বড়দীঘি চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
বড়দীঘি চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
------------------------
এখানে আমলকি বনে ঝাঁকে ঝাঁকে বনটিয়া, ময়ূর, দোয়েল, ফিঙে, বুলবুলি, খঞ্জনি পাখিদের মেলা। ঝরে পড়ছে রাশি রাশি সেগুন, শালপাতা, হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ছে শিমূল তুলো। লকড়ি কুড়াতে গিয়ে বাইসন, গন্ডার না হলে হাতির লাথি খেয়ে অনেকে মরে। শুকনো পাতায় পথের নিশানা ঢেকে যায়। মাঝে মাঝে ছোট্ট চা বাগিচা। কাল ছিলাম টিলাবাড়িতে। একটি বর্ণময় পরিবেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের উদ্যোগে জলপাইগুড়ি জেলার মাটিয়ালি ব্লকের টিলাবাড়িতে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে টিলাবাড়ি টুরিস্ট কমপ্লেক্সের। বাতাবাড়ি এবং বড়দীঘি চা-বাগানের টিলাবাড়ি ডিভিশন সংলগ্ন এই স্থানটি অপেক্ষাকৃত একটি উঁচু টিলা। নানারকম গাছের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা এই টিলাটিতেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিজম দপ্তর নির্মাণ করেছে এই ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স। এসেছি ডুয়ার্সের অন্যতম প্রসিদ্ধ দুটি বাগান বড়দীঘি আর বাতাবাড়ি চা বাগিচা সার্ভের কাজে। টিলাবাড়ি থেকে চা বাগানের রাস্তা ধরে এখান থেকে মাত্র চার কিমি বড়দীঘি চা বাগিচা। বড়দিঘী চা বাগিচা সার্ভে করার পাশাপাশি এক ঢিলে দুই পাখি মারার প্রয়াসে পর্য্যটন সফর এবং আদিবাসী জীবনচর্চার সুলুকসন্ধানে এসেছি। ডুয়ার্সের চা বাগিচা পরিভ্রমণ করতে করতে আমার মনে হয়েছে ডুয়ার্সের আদিবাসী সমাজ অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু। যে কোনো পরিস্থিতিতেই তারা সর্বংসহা। সরু পথ ধরে হাঁটছি। নির্জন বনতলী। পথের মধ্যে দেখি দুটি ময়ূর লেজ দুলিয়ে খাদ্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাদের পায়ের শব্দে বিকট আওয়াজ করে ওঠে। কিছুটা যাবার পর মনে হলো পাশের জঙ্গল থেকে কি একটা ঝপাং করে উড়ে এসে ঝোপেঝাড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু ভয় পেলাম। পৌঁছে গেলাম বড়দীঘি বিট অফিসে। আদ্দিকালের ভাঙ্গাচোরা কাঠের ঘরবাড়ি। বিবর্ণ সাইনবোর্ড। এক ছোকরা শালগাছের নিচে দাঁড়ানো। ওই আমাদের গাইড। বড়দীঘি বিট ছাড়িয়ে কিছুটা অরণ্যপথ। এঁকে বেঁকে আমরা পৌঁছে গেলাম ছাওয়াফুলির অন্দরমহলে।
ডানদিকে নেওড়া নদী, দূরে আবছা আপালচাঁদ ফরেস্টের ছবি। বনরক্ষী বলল, ও কিছু না বনমোরগ। বেশি সংখ্যায় রয়েছে পাখিরা। ডালে ডালে কত যে বিচিত্র শব্দ ঝংকার। সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার কনসার্ট। এসে পড়লাম চা বাগিচার ফ্যাক্টরির দোড়গোড়ায়। মালবাজার মহকুমার মেটেলি ব্লকের অন্তর্গত রায়ডাক সিন্ডিকেট লিমিটেড বড়দীঘি টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী। বাগানটির ম্যানেজমেন্ট সহযোগিতা দিয়ে থাকে ডিবিআইটিএ। এনইউপিডব্লিউ, সিবিএমইউ, পিটিডব্লিউইউ মূলত এই তিনটি সংগঠন বাগানের স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন। মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৬ জন। বাগিচাক্ষেত্রের আবাদযোগ্য আয়তন, গ্রস এরিয়া এবং গ্র্যান্ট এরিয়া ৮৬৬.