পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৩৫
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
বিষকাঁটালির পাত
"এমন আটমাসিয়া দিনোত তোমরা আরো কাদো কোটে পালেন বা। এখেরে জুতা মুজার নাখান করি পিন্দি আছেন মনটা কছে!"
সুপেনের দুই পায়ে হাঁটু অবধি কাদা। তাই দেখে বুধেশ্বরের বউ হাসতে হাসতে কথা ক'টা বলে। রসবালা বের হয়ে বলে,
"দ্যাখ তো পাগলিটা কেমতোন হাসিতে হাসিতে নুলি পড়েছে এখেরে।"
তারপর একটু থেমে বলে,
"চুয়া খুঁড়েছে বারে! তাঙ্কুবাড়িত জল দিবে। দেখেছেন না বাঁশের না টৌপা বানাইসে ঘিরি দিবার জইন্যে। ছাওয়া ছোটোর ভয়।"
সুপেন গোয়ালঘর থেকে কোদালটা নিয়ে আবার মাঠের দিকে রওনা হয়। রসবালা অবাক হয়ে বলে,
"কোদালখান বাড়িতে তে চুয়া কি দিয়া খুঁড়েছেন!"
"মানষিরনা, তে নাগে বলে নিগাইল।"
কথাগুলো সংক্ষেপে বলেই সুপেন আর দাঁড়ায় না। বুধেশ্বরের বউ একফালি লাউ রসবালার হাতে দিয়ে বলে,
"বড্ড একটা নাউ কাটিসি তে মাও কছে দিয়া আইসো। অসবালা ডাইল আন্দে ভাল।"
রসবালা খুশি হয়। হেসে বলে,
"তোমার মার ওইলা কাথা! আইতোত এলায় আন্দিম। ঠান্ডা নাগাইসে, হামার বাছা বাউর খাওয়া না যাবে। হামরা খামো। তোমরা খাইলে নিগান"
বুধেশ্বরের বউ বলে,
"মুই কালি নিগাইম বারে। বাসিয়া নাউর ডাইল মোক খিবে ভাল নাগে। মোর জইন্যে এখেনা থন।"
রসবালা পিছন থেকে ডেকে বলে,
"তোমার চোন্দোনি আছে বারে বৌমা? মোরলা নাই, শ্যাষ হয়া গেইসে। নাউর ডাইলোত চোন্দোনি না হলে ভালে নাগে না।"
বুধেশ্বরের বউ বলে,
"আছে বারে। বেলাভাটি এলায় আনি দিম। এলায় তো নানাগেছে। আন্দিতে আন্দিতে ঝুনি আতি?"
বুধেশ্বরের বাপ মনে করে চাষ বাসও হল হিসেবের কাজ। উপযুক্ত শ্রোতা পেলেই হল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করবে,
"এ বাপোই। হয় না হানে হামরা তোমাল্লার মতোন ইস্কুল কেলাস করি নাই। কিন্তুক হিদি হিসাব হামার টনটনা। তাঙ্কু গাড়িবার একখান মাস যাবে, ওদি উয়ার কুশি পাতারি ভাঙির নাইগবে। একবারে না হয়, দুইবার, তিনবারে পাতা ভাঙির নাগে।"
সুপেন মতিহারী জাতের তামাক আবাদ করেছে। একমাসের মধ্যে প্রতি গাছে পাঁচটি করে পাতা রেখে যত নতুন কুশি পাতা হয়েছে সব ভেঙে দিয়েছে। মোটামুটি বার তিনেক হল। দুই ছেলে, রসবালা সবাই এখন তামাক চাষের কাজেই ব্যস্ত। এখন কূয়ো খুঁড়ে জল সেচ করবে। জলসেচেরও তো কায়দা আছে। তামাক গাছের সারি বাঁচিয়ে নালি কাটা হয়ে গেছে। এখন কূয়ো থেকে জল তুলে ওই নালি দিয়ে সারা জমিতে সবখানে আগে জলটা আনতে হবে। তারপর থালা বা সেরকম কিছু দিয়ে জলটাকে এমনভাবে তুলে তুলে ছুঁড়তে হবে যেন মনে হবে বৃষ্টি হচ্ছে। সুপেনের জমি মোটামুটি রসালো। একবার সেচ দিলেই হয়ে যায় প্রতিবছর। তবে অনেকেরই তামাক ক্ষেতে দুবার জল দিতে হয়।
