শালসিঁড়ি-৩৭/বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি-৩৭
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
সেন্ট্রাল টাওয়ারে ফেরার পথে রবিলাল আর নরমায়া বেশ জোরে হাঁটল। ফেরার পথে শুঁড় দিয়ে শরীরের রস বের করে শরীরে ডানে বাঁয়ে মাঝে মধ্যে এমন ভাবে ছিটাচ্ছিলো যে বিকাশদের গায়ে এসে পড়ছিলো। রবিলালরা হয়তো বুঝতে পেরেছিলো ওরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, তাই অধিক পরিশ্রমে রাগে গুড় গুড় করলেও বিপত্তি কিছু ঘটায়নি। মনে হয় তাড়াতাড়ি হাঁটল বাড়ি যাবার আনন্দে। পোষা হাতিদের বাড়ি ওদের পিলখানা। ওদের পিলখানা যে সেই অভয়ারণ্যে। দূরে হলে কি হবে- বাড়ি যাবার সময় দূরত্ব কমে যায় মনের আনন্দে। টাওয়ারে এসেই রবিলাল নরমায়া কেউ… কুউ… করে কেমন যেন তীক্ষ্ণ শব্দ করে, দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির গন্ধ নেয়। নির্মলবাবু তাপস হাতিকে গাড়ির দিকে আসতে দেখে সরে যায়। দুই পাতাওয়ালা বা সহকারী মাহুত গাড়ি থেকে নেমে টাওয়ারের উপরে ওঠে। প্রথমে নরমায়া টাওয়ারের পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, পাতাওয়ালা সাহায্য করে সীতারামদের হাতির পিঠে থেকে নামতে। তারপর নামে বিকাশরা। টাওয়ার থেকে নেমে পাতাওয়ালারা গাড়ি থেকে বের করে দেয় হাতিদের ধর্না বেড়ি। রবিলাল ও নরমায়া গন্ধ শুঁকে যে যার লোহার চেইন গুলো শুঁড় দিয়ে তুলে মুখে নিয়ে দাঁতে কামড়ে রাখে। পাতাওয়ালারা যে যার হাতিতে ওঠে বসে। মাহুত হাতিগুলোকে কি যেন ইশারা দেয়। হাতিগুলো শুঁড় তুলে চেইনগুলোকে মাহুতের হাতে ধরিয়ে দেয়। মাহুত পাতাওয়ালা দুই জনে মিলে হাতির চেইনগুলো হাতির পিঠে তুলে নেয়। জগবন্ধু বলে-
- স্যার আমরা আসছি… দেখেন বিকালে কি হয়। হাতিটা মনে হয় এইখানে নাই।
মাইল… বলার সাথে সাথে হাতি দুটো হাঁটা শুরু করে নিজের বাঁধন নিজের পিঠে নিয়ে। বিকাশ তাকিয়ে থাকে রবিলাল নরমায়ার চলার পথে। শুধু রবিলাল নরমায়া নিজের বাঁধন নিজের পিঠে বয়ে চলে না। কত প্রাণ নিজের বাঁধন নিজের বুকে বেঁধে চলে! অনেক দিন একা থাকলে এই রকম মনে হয় বেশী। অপূর্ব মারা যাবার পর মাধুরীর খবর নেওয়া হয়নি একবারও। ময়নাডাঙার মেয়েটি ভাঙ্গা দুয়ারের খাঁচায় মুক্ত হয়েও বন্দি হয়ে আছে। মাস্টারদা আবার কী মাস্টারি করছে কে জানে? বেইট ভীম ওরাওঁ অন্য কারো চারা খাচ্ছেনাতো? সাত্তার আবার কী ষড়যন্ত্র করছে কী জানি? … নির্মলবাবু বলে-