৪৬ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য আবাদী অঞ্চল ৬৪২.৫৭ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য আবাদীক্ষেত্রে উৎপাদিত কাঁচা চা পাতা ১৫০০ কেজি। বছরে গড়ে ৩৩ লাখ কেজি নিজস্ব উৎপাদিত কাঁচা চা পাতা থেকে বড়দীঘি চা বাগানের ফ্যাক্টরিতে ৭ থেকে ৮ লাখ কেজির মত বিক্রয়যোগ্য উন্নত মানের ইনঅর্গ্যানিক সিটিসি চা প্রস্তুত হয়। রায়ডাক সিন্ডিকেট লিমিটেডের নামে কোম্পানীর লিজের সময়কাল ২০২৬ সাল পর্যন্ত। বড়দীঘি চা বাগিচার সাব স্টাফ এর সংখ্যা ১০১ জন, করনিক ১৫ জন, ক্ল্যারিক্যাল স্টাফ ১৫ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ১০৫২ এবং মোট জনসংখ্যা ৫০২২ জন। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিযুক্ত স্থায়ী শ্রমিক সংখ্যা ১৪১২। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ১০২ জন। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী এবং চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক ছিল। মোট কর্মরত শ্রমিক ১৬৯০ এবং শ্রমিক পরিবারগুলির উপর নির্ভরশীল অশ্রমিক ৩৩৩২। সাম্প্রতিককালে এই পরিসংখ্যান কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। বাগিচাতে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ জন ক্যাজুয়াল শ্রমিক লাগে। বড়দীঘি চা বাগিচাতে ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকা বাড়ির সংখ্যা ১৫৩০। তার মধ্যে আলাদা সেপারেট মিটারযুক্ত বাড়ি ৭৬৫, ক্লাস্টার মিটারযুক্ত বাড়ি ৭৬৫। আধা কাঁচা বা সেমি পাকা বাড়ি ১৩৯ টি। মোট বাড়ি ১৬৬৯, মোট শ্রমিক ১৬৯০। বড়দীঘি চা বাগিচাতে ৯৯% পাকা বাড়ি নির্মিত হয়েছে। বাগিচাতে শৌচাগারের সংখ্যা ২৭৭।
বাগিচায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে এবং বাগিচায় আবাসিক ভিত্তিতে ডাক্তার রয়েছে। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি এমবিবিএস পাশ করে চা বাগিচায় কর্মরত রয়েছেন। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল দ্বারা অনুমোদিত। বাগিচায় প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা একজন এবং নার্স এর সহযোগী আয়া অথবা মিড ওয়াইভস আছেন ২ জন। স্বাস্থ্য সহযোগী রয়েছে দুই জন। বড়দিঘী চা বাগিচায় ডিসপেনসারি আছে একটি। অর্থাৎ এখানে কোন হাসপাতাল নেই। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ১২ টি এবং ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ১৫ টি। বাগিচায় অপারেশন থিয়েটার আছে। অ্যাম্বুলেন্স আছে এবং বাইরে চিকিৎসার জন্য রোগীকে রেফার করা হয়। বাৎসরিক বোনাসের শতকরা হার গড়ে কুড়ি শতাংশ। বড়দীঘি চা বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। ক্রেশের ব্যবস্থা ভালো। শৌচাগার এবং পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা আছে। দুধ বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার শিশুদের ঠিকমতো সরবরাহ করা হয় না অথবা নিয়মিত পোশাক দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ আছে। বড়দীঘি