কিলকট এবং নাগেশ্বরী টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
কিলকট এবং নাগেশ্বরী টি গার্ডেন
গৌতম চক্রবর্তী
-----------------------------------------
মেটেলিতে গুডরিকস বা ডানকানস চা বাগিচাগুলি নিয়ে কিছু লেখার আগে প্রথমেই একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। সেটা হল মেটেলি জনপদ গড়ে উঠেছিল চা আবাদকে কেন্দ্র করেই এবং চা আবাদ পরিচালনার অন্যতম পরিচালকগোষ্ঠী গুডরিকস এবং ডানকানস পরিচালিত অনেকগুলি বাগান আছে মেটেলি সার্কিটে। চিলৌনি, চালসা, আইভিল গুডরিকস গ্রুপের বাগান যারা গুণগত মানের চা উতপাদন করে। আবার ডানকানস গ্রুপের বাগিচা কিলকট এবং নাগেশ্বরির কথা যত কম বলা যায় তত ভালো। মেটেলি ব্লকের বাগিচাগুলির সমীক্ষা করার পর এক অদ্ভূত আনন্দ এবং বিষাদের অনূভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। বিষাদ এইজন্যই যে কিলকট এবং নাগেশ্বরী চা বাগানের ভয়ঙ্কর রূপ দেখলাম। আবার আনন্দ পেলাম এইজন্যই যে চালসা, মেটেলি, আইভিল, এঙ্গোর মতো গুছানো বাগান দেখে মন ভরে গেল। ডানকানস গ্রুপ অব টি ইন্ডাস্ট্রিজ তরাই এবং ডুয়ার্সের বাগিচা শিল্পের এমন কোম্পানি যাদের চা শিল্প এবং বাণিজ্যের সুখ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে সুদূর বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল এককালে। ডানকানস গোয়েঙ্কারা দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গের চা শিল্পের অন্যতম প্রধান স্টেক হোল্ডার। কোম্পানির টি প্ল্যান্টেশন ডিভিশনের মালিকানায় ১৫ টি বাগান আছে। উত্তরবঙ্গের তরাই ডুয়ার্স এবং দার্জিলিং এর প্রায় আট হাজার হেক্টর আবাদি জমিকে কেন্দ্র করে ডানকানের চা সাম্রাজ্য। বছরে প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ কেজি মেড টি প্রস্তুত করতে সক্ষম এই চা সাম্রাজ্য। চা শিল্পের অবস্থা এবং শ্রমিক শ্রেণীর আর্থ- সামাজিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে পৌঁছেছিলাম ১৮৭৫-৭৬ সালে গড়ে ওঠা বাগরাকোট টি এস্টেটে। তারপর ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে করতে একসময় কখন যে সবকটা বাগানে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে ফেলেছি নিজেও খেয়াল করিনি।
মালবাজার মহকুমার কিলকট এবং নাগেশ্বরী টি গার্ডেনটি যখন ১৯১৭ সালে সমীক্ষা করেছিলাম তখন পরিচালক গোষ্ঠীঞ্ছিল ডানকানস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন এর আগে বেশ কয়েকটি ছিল। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর ট্রেড ইউনিয়নের প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত দেখেছিলাম। বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৫ জন। বাগানের স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন ছিল প্রোগ্রেসিভ টি ওয়ার্কাস ইউনিয়ন। কিলকট চা-বাগানের আয়তন ৬৩৬.৪৬ হেক্টর, নাগেশ্বরী চা বাগানের আয়তন ৯৪৬.১৯ হেক্টর। কিলকটের চাষযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৪৪২.৩১ হেক্টর। এক্সটেনডেড জমির পরিমাণ জানা যায়নি। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৭১.৬৩ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ৪৩০.৪৩ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদীক্ষেত্র ৪৩৭.৫৭ হেক্টর। উৎপাদনযোগ্য এবং ড্রেন ও সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে প্রতি হেক্টর জমি পিছু ১৬৯৭ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। নাগেশ্বরীর সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ৬২৯.৫৭ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদীক্ষেত্র ৬২৯.৯২ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ১৭৩৫ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়।