- স্যার নিচে আসুন। এবার আমাকে বলুন বিকালে কি ভাবে ডিউটি করতে হবে।
বিকাশ জামতলার দিকের রাস্তা দ্যাখে। বিকালের বরাদ্দ হাতিগুলো আসছে কিনা। সকালের হাতিগুলো তিন ঘণ্টার পরিবর্তে পাঁচ ঘণ্টা ডিউটি করল। মাঝে মধ্যে জরুরীকালীন অবস্থার জন্য বনে সাধারণ নিয়ম ভাঙ্গা হয়। আর এই জরুরীকালীন পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্য কত দুর্ঘটনা ঘটে যায় চোখের সামনে। রবিলালের ছিটানো শরীরের গরম রস এখনো বিকাশের শরীরে চট চট করে। রবিলালের আগের মাহুতের কথা মনে পড়ে। সেবার রবিলাল খুঁজতে বের হয় একটা পোষা স্ত্রী হাতি। সাথে ছিলো এই নরমায়া। রবিলাল সব হাতি পছন্দ করে না। কিন্তু নরমায়া ওর পছন্দের। তাই ওদের জুটি করে পাঠানো হয়েছে লালমনিকে খুঁজতে।
- লালমনিকে নদীতে স্নান করাচ্ছিল রফিক আর হরি। লালমনি ডাইন পাশ ফিরে শুইয়েছিল হাঁটু জলে। আমারাও পাশে আমাদের হাতিকে স্নান করাচ্ছিলাম। লালমনি দেখলাম জলের থেকে মাঝে মাঝে শুঁড় তুইলে এদিক সেদিক কিছু গন্ধ নিচ্ছে। আমরা হাতিদের এই রকম গন্ধ নিতে হামেশাই দেখি। রফিক বলে- উঠ, বাঁ তিরে উঠ বাঁ তিরে। বাঁদিকের শরীর ঘষা হয়ে গেছে এবার ডাইনদিকের শরীর ঘষবে। তাই বাঁ পাশ ফিরে শুতে বলল লালমনিকে। লালমনি বাঁ তিরে হইতে গিইয়া এমন ঝড়ের মতো জংগলের দিকে দৌড় লাগাইলো যে কেউ কিছু বুঝতে পারার আগে সে পৌঁছাই গেল পুব দিকে ধাদিনার কাছে। ধাদিনার কাছে গিইয়া সে একবার পিছনে ফিইরে তাকাইলো। কী জানি কি হইলো লালমনির। মনের কথা কি আর জানা যায়। সম্বিৎ ফিরে পাইতেই রফিক হরি খালি গায়ে ভিজা হাফ প্যান্ট আর মাথায় গামোছা বাঁন্ধা অবস্থায় ‘হেই হাতি থাম, লালমনি থাম’ বলে চিৎকার কইরে হাতির দিকে দৌড়াইতে লাগলো। রফিক হরি কে দৌড়াইতে দেখে লালমনি আবার দৌড়াইতে শুরু করে জংগলে ঢুইকে গেল। রফিক হরিও সেই দণ্ডী ধইরে পিছনে পিছনে জঙ্গলে ঢুইকে গেল।
- জগবন্ধু শীলতলা ক্যাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে শুকনো গলায় কথাগুলো বলে গেলো একটানে। জগবন্ধুর চোখ যেন খরায় শুকিয়ে চিরে যাওয়া ফাঁকা মাটির মাঠ।
- তুমি তখন কোন হাতিতে ছিলে? খরার মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষকের মতো বিকাশের আর্তি।
- আমি তখন রবিলালের পাতাওয়ালা।
- লালমনি ঐ ভাবে জল থেকে ওঠে দৌড় দিলে তো জলের প্রচণ্ড শব্দ হবে। তোমাদের হাতি ভয় পায়নি?
