চালসা চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
চালসা চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
----------------------
জলপাইগুড়ি থেকে রওনা হয়ে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণের বাসে এসে পৌছালাম চালসা গোলাইতে। ঘড়িতে সময় সকাল সাড়ে নটা। চায়ের জনপদ মেটেলির আজকের সুহানা সফর শুরু করলাম চালসা থেকে। চালসা থেকে মেটেলির দূরত্ব মাত্র ৭ কিমি। শেয়ার জিপেই যাওয়া যায়। জিপে বেশিরভাগই স্কুলযাত্রী এবং অফিসকর্মী। চালসা গোলাই থেকে পাহাড় উজিয়ে যাত্রা করলাম মেটেলির দিকে। দোকানপাট, হাট-বাজার, স্কুল, অফিস, বাড়িঘর নিয়ে পূর্ব ডুয়ার্সের একটি ছোট্ট জনপদ চালসা। চালসা মোড় থেকে কিছুটা এসেই রেললাইন। আগের মিটারগেজ সরিয়ে ব্রডগেজ লাইন পাতা হয়েছে। আর ঠিক তারপরেই দুতিনটে সর্পিল বাঁক ঘুরে পাহাড়ি পথের শুরু। এক লাফেই যেন অনেকটা উঁচুতে উঠে গেলাম। নিচে একান্তে পড়ে রইল ডুয়ার্সের সমতল আর চালসা শহরতলী। সামান্য উঁচু হলেও পাহাড়ের সকল বৈশিষ্ট্য রয়েছে চালসা থেকে মেটেলির যাত্রাপথে। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা যায় নিচে চালসার ছোট্ট জনপদ। তারপর গরুমারা অরণ্যের বিস্তার আর মুর্তি, কুর্তি, নেওড়া দুরে রুপোলী রেখার মত দিগন্তে মিলিয়ে যায়। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা মসৃণ পথ বেয়ে উত্তরে চলেছি। দুইপাশে আদিগন্ত চা-বাগানের সবুজ ঢেউ। বাঁদিকে চড়াইয়ের কিনারা ঘেঁষে সিনক্লেয়ার্স গ্রুপের রিসর্ট। অবকাশ যাপনের এক মহার্ঘ্য আবাস। এখানে বসে দুচোখ ভরে দেখে নেওয়া যায় ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ উপত্যকা, চা বাগিচা, দূরের নীল পাহাড় এবং আকাশ ভরা মেঘপুঞ্জ। চালসা এবং মেটেলি চা বাগান অধ্যুষিত অঞ্চল। সোনগাছি, আইভিল, ইনডং, এঙ্গো, জুরান্তী বাগান ঘুরে দেখার পরিকল্পনা। পুরনো মেটেলির ছবিটা যেন চোখের সামনে ভাসছিল। চালসার সিনক্লেয়ার্সকে পিছনে রেখে এগিয়ে চলেছি। সামনে অনন্ত সবুজ প্রান্তর। মাঝখানে সবুজ শ্যামলিমা চিরে মসৃণ রাস্তা। মানকচু বাগিচার মাঝে মাঝে শিরীষ গাছের জঙ্গল। সবুজের সমারোহ। ডাইনে কিলকট, আইভিল, ইঙ্গো, চালসা ইত্যাদি ছায়াঘেরা চা বাগিচা পেরিয়ে মাটিয়ালি বা মেটেলির ব্যস্ত জনপদে পৌছলাম। আজকের সার্ভের তালিকাতে রয়েছে গুডরিকসের চালসা চা বাগিচা।
সকালে ঘুমচোখে ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক না হলে যাকে বলে দিনটাই মাটি। চায়ের টানে ভারতের চায়ের বাজার বাড়তে বাড়তে পৌঁছে গেছে প্রায় দশ হাজার কোটিতে। বিশ্বের দু'নম্বর চা প্রস্তুতকারক দেশের তকমা এখনও আমাদেরই দখলে। তাই বর্তমানে ছুটতে থাকা জীবনযাত্রায় দোকানে গিয়ে মনের মতো চা কিনে আনার সময় আর নেই। তাই ওয়েবসাইটে দেওয়া দাম দেখে অর্ডার করে দিলেই দায়িত্ব নিয়ে সেই চা একেবারে ক্রেতার দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে দেবে কোম্পানি। অন্য ই-কমার্স ওয়েবসাইটের মতোই অর্ডার ট্র্যাকিং করাও সম্ভব হবে এই পোর্টালে। এই দায়িত্ব নিয়েছে গুডরিক সংস্থার ক্যাচলাইন ‘দ্য টি পিপল’ এর মতোই তরতাজা মোড়কে। সংস্থার সুবিশাল ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে আরও বড় কলেবরে গ্রাহককে আরও বেশি করে পরিষেবা পৌঁছে দিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থা। এর মাধ্যমে বিক্রি চার গুণ বাড়ানোর প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে গুডরিকের। গুডরিকস কোম্পানি আইন ১৯৫৬ এর নিয়মানুযায়ী একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসাবে ১৯৭৭ এর ১৪ জুন থেকে চা ব্যবসার কাজে অবতীর্ণ হয়। বিভিন্ন ধরনের চা উৎপাদন এবং ক্রয়বিক্রয় সহ চা উৎপাদনকারী হিসাবে গুডরিক গ্রুপ লিমিটিড ১৭ টি বাগানে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি রূপে চা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। গুডরিক গ্রুপ লিমিটেডের ১৭ টি চা বাগানের আটটি স্টার্লিং চা কোম্পানির মালিকানাধীন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এবং ভারতে চা ব্যবসার কাজে যুক্ত হয়। স্টার্লিং কোম্পানিগুলির মধ্যে প্রধান ছিল আসাম-ডুয়ার্স চা কোম্পানি লিমিটেড, লেবং টি কোম্পানি লিমিটেড, ব্রিটিশ দার্জিলিং চা কোম্পানি লিমিটেড, লিস নদী চা কোম্পানি লিমিটেড, মীনগ্লাস চা কোম্পানি লিমিটেড এবং ডেঙ্গুয়াঝাড় চা কোম্পানি লিমিটেড। ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট (১৯৭৩ সাল) অনুসারে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক স্টার্লিং কোম্পানিগুলিকে ব্যবসা চালানোর অনুমতি দেওয়ার জন্য সম্মতি প্রদান করে।
ডিবিআইটিএর সদস্য মালবাজার মহকুমার চালসা টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী গুডরিক গ্রুপ লিঃ কোম্পানি ১৯৭৭ সালে বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাইভেট সেক্টর চা উৎপাদক গুডরিক গ্রুপ অফ টি কোম্পাণী লিমিটেডের দার্জিলিং, ডুয়ার্স, আসাম এবং কাছাড় মিলে ২৭ টি বাগান আছে। ১৮০০ শতকের শেষের দিকে গুডরিকস চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে এবং ধীরে ধীরে তারা ভারতে ব্যবসা চালাতে থাকে। ডুয়ার্সের অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই চালসা চা বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৫ জন। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কাস এবং প্রোগ্রেসিভ টি ওয়ার্কাস ইউনিয়ন। চালসা চা বাগিচার আয়তন ও চাষযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৬২৪.০৯ হেক্টর। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ১৪.৪১ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ৩২৭.২৫ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য উপাদনক্ষম আবাদীক্ষেত্র ৪৪২.১৩ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং ড্রেন ও সেচযুক্ত 'প্ল্যান্টেশন এরিয়া' থেকে ২১০৬ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। চালসা চা-বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ৭৮ জন। করণিক ১১ জন। ক্যারিকাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ১৭ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৬৯৫ জন। মোট জনসংখ্যা ৪৫৮৭ জন। স্থায়ী শ্রমিক ১১২৪ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ১৫৬ জন। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক সংখ্যা ২০ জন। কম্পিউটার অপারেটর একজন। সর্বমোট সাব স্টাফ ৭৮ জন। ক্ল্যারিক্যাল, টেকনিক্যাল শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ৩৪ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১৪১৩ জন। শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৩২৭৪ জন।
ডুয়ার্সের প্রকৃতি নিত্যনতুন সাজে পর্যটকদের জন্য প্রতীক্ষারত। পর্যটক, প্রকৃতিপ্রেমিক, বন্যপ্রাণী এবং পক্ষী বিশারদেরা ডুয়ার্সের বনে জঙ্গলে, সবুজ তেপান্তরে, নদী নির্ঝরে, চা বাগিচার সবুজ গালিচায় বেড়াতে আসেন। শুধুমাত্র অরণ্য বা পাহাড়ের হাতছানিতে নয়, পুরনো মন্দির, মসজিদ এবং মাজারের টানেও পর্যটকেরা আসছেন। রয়েছে ভাওয়াইয়া, মুইশাল, মাহুত বন্ধুর গান, চোর-চুন্নির গান। ডুয়ার্স পরিক্রমায় দেখা যায় মেচ, রাভা, টোটো, ডুকপা, রাজবংশী, ওঁরাও জনজাতি, ডুয়ার্সের হাট, চা বাগিচার মোরগ লড়াই, ধামসা মাদল নৃত্য এবং লোকসংস্কৃতির বহু বিচিত্র এবং বর্ণময় সংস্কৃতি। মেঘেদের লুকোচুরি খেলার মাঝে সন্ধ্যায় মাদলের ধিতাং ধিতাং শব্দে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশে পর্যটকেরা যেতে পারেন। মেটেলি সার্কিট এবং নাগরাকাটাকে কেন্দ্র করে পর্যটকেরা বেরিয়ে আসতে পারেন জুরান্তী, সামসিং, চালৌনি, চালসা, জিতি, হোপ, হিলা, এবং কূর্তি চা বাগানে। চা শিল্পের সংকটে পর্য্যটনকে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে বলে চালসা, মালবাজার, লাটাগুড়ি এবং নাগরাকাটাকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এখান থেকে যাওয়া যেতে পারে চাপরামারি জঙ্গল পেরিয়ে ঝালং বিন্দুর পাহাড়ি রাস্তায় জলঢাকা জলবিদ্যুত প্রকল্পের জলঢাকাতে। কুলকুল শব্দে একটানা বয়ে যাওয়ার ছন্দ মন আকুল করে। বনাঞ্চলের অপূর্ব শোভার পাশাপাশি তরাই এবং ডুয়ার্সের শ্রেষ্ঠ সম্পদ চা উৎপাদনের প্রক্রিয়া দেশী এবং বিদেশী পর্য্যটকদের দেখাবার মধ্য দিয়ে তারা যাতে চা বাগিচা অঞ্চলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পায় তার জন্য চা বাগিচা কতৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্য সরকার পরিকল্পনা রচনা করলে পর্যটন শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও সরকার উপকৃত হবে। চা বাগানে কিভাবে চা পাতা তোলা হয় এবং ফ্যাক্টরীতে কিভাবে চা তৈরি হয় তা পর্যটকদের নিয়ে দেখানোর পাশাপাশি ভ্রমণের ব্যবস্থা যদি করা যায় তাহলে ট্যুরিজমের আকর্ষণীয় প্যাকেজ চালু করা যেতে পারে।
চা বাগান সম্পর্কে অনেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন সময়ে প্যাকেজের কথা বলেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নির্মলা সীতারামন বারকয়েক চা বাগান ঘুরে গিয়েছেন। কখনও বলা হয়েছে চা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। আবার কখনও চা-কে কৃষিভিত্তিক শিল্প নাম দেওয়া হয়েছে। যে যা প্রতিশ্রুতিই দিন না কেন চা শিল্প যে এখনও পুরোপুরি উপেক্ষিত সেকথা বললে অত্যুক্তি হবে না। দীর্ঘদিন হয়ে গেল চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি চুক্তিই হচ্ছে না। এর নির্ধারিত সময় কবে পার হয়ে গিয়েছে। বর্ধিত মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন চা শ্রমিকরা। উত্তরবঙ্গে তাদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তিন লক্ষের বেশি। ১৯৬৮ সালের ১ এপ্রিল উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকরা মজুরি পেতেন ২ টাকা ২৬ পয়সা। ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্য অনুসারে ২০১০ সালে এই মজুরির পরিমাণ ছিল ৬৭ টাকা। ২০১০ সালের ১ এপ্রিল চা শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে হয় ৮৫ টাকা। বর্তমানে চা শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছেন দৈনিক ২১২ টাকা। ৫২ বছরে তাদের মজুরি বেড়েছে ১৭৩ টাকা ৭৪ পয়সা। ইতিমধ্যে টাকার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। আনুপাতিক হারে মূল্যবদ্ধি ঘটেছে। অথচ উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির প্রাণভোমরা চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটেনি। কেউ বোঝারই চেষ্টা করেনি যে এটা না করলে উত্তরবঙ্গের সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে না। মজুরি চুক্তি আবার কবে হবে জানেন না চা শ্রমিকরা। বাজার মূল্যের নিরিখে এ মজুরি দিতে মালিকপক্ষের অনীহার শেষ নেই। চা শিল্পের আধুনিকীকরণে নতুন বিনিয়োগ না করায় বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন অনেক চা বাগানের ঝাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হাজার হাজার চা শ্রমিক অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে।
চা-বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত কাঁচা চা পাতা ৩৫ লাখ কেজি এবং ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চা ৭ - ৭.৫ লক্ষ কেজি। বহিরাগত বাগান থেকে সংগৃহীত এবং কেনা কাঁচা চা পাতায় প্রস্তুত বিক্রয়যোগ্য চায়ের পরিমাণ ১১ লক্ষ কেজি। ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত মোট বিক্রয়যোগ্য চায়ের পরিমাণ ১৮-১৯ লক্ষ কেজি। উৎপাদিত চায়ের প্রকৃতি অনুযায়ী এই বাগানে ইনঅরগ্যানিক সিটিসির উন্নত কোয়ালিটির চা উৎপাদিত হয়। চালসা বাগানটি চরিত্রগত দিক থেকে উন্নত প্রকৃতির বাগান। চালসা টি গার্ডেন এসজিআরওয়াই বা এমজিএনআরইজিএস - এর সুবিধা পায় না। ব্যাঙ্কের কাছে বাগানটি দায়বদ্ধ। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে ব্যাঙ্ক, নিজস্ব আর্থিক সোর্স এবং চা বিক্রি বাবদ আয় থেকে। বাগানটির লিজ হোল্ডার গুডরিক গ্রুপ লিমিটেড। বর্তমান লিজের ভ্যালিডিটি ২০২৭ সাল পর্যন্ত। চালসা চা-বাগিচায় ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ৬৮২ টি। বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাস নেই। অন্যান্য বাড়ির সংখ্যা ১১১। মোট শ্রমিক আবাস ৮০১। শ্রমিক সংখ্যা ১৪১৩। বাগিচায় শতকরা ৫৭ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ। শ্রমিক আবাস নির্মাণ, মেরামতি এবং রক্ষণাবেক্ষণে বাৎসরিক গড় খরচ ২০ লাখ। বাগিচায় স্থায়ী ক্রেশের সংখ্যা একটি, ভ্রাম্যমান একটি। ক্ৰেশে শৌচাগার এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের সরবরাহ করা হয়। ক্ৰেশে নিয়মিত পোশাকও দেওয়া হয়। ক্ৰেশে মোট অ্যাটেনডেন্ট তিনজন। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় আছে। বিদ্যালয়ের নাম মেটেলি হাই স্কুল। মিডিয়াম বাংলা। শ্রমিক-সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা হিসাবে একটি বাস আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব এবং খেলার মাঠ আছে।
শিল্প এবং বাণিজ্যমন্ত্রকের কাছে চা বাগানের মোট জমির অন্তত কুড়ি শতাংশ বিকল্প কাজে ব্যবহারের দাবি জানিয়েছিল চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মালিকপক্ষ এবং শিল্পমহল। পাশাপাশি বন্ধ বাগানগুলির মত বাকি বাগানেও অস্থায়ী শ্রমিকদের ১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে বাগান পরিচর্যার দাবি উঠে আসে। টি বোর্ডের মত ছিল বর্তমান ব্যবস্থায় অসমের চা বাগানে জমির ৫% বিকল্প ফসল চাষে ব্যবহার করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ফসল চাষ সহ আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ একর জমি ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। চা বাগানগুলো চাইছিল এই পরিমাণ বাড়িয়ে অন্তত কুড়ি শতাংশ করা হোক। টি বোর্ড এর মত ছিল বিষয়টি সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের বিষয়। তাই এই দাবির ব্যাপারে রাজ্য সরকারই বিচার বিবেচনা করতে পারে। টাই এর ডুয়ার্স শাখার তৎকালীন সম্পাদক রামঅবতার শর্মার মত ছিল কোন পূর্ব শর্ত ছাড়া শিল্পবান্ধব অন্য কোন প্রকল্পে চা বাগানের জমি ব্যবহারের অনুমতি মিললে সব ধরনের বাগান উপকৃত হবে। শিল্পমহল সেই কথাই জানিয়েছে। রাজ্যে ট্যুরিজম পলিসি সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে রাজ্য সরকার ২০১৯ সালে। বলা হয় কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কালিম্পং এবং উত্তর দিনাজপুর জেলায় এই পলিসি কার্যকর হবে। নতুন এই পলিসির নাম দেওয়া হয়েছিল টি ট্যুরিজম এন্ড অনলাইন বিজনেস পলিসি ২০১৯। এই আইনে বলা হয় চা বাগানগুলি তাদের চা বাগান এলাকার বাইরে থাকা অতিরিক্ত জমির ১৫ শতাংশ জমি অন্য প্রকল্পে ব্যবহার করতে পারবে। এতদিন চা-বাগানে পর্যটনের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ একর জমি ব্যবহারের অনুমতি ছিল। নির্মাণ কাজ করা যেত দেড় একরে। রাজ্য ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাগানের মোট জমির ১৫% পর্যটনের কাজে ব্যবহার করা যাবে। তার ৪০ শতাংশ জমিতে নির্মাণ কাজ করা যেতে পারে। সর্বোচ্চ ১৫০ একর জমি টি ট্যুরিজমের জন্য বরাদ্দ হতে পারে।
চালসা চা-বাগিচায় হাসপাতালের সংখ্যা একটি। ডিসপেনসরির সংখ্যাও একটি। আলাদাভাবে পুরুষ/মহিলা/আইসোলেশন ওয়ার্ডের ব্যবস্থা আছে। মেটারনিটি ওয়ার্ডও আছে। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৯ টি এবং ফিমেল ওয়ার্ড ৯ টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড ৯ টি। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার আছে। বাগিচায় অ্যাম্বুলেন্স আছে। বাইরে চিকিৎসার জন্য গড়ে ২০০ জন শ্রমিককে রেফার করা হয়। বাগিচায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। চা বাগিচায় ডাক্তার আছে। ডাক্তারের নাম ড অনুপ ডেকা। তিনি আবাসিক হিসাবে বাগিচায় নিযুক্ত। শিক্ষাগত যোগ্যতা এমবিবিএস। গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজ থেকে তিনি পাস করেছেন। তাঁর পদটি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিল দ্বারা অনুমোদিত। চালসা চা বাগানে প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা ২ জন। নার্সের সহযোগী আয়া বা সমতুল মিডওয়াইফ একজন। কম্পাউন্ডার একজন। স্বাস্থ্য সহযোগী একজন। বাগিচায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ হয়। ওষুধের তালিকা স্টক অনুযায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নোটিশ বোর্ডে দেওয়া হয় না। উন্নতমানের পথ্য সরবরাহ করা হয়। নিয়মিত ডায়েট চার্ট অনুসরণ করা হয়। মেটারনিটির সুবিধা পাওয়া নারী শ্রমিকদের বাৎসরিক গড় জানা যায় নি। ২০০৭ সাল থেকে চা-বাগানে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার আছেন। নাম রাহুল শর্মা। চালসা চা-বাগানে শতকরা ২০ শতাংশ হারে বোনাস দেওয়া হয়। বিগত অর্থবর্ষে ৮০-৯০ লক্ষ টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ড খাতে জমা পড়েছে। বাগিচায় মালিকপক্ষ নিয়মিত প্রভিডেন্ড ফান্ডের পুরো অর্থই জমা দিয়ে দেয়। মজুরি চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। শ্রমিকদের মজুরি, রেশন, জ্বালানি, চপ্পল, ছাতা, কম্বল নিয়মিত সরবরাহ করা হয়। বিগত অর্থবর্ষে গ্র্যাচুইটি বাবদ বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ। বছরে গড়ে ৫০-৬০ জন শ্রমিক গ্র্যাচুইটি পেয়ে থাকেন। শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটির অর্থ বকেয়া নেই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