শালসিঁড়ি-৩৬
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
রবিলাল চলতে থাকে জগবন্ধুর ইশারায়। জগবন্ধু চলে হাওয়ার টানে। হাওয়াদণ্ডী মাঝে মধ্যে হাওয়া হয়ে যায়। জগবন্ধুকে যুদ্ধ করতে হয় নিজের অভিজ্ঞতার সাথে। মাঝে মধ্যে জগবন্ধুকে দেখে মনে হয় ও যেন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের ময়দানে চক্রব্যূহর মধ্যে আটকে গেছে অভিমন্যুর মতো। কিন্তু জগবন্ধু যে মাহুত। শুধু নয় মাস মায়ের পেট থেকে নয়, পেট থেকে পড়েও হাতির সাথে থেকে হাতি ও বন দেখে বড় হয়েছে। বনের সব চক্র ভাঙতে ওস্তাদ। জগবন্ধু আবার হাওয়াদণ্ডী ধরে চলতে থাকে। নরমায়া আগে পিছে লাঠির গুঁতো খেয়ে এখন সোজা হাঁটছে। লাঠি এমন জিনিষ যে সঠিক ব্যবহার করলে হাতিও সোজা হাঁটে। হাতির পিঠে বসে হাতি খোঁজে মানুষ। রবিলাল মাকনা হাতি বলে ওর নামের সাথে কত একথা সেকথা যোগ হয়েছে। সে বদমেজাজি, বনে হাঁটতে চায় না মাঝে মধ্যে আস্তে হাঁটে আবার জোরে হাঁটতে শুরু করে। প্রায় দুই ঘন্টা ধরে পিঠে তিনজন মানুষ নিয়ে হাঁটছে। হাঁটছে আর গাছের ডাল লতাপাতা খাচ্ছে। কোন অসুবিধা করছে না। সিন্দুরি গাছের একটা ডাল ভেঙে গোটা খেয়ে নিল। তারপর আর একটা ডাল ভাঙল।
- জগবন্ধু ওটা কি গাছের ডাল ভাঙল?
- কাবরা।
- কি? এই নামের গাছ যে আছে জানা ছিল না তো।
- এই রকমের প্রায় পঁচিশ তিরিশটা গাছের নাম জানি স্যার, যেগুলো হাতি খায়।
হাতি হেঁটে চলে। বিকাশরা গাছ দ্যাখে গাছের বাকল দ্যাখে গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘাস দ্যাখে কিন্তু কোনো হাতি বা হাতি থাকার কোনো লক্ষণ দ্যাখে না। নানাগাছের মধ্যে কোন কোন গাছ হাতি খায় বিকাশ বুঝতে চায় হাতি খুঁজতে খুঁজতে। কাবু যত গাছ চিনিয়ে ছিল এবং নিজের চেষ্টায় যে কয়টা গাছ চিনেছে তার সব কয়টা গাছের চারা নার্সারিতে তৈরি হয়। হাতি খুঁজতে খুঁজতে বনে সে সব গাছের প্রায় সব গাছ দেখতে পেয়েছে। কিন্তু সেই সব গাছ বাদ দিয়ে আরো কত ধরণের গাছ দাঁড়িয়ে আছে। হাতি সব গাছ সব লতা পাতা খাচ্ছেনা। শুঁড় লম্বা করে বেছে বেছে খায়। একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে ডালের গোড়ার দিক মুখে কামড়ে ধরে ডালটিকে শুঁড় দিয়ে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে। তারপর শুঁড় দিয়ে ডালের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত চেঁছে টেনে পাতাগুলো আলাদা করে খেয়ে নেয়। আবার আরেকটা গাছের ডাল ভেঙ্গে পুরো ডাল পাতা খেয়ে নেয়। মাঝে মধ্যে কিছু ছোট ছোট গাছ শিকড় শুদ্ধ তুলে নিয়ে পুরো গাছটিকে খেয়ে নেয়। হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপর পা দিয়ে লাথি মেরে ঘাস মাটি থেকে তুলে শুঁড় দিয়ে তুলে ঝেড়ে খেয়ে তবেই আবার হাঁটে। এই সময় জগবন্ধু হাতিকে কিছু বলে না। বিকাশ বুঝতে পারে না কেন জগবন্ধু এমন তাড়ার সময়ও হাতিকে মাঝে মধ্যে দাঁড়াতে দেয়। জগবন্ধু কি মাকনা বলে ভয় পায় ? নাকি হাতির সঠিক প্রশিক্ষণ এখনো হয়নি? নাকি হাতির প্রতি এত অগাধ ভালোবাসা যে হাতিকে খাওয়ার সময় বিরক্ত করবে না! বোঝা বেশ কঠিন। মানুষের মনের কথা মুখে না বললে বোঝা যায়না, অনুমানে অনেক সময় মারাত্মক ভুল হয়ে যায়। বিকাশ মনের প্রসঙ্গ এড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে-
- আচ্ছা, তুমি যে পঁচিশ তিরিশটা গাছের পাতা ডাল হাতি খায় বলেছ সেই সব গাছ সব জায়গায় পাও?