- কিছুই হইলো না ওদের দেখলাম। ওরা একদম ঠিক ভাবে ছিল। মনে হয় এই পালানোর পিছনে ওদেরও মত ছিলো।
- তারপর।
- আমরা ভাবলাম, স্নানের সময় মাঝে মধ্যে হাতিরা মাহুতের সাথে এই রকম লুকাচুরি খেলে। কিছুক্ষণ পরে দেখা যাইবে রফিক লালমনির কান ধইরে নিয়া আইসবে। আমরা আমাদের হাতি স্নান করাইতে থাকি। কিন্তু আমাদের হাতির স্নান হইয়ে যাইবার পরও লালমনিকে আইসতে না দেখে আমরা ভাইবলাম, রবিরা লালমনি কে হয়তো জংগল থেইকে পিলখানায় নিয়া গেছে। আমরা হাতিকে নিয়া পিলখানার দিকে রওনা দিছি আর তখনি বনের মধ্যে হাতির ভীষণ চিৎকার। রবি চিৎকার করছে- বাঁচাও… বাঁচাও…
- তারপর?
- আমরা বস্তা পাইতে হাতির ভিজা পিঠে বইসে পড়লাম। বিরসা- রবিলালের মাহুত রবিলালকে পিলখানা ফিরবার দণ্ডী ছেড়ে ধাদিনার দণ্ডী ধইরতে বললে, রবিলাল যাইতে চায়না। দুই হাতি শুঁড় তুলে শুধু গন্ধ নিতে থাকে। বিরসা রাগ করে রবিলালের মাথায় অঙ্কুশ মারে। রবিলাল গাইগুঁই করে ধাদিনার দণ্ডী ধরে। ধাদিনা ওঠার মুখে দেখতে পাই, হরি হাঁপাইতে হাঁপাইতে ছুটে আসছে।
- কি হইছে হরি? বিরসা জিজ্ঞাসা করে।
- বনে এক দল হাতি আছে। সেই দলের দিকে লালমনি চলি যাচ্ছিল। আমরা হাতির পিছনে ছুটছি, হঠাৎ জংগল থেকে একটা দাঁতাল আমাদের দিকে ছুটে আসল। আমরা পিছনের দিকে ছুটতে থাকি। তারপর হঠাৎ হাতিটা জোরে চিৎকার কইরে ওঠে। মনে হয় রফিকে ধইরে নিয়েছে। - হরি বলে।
- না হয়। চল দেখি। - আমি বলি। তারপর আমরা সবাই ধাদিনা দিইয়া উঠতে থাকি। ধাদিনার ডান দিকে খাড়া মাটির ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা একটা শালগাছের তলায় শালগাছের শিকড় ধরে ঝুলে থাকতে দেখা যায় রফিককে। প্রায় ষাইট ফুট উঁচু জমির ঢালে শালগাছটির শিফার (মূলের) অর্ধেক মাটির ভিতরে আর অর্ধেক মাটি বৃষ্টিতে ধুইয়ে যাইবার জন্য শিকড়ের আধা চান্দের মতো মাচাং তৈরি করছে। সেই মাচাঙ্গের তলায় শিকড় ধরে ঝুলে আছে রফিক।
- শালসিঁড়ির কী মায়া, বুক দিয়ে আগলে রাখে প্রাণ- বিকাশ মনে মনে বলে। জিজ্ঞাসা করে তারপর-
- আমরা সবাই চলে যাই শালগাছের গোড়ায়। শাল গাছের গোড়ায় দেখা যায় জংলী হাতির পায়ের ছাপ। আমি লাফ দিয়ে নামি যাই রবিলালের পিঠ থেকে। হাত বাড়াইয়ে হাত ধরি রফিকের। রফিক উঠে আসে মূল-মাচাঙ্গের উপরে। আমরা সবাই পিলখানায় ফিরে আসি। আমরা হাতিতে গদি লাগাই। তখনো সন্ধ্যা হইতে ঘণ্টা দুই বাকি। বিরসা বলে – হাতিকে দানা পরে খাওনো হবে। আগে লালমনিকে ধইরে নিয়ে আইসতে হবে। বিটবাবু অফিসে গেছে। গার্ড-বাবু বিনয়দা ছুটতে ছুটতে আসে দোনলা বন্ধুক নিয়ে। পোষা হাতি বনে হারাই গেলে যে অনেক ঝামেলা পোয়াইতে হবে। বিটবাবু না থাকলে গার্ডবাবুর দায়িত্ব বাড়ি যায়। আমি বিরসাদাকে বললাম - তখন হাতিটাকে অঙ্কুশ মারলা, হাতিটা কেমন আজ তোমার কথা শুনছেনা। দাও আমি চালাই। বিরসাদা বলে- পাতাওয়ালা পাতাওয়ালার মতো থাক। আমিই হাতি নিয়া যাবো। আমরা দুটি হাতি নিয়ে লালমনির দণ্ডী ধরে জংগলে ঢুইকে গেলাম। দিন হইলেও জংগলের ভিতরটা অন্ধকার। মাঝে মাঝে লালমনির একপায়ের পায়ের লোহার বেড়ির শব্দ আসছে ঝুন ঝুন কইরে। আমরা সেই শব্দ শুইনে সেই দিকে ছুটছি। আবার শব্দ হারায় যায় আবার আমরা দণ্ডী খুঁজি। আবার শব্দ শোনা যায় আবার হারায় যায়। জংগলের ভিতরটা আরো অন্ধকার হয়ে ওঠে। আমি বললাম- বিরসাদা, আজ চল কাইলকে আবার দেইখব। ঠিক তখনি আবার জংলী হাতির ডাক শোনা যায়। বিরসা বলে হাতির দলটা সামনের দিকে আছে। এখনো লালমনি দলে ভিড়েনি। চল দল হাতির দিকে যাই। লালমনি তো এখন মাইরের ভয়ে পালাচ্ছে। দলের দিকে আমাদের হাতির গন্ধ পাইলে লালমনি উলটা দিকে পালাবে। দলে ভিড়তে পারবেনা। এই বলে রবিলালকে বলে – আগত, মাইল…। রবিলাল শরীরকে জোরে আগায় নিয়া আবার পিছনের দিকে এমন ভাবে নিয়া আসে যে বিরসা উল্টায় পড়ে যায় রবিলালের সামনে। রবিলাল পা দিয়ে…
জগবন্ধু দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বিকাশ জগবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়।
- আমি কত করে বইললাম, আমার ঠাকুরদা মাহুত ছিলো, আমার বাবা মাহুত ছিল, আমি জানি মাদি হাতি বেশী দিন বনে থাইকতে পারবে না, একদিন ঠিক রেশন খাইতে ঘুরে আসবে। লালমনির মনে হয় প্রথম হিট হইছে, আমার কোন কথা শুনলনা। আমার কথা শুনলে আজকে… আবার জগবন্ধু কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে…
- তোমাদের বিটবাবু বড়বাবু কোথায়? - বিকাশ জগবন্ধুর পিঠে হাত রেখে বলে।
- বিরসার পোস্ট মর্টেমে গেছে।
সেই দিন হাতির পায়ে মাহুতের মৃত্যুর খবর জানার পর বিকাশ গিয়েছিলো পাশের বনে। যদি কোন সাহায্যের দরকার হয়। আজকে আবার মনে ভেসে ওঠে সেই পুরনো সব ছবি। জামতলা টাওয়ারের দিকে বনের ভিতরে হাতির পায়ের বেড়ির ঝুন ঝুন শব্দ শোনা যায়। বিকাশ ফিরে দেখে বনে। কোন হাতি দেখা যায়না। মনে হয় মনের ভুল।
- গাড়িতে খাবার কিছু আছে? বিকাশ জিজ্ঞাসা করে।
- তেমন কিছু নেই, জল আছে আর আমার কাছে বিস্কুট আছে। বিস্কুট আমি সাথে রাখি,গ্যাস্ট্রাইটিসের সমস্যা আছে, তাই। নির্মলবাবু বলে।
- ঠিক আছে, ওতেই চলবে। বিকাশ টাওয়ার থেকে নামতে নামতে বলে।
- আপনি নিলয় চলে যান, এবার আমি আর তাপস উঠবো এই বেলা হাতিতে।