চা বাগিচাতে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে উঠে এল ডুয়ার্সের অন্য এক ছবি। শীতের মরশুমে চা বাগানে পাতা তোলার কাজ থাকে না। বাগানে আগাছা পরিষ্কারের কাজ চলে। প্রায় তিন মাস চা পাতা উত্তোলনের কাজ বন্ধ থাকার পর অনেকেই এ সময় চা পাতা তোলার কাজও শুরু করে। শীতে কাটিং এবং প্রুনিং এর ফলে শীতের শেষাশেষি চা গাছে বেরোয় সবুজ পাতা। বাগিচা পুরো সবুজ হয়ে যায়। বেশ লাগে চারদিক। শীতের রোদ গায়ে মেখে সবুজ রঙের কচি কচি পাতা যেন সদ্য আড়মোড়া ভাঙে। হাতের আলতো টানে তুলে নিতে হয় দুটি পাতা। ছেঁড়ার পরে বেশিক্ষণ রোদে রাখার নিয়ম নেই। তাতে পাতা মিইয়ে যায়। এরকম যত্ন পেলেই শীতের পরে ফার্স্ট ফ্লাশের চা পাতার স্বাদ এবং গন্ধ অটুট থাকে। শীতের পরবর্তীকালে উত্তরের চা বাগানের ছবি এমনই। স্বাদে এবং গন্ধে মরসুমের যে কোনও সময়কে পিছনে ফেলে দেয় শীতঘুম ভাঙা এই সময়ের চা পাতা। চা বাগান পত্তনকারী সাহেবরা যে পাতার নাম রেখেছিলেন ফার্স্ট ফ্লাশ।
সাহেবি প্রথা মেনে আগে ডিসেম্বরের শুরুতেই চা পাতা তোলা বন্ধ হয়ে যেত। তারপর শুরু হত চা গাছের যত্ন। গাছের ওপরের দিক কেটে দেওয়া হতো। শীতে দু একবার বৃষ্টি পেয়েই চনমন করে উঠত চা গাছ। মার্চ মাসের গোড়া থেকে শুরু হত পাতা তোলা। রং খেলার পর থেকে ভরপুর পাতা তোলা শুরু হয়ে যেত। আবহাওয়া এখন বদলেছে। ডিসেম্বরের পরেও চা গাছে পাতা আসছে। এ দিকে ফেব্রুয়ারি বা মার্চে বৃষ্টি কমেছে। শীতও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এখন জানুয়ারির শেষ থেকে শীত কমতে শুরু করলেই চা গাছে নতুন পাতা উঁকি দিতে শুরু করে। এ বছর মার্চ মাসে কিছুটা বৃষ্টি হয়েছিল ডুয়ার্সে। তাতে হাসি ফুটেছিল বাগিচা মালিকদের। কিন্তু এই সময়কালে ভুরু কুঁচকে গেছে চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিস্ট জনেদের। চা পর্ষদের নির্দেশে ২০২০ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে, ২০২১ সালে কিছুটা পিছিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে, ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ডুয়ার্স এবং তরাইয়ে ‘ফার্স্ট ফ্লাশের চা পাতা তোলা শুরু হয়। মার্চ মাসের গোড়া থেকে উৎপাদনের কাজকর্ম পুরোদমে শুরু হয়ে গেলে এপ্রিল মাস পর্যন্ত যে উৎপাদন হয় তা ফার্স্ট ফ্লাশ হিসেবেই পরিচিত। গুণগত মান ভালো থাকার জন্য এই চায়ের দাম সবচেয়ে বেশি পেয়ে থাকে বাগানগুলি। ফার্স্ট ফ্লাশের এই উৎপাদনের দিকে চা শিল্প সারাবছর তাকিয়ে থাকে। গাছে কাঁচা পাতা চলে আসে এবং তা তুলে উৎপাদনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়। প্রত্যেক বছর টি অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া ডুয়ার্স ব্র্যাঞ্চ, ডিবিআইটিএ, আইটিপিএ এবং ক্ষুদ্র চা চাষীরা পূর্ণ উদ্যমে নেমে পড়েন তাঁদের সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত বাগানগুলির ফার্স্ট ফ্লাশের চায়ের উৎপাদনের গুণগত মান বৃদ্ধির দিকে। গুণমানের দিক থেকে মরশুমের ফার্স্ট ফ্লাশ চা পাতার চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। বাজারে এর দামও চড়া। অর্থোডক্স তথা বড় পাতার চা এর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ফ্লাশের কদর আছে। চা রসিকেরা দাবি করেন দার্জিলিংয়ের বেশ কিছু চা বাগান রয়েছে যে বাগানের ফার্স্ট ফ্লাশের থেকে সেকেন্ড ফ্লাশের চায়ের দাম বেশি। তবে ডুয়ার্সের সিটিসি চায়ের ক্ষেত্রে ফার্স্ট ফ্লাশ বাজার ধরার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