- না স্যার। অনেকগুলো এখন আর পাওয়া যায়না। কিছু গাছ তো এমন আছে যে হাতি শিকড় শুদ্ধ তুলে খেয়ে নেয়। আবার কিছু গাছ আছে যেগুলোর বাকল এমন ভাবে খায় যে গাছটা পরে মরে যায়। এখন হাতিদের খাওয়ার খুব কষ্ট।
- কেন?
- আগে হাতি বনে পঁচিশ তিরিশ ধরণের গাছের ডাল পাতা খেত। এখন পাঁচ সাতটার বেশি রকমের গাছ নেই।
হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ে রবিলাল। মাহুত কিছু বলেনা।
- কি হল জগবন্ধু?
- না স্যার কিছু হয়নি।
- দাঁড়ালে কেন?
- হাতি পটি করবে।
রবিলাল পটি শুরু করলো, সাথে সাথ দিল নরমায়া। দুই হাতি মিলে অনেক পটি করল। সাথে অনেক প্রস্রাব। জায়গাটাতে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে গেল। রমেশ বলল-
- দা, দেখ কাইল হাতি চালতা খাইছিল।
জগবন্ধু রবিলালকে কষ্ট করে ঘোরায়- রবিলালের যে এখনো পটি শেষ হয়নি।
- স্যার দেখলেন।
- কি?
- চালতা, দুটি হাতির পটিতে আছে।
- হ্যাঁ। দুই তিনটা করে আছে মনে হয়।
- এই চালতাগুলো কালকে রাতে খেয়েছিল। রাতে যে ফডার দেওয়া হয়েছিল তাতে চালতা সহ চালতার ডাল ছিল। বুলবুল নাইনের স্টাফরা জোগাড় করে রেখেছিল। ওরা তো জানে না তাই কলাগাছের সাথে চালতার ডালও দিয়েছিল। সকালে দেখি চালতা ডাল থেকে সব চালতা খেয়ে নিয়েছে। হাতি চালতার ডাল থেকে বেশি চালতা খেতে ভালোবাসে।
- হুম। চালতাকে যে হাতির অ্যাপেল বলা হয়।
- দেখুন বুলবুল নাইনের চালতা গাছ এবার এখানে জন্মাবে। হাতির লাদিতে যে চালতা থাকে তার চারা খুব ভালো হয়।
- ঠিক, এই জন্য হাতিকে বনের কৃষক বলা হয়। শালসিঁড়ির রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী, তাই না বল।
জগবন্ধু শব্দ না করে হাসে। এই হাসির অর্থ বোঝা মুশকিল। হাতিগুলো কোথাকার চালতা কোথায় এনে ফেলল। বুনো হাতিগুলো বনের কত ফল খায়, পাতা খেতে গিয়ে ফল সহ কত ডাল মুখে কামড়ে এখান থেকে ওখানে নিয়ে যায়, পা দিয়ে লাথি মেরে ঘাস খেয়ে কত জায়গায় মাটি বের করে নরম করে দেয়, নিজেদের শারীরিক কসরত করতে গিয়ে বা প্রেমের জন্য নকল লড়াই করতে গিয়ে বনের ভিতরে ভিতরে অনেক জায়গা ফাঁকা করে মাটি বের করে দেয় - কৃষকের মতো। ছড়িয়ে দেয় বিভিন্ন ধরণের গাছের বীজ। তাই সারা বনে সব ধরণের গাছের সমারোহ ঘটে। পাখিরাও বীজ ছড়ায় কিন্তু হাতির মতো জমি চাষ করতে পারে না। তাই হাতিই বনের একমাত্র কৃষক। শালসিঁড়ির দেশে হাতি না থাকলে শালসিঁড়ির রাজ্য থাকবেনা। আবার শালসিঁড়ির রাজ্য না থাকলে হাতিও থাকবে না। শালসিঁড়ির রাজ্য যদি শুধু জানা কিছু গাছের বাগান হয়ে যায় সেখানে যে হাতি বাঁচতে পারবেনা। হাতি না থাকলে যে অনেক গাছ অনেক পোকামাকড় অনেক পাখি হারিয়ে যাবে।
কাবু বলত - আগে এই বনে বুনো মহিষ ছিল, এখন নাই। আগে এই বনে কতো কালো শিরিষগাছ ছিল, এখন নাই। কোথায় যে চলে গেল। পৃথিবীর প্রতিটি গাছে প্রাণীতে যে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবাণু বাস করে, ম্যালেরিয়ার জীবাণুর মতো। তাহলে যে সকল জাতের গাছ বা প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবাণুগুলো গৃহহীন হয়ে যাবে কোথায়? যত গাছ আর প্রাণী কমে যাবে, জীবাণুর আক্রমণ বেড়ে যাবে বেঁচে থাকা গাছ বা প্রাণীর ওপর। তখন বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। আরো কত প্রাণী কত গাছ হারিয়ে যাবে- হয়তো মানুষই বেঁচে থাকতে পারবে না। বিকাশ কাবুর কথায় কোন উত্তর দেয়নি। মনের ভিতরে কেমন একটা চাপ অনুভব করে – তাহলে একদিন হাতিও কি ডাইনোসরের মতো …!!! বিকাশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে-
- এত দেরী হচ্ছে কেন?