বিকাশ গাড়ি থেকে জলের বোতলের নিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে অল্প ফ্রেস হয়, নির্মলবাবুর থেকে বিস্কুট নিয়ে খায়। ওয়াকি টকিতে খবর নেওয়ার চেষ্টা করে পায়ে হাঁটা দলগুলোর। কনট্রোল থেকে বার বার চেষ্টা করা সত্ত্বেও রেডিও টেলিফোন যোগাযোগ করা যায়নি । গভীর বনে এই এক অসুবিধা। সিগন্যাল পাওয়া যায়না সব সময়। জগবন্ধু এই জীবনে প্রথম দেখালো ছয় নখের হাতি পায়ের ছাপ। তারউপর বনে অনেক হাতি আছে -বলছে জগবন্ধু। আজকের বিশেষ টহলের বিষয়ে প্রতিটি স্টাফকে বলা আছে যে বুনো হাতিটিকে দেখতে পাওয়া যাক বা না যাক, তাদের নির্দিষ্ট এলাকা যতটা সম্ভব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দেখে নিতে হবে। সবাই যেন নিজের কাছে পরিষ্কার থাকে যে তার টহল এলাকায় কোন বুনো হাতি ছিলোনা। টহলের সময় বুনো হাতি কাছাকাছি থাকলে কী করতে হবে বলে দেওয়া আছে পই পই করে। বলা হয়েছে অস্বাভাবিক কিছু নজরে এলে সেটাকে খূটিয়ে দেখতে। গতরাতে নদীর পাড়ের ডিউটি হস্তান্তর করে রাতেই চার বিটে গিয়ে গিয়ে আজকের ডিউটির বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। তবুও হাতিদের গতিবিধি দেখে উচাটন হয় মন। কিছু স্টাফতো ঘুম থেকে উঠে মিটিঙে এসেছে। সব কথা ধরতে পেরেছে কিনা কে জানে!
বনের ভিতরে বিটগুলোতে বন বস্তির মতো সন্ধ্যায় রাতের খাওয়া খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে যাদের রাতের ডিউটি থাকে না। আর লাইট না থাকলে তো আর কথা নেই। গত কয়েকদিন আকাশ মেঘলা থাকার জন্য সোলার লাইটগুলো চার্জ হয়নি পুরো। সন্ধ্যা রাতেই অন্ধকারে ডুবে যায় বিট অফিস। বিটবাবু ডিউটির সার্চ লাইট জ্বালিয়ে সিলিঙে আলো ফেলে অফিসকে সামান্য আলোকিত করে। হরিণধরা বিটে ফাগু আর পাকুকে রীতিমতো ঠেলে ঠেলে নিয়ে এসেছিলো ইদ্রিস। ইদ্রিস আগে মাহুত ছিল। অনেক দিন হাতি চালানোর জন্য মেরুদণ্ডের রোগ হয়াতে এখন পেট্রোলিং করে। ও খুব ভালো বুনো প্রাণী ট্রেক করতে পারে। হাতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান প্রচুর। মিটিঙের সময় ইদ্রিস যে কথাগুলো বলেছিলো সেগুলো মনে পড়ে বিকাশের।
- স্যার খুনি হাতিটি বিশেষ হাতি।
- কেন?
- বেশ কয়দিন আগে আমাদের বনে এক দল হাতি ছিলো। সেই দলের আশেপাশে মৃত দাঁতালটি ছিলো। কিন্তু কয়দিন পরে দেখলাম হাতির দলটি আমাদের বন ছেড়ে চলে যায়, দাঁতাল হাতিটি থেকে যায়।
- সে তো হয়ই।
- কিন্তু এই খুনি হাতিটি কখন আমাদের বনে আসলো আমরা বুঝতে পারলাম না। আমরা বন টহলের সময় কোনো দিন দেখতেও পাইনি।
- কিন্তু হাতিরা তো অন্য হাতি এলে বুঝতে পারে।
- হ্যাঁ সার, সেই জন্যই তো হাতির দলটি আমাদের বন ছেড়ে গেলো।
- কেন বিশেষ হাতি বলছ?
