শালসিড়ি-৩৪
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
মাইল… মাইল… হেই হাতি মাইল…
বিরক্তি
সহকারে হাতিটিকে সামনের দিকে নিতে চায় মাহুত, হাতিটি কিছুতেই এগোতে চায়
না। চড়াই উতরাই বনভূমির একটা চড়াইয়ে হাতিটি ডাঁই দাঁড়িয়ে পড়ে। জমির ঢালে
কাত হয়ে মাটি থেকে কী যেন তুলে খেতে চায় হাতিটি। পিছনে নিলয় টাল সামলাতে
হিমশিম খাচ্ছে। এই পড়ে কি সেই পড়ে যায় হাতির পিঠ থেকে। হাতিটি অনেকক্ষণ
কসরত করে কী একটা বুনো গাছের মূল তুলে নেয় শুঁড়ে তারপর আবার হাঁটা শুরু
করে।
গতকাল রাতে অভয়ারণ্য থেকে দুটো হাতি চলে
এসেছে বুলবুল নাইনে। বিকালে আবার দুটো হাতি আসবে জামতলা টাওয়ারে। গত কয়েক
দিনের টানা ডিউটির পর আজ ভোরের ডিউটিতে নির্মলবাবু আর তাপসের ডিউটি অফ।
বিকাশ হাতির পিঠে বসে ডিউটি করতে পছন্দ করে। কত দিন পর আবার এই টেরিটোরিয়াল
বনে হাতির পিঠে বসে বন খুঁটে দ্যাখার সুযোগ এল। বিকাশ এই সুযোগ হাতছাড়া
করতে চায়নি কিছুতেই। রাতে শুতে যাবার সময় বলে রেখেছে সুনীলকে ভোর হবার আগেই
যেন ডেকে দেয়। রাতে ঘণ্টা দুয়েক লম্বা হয়ে নিয়ে সূর্য ওঠার আগেই চলে আসে
বুলবুল নাইনে। বিকাশ নিলয় বুলবুল নাইনে পৌঁছানোর আগেই হাতিটি পেট্রোলিং গদি
করে রেডি হয়ে ছিল। বিকাশরা পৌছাতেই হাতিটি শুঁড় তুলে নমস্কার জানায়। মাহুত
লোহার অঙ্কুশটি হাতির কানে রেখে নমস্কার জানায়। বিনিময় সম্মান বার্তা
জানিয়ে, একটা আধা টঙ কোয়াটারের কাঠের রেলিঙের উপর দিয়ে বিকাশ নিলয় ওঠে বসে
হাতির উপরে। বিনিময় সম্মান বার্তা পোষা হাতিরা বেশ খেয়াল রাখে। মাহুত মাইল
বলে আবার ধাত্ বলে। হাতিটিএগোতে গিয়ে এমনভাবে ব্রেক কষে যে নিলয়ের কাঁধে
রাখা বন্দুকের নল বিকাশে মাথার পিছনে লাগে ঠক্ করে। ব্যাপারটা বুঝতে গিয়ে
দেখে, বুলবুল নাইনের বিটবাবু নিচে দাঁড়িয়ে আছে রাতের ডিউটির রিপোর্ট
জানাতে। আতঙ্কিত বিটবাবু বলে-
- স্যার রাতে নদীর পাড়ে একটা ছোট আলো দেখেছিলাম।
- পাখির চোখ হবে হয়তো। রাতে ফিশিং আউল, ঈগল নদীতে মাছ ধরতে আসে। তাদের চোখ দেখেছ হয়তো।
- না স্যার। আমরা তো সারা রাত কোন সার্চ লাইট জ্বালাইনি… কোন আগুন জ্বালাইনি।
- সেই আলোকে ফলো করেছিলে?
-
হ্যাঁ স্যার। সেখানে এই প্লাস্টিকের থলিটি পেয়েছি। দেখুন এর ভিতরে এখনো
কয়েকটি চিড়া আছে। মনে হয় রাতে নদীর পাড়ে কেউ খাওয়া-দাওয়া করেছে। আমরা তারপর
ঐ জায়গার কাছে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম বন্দুক লোড করে। আবার নদীতে এলেই
হতো মুখোমুখি লড়াই।
- ঠিক আছে, তোমরা এই বেলা রেস্ট কর।
মাহুত বলে- মাইল… মাইল… হাতিটি দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। হাতির দোলাচলে দুলে ওঠে শরীর মন…
- স্যার আজকে পার্টি ঢুকেছে। চলুন আজকে হাতে নাতে ধরব। কাবু বলে।
- ঠিক! তাহলে আমার সম্মান একটু বাঁচবে।
- কেন স্যার?
- আরে বিট প্রশিক্ষণের তিন মাস হয়ে গেল, নিজে হাতে একজন অপরাধী ধরতে পারলাম না। সদরে গেলেই সবাই একটু যেন কেমন করে তাকায়।
- আচ্ছা, আজকে তাহলে অপরাধী ধরতেই হবে।
বিকাশ
কাবুরা রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে অফিস থেকে। বন থেকে চা বাগানে বের হবার
তিন-তিনটি রাস্তা আছে। কাবুদের মধ্যে কোন রাস্তা দিয়ে বন থেকে কাঠ বের হবে
তা নিয়ে অল্প বিস্তর মত পার্থক্য হয়। এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা প্রাধান্য পায়।
কাবু বলে –
- জোড়া শাল গাছের কাছাকাছি বসতে হবে।
সেখানে চা বাগানের তার জালের বেড়া কেটে নতুন রাস্তা বানানো হয়েছে, বনে
ঢোকার। চা বাগান আর বনের সীমানাতে যে নালা কাটা আছে সেটার পাড়কে ঢাল করে
ঝোপের মধ্যে বসলে বনের রাস্তা দেখা যাবে এবং বুনো হাতির ভয় থাকবে না।
সবাই বনে ঢুকে বনের বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে ঝোপ ঝাড়ে ঢাকা সরু দণ্ডীতে ঢুকে পড়ে।
- রাস্তা দিয়ে গেলে হত না?- বিকাশ জিজ্ঞাসা করে।
- বড় রাস্তা থেকে এই রকম চোরবাঁটোতে গেলে সুবিধা হবে। - কাবু বলে।
- কেন?
- এই চোরবাঁটোতে সচরাচর হাতি আসে না। আর দূর থেকে আমাদের কেউ দেখতে পাবে না।
- কিন্তু এই চোরবাঁটোতে চোর আসতে পারে।
- রাস্তাটি দেখুন।
এই চোরবাঁটো অনেক দিন ব্যবহার হয় না। ঝরা পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় বুনোদের চলার চিহ্ন।
- এটা বনশূকরের এটা হরিণের ক্ষুরের দাগ। আর এটা চিতাবাঘের পায়ের ছাপ।
চোরবাঁটোর
মাঝে মধ্যে দুপাশ থেকে পুটুস (Lantana camera) এমন ভাবে ওভার ল্যাপ করে
সরু রাস্তাটিকে ঢেকে রেখেছে যে রাস্তাটি যেন একটা বন- সুড়ঙ্গ। সেই রাস্তায়
কখনো কোমর থেকে বেঁকে অর্ধেক হয়ে কখনো হামাগুড়ি দিয়ে বিকাশরা চলছে
নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এই সুড়ঙ্গে কাবুরা যেন কেমন করে হরিণের মতো চলে
যাচ্ছে। বিকাশ জীবনে প্রথম চোরবাঁটোতে চোর ধরতে যাচ্ছে। এই রাস্তায় যে শূকর
হাঁটে, বনে শূকর নাকি খুব ভয়ঙ্কর। তার উপর চিতাবাঘও হাঁটে। কখন যে কী ঘটে
কে জানে। মাঝে মধ্যে কাঁধে রাখা বন্দুক লতাতে আটকে গিয়ে বিকাশের চলার গতি
আরো আস্তে করে দেয়। বনের বাস্তব অভিজ্ঞতার শোনা কিছু কথা যেনে মনে ভয় নিয়ে
আসে। প্রশিক্ষণের সময় মানসে কাউকে কিছু না বলে বনে বাঘ দেখতে যে চলে
গিয়েছিল, তখন কোনো রকম ভয় লাগেনি। অজ্ঞতা মানুষকে বোকার মতো বিজ্ঞ করে
রাখে! বিকাশের মনে হয় কে যেন পিছন থেকে বিকাশকে টেনে ধরেছে!
- কে?
- কি হলো স্যার? কাবু আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
- কে যেন আমাকে পিছন থেকে টানল। কাবু দেখ, দেখ।
কাবু চিতাবাঘের মতো পিছনের দিকে ছুটে চার দিকে দেখে বিকাশের প্যান্টে লেগে থাকা কাটুসের কাঁটা খুলে দিয়ে বলে –
- না কেউ টানেনি। আপনি আগে আগে চলুন। তবে জীবনের প্রথম চোর ধরতে গেলে শব্দ করা যাবে না- স্যার।
বিকাশের
অবস্থা মরশুমি ঝোরার মতো। শুকনো ঠন ঠন করছে। কবে যে বর্ষা আসবে, জলে ভরে
উঠবে- একটা কাঠচোর নিজের হাতে ধরবে। কত কাঠ যে চুরি হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে
একটা বুনো শূকর তণ্ডু উঁচু করে বিকাশের দিকে গোত গোত করে এগিয়ে আসছে।
হামাগুড়ি দেওয়া বিকাশকে দেখে মনে হয় বুনো শূকরটি, মানুষ নয় অন্য কিছু
ভেবেছে। কাবু মনে মনে প্রমাদ গোনে। ভাবে স্যারকে পিছনে দিলেও বিপদ সামনে
দিলেও বিপদ। কাবু দুই ঠোঁট জোড়া করে উচ্চ কম্পাঙ্কে ভুরর ভুরর করে শব্দ করে
ওঠে। বুনো শূকরটা কেমন ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে ধড়ফড় করে ডানদিকে বনে ঢুকে যায়।
বিকাশের মনে হয় পুনেতে আর্মির প্রাথমিক প্রশিক্ষণের সময় বুবিট্র্যাপ বিছানো
পথে হাঁটার থেকেও চোর বাটোতে হাঁটা বেশী কঠিন। কানের তলায় কলারের তলায় লাল
পিঁপড়ের কামড়ায়, আঁকশি কাঁটায় হাত চিরে যায়। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হাঁটার পার
কাবু বলে-
- এইখানে বসতে হবে। সীমানা নালা বরাবর
ওরা এসে এই জায়গাটা পার হবার পর ডানদিকে বেঁকে এই ছিঁড়া তারজালের ফাঁক দিয়ে
চাবাগানে ঢুকবে। যদি আমার ধারণা ঠিক হয়।
কাবুরা সীমানা নালার বাঁধকে আড়ালে নিয়ে বনমারা দাঁতরাঙ্গা পুটুস গাছের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকে। কাবু বলে-
-
রাজু, গৌতম তোরা চারজন কিন্তু খুব সাবধানে কাজটা করবি। ওদের হাতে চপার
থাকে। যে মুহূর্তে ওরা আমাদের পার করবে, পিছন থেকে চিতাবাঘের মতো ঝাঁপিয়ে
পড়ে জাপটে ধরবি। যাতে ছাড়াতে না পারে। তোদের বয়স কিন্তু কম। তোদের মধ্যে
যার অসুবিধা হবে তাকে আমি সাহায্য করবো। বেশি বেগতিক দেখলে স্যার গুলি করে
অবস্থা সামলাবেন। ঠিক আছে। এখন আর কথা নয়।
কাবু
বিকাশরা ঝোপের আড়ালে আধ ঘণ্টা… এক ঘণ্টা… দেড় ঘণ্টা… দুই ঘণ্টা… বসে আছে
বোবার মতো। দূরে কাছাকাছি কোথাও মনে হয় সাপ ব্যাঙ ধরেছে। ব্যাঙ কাঁদছে আকুল
ভাবে বাঁচবার জন্য। ব্যাঙকে বাঁচানোর কেউ নেই এই বুনো যাপনে। এই যে
শালসিঁড়ির রাজ্যের অমোঘ নিয়ম। কাবু ফিস ফিস করে বলে- লক্ষণ ভালো। সবাই
সাবধান। সাপের কথা শুনে বিকাশের শরীর কেমন যেন শির শির করে ওঠে।
বনের
নানা জানা অজানা শব্দের মধ্যে হঠাৎ শুনতে পাওয়া গেল মানুষের কথা। কাবু
উঁকি দিয়ে দেখে আকারে ইঙ্গিতে বলে, শাহানশা আসছে। সামনে এক জন টানছে,
পিছনে দুই জন ঠেলছে। ওদের পথ দেখাতে সামনে আছে একজন। মনে হচ্ছে পালের গোদার
হাতে লাঠি বা চপার জাতীয় কিছু আছে।
মুহূর্তে
কী যেন ঘটে গেল। বিকাশ মা করে উঠল…পুটুস দাঁতরাঙ্গা বনমারা গাছের মাথাগুলো
চা গাছের মতো টেবিল হয়ে কেটে গেল… কাবুর বন্দুক থেকে গুলি ফায়ার হয়ে গেল…
ওরা ছয় জনেই চাবাগান এবং বনের সীমানার নালাতে আগুনহীন ফানুসের মতো পড়ে থকে।
লোকগুলো চার জন চারদিকে ধড়ফড় করে পালিয়ে গেল। বনের নীরবতা ভেঙ্গে গাছের
ডালে ডেকে ওঠে ময়ূর ময়ূরী- বিশ্রী ভাবে। ময়ূরের ডাকে সম্বিত ফিরে আসে
কাবুদের।
শাহানশার ওপরে চারটি কাঁচা শাল গাছের লগ।
শাহানশাটি উল্টে আছে নালার ওপরে। রাস্তার ওপর পড়ে আছে দুই-দিক ধারালো লম্বা
চপারটি। গৌতম রাজুরা টর্চ জ্বালিয়ে ফোকাস করতে থাকে চার দিকে। নীরবতা
ভেঙ্গে কাবু বলে-
- স্যার মালগুলো নিয়ে যেতে হবে।
- এখান থেকে তো মালগুলো নিয়ে যাবার রাস্তা নেই।
বিকাশ গলা ঝেড়ে কথা বলতে গিয়ে কেশে ওঠে। মনে মনে জল চায়। জল পাবে কোথায়। সীমানার নালা যে শুকনো- বিকাশের গলার মতো।
- চা বাগানের মধ্যে দিয়ে যাব, যে রাস্তায় ওরা নিয়ে যেত ঠিক সেই ভাবে।
সবাই
মিলে লেগেপড়ে ভ্যানটাকে সোজা করে কাঁচা শালের লগগুলোকে ভ্যানে লোড করতে।
টর্চ-এর আলোয় দেখা যায় লগের গা থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে। বিকাশের মনে হয় এ
যেন জল নয় রক্ত। শালসিঁড়ির রক্ত। এই রক্ত যেন জল না হয় তার জন্য রক্ত জল
করে কত কাবু। বিকাশ ক্রস বেল্টে বন্দুক পিঠে নিয়ে লেগে পড়ে লগ ভ্যানে লোড
করতে। বনে বিপদে বিজন বিভূঁইয়ে সব বনকর্মীর একটা ধর্ম- ফরেস্টর। কাবু বলে-
- আপনার বন্দুকটি রাজুকে দিয়ে দিন। এই চপারটি ধরুন। আমাদের আগে আগে চলুন। আমরা শাহানশা ঠেলছি।
- তোমরা ভ্যানটাকে শাহানশা বলছ। আমি এতক্ষণ ওদের দলের সর্দারকে শাহানশা ভাবছিলাম। কেন এই ভ্যানকে শাহানশা বলো?
কাবু
টর্চ- এর আলোয় দেখায় ভ্যানের চাকা, এক্সেল। মানুষ টানার ভ্যানের এক্সেল
থেকে এই ভ্যানের এক্সেল অনেক বেশী মোটা। চাকাতে দুটো রিং। এই ভ্যানেকে এই
রকম শক্ত পোক্ত করার কারণ হলো ভারী ভারী কাঠের লগ টানার জন্য। রাতে
অনেকগুলো টর্চ-এর আলো বন থেকে চা বাগানের দিকে আসছে দেখে, চাবাগানের লেবার
ওয়েল ফেয়ার অফিসারের বাংলোর সামনে জমা হয় অনেক লোকজন। রাজু বলে-
-
আমাদের মনে হয় এই রাস্তা দিয়ে না গেলে ভালো হয়। এই বাগানের লোকজন রাতে
নেশা-ভাঙ করে থাকে। হয়তো ঐ চোরেরা ওই লোকজন জমা করতে পারে। ওদের গায়ে যদি
বন্দুকের গুলির ছররা লেগে থাকে তা হলে উত্তেজনা আরো বাড়বে।
-
না আমরা এইদিক দিয়েই যাব। তা না হলে এই মাল ছেড়ে চলে গেলে আমাদের পারাজয়
হবে ওদের জয় হবে। ওরা এসে রাতেই এই মাল নিয়ে চলে যাবে। ওদের সাহস বেড়ে
যাবে। তারপর চাপা গলায় বলে- দেখছিস, স্যারের হাঁটার স্টাইল। মনে হচ্ছে হাতে
চপার নিয়ে চব্বিশ বছরের ছয় ফুট লম্বা টারজান হেঁটে যাছে। পিছন থেকে টর্চের
আলোর স্যারের ছায়া যেন ছেয়ে দিচ্ছে চা বাগান।
লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসারের বাংলোর সামনে পৌঁছানর পর পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব অফিসার বলে-
- স্যার, আপনি! এত রাতে।
বিকাশ
পিছনের শাহানশা দেখায়। ওয়েল ফেয়ার অফিসারের সমীহ অঙ্গভঙ্গিতে হাজির হওয়া
লোকজন চুপ করে দুই দিকে সরে যায়। বিকাশরা শ’খনেক লোকের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে
চলে যায়। একটা কালো টি শার্ট পরা যুবক এক অজানা ভাষায় কী যেন বলে তার
সাথীকে…
- ওই ছেলেটি কী বলছিল? - বিকাশ জিজ্ঞাসা করে।
-
ওরা বলছিল, আপনার হাতের চপারটি ওদের। আর ওরা ভেবেছিল, ও যে ভাবে চপার
চালিয়াছিল তাতে আমাদের কয়েক জনের অবশ্যই গর্দান যাবার কথা ছিল। আপনার এই
ভাবে রাতের বেলায় বাগানের মধ্যে দিয়ে মাল নিয়ে যাওয়াতে, আপনার সাহস দেখে
ওরা ঘাবড়ে গেছে।
- যা করলে তা তো তোমরা করলে।
-
না আমরা তোমরা নয় স্যার। আমরা সবাই। আপনি আমাদের নেতা। দেখলেন না, আপনাকে
দেখে বাগানের অফিসার কেমন সম্মান দেখাল। আপনি না থাকলে আমরা ওই বাগান পার
হতে পারতাম না। আপনি থাকতে পুরো ব্যাপারটি অন্য রকম হয়ে গেল। এরপর দেখবেন
এই বাগানের অপরাধীরা সবাই কেমন ভয় পাবে।
- কিন্তু আমার যে খরা কাটল না।
- স্যার ঐ ছেলেটার মুখটা মনের মধ্যে ভালো করে গেঁথে রাখুন।
- কেন?
- ও এসেছিল আপনার যম হয়ে। শীঘ্র আপনি ওর যম হবেন।
- কি ভাবে?
-
সে হবে একদিন। কিন্তু স্যার আপনি কেন তখন ঐ ভাবে ‘মা’ বলে উঠলেন। আমি
আপনাকে মুহূর্তে বাঁ হাতে দিয়ে টেনে নালায় ফেলে দিতে না পারলে আজ যে কী ঘটে
যেত!!! এক মুহূর্তে আমরা পড়ে গেলাম আর চপারটি সাঁ করে বয়ে গেল। দেখলেন
গাছগুলো কেমন সমান হয়ে কেটে গেছে- চা গাছের মতো।
-
কী যে হল। ঐ দিকে সাপে ব্যাঙ গিলছে। ব্যাঙ কাঁদছে। আমার মনে হল আমার হাতের
ওপর দিয়ে খুব ঠাণ্ডা মতো কিছু ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছে। আমি আকস্মিকতায় ‘মা’ বলে
ওঠি।
- যা হয়েছে ভালো হয়েছে। আমাদের শক্তি হল আমাদের
অভিজ্ঞতা। বনে দিনে রাতে টহল দেওয়া যত হালকা মনে হয় তত সহজ নয়। বনে
স্নায়ুর লড়াইয়ে জেতার শক্তি অর্জন করতে হয় এই রকমের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।
বিকাশ
মনে মনে বুলবুল নাইনের টিমকে সম্মান করে। সারা রাত কী অসাধারণ স্নায়ু
শক্তি নিয়ে টাস্কর হান্টারের আলোকরেখা বুকে চেপে অক্ষত ফিরে এল। এখন সে সেই
আলোক দিশারি ক্যাপ্টেনের হাতে…
ধাত্… মাহুতের আদেশে হাতিটি দাঁড়ায়। হাতিটি মাটি খুঁড়ে তুলে আনা গাছটির শিকড় চিবায়। মাহুত বলে –
- স্যার মনে হচ্ছে এইখানে হাতিটাকে মারছে।
দেখা
যায় বুলবুল নাইনের স্টাফরা যেরকম বলেছিল তার থেকেও বেশী ভয়ানক হয়ে আছে
বনের ভিতর বনের উঠোনটি। উল্টে পড়ে আছে মাঝারি মাপের চার পাঁচটি গাছ। রক্তের
দাগ বলে দেয় জয়ী বিজিতের কথা। একটা বড় কাইঞ্জল গাছের বাকল এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে
গেছে দাঁতালের দাঁতের ভীম আঘাতে। তার পরেই গল গল করে রক্ত পড়ার দাগ। মনে হয়
পরাজিত হাতিটি হার অনুমান করে বাঁচার চেষ্টা করে গাছের আড়াল নিয়ে। সেই
আড়ালে কাল হল হাতিটির। শেষ রক্ষা হয়নি বন বস্তিতে গিয়েও… নিলয় ওয়াকিটকিতে
উত্তর দেয়-
- রেসপন্ডিং প্যাট্রোলিং পার্টি
- চারটি দল স্ক্যানিং শুরু করেছে। মোট চল্লিশ জন স্টাফ আছে।
- ওকে ওভার।