- হাতির লেজের তলায় লোহার দুমচি লাগানো আছে, তার জন্য গদি-ছাড়া-হাতির থেকে গদি-বাঁধা- হাতির পটি করতে সময় বেশি লাগে। জগবন্ধু বলে।
- দুমচি কি?
- ইউ আকারের একটা লোহার পাইপ যেটা হাতির লেজের তলায় দেওয়া আছে। যার ভিতর দিয়ে রশা ঢুকিয়ে গদি বাঁধা হয়েছে।
- ও…
রবিলাল হাঁটা শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ রবিলাল নিচের দিকে নামতে শুরু করে। জগবন্ধু বলে-
- স্যার পিছনের রশা ধরুন। না হলে পড়ে যাবেন।
বিকাশ নিলয় তড়িঘড়ি করে যার যার পিছনের রশা শক্ত করে ধরে। নিলয় জিজ্ঞাসা করে-
- কি হল?
- হাতি নদীতে নামছে।
দুটি হাতি নদীতে নেমে জল খায় অনেকক্ষণ ধরে। শুঁড় দিয়ে জল নিয়ে মাথা উঁচু করে মুখে ঢেলে দেয়। আবার শুঁড় দিয়ে জল তুলে আবার মাথা তুলে মুখে জল ঢেলে দেয়। অনেক পোষা হাতিকে দেখা যায় জলে পটি ও প্রস্রাব করতে। এই হাতি দুটি নদী নোংরা না করে নদীর জল পরিষ্কার রাখে বুনো হাতির মতো।
- হাতি দুটির অভ্যাস বেশ ভালো।
- হ্যাঁ সার। এই হাতি দুটি খুব পরিষ্কার। ওরা ঠিক বুঝতে পেরেছিল সামনে নদী আছে। তাই কাজটা আগে করে এসেছে। তারউপর নদীর আশেপাশে পটি করলো কারণ চালতা গাছতো নদীর কাছাকাছি ভালো হয়।
বিকাশ কথা বাড়ায়না। জগবন্ধুর যুক্তি শুনে অবাক হয়ে যায়। তাহলে হাতি শালসিঁড়ির কৃষক নয় কৃষি বিজ্ঞানী! হাতি বুদ্ধিমান হয় জানা ছিল, কিন্তু এত বুদ্ধিমান! বিকাশ অবাক হয়ে যায়। হাতি হাঁটতে থাকে নদী নদী। বিকাশের মনে হলো ওর শরীর যেন কেঁপে উঠলো। বিকাশ কিছু বলে না। জগবন্ধু যেন একটু কড়া ভাবে “হেই হাতি” বলে হাতির মাথায় লাঠি দিয়ে কয়েকটা বাড়ি মারলো। মনে হচ্ছে নদীর বুকে পাথরের উপর হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। রবিলাল নদীর বুকে ভেসে ওঠা ছোট একটা বালু মাটির চরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।
- স্যার দেখুন একটা পায়ের ছাপ। বেশ বড়।
- তাই তো। রবিলাল কি জল থেকেই বুঝতে পেরেছিলো।
- মনে হয় স্যার।
- এটা কোন পা, সামনের না পিছনের।
- সামনের পা।
- কতগুলো নখ আছে গোন তো।
- স্যার ছয়টা।
- কি!!! ভালো করে গোন।
- হ্যাঁ ছয়টা।
- হাতির কয়টা নখ থাকে।
- সামনের পায়ে পাঁচটা করে দশটা আর পিছনের পায়ে চারটা করে আটটা। মোট আঠারটা। আবার কখনো চার পায়ে চারটা করে ষোলটা।
- তাহলে ছয়টা হবে কি করে। ভালো করে গুনো।
সীতারাম গবিন নরমায়ার পিছন দিক থেকে রশা ধরে ঝুলে নামে নদীতে। দুজনে ভালো করে গুনে বলে
- ছয়টাই আছে স্যার, নখ।
- দেখতো সামনের পায়ের উপরে পিছনের পা পড়েছে কিনা।
- না স্যার। এই তো পিছনের পা। একদম স্পষ্ট।