- আমরা কয়েক দিন থেকে দেখছিলাম দুইটি একুরা হাতির লাদি। হাতির লাদি দেখে দাঁতাল বা মাখনা বলা যায়না। কিন্তু হাতির লাদি একুরা হাতি বা দল হাতি বুঝা যায়। হাতিটি কোন এলাকা থেকে আসছে বা গতি প্রকৃতি বোঝা যায়।
- সেটা কেমন?
- আমাদের বুনো হাতিগুলা একবন থেকে অন্য বনে যাবার সময় গ্রাম চা বাগান হয়ে যায়। সাধারণ স্বভাবের হাতি যায় আর খায়। খায় আর যায়। ওদের লাদিতে কালাগাছের আঁশ কাঁঠালের বীচি ইত্যাদি থাকে আর রঙ সাধারণত হালকা সবুজ-হলুদ বা হালকা হলুদ-বাদামি হয়। যে হাতিটি মারা গেছে তার লাদি হালকা হলুদ-বাদামি। ওর দণ্ডীতে পুরা মস্তির গন্ধ ছিল। আর দণ্ডীর দুই পাশে অনেক গাছের ডাল ভাংছে, গাছ ঠেলে উল্টে ফেলে দিচ্ছিল।
- তাই?
- হ্যাঁ স্যার। আমরা তো এই কয় দিন আরও একটা হাতির দণ্ডী দেখছিলাম। হাতিটির লাদি খুব কালো। তারপরের দিন দেখলাম লাদিতে পানি লহরার আঁশ শালের বাকল। হাতিটির দণ্ডীতে মস্তির গন্ধ আছে কিন্তু একাটা মিষ্টি গন্ধ যেন মিশে আছে ঝাঁঝালো গন্ধের সাথে। কিন্তু হাতিটাকে অনেক চেষ্টা করেও দেখতে পাই নাই। মনে হয় লুকায় থাকে।
- কি বল। হাতির মস্তির ঝাঁঝালো গন্ধের সাথে মিষ্টি গন্ধ! যাও রাত হয়েছে অনেক, ঘুমাতে যাও। সকালে উঠতে হবে। আর যে ভাবে বলেছি ডিউটি যেন ঠিক সেই ভাবে হয়, বুঝলেন বিটবাবু।
- স্যার বিশ্বাস করলেন না তো! আমার বাবা ঠাকুরদা রাজার মাহুত ছিলো। ছোটবেলায় শুনেছি সেই রাজার কাছে গজমুক্তা ছিলো। আর আপনিও বলছেন কারা যেন গজমুক্তার জন্য হাতি শিকারে বের হইছে। সব হাতির তো গজমুক্তা হয়না। গজমুক্তা হয় বিশেষ গুণওয়ালা হাতিতে। হাজার হাতির মধ্যে একটা হাতি এই রকম হয়। হয়তো এই হাতিটি সেই রকমের হাতি। তাই ও বনের বাইরের খায়না। মস্তির গন্ধে মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায়। মস্তি অবস্থায় একটা গাছও ভাঙে না, কত ঠাণ্ডা মাথার হাতি। ওই জন্য ঠাণ্ডা মাথায় এত বড় হাতিটাকে খুন করতে পারলো।
অভিমানে একটানে এতগুলো কথা বলে, নমস্কার জানিয়ে ইদ্রিস চলে যায় তার কোয়ার্টারে। মাহুতদের এই এক সমস্যা। ওরা খুব সংবেদনশীল হয়। আজকে হাতিটিকে খুঁজে পেলে, ইদ্রিসকে বলতে হবে ছয় নখের কথা। বিকাশ সিদ্ধান্ত নেয় বিকালের স্ক্যানিঙের ও নিজে থাকবে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