার টোপলাটা নিসেন? মাছটা ঝুলি ন্যাও। নন কনেক সেন্দুর প্যান্দে দ্যাং।"
তারপর মালতীর মাকে জিজ্ঞেস করে,
"মিষ্টি আনিসে মাই?"
"না আনে ওদি কিনিবে বলে হাটখোলাত। কালি যায়া কয়া আইচ্চে না দাদায়! নাহাতে মিলিবে না। এতলা মিষ্টি!"
রওনা দেবার মুহূর্ত এগিয়ে এলে মালতীর বড়মামি তুলসিতলায় প্রদীপ ধরিয়ে জোড়াপান সুপারির গায়ে সিঁদুর লাগিয়ে উলু দেয়। শঙ্খে ফুঁ দেয়। তারপর গলায় আঁচল পেঁচিয়ে প্রণাম করে। এই পুরো সময়টায় বাড়ির পুরুষ মানুষগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রণাম পর্ব শেষ হলে ওর বড়মামাই বলে,
"ন্যাও বারে। হাটো। বেলাটা যাছেকে।"
নাকদড়ি লাগিয়ে ঝোলানো একটা বড় রুই মাছ, পান-সুপারির টোপলা আর বরণের সব জিনিসপত্র নিয়ে দলটি ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরোতে থাকে আর মালতীর মামি, জড়ো হওয়া আরো দু'চারজন বৌ যারা উপস্থিত ছিল সবাই উলুধ্বনি দিতে থাকে। মালতীর মা জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য প্রণাম জানায়। অস্ফুটে বলে,
"ভালে ভালে ঝোন সব হয় ঠাকুর। ছাওয়াটার হামার ঝুনি দুঃখ না হয়।
..............................................................
সইষ্যা কুড়িয়া ব্যাল করা - তিলে তিলে জমানোর মতো উপমা
হুদিকার - ওদিককার
কাজাকিয়া - কাজাক বা রসিকতা করার সম্পর্ক যাদের সঙ্গে (দাদু দিদা জাতীয়)
হেটে - এখানে
ছাওয়াটাক আগিছে - মেয়েটাকে নিচ্ছে
আগমণির টাকা - বরপণের চলনসই সুন্দর নাম
আন্দন - বৌভাত
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