বিকাশ চুপ মেরে যায়। গত রাতে ঠিক ঘুম হয়নি। সকাল থেকে হাতির পিঠে তিন ঘন্টা হয়ে গেল। হাতির দেখা পাওয়া গেলনা। যেটা পাওয়া গেল সেটা অবিশ্বাস্য। গজ মুক্তার মতো দুষ্প্রাপ্য। হাতির সামনের পায়ে ছয় নখ! বিকাশের মাথা ঝিম ঝিম করে।
- জগবন্ধু চল এগিয়ে যাই।
- হ্যাঁ স্যার, দেখুন ঘোলা জল আসছে। মনে হয় কোনো হাতি সামনে জলে আছে।
জগবন্ধুর কথা শুনে বিকাশের চোখ আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠে। মুহূর্তে সমস্ত ক্লান্তি চলে যায়। হাতি যদি স্নান শুরু করে তবে কিছুক্ষণ সময় পাওয়া যাবে। বিকাশ জগবন্ধুকে ইশারা করে তাড়াতাড়ি হাতি হাঁটাতে। কিন্তু রবিলাল কিছুতেই আর হাঁটতে চাইছে না। অনেক কষ্ট করে রবিলালকে প্রায় ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে উজানের দিকে। রবিলাল মাঝে মাঝে শুঁড় থেকে কেমন একটা শব্দ বার করে। সামনে দেখা যায় কতগুলো গরু মহিষ নদী পার হচ্ছে। বনের ভিতরে গরু দেখে রবিলাল আরো বেশি চঞ্চল হয়ে উঠে। বিকাশের মনের ভিতরে রাগ দলা পাকিয়ে ওঠে। সংরক্ষিত ( Reserve) বনে গরু মহিষ চরানো যেন অধিকার হয়ে গেছে। মনের সব রাগ গিয়ে পরে সীতারামের উপর -
- বনের ভিতরে এত গরু মহিষ কেন?
- স্যার এটা তো রিজার্ভ ফরেস্ট।
- কে বলেছে যে বিনা অনুমতিতে রিজার্ভ ফরেস্টে গরু চরানো যায়। রিজার্ভ ফরেস্টে কি হাতি হরিণ গাউর থাকে না?
- গ্রামের মানুষ কথা শোনে না আবার আশেপাশের মানুষও আমাদের সমর্থন করে না।- সীতারাম বলে।
রবিলাল শুঁড়ে জল তুলে শরীরে ছড়িয়ে দেয়। সেই জলের ছিটা এসে পড়ে বিকাশদের গায়ে। মনে হয় রবিলাল বনে গরু মহিষ দেখে রাগে ঘৃণা ছিটিয়ে দেয়, এরা হাতির খাওয়া খেয়ে নেয়, রোগ ছড়ায়। এই গরু মহিষের আড়ালে লুকিয়ে থাকে বুনো প্রাণীর শিকারের কথা। মনে পড়ে ছয় পা মহিষের কথা। কাবু যে এক বিচিত্র চরিত্র। একদিন সন্ধ্যার বলে-
- কালকে ভোর চারটায় ডিউটি যাব। দল শিকারের খবর আছে। চাবাগান থেকে আসবে।
- সকাল চারটার সময় যাবে?
- হ্যাঁ স্যার। তা নাহলে ওদের ঠেকানো যাবে না।
- কেন?
- ওরা নানা দিক থেকে এসে বনের মধ্যে একটা গাছের পূজা করে। তারপর ধনুকে জ্যা লাগায়। তারপর তদের ফিরানো খুব কঠিন। ওদের সেই পূজা যদি ভণ্ডুল করে দেওয়া যায় তাহলে সেই দিনের জন্য শিকারটা বন্ধ করা যাবে।
- ঠিক আছে আমি রেডি থাকব।
ভোর হওয়ার অনেক আগে ওঠে সবাই নদীর পারে একটা গাছের তলায় সবাই বসে পড়ে। গৌতম গাছের উপরে ওঠে বসে। ভোরের বিকীর্ণ আলোতে নদীকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নদীর মাঝে একটা টাপু (উঁচু চর)। সেখানে একটা বড় গাছ দেখা যাচ্ছে।
- ওটা কি গাছ?
- জোড়া শাল গাছ। ওরা প্রথমে ওখানে এসে জড়ো হবে। ওদের এক জন গোঁসাই আছে যে শিকার পূজা করে। তারপর দল বেঁধে বনে ঢোকে ধনুকে জ্যা লাগিয়ে। বনে কোন বুনো প্রাণী না পেলে শাল গাছের ডাল কেটে নিয়ে যাবে।
সবাই অপেক্ষা করে বসে আছে। দিনের আলো ফুটে ওঠে। নদীতে কিছু লোক মাছ ধরার জন্য ফাঁসি জাল লাগিয়েছিল গতকাল সন্ধ্যায়। সেগুলো মাছ সহ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু লোকজন ঝাঁপি জাল নিয়ে নামছে নদীতে মাছ ধরতে। নদীর পূর্ব দিকটি বনের নয়। নদীর পাড়ে মাঠে আস্তে আস্তে গরু চরতে আসছে। বনের বাইরে সব স্বাভাবিক চালচিত্র চলছে মনে হচ্ছে। বনের ভিতরে পরিবেশ বেশ গুমোট হয়ে উঠছে। চাপা উত্তেজনা সবার মধ্যে। বুঝি এই বের হবে শিকারি দল। কাবু বলে-
- স্যার দেখতে পাচ্ছেন, কতগুলো গরু মহিষ লাইন দিয়ে নদী পার হচ্ছে।
- হ্যাঁ।
- দেখতে পাচ্ছি। গরু মহিষের লাইন যে ক্রমশ লম্বা হচ্ছে।
- এরপর দেখবেন এদিক সেদিক থেকে এক জন দুই জন করে লোক বের হবে। আলাদা আলাদা করে নদী পার হবে। তারপর সবাই ঐ জোড়া শালগাছের কাছে আসবে।
- স্যার দেখুন মহিষগুলোর যেন ছয় পা। -গৌতম বলে।
- কি বলিস! - কাবু বলে।
- হ্যাঁ। ভালো করে দেখ।
সূর্যের আলোর সামনে কালো মহিষকে আরো বেশি কালো মনে হয়। বিকাশ কাবু ভালো করে গরু মহিষের লাইন দ্যাখে। গরুগুলো সব চার পেয়ে কিন্তু মহিষগুলো যে সব ছয় পায়ের। বিকাশ কিছু বুঝে উঠতে পারেনা। কাবু বলে-
- স্যার সাবধান হয়ে যান। শিকারি দল ঢুকছে।
- কোথায়?
- স্যার শিকারি দল আপনার সাথে বুদ্ধির খেলায় নেমেছে। আপনি শিকার করতে দিবেন না আর ওরা শিকার করবে।
- ওরা জেনে গেছে যে আমরা ওদের বনে ঢুকার টেকনিক বুঝে গেছি। তাই ওরা ওদের বনে ঢুকার টেকনিক বদল করেছে।
- কিভাবে?
- প্রতিটি মহিষের আড়ালে একজন করে শিকারি আছে। তাই মহিষের ছয় পা মনে হচ্ছে।
- আশ্চর্য!
- স্যার, তাড়াতাড়ি চলুন টাপুতে যাই। ওরা শাল গাছের কাছে আসার আগেই আমরা ওখানে পৌঁছাই।
বিকাশরা টাপুতে গিয়ে নদীর পাড়ে হাজির হয়। বিকাশদের দেখে সব মহিষেরা চার পায়ের হয়ে যায়। কিছু লোক গ্রামে বাগানে ফিরে যায়…
রবিলাল ফিরে চলতে থাকে অভয়ারণ্যের দিকে। বিকাশ বলে-
- জগবন্ধু গরু মহিষের লাইনটা দেখলে হতো না? যদি ওদের পিছনে টাস্কর হান্টারের কোন যোগ থাকে!
- স্যার, হাতিটি কথা শুনতে চাইছে না। শরীর গরম হয়ে গেছে।
- সীতারাম সেন্ট্রাল টাওয়ার এখান থেকে কত দূর।
- স্যার পিছনের দিকে এক কিলো মিটার হবে। তবে সেই দিকে চলো। নিলয়, কনট্রোলকে বলো, বিকালের হাতি দুটোকে সেন্ট্রাল টাওয়ারে আসতে।