কিলকট চা-বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ৯০ জন। করণিক ৭ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ১৬ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৬১৬ জন। মোট জনসংখ্যা ৪৫০০ জন। স্থায়ী শ্রমিক ৮৯৯ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ২১৫ জন। কম্পিউটার অপারেটর একজন। সর্বমোট সাব স্টাফ ৯০ জন। ক্ল্যারিক্যাল, টেকনিক্যাল শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ২৭ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১২৩১ জন। শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৩২৬৯ জন। নাগেশ্বরী চা বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ১১৭ জন এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ১৭ জন। শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৬৫৯। মোট জনসংখ্যা ৫৫০০। স্হায়ী শ্রমিক ৮৫০ জন। কম্পিউটার অপারেটর ছিল ৫ জন। সর্বমোট সাব স্টাফ ১৮০ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১০৯২ জন। বাগিচার অ শ্রমিক সদস্যদের সংখ্যা ৪৪২৮ জন। কিলকট চা-বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত চা ৩০-৩৪ লক্ষ কেজি এবং ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চা ৭-৮ লক্ষ কেজি। বহিরাগত বাগান থেকে সংগৃহীত এবং কেনা কাঁচা চা পাতায় প্রস্তুত বিক্রয়যোগ্য চায়ের পরিমাণ গড়ে ১০০০০ কেজি। ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চায়ের পরিমাণ ৭.৫ - ৮ লক্ষ কেজি। উৎপাদিত চায়ের প্রকৃতি অনুযায়ী এই বাগানে ইন অরগ্যানিক সিটিসি কোয়ালিটি চা উৎপাদিত হয়। নাগেশ্বরী চা বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত চা গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ কেজি। ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত চা এর মোট বিক্রির পরিমাণ ১০ থেকে ১২ লাখ কেজি। উৎপাদিত চা এর প্রকৃতি অনুযায়ী বাগিচায় ইনঅরগানিক সিটিসি চা প্রস্তুত হয়। বাগানটি চরিত্রগত দিক থেকে উন্নতমানের হলেও পরিকাঠামোহীন হয়ে পড়ার ফলে আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। ফলে মাঝেমধ্যেই মজুরি সংকটে বাগানটি সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। এই বাগানটি ডান এবং বাম শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার।
১৮৫৯ সালে স্কটিশ ব্যবসায়ী প্লে ফেয়ার ডানকান চা ব্যবসার জন্য ডানকান এন্ড কোম্পানীর পত্তন করেন। বিদেশের বাজারে উৎকৃষ্ট চা রপ্তানি করার ক্ষেত্রে কোম্পানি সুনাম অর্জন করার ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ডানকানস ইন্ডিয়া লিমিটেড চা শিল্প সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অত্যন্ত সুখ্যাতি লাভ করে। ১৯৫৯ সালে গোয়েংকা পরিবারের প্রাণপুরুষ কেশবপ্রসাদ গোয়েংকা ডানকান ব্রাদার্স কিনে নিলেন। গোয়েংকা পরিবার ক্রমে ডানকান গোয়েঙ্কা নামে পরিচিতি লাভ করলো। চা বাগিচা, চা শ্রমিক বা মালিকপক্ষ যতই সমস্যাতে পড়ুক না কেন, ডানকান গ্রুপের বাগানগুলির সমস্যা যেন অনেক বেশি। এই রকমই বাগান নাগেশ্বরী এবং কিলকট যেগুলি মালবাজার সাব ডিভিশনের মেটেলি ব্লকে অবস্থিত। মেটেলিতে প্রথম চা বাগানটি সঠিক কোন বছর তৈরি হয়েছে তা জানা না গেলেও নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায় ১৮৭৪ সালের মধ্যে প্রথম যে ৪৭ টি বাগান গড়ে ওঠে তার অধিকাংশ ছিল মেটেলি পাহাড়ে এবং মালিকানায় ছিল ডানকান ব্রাদার্স। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ছবিটা সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রমী। বাগরাকোটের পাশাপাশি নাগেশ্বরী এবং কিলকট এই দুটি চা বাগিচাতে পরিস্থিতি ভয়াবহ। বাগিচাগুলিতে ওষুধের সরবরাহ কার্যত বন্ধ। বাগিচাগুলিতে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসারের কার্যত কোন ভূমিকাই নেই। বাগিচায় ক্রেশ থাকলেও ধোয়া কাচার ব্যাবস্থা, শিশুদের দুধ,খাবার অথবা গরম পোশাকের ব্যাবস্থা নেই। পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থাও বিঘ্নিত। বাগরাকোট, কিলকট বা নাগেশ্বরী কোন জায়গাতেই কিন্তু ক্রেশগুলিকে স্ব্যংসম্পূর্ণ মনে হয় নি। নাগেশ্বরীতে দেখলাম বাগিচায় আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকা বাড়ির সংখ্যা ৬৫৯ টি। বাগিচায় শৌচাগারযুক্ত বাড়ি মাত্র ৩৫৬ টি। বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাস প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। শ্রমিক সংখ্যা ১০৯২ জন। বাগানে শতকরা ৪০% শ্রমিক আবাসন আছে বসবাস করার উপযুক্ত।
প্রকৃতপক্ষে বাংলার চা শ্রমিকদের মজুরি ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই অন্যান্য সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের মজুরির থেকেও কম। গত দেড়শ বছর ধরে ওদের মজুরি যা ছিল বা আজও যা আছে তা শুধু বাংলা নয়, সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতেও একই অবস্থা কমবেশি। তবে সুযোগ সুবিধা প্রদানের প্রশ্নে বাংলায় শোষণের হার অনেক বেশি। চা শিল্প যখন গড়ে উঠেছিল তখন ওদের কত মজুরি দেওয়া হতো তা জানা যায় না। গুল্মলতা, কাঁটার জঙ্গল, স্যাঁতসেঁতে ঘন অন্ধকারে আবৃত জঙ্গলে যে কঠিন কাজ শ্রমিকেরা করত তার মজুরী কত নির্ধারিত হয়েছিল তা জানা দুষ্কর। বাংলায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কোন মহিলা ও শিশু এই কাজে আসেনি। জঙ্গল পরিষ্কার করে শ্রমিক নিয়োগের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে চা-করেরা আবিষ্কার করেছিল এই শিল্পে সমস্ত শ্রমিক পরিবারকে পরিবারভিত্তিকভাবে নিয়োগ করা যাবে এবং কম পয়সা দিলেও চলবে।
পরীক্ষামূলকভাবে যখন চা শিল্পে মহিলাদের নিয়োগ করা হয় তখন জানা যায় মহিলা শ্রমিকরা পুরুষদের থেকেও ক্ষিপ্রগতিতে পাতা তুলতে পারে। সুতরাং মহিলা শ্রমিক নিয়োগ আবশ্যক হয়ে ওঠে। কিন্তু মহিলারা ভালো কাজের হলেও দীর্ঘ একশো বছর পুরুষের চেয়ে কম বেতন পেয়েছে। এরপর কিশোর কিশোরী এবং বালক ও বালিকাদের নিয়োগ করা হয়। শিশু শ্রমিকদের মজুরি ছিল আরও কম। সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে।
স্বাধীনতার পরেও চা বাগিচাগুলিতে শোষণের হার এতটাই তীব্র থাকবে একথা ধারণা করা যায় নি। চা শিল্পের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত চা-করেরা সবসময় বলে চা শ্রমিকদের মাসিক আয় সবচেয়ে বেশি। কারণ ওদের মজুরি ছাড়াও বাড়তি কাজ করলে বেশি পয়সা। তাছাড়া ওদের বিনা পয়সায় থাকার ঘর দেওয়া হয়, জ্বালানি দেওয়া হয়, কোয়ার্টার সংলগ্ন জমিতে সবজি, ফল চাষ এবং হাঁস, গরু মুরগী পালন করে ওরা আরও আয় করে। অনেক সময় ওদের জমি দেওয়া হয়েছে ধান চাষের জন্য। তাছাড়া ওদের জন্য ছিল এবং আছে চিকিৎসা ও বিনা পয়সার ওষুধ। ওদের পরিবার সন্তান প্রসব করলে দেওয়া হত মেটারনিটি সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা। চা করেদের বক্তব্য এত সুযোগ সুবিধা অন্য কোন বাগানে নেই। কিন্তু চা বাগিচাতে সুযোগ সুবিধার কথা যদি ওঠেই তাহলে শোষণের চিত্রটা দিবালোকের মতোই চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তাই তো পিঁপড়ায় খায় লাভের গুড়, মজুরী চুক্তি বহুত দূর। তবে বাগিচাগুলিতে স্কুলের শিশুদের পৌঁছাবার এবং নিয়ে আসার জন্য বাগিচার বাস যায়। কোন কোন বাগিচায় ট্রাক অথবা ট্রেকারের মাধ্যমে পড়ুয়াদের বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বাগানে ক্লাব এবং খেলার মাঠ বা হাসপাতাল আগে ছিল। এখন এগুলি ভাঙাচোরা পোড়োবাড়ি ছাড়া কার্যত আর কোন কিছুই নয়।
একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায় ব্রিটিশ আমলে নানা অছিলায় শ্রমিকদের মজুরি কেটে নেওয়া হতো। মজুরি পাবার পর এক পয়সা করে সর্দারদের কমিশন দিতে হতো। শ্রমিকেরা অজ্ঞ এবং অশিক্ষিত হওয়ার ফলে মজুরি কম দিলেও ওরা ধরতে পারতো না। পাতা তোলার মরশুমে নির্দিষ্ট কোটার চেয়ে বেশি পাতা তুললে ওদের বেশি পয়সা দেওয়া হত। পাশাপাশি পাতা তোলার ওজন কম দেখিয়ে ওদের কম মজুরী প্রদান করে শোষণ করা হত। শোষণের এই চিত্রের সামান্যতম হেরফের হয়নি। পাতা তোলার মরসুম ছাড়া অন্য সময়ে ওদের বেশি মজুরি পাবার সুযোগ থাকত না। কাজের কোনো নিয়মনীতি ছিল না। অধিকাংশ সময়ে শ্রমিকদের বেশি সময় ধরে কাজ করতে হতো এবং কাজ বন্ধ থাকলে মজুরি কাটা যেত। ছুটির দিনে কোন মজুরি দেওয়া হতো না। অধিকাংশ দিনেই বেগার খাটতে হতো। চা শিল্পে অর্ধশতাব্দী ধরে একই মজুরি দেওয়া হয়েছে।
কিলকট এবং নাগেশ্বরী চা বাগিচায় হাসপাতাল বা আলাদাভাবে পুরুষ এবং মহিলা ওয়ার্ড এর ব্যবস্থা আছে ঠিকই, কিন্তু ক্ষেত্রসমীক্ষার সময়ে গিয়ে কাউকে চোখে পড়লো না। স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে যখন কথা বললাম তখন জানলাম ওয়ার্ডের ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে কোন বেড নেই। মেটারনিটি ওয়ার্ড থাকলেও রোগীরা আসে না। তাদেরকে স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালের একটিমাত্র অ্যাম্বুলেন্স এর সামনের টায়ার পাংচার অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম। কর্তব্যরত চৌকিদারের কাছ থেকে জানতে পারলাম স্বাস্থ্য পরিসেবার হাল ভয়ংকর খারাপ। বাইরে চিকিৎসার জন্য শ্রমিকদের রেফার করে দেওয়া হয়, অথচ তাদেরকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য কোন অ্যাম্বুলেন্স অথবা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। বাগিচায় ডাক্তার আছে ঠিকই, তবে কি চিকিৎসা পরিষেবা তিনি দেন তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কারণ বাগিচায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ করা হয় না বলে স্বাস্থ্যকর্মী নিজেই জানালেন। নাগেশ্বরী বাগিচায় প্রশিক্ষিত নার্স একজন মাত্র। কোন মিড ওয়াইভস চোখে পড়ল না। স্বাস্থ্য সহযোগীর নাম মুরলীধর। বাগিচায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। অধিকাংশ মেটারনিটি রোগীদের চালসা অথবা