সুপেন চলে গেলে রসবালাও আলুক্ষেতে জল দিতে যায়। দুই ছেলে মিলে বাড়ির কুয়ো থেকে একটা নালা কেটে দিয়েছে। রসবালা জল তুলে নালায় ফেলতে থাকে। বসমতী এসে ডাকতেই কূয়োপাড় থেকে সাড়া দেয়।
"জল তুলোছোং দি। আলুবাড়িত দিম। বিলাতী আলু গাচ্চুং যে কয়টা ঘুঁই।"
বসমতী আর কথা বাড়ায় না। এসেছিল একটা বাটি দিতে। রান্নাঘরের দরজার বাঁশের লাঠিটা ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে বাটিটা রেখে বের হয়।
"পরে, ভাটিবেলা সোমায় পাইসতে আসিসখেনে। আর কয়দিন পরে তো তাঙ্কু কাটার তালোত পড়িবু, আরোয় সোমায় পাবু না।"
বলে আর দাঁড়ায় না। বাড়িতে হাজিরা নিয়েছে, খেতে দিতে হবে। বসমতী যেতে না যেতেই ছোটছেলে বিষেণ বাড়ি আসে জল খেতে। ওর মা কে এত কাজ করতে দেখে রেগে যায়।
"দেহা-পিটিত বিষ হোউক তো তোর। সেলা এলায় কোঁকাইস। থো হুলা। হামরা দুই ভাই দিমো এলায়।"
"তোমরা তাঙ্কুবাড়িতে যে খাটেছেন! সোমায়ে নাই। দ্যাং আস্তে আস্তে করি। পাইম ঝুনি। না বিষায়।"
বিষেণের বরাবরই রাগ বেশি। কিছু না বলে মায়ের হাথ থেকে বালতিটা নিয়ে দড়ি খুলে উঠোনের একপাশে রেখে দিয়ে যেতে যেতে বলে,
"হামরা এলায় আতি আতি দিমু।"
রসবালা আপনমনে বলে, এমন ঠান্ডাখানোত!
কথাটা বসমতী তখন খুব একটা ভুল বলেনি। তিনবিঘা জমির তামাক কাটা কম কথা নয়! সুপেন আগে ছেলেদের নিয়ে গমটা কেটে ফেলে। রসবালাও গমক্ষেতে একসঙ্গে কাজ করে। তাতেই তামাক কাটার সময় হয়েই আসে।
চৈত্র মাস। সুপেন একটু কচি দেখে বাঁশ কেটে ছোট ছোট টুকরো করে জলে ভিজিয়ে রাখে। পরের দিন জল থেকে তুলে বিকেলবেলা বসেছে বাড়ির উঠোনে। পাতলা করে আঁশ তোলার জন্য। সুরেন দেখে বলে,
"তাঙ্কুখান কাটিবেন? তেওয়াল তুলেছেন?"
সুপেন মাথা নাড়ে। তারপর বলে,
"কেনে তে কাকা?"
সুরেন চিন্তিত মুখে বলে,
"বাউটাক কয়টাদিন হাজিরা নিবার চাছোং।"
সুপেন বলে,
"একঝোনকাক নেক। হামরা তিনোঝনে পামু আস্তে আস্তে।"
সুরেন একটু আস্বস্ত হয়। বলে,
"তে ছোটো বাউটাকে পেটাইস। আছে উয়ায়? আছে তে মুয়ে এদি কয়া গেনু হয়!"
সুপেন গলায় তিচ্ছিল্য এনে বলে,
"উয়াক কী এলা পান তোমরা! ওয় কোটে হাডুডু খেলা হবে তারে না মিটিং বসাইসে কোটে বা যায়া। তোমরা যাও, মুই কইম এলায়। কী গম ডাঙের না?"
সুরেন সমর্থনের সুরে বলে,
"হ্যাঁ বাপোই। ওই গমখানে ডাঙের মানষি না পাছোং। সোগায় তাঙ্কুবাড়িত খাটেছে।"
পরদিন ভোর থেকেই শুরু হল তামাক কাটা। সকাল সাড়ে সাতটা অবধি তামাক কেটে বিষেণ হাজিরা কাজে রওনা হল। সুপেন, সুষেণকে মাঠে রেখে রসবালাও বাড়ি এল। চা করে ছেলেকে দিয়ে তামাক ক্ষেতেই গ্লাসে করে চা নিয়ে গেল। সবাই চা-টা গলায় ঢেলেই আবার তামাক কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বেলা প্রায় নটা পযর্ন্ত পাতা কেটে চৈত্রের কড়া রোদে শুকানোর জন্য পাতাগুলি ফেলে রাখল। বিকেল হতেই আবার তামাক ক্ষেতে। পাঁচটা করে পাতায় একটা আঁটি তৈরি করে বাঁশের তেওয়াল বা পাতলা আঁশ দিয়ে বেঁধে সার সার করে ফেলে রেখে রেখে দ্রুত হাত চালিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে সুপেনরা। সবগুলো পাতা আঁটি বাঁধা হয়ে গেলে এ বেলাটা বিশ্রাম। আবার রাতে।
রাত্রিবেলা রসবালা আর গেল না। রান্না বসাল। রাত ন'টার দিকে আবার তিন বাপ-ব্যাটা মিলে কূপি নিয়ে তামাকপাতা তুলে আনতে গেল। সঙ্গে বড় বড় তিনটা খাচারি। যেতে যেতে সুপেন আপন মনে বলে,
"নানানখান ভেজাল এখেরে তাঙ্কুত। দুপুরিয়া ওউদোত মড়মড় করি শুকাও, সোইন্দাত আরো পচ্চিয়া বাওয়োত ঠান্ডা করি তবেসিনি ঘরোত আনো।"
সুষেণ নির্বিকার কন্ঠে বলে,
"এত ভেজাল মনে করিছিত তে দুপুরে না মড়মড়াতে আনির পালু হয়, ভাঙিয়া গুন্ডা হইলেক হয় তে হইলেক হয়।"
সুপেন ধমক দেয়।
"তোর খালি আগখান। মুই কি কছোং ভেজাল? সেই কছোং।"
তারপর হাঁটতে হাঁটতে বলে,
"এইলা আজি নিগি থুয়া কালি আরো শুকির দিবার নাইগবে। বোন্টাটা তো একেদিনে শুকায়কে না। ওউদোত দ্যাও, ঘরোত থও, আরো ওউদোত দ্যাও। আরো ফির হুলা ভুঁই কাটির নাইগবে।"
সুষেণ আর কিছু বলে না। সত্যিই খুব ঝামেলার কাজ। বিষেণ বলে,
"সুকারুদাঘর তো দেখোছোং চাটিতে ঝুলি থুসে।"
"উমার অল্প থাঙ্কু যে। একপোয়া মাটির ভুঁই। হামার এতলা কোটে থুইস!"
সুপেন এই অবধি বলে একটু থামে। কী যেন ভাবে। তারপর বলে,
"বেচেবার সোমায়ও উমরা হাট-বাজারের ধার ধারে না অত। বাড়িতে পাইকারোক দিয়া দেয়। বাড়িত দিলে লস। দাম কম কয়।"
সুষেণ বলে,
"অল্প তাঙ্কু তো হয়। সুকারুদা কনেক আলসিয়াও আছে। হাট-বাজার যাবারে না চায়। দেখিস না যেদি মানষির ভিড় উয়ায় ওদি মুয়ায়ে না!"
বিষেণ বলে,
"এই দা এইবার তোর ভ্যানখান ধরি হামরা দোনোভাইয়ে যামু ধূপগুড়ি হাট। বাবাক নানাগে।"
সুপেন ধমক দেয়,
"তোমরা সেলা পাইকারের সতে কাথা কবার পাবেন?"
তারপর একটু থেমে বলে মুই একেলায় সাইকোলোতে ধূপগুড়ি হাট নিগাসুং তাঙ্কু।"
ক্ষেতে নেমে চটপট তামাকের আঁটিগুলো সাবধানে খাচারিতে তুলতে তুলতে ওরা পুরনো প্রসঙ্গেই কথা বলতে থাকে। সুপেন বলে,
"হরেন পিসাক দ্যাখ তো। এই বসোতো কেমতোন টনটনা। হামার থাকি কত বড়। হর দেখেক ভারোত করি তাঙ্কু সাজে নিবে। উপরোত এখেরে যত্তন পত্তন করি বিষকাঁটালির গছের পাত ঢাকা দিয়া কুন ভোর থাইকতে বেরেয়া এতখান আস্তা কেমন হাঁটি যায় হাট।"
"কুন ভোরে বলে! ওতো ভোরে যাবার দোরকার কুনটা। হাটটা কি পালে যাছে!"
সুপেন হাসে। গলায় তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলে,
"ওই তো বাবারে। তোমরা আর কি বুজিবেন। বেশি ওউদোত তাঙ্কু শুকিয়া মড়মড়া নাগিবে। কেজিতে মেলা ওজন কমি যাবে। ওই ভয়োতে তো হরেন কাকা এখেরে আন্দাসাতে বিরায়। বেলা উটার আগোতে হাট পোঁহুছি যায়। ওজোনটায় যাহাতে না কমে, উপরোত বিষকাঁটালির গছ হোউক কি পাত হোউক ঢাকা দিয়া নিগির নাগে। হাটখেনা যাইতেও কত ফেষ্টি করির নাগে।"
ইতিমধ্যে দুটো খাচারি ভরে দুই ছেলের মাথায় তুলে দেয় সুপেন। বাড়িতে ওর মা নামানোর সময় ধরবে একজনকে। ওরা চলে গেলে আর একটা খাচারিতে তামাকপাতা তুলতে থাকে সুপেন। শোনা যাচ্ছে এবার তামাকের দাম সেরকম নেই। এত কষ্ট! বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ভাবছে মেয়ের বিয়ের সময় যে জমিটা বন্ধক দিয়েছে ওটা ছাড়াবে। পারবে কিনা কে জানে। এগুলোও বন্ধক ছিল। তিন বাপ-ব্যাটায় হাজিরা করে লোকের বাড়ি কাজ করে, সুষেণ ভ্যান চালিয়ে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে ছুটি করেছে। তবু মেয়েটা ভালো আছে। জামাই তো ভালোই, শ্বশুর-শাশুড়িও ভালো। সবার এমন কপাল হয় না। জমি বেচে, বন্ধক দিয়ে বিয়ে দিয়েও কতজনের মেয়ে শ্বশুর বাড়ির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়ি এসে যেতে চায় না। কান্নাকাটি করে। জোর করে পাঠাতে হয়। সেদিক দিয়ে সুপেনের মেয়ে সুশীলা ভালো আছে।
"তিন বিঘাতে হামার কয় মোণ তাঙ্কু হবে রে দা? তালে দক্ষিণের খোটুটা আর খালি বাকি আছে, ছাড়ালি হয়।"
সুপেনের মতোই বিষেণও ভাবছে! সুপেনই উত্তর দেয়,
"বিঘাপ্রতি দশ-বারো মোণ হয়। এলা হিসাব কর। তে তাঙ্কুর বোলে এইবার দামে নাই রে, সোগায় কছে।"
মোটামুটি তামাক পুরো শুকানো হলে সুপেন প্রথমে অল্প করে বিক্রি করবে ঠিক করল। দুটো খাচারিতে তামাক হাটের জন্য সাজাতে বসল। মোটামুটি দশটা ছোট আঁটি দিয়ে আবার নতুন করে বাঁশের 'তেওয়ালি' তুলে একটা করে নতুন আঁটি বাঁধল। রাতেই সব রেডি করে ঘরের মেঝেতে রেখে দিল। পরদিন অন্ধকার থাকতেই দুই ভাই খাচারিদুটো ভ্যানে তুলে নিয়ে হাটে যাবে। সুপেন মনে মনে একটু স্বস্তিবোধ করে। এখন ছেলেদুটোর উপর ভরসা করা যায়। বয়স হচ্ছে। আর কী চাই!
তথ্যসংগ্রহ - ধনেশ্বর রায়(মনা), খগেন হাট, ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার।
................................................................
আটমাসিয়া - বর্ষাকে চারমাস ধরা হয়। বাদবাকি সময়কে বলে আটমাস বা বৃষ্টিহীন সময়টা।
নুলি পড়া - এলিয়ে পড়া
বিলাতী আলু - গোল গোল দেশি আলু
ঘুঁই - আলুগাছের এক একটা সারিকে এক একটা ঘুঁই বলে।
চাটি - বেড়া
মুয়ায়ে না - মুখ দেখায় না বা মোটে যায় না অর্থে।
বসোতো - বয়সেও
ভারোত - ভার বা বাঁকে
আন্দাসাতে - অন্ধকার থাকতে
বিষকাঁটালি - পুকুর শুকিয়ে গেলে একধরণের গাছ হয় ব্যথা বেদনা সারাতে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই গাছটাই পাতাসুদ্ধ তামাকের উপর ইচ্ছাদন হিসেবে দেওয়া হয়।
ছবি - রীতা রায়