ডুয়ার্সের সিংহভাগ মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চা পাতা ব্যবসার কাজে যুক্ত। জলপাইগুড়ি জেলায় ময়নাগুড়ি, মালবাজার, মেটেলি, নাগরকাটা সহ বিভিন্ন চা বাগান অঞ্চলে বৃহদায়তন চা বাগিচা বা ফ্যাক্টরির পাশাপাশি ময়নাগুড়ি ব্লকের পানবাড়ি, রামশাই, আমগুড়ি, খাগড়াবাড়ি, জল্পেশ, ব্যাংকান্দি সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ২৫ হাজার ক্ষুদ্র চা বাগানগুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। অধিকাংশ মানুষের প্রচুর সংখ্যায় ছোটবড় চা বাগান রয়েছে। চা বাগানে নিয়মিত সেচ দিতে প্রচুর খরচ হয়। তাই বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল উত্তরের চা চাষীরা। মাঝেমাঝে শীতকালে বিশেষ করে মাঘ ফাল্গুনে অকাল বৃষ্টি হলে সেকেন্ড ফ্লাশে পাতার ফলন ভালো হয়। আর কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। চাষিরা বেশি উপকৃত হন। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী ফাল্গুনে বৃষ্টি হলে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষয়ক্ষতি হলেও ডুয়ার্সে ফাল্গুনের বৃষ্টিতে নতুন আশা তৈরি হয় চা পাতা ফলনে। বৃষ্টির জেরে বড় চা বাগানের মত ছোট বাগানগুলিতেও খুশির হাওয়া বয়ে যায়। আচমকা এই বৃষ্টিতে উপকার হয় চা বাগিচা শিল্পের। কয়েকদিন বৃষ্টি থাকলে ব্যয়বহুল খরচ অনেকটা কমে। অকাল বৃষ্টি চারাগুলির বপনের ক্ষেত্রে খুব কাজে দেয়। পোকামাকড় থেকে চা গাছ রেহাই পায়। রোগপোকার সংক্রমণ থেকেও পাতা রক্ষা পায়।
গ্রীষ্মের তীব্র তাপপ্রবাহে কার্যত পুড়ছে উত্তরবঙ্গের বাগান। ধুঁকছে কুঁড়ি, সঙ্কটে চা শিল্প। প্রখর তাপে চাতক পাখির দশা চা পাতার কুঁড়িরও। পাল্লা দিয়ে চড়ছে তাপমাত্রার পারদ। আমজনতার মতোই যেন হাঁসফাঁস অবস্থা চা গাছগুলির। মরসুমের শুরুতে বাজারে এই সময়ের ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ বলে পরিচিত চায়ের উৎপাদনে এই প্রতিকূল আবহাওয়ায় ধাক্কা লাগতে শুরু করেছে। আশঙ্কা চায়ের গুণমান খারাপ হওয়ারও। শিল্পমহলের ধারণা, এই অবস্থা আরও কিছু দিন চললে প্রবল চাপ তৈরি হবে শিল্পের অন্দরে। বৃষ্টি হলেও ইতিমধ্যেই হওয়া ক্ষতি কতটা পূরণ করা যাবে তা নিয়ে সংশয়ে তারা। বৃষ্টির অভাবে এ বার এখনও পর্যন্ত ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ চায়ের উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ কমেছে। গরমে কর্মীরাও ঠিক মতো কাজ করতে পারছেন না। তার উপর রফতানি বাজারে কমছে দার্জিলিং চায়ের চাহিদা। কারণ, অর্থনীতিতে ঝিমুনির জন্য ইউরোপের অনেক দেশে একই চা পাতা দু’বার ফুটিয়ে খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। গত বছর উত্তরবঙ্গে চায়ের উৎপাদন নজির গড়েছিল। এ বার সংশয় বাড়াচ্ছে আবহাওয়া। টি রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (টিআরএ) জানাচ্ছে, চড়া তাপমাত্রা এবং বাতাসে আর্দ্রতার অভাব পাতার কুঁড়ির বৃদ্ধিকে আটকে দিচ্ছে। নতুন পাতা না হলে চায়ের গুণমানে প্রভাব পড়বে। ডুয়ার্সে এই অবস্থা আরও এক সপ্তাহ চললে ‘সেকেন্ড ফ্লাশ’ চায়ের উৎপাদনও মার খাবে। তরাই এলাকায় তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ানোয় গাছে সালোকসংশ্লেষের হার কমছে। তা ৪২ ডিগ্রি হলে সালোকসংশ্লেষ কার্যত হবেই না। তাই গাছের উপরে আচ্ছাদন তৈরির পরামর্শ দিয়েছে তারা। কিন্তু এপ্রিলে আবহাওয়ার উন্নতি না হলে সব মিলিয়ে উৎপাদন মার খেতে পারে।টিআরএ- থেকে খবর পেলাম দার্জিলিঙের বাগানে গরমের চেয়েও বড় সমস্যা বৃষ্টি না হওয়া। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৪ ডিগ্রি বেশি। বৃষ্টির অভাবে বাতাসের আর্দ্রতা কমেছে। ফার্স্ট ও সেকেন্ড ফ্লাশ মিলিয়ে উৎপাদন ৩৫%-৪০% ধাক্কা খেতে পারে।
চা রসিকদের পেয়ালায় দার্জিলিঙের ফাস্ট ফ্লাশের সুবাস উঠতে শুরু করে মার্চ মাসের শেষ থেকে। আসলে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ফার্স্ট ফ্লাশের চা তৈরি শুরু হয় যা বজায় থাকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। ফার্স্ট ফ্লাশের ডুয়ার্সের সিটিসি চায়েরও কদর যথেষ্ট। শীতের শেষ এবং বসন্তের শুরুর সময়ে যে পাতা তোলা হয় সেই কচি পাতায় চায়ের রং ঘন হয়। স্বাদও হয় ভিন্ন। দুধ দিয়ে বানানোর পরেও সিটিসির চায়ের সুবাস অক্ষুন্ন থাকে ফার্স্ট ফ্লাশে। বছরের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৫ শতাংশ পাওয়া যায় ফার্স্ট ফ্লাশের উৎপাদন থেকে। আসলে দিনে যতই গরম থাকুক, রাত নামলে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। কয়েক বছর আগেও ডুয়ার্সের গ্রীষ্মকাল মানেই ছিল এমন একটা ধারণা। কিন্তু, এমন মনোরম ডুয়ার্স যে আর নেই তা যেন স্পষ্ট করে দিচ্ছে এপ্রিল মাসের ঝলসানো আবহাওয়া। প্রবল দাবদাহে পুড়ছে জলপাইগুড়ি, কোচবিহারও। এমনকি দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াঙেও শান্তি নেই। বড়দিঘি চা বাগানের ম্যানেজার তথা ডিবিআইটিএ এর চালসা শাখার চেয়ারম্যান ইন্দ্রজিৎ সিংহ চহ্বানের কাছ থেকে জানতে পারলাম ‘‘চা গাছ ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় বেড়ে উঠতে পারে। কিন্তু তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরোলেই সালোকসংশ্লেষ বন্ধ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে চা গাছের বৃদ্ধিও থমকে যায়। এখন তাপমাত্রা যদি ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছে চলে যায় তাহলে চা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। নতুন পাতা আসাও একপ্রকার বন্ধ হয়ে যাবে। এরকম রোদ যদি না কমে তা হলে সমূহ বিপদ। এমন ঝলসানো আবহাওয়া চললে অনেক জায়গায় চায়ের গুণগত মান বজায় রাখা সমস্যা হয়ে যেতে পারে।’’ ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গিয়েছে তাপমাত্রা। গরম বাতাসের ধাক্কায় পুড়ে যাচ্ছে চা বাগান। তামাটে হয়ে যাচ্ছে সবুজ পাতা। বাড়ছে রোগপোকার দাপটও।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