ইনডং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেফার করে দেওয়া হয়। নাগেশ্বরী বাগানে ডাক্তারের দেখা পেয়েছিলাম। তিনি পাঁচ বছর ধরে বাগানেই আছেন। নাগেশ্বরী বাগানের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় তিনিই দেখাশোনা করেন। বাগিচার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি কোনোরকম কথা বলতে প্রাথমিক অবস্থায় নারাজ ছিলেন। পরবর্তীকালে উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বলাতে তিনি যে তথ্য সরবরাহ করলেন তার সঙ্গে বাস্তবের প্রতিফলন অনেকটাই কম।
কিলকট চা-বাগানটির লিজ হোল্ডার ডানকান্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ব্যাঙ্কের কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ কিনা বা বাগান পরিচালনার জন্য মূলধন কোথা থেকে আসে এই বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায় নি। কর্তৃপক্ষের তথ্য গোপন করার মনোভাব সন্দেহ সৃষ্টি করে। মোট শ্রমিক আবাস ৬১৬। শ্রমিক সংখ্যা ১২৩১ জন। বাগানে শতকরা ৫০ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। শ্রমিক কল্যাণে কোনও খরচই কার্যত করে না ডানকানস কর্তৃপক্ষ এই কিলকট চা বাগিচায়। বাগিচায় শ্রমিক আবাসে শৌচাগারও নেই বললেই চলে। বাগিচায় একটি হাসপাতাল থাকলেও ক্ষেত্রসমীক্ষার সময়ে একজনও রোগী ছিল না। তাছাড়া সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার ফলে কাউকে পাওয়া যায়নি। সমীর কেরকেট্টা, বিশু হাঁসদা এবং বাগানের অস্থায়ী চৌকিদার লছমন সোরেনের কাছ থেকে জানা গেল মেল ওয়ার্ড বা ফিমেল ওয়ার্ডও আছে। বেডও আছে ভাঙাচোড়া হলেও বেশ কয়েকটি। পাংচার হয়ে যাওয়া, জানালার শার্সিবিহীন একটি অ্যাম্বুলেন্সও নজরে পড়ল। সমীর জানাল হাসপাতালে কোনও পরিষেবাই দেওয়া হয় না, ইনডং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা এমবিবিএস ডাক্তারও ছিলেন বাগিচায় জানা গেল। তবে বেশ কিছুদিন হল ছুটিতে থাকায় ক্ষেত্রসমীক্ষার সময়ে তাকে পেলাম না। বাগিচায় দু’জন প্রশিক্ষিত নার্স আছে, এদের মধ্যে একজন মিড ওয়াইফ। একজন করে হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। কিলকট চা-বাগিচায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ হয় না। মেটারনিটির সুবিধা পাওয়া নারী শ্রমিকদের নিকটবর্তী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অথবা মহকুমা শহর মালবাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নাগেশ্বরীতেও দেখলাম বাগিচার ডাক্তারবাবুরা কোনরকমভাবে এখনো স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে চলেছেন। তবে বর্তমানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি থেকে ওষুধ এবং মেটারনিটি সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সম্প্রসারিত করা হয়েছে।
কিলকট বাগিচায় ক্রেশের সংখ্যা ২ টি। পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা নেই। ক্ৰেশে শৌচাগার নেই। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের সরবরাহ করা হয় না। ক্ৰেশে নিয়মিত পোশাক দেওয়া হয় না। পানীয় জল অস্বাস্থ্যকর এবং ব্যবহারযোগ্য নয়। ক্ৰেশে মোট অ্যাটেনডেন্ট ৪ জন। নাগেশ্বরী চা বাগানে গিয়ে বুঝতে পারলাম মেটেলির অন্যতম এই বাগানটির ভিত্তি ডানকানসের হাতে স্থাপিত হলেও তাদের উত্তরসূরী গোয়েঙ্কারা একেবারেই ছিবড়ে করে দিয়েছে। বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই দীর্ঘদিন থেকেই। ভাঙ্গাচোরা বিধ্বস্ত ক্রেশের সামনে গিয়ে শিশুদের অসহায় চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছিল। শ্রমিকদের কাছ থেকে জানতে পারলাম ক্রেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা থাকে না। শৌচাগার নেই। দুধ বিস্কুট, পুষ্টিকর খাবার শিশুদের সরবরাহ করা হয় না, পোশাক দেওয়া হয় না। পানীয় জলের বন্দোবস্ত নেই। চারজন অ্যাটেনডেন্ট থাকলেও খুব স্বাভাবিক কারণেই বাগিচা শ্রমিকেরা তাদের শিশুদেরকে না পাঠিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করে কাজে যান ।বাগিচায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। তবে পার্শ্ববর্তী মেটেলিতে আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম মেটেলি হাইস্কুল। সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা আছে। তবে তা সচল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। মাঝেমধ্যেই বাগিচার একমাত্র বাসটি বিগড়ে থাকে। তখন শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের বিদ্যালয়ে নিজেদের উদ্যোগেই যেতে হয়। তবে শ্রমিক পরিবারের সন্তান বাবলু হেমব্রম জানালো, যেহেতু মেটেলি হাইস্কুল খুব একটা বেশি দূরবর্তী নয়, তাই তারা সাইকেল নিয়েই যাতায়াত করে।
কিলকট চা-বাগিচাতে কার্যত শ্রমিক কল্যাণসাধনে কোনও ভূমিকা নেই বলে অভিযোগ ট্রেড ইউনিয়নগুলির নেতৃত্বের।
কিলকট চা-বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় মোটামুটি দূরত্বে। বিদ্যালয়ের নাম চালসা গয়ানাথ উচ্চতর বিদ্যালয় এবং মেটেলি হাইস্কুল। দুটিই বাংলা মিডিয়াম। আছে একটি হিন্দী মিডিয়াম স্কুলও শ্রমিক-সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেওয়ার জন্য। যানবাহন হিসাবে একটি বাসের ব্যবস্থা আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব এবং খেলার মাঠ আছে। কিলকট চা-বাগিচায় বাৎসরিক বোনাসের হার ২০ শতাংশ। মোট শ্রমিক ১২৭৪। গড়ে বছরে ৫০ লক্ষ টাকা বোনাস প্রদান বাবদ ব্যয় করা হয়। কিলকট টি গার্ডেনে ডানকানস কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বিনিয়োগ করা টাকা প্রভিডেন্ড ফান্ড খাতে জমা নিয়মিত করে না। বাগিচায় মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রভিডেন্ড ফান্ডের অর্থই ঠিকমতো দেওয়া হয় না। বকেয়া প্রভিডেন্ড ফান্ডের মোট অর্থ কত তা জানা না গেলেও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের অভিযোগ অনুযায়ী প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। তাদের অভিযোগ মজুরিও চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয় না। শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া থাকে প্রায়শই। রেশন বকেয়া থাকে মাঝে মাঝে। শ্রমিকদের জ্বালানি/চপ্পল/ছাতা/কম্বল নিয়মিত সরবরাহ করা হয় না। বকেয়া মজুরির এরিয়ার দিতে গড়িমসি করে কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটির অর্থ প্রায়শই বকেয়া থাকে। এমনকি মৃত্যুও হয়ে যায় অনেক শ্রমিকের। তা-ও তারা গ্র্যাচুইটি পায় না বলে অভিযোগ। মেটেলি সার্কিটের চা বাগিচার সমীক্ষা প্রায় শেষ করে ফেলেছি। কিন্তু কিলকট এবং নাগেশ্বরী বাগান পরিক্রমা করে আর পা দিতে ইচ্ছা করেনি এই বাগানে। তাই চার বছর পরে যখন লিখতে বসলাম তখন ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এইজন্যই যে এগুলো কিন্তু আপডেট অথ্য নয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