চা-ডুবুরি/পর্ব : ৩৪
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^^
চা-বাবুদের মুছে যাওয়া দিনগুলি (২)
------------------------------------------------
-"আসলে সেই সময়ে চা বাগানের বাবুদের ঠাট-বাটই ছিল আলাদা। আজকের মতো এত দূরবস্থা ছিল না" - সুবর্ণ যোগ করে কথাটা।
সত্যপ্রিয় খানিক কি যেন ভাবেন তারপর ম্লান হেসে বলেন, "এ কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। কেন নয় তা বলছি তবে তার আগে এক দর্জি আর ইউরোপিয়ান সাহেবের গল্প শোনাই। বড় মজার গল্প। ঘটনাটা অতীন লিখেছে ওর একটি লেখায়। হয়েছে কি, সেসময় ডুয়ার্সে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরের প্রকোপ ছিল ভীষণ। যে জন্য অনেক বাগানেই সাহেবদের বাংলোয় তখন দু একটা করে কফিন বাক্স রাখা থাকত। রাত বিরেতে হঠাৎ কেউ মারা গেলে কাঠমিস্ত্রি ডেকে বাক্স তৈরি করতে যাতে সময় নষ্ট না হয় তাই এ ব্যবস্থা। তো, একবার কলকাতা থেকে এক দর্জি এসেছে। বিভিন্ন বাগান ঘুরে ঘুরে সাহেবদের জামাকাপড়ের মাপ নিয়ে রাতে সে যখন সেই বাগানের বাংলোয় ফিরে এল তখন তার গায়ে ধূম জ্বর । শরীরে কাঁপুনি ধরেছে ভীষণ। কোনোদিকে না তাকিয়ে সে বাংলোয় ঢুকে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো সাহেবের খাটে। এদিকে সাহেব একটু বেশি রাতে নেশা করে বাংলোয় ফিরে দেখেন কেউ একজন তার খাটে শুয়ে। তিনি আর তাকে না জাগিয়ে নেশার ঘোরে কফিন খুলে সটান শুয়ে পড়লেন। এদিকে মাঝরাতে বাথরুম যেতে গিয়ে সেই দর্জির চোখ পড়ল কফিনের ওপর। দেখে তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম। ইতিমধ্যে ঘুমের ঘোরে সাহেব একটু নড়ে উঠতেই দর্জির তো প্যান্ট ভিজে যাওয়ার অবস্থা। এক দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে দর্জি সেই যে পালিয়েছিল বাগান ছেড়ে, দ্বিতীয় বার আর বাগানমুখো হয়নি!"
-" বেশ মজার তো, কত যে ঘটনা লুকিয়ে আছে অতীতের চা বাগানকে ঘিরে !" - সুবর্ণ বলে।
-" তবে তুমি যে বললে সে যুগে বাবুদের ঠাট-বাটই আলাদা ছিল তা কিছুটা ঠিক হলেও পুরোপুরি ঠিক নয়। সব বাবুরা নয়, শুধু বড়বাবু বড়গুদামবাবু, ডাক্তার বাবু এদের কারো কারো জীবনযাপন বেশ বর্ণময় ছিল। কেউ কেউ বিশেষ কিছু ক্ষমতা ভোগ করতেন। যেমন, অনেক আগে ডিমডিমা বাগানে এক বড়বাবু ছিলেন বিভূতি রায়, তাঁর একটি কালো অস্টিন গাড়ি ছিল। সেই গাড়িতে করে তিনি কাজলিডাঙায় আসতেন, দলগাঁও ড্রামাটিক ক্লাবে যেতেন নাটক করতে। খুব ভাল নাটক করতেন তিনি। নাটকের জন্য দলগাঁও ড্রামাটিক আর ডিমডিমার ভিক্টরস্ ক্লাবের খ্যাতি ছিল। ভিক্টরস্ ক্লাবে অভিনেতা মহেন্দ্র গুপ্তে বাগানের কলাকুশলীদের সাথে 'শাজাহান' নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন। সেসময় পুরুষরা নারীচরিত্রে অভিনয় করত। কেবলমাত্র ডিমডিমা চা বাগানেই শিবপ্রসাদ মজুমদারের আত্মীয়া লিলি ও ইলা মজুমদার পুরুষদের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। এ সবই আমার ঐ বইতে লিখেছি আমি।"
-" হ্যাঁ আমি পড়েছি। 'চা-বাগানের সংস্কৃতি চর্চার একদিক' নাম ছিল প্রবন্ধটির।"
-" ডিমডিমা ও দলগাঁও বাগান সেসময় সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র ছিল বলা যায়। পরবর্তীতে ডিমডিমা বাগানের বড়বাবু মিঃ রায়নাথ, তাঁকে দেখেছি তাঁর বাড়ির সামনে সবসময় একটি জিপ দাঁড়িয়ে থাকত। তিনি বাগানের কাজে বাইরে যাবেন, বেতনের টাকা আনতে যাবেন, গাড়িতে যেতেন। ভদ্রলোক যদিও ঠিক সেই অর্থে জাঁদরেল বড়বাবু বলতে যা বোঝায় ছিলেন না। ছিলেন অসামান্য জ্ঞানী। সেই যুগে বাংলায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ। ঐ কোয়ালিফিকেশন নিয়ে কেউ চা বাগানে চাকরি করতে আসত না। তিনি এসেছিলেন। ইংরেজিতে দখল ছিল তাঁর খুব। এসেছিলেন বানারহাটে জামাইবাবুর কাছে বেড়াতে। ডুয়ার্সের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রয়ে গেলেন। প্রথমে বানারহাট স্কুলে তারপর চা-বাগানের ছোটবাবু হয়ে বড়বাবুতে প্রমোশন পান। সাহেবরা তাঁকে সম্মান করতো। বড়বাবুদের বেতনও ছিল বেশি। অন্যান্য বাবুদের বেতনও কিছু কিছু সরকারি চাকরির চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু এসব দেখেই শুধু বিচার করলে চলবে না, সেসময় বাবুদের জীবনে কষ্টও ছিল ভীষণ। তাছাড়া ব্রিটিশ যুগে চাকরির কোনও নিশ্চয়তাও ছিল না। সামান্য চুন থেকে পান খসলেই তা সে বাবুই হোক কিংবা শ্রমিক,চাকরি চলে যেত। আর কয়েক ঘন্টার নোটিশে তাকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে হতো চা-বাগানের বাইরে। না গেলে চৌকিদার দিয়ে তার জিনিসপত্র বাইরে বের করে দেওয়া হতো। এই প্রথাকে বলা হত 'হটাবাহার'।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে ভঞ্জবাবুর কথা। বাগানে চাকরি পেয়ে আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। বাইরের ঘরে শুতেন। রোজ ঘুম থেকে উঠে দেখতাম ভঞ্জবাবু তার বিছানাটি চৌকির ওপর ভাঁজ করে বেঁধে রেখে যেতেন। মাকে কারণটা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন,' বাবুদের চাকরির তো কোনও স্থিরতা নেই। সাহেব বললেই কয়েক ঘন্টার ভেতর ছেড়ে দিতে হবে বাগান,তাই ঐ ব্যবস্থা।' পরবর্তীতে বাবুদের ট্রেড-ইউনিয়ন হওয়ায় মালিকপক্ষ এখন আর হুটহাট কাউকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারে না। তবে দু চারটে উন্নতি দিয়ে সার্বিক বিচার করা সম্ভবও নয়। বহিরঙ্গে চাকচিক্য এলেও আজো যে বাবুদের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি তা তো তোমরা নিজেরাই বোঝ। এখন চিত্রটা পুরোপুরি উল্টো।সরকারি চাকরির চেয়ে চা বাগানের বেতন বহু যোজন দূরত্বে পিছিয়ে। আগেকার মত সেই সমস্ত সুযোগ সুবিধেও আর নেই। তবে সে যুগে সুযোগ সুবিধে থাকলেও এই পিছিয়ে পড়া চা বাগান অঞ্চলে বাবুরা নানা কষ্টেই দিন কাটাত।"
-" কী রকম?" সুবর্ণ জানতে চায়।
উত্তরে সত্যপ্রিয় যা শোনান তা এভাবেই লেখায় তুলে আনে সুবর্ণ, "বহু কাল আগে যে সময় রুজির টানে পরিবার পরিজন ছেড়ে বহুদূরে এই বনজঙ্গলের দেশ ডুয়ার্সে এসেছিলেন বাবুরা সে সময় চা বাগান গুলোয় বাবুদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সারা দিন কাজের পর সন্ধে নাগাদ ফিরে আসতেন বাবুরা তাদের আস্তানায়। সে সময় স্টাফ কোয়ার্টার গুলোয় বিদ্যুতের আলোও আসে নি। কেরোসিনের লন্ঠন আর কুপি জ্বলত। অনেক বাগানেই কোয়ার্টার ছিল কাঠের। ছিল বন্য জন্তুর ভয়। রাত বাড়লেই তাদের উৎপাত বাড়ত। ছিল বিষাক্ত সাপ। তবে এখনকার মতো এত হাতির উৎপাত শোনা যেত না। হাতি জঙ্গলেই থাকত। বাগানে এসে হামলা চালাত না। বাবুরা দিনের আলো থাকতে থাকতে ঘরে ফিরে আসতেন। ঘর ছেড়ে বেরোতেন না । আর বের হবেনই বা কোথায়, কথা বলার লোকই তো ছিল। কথা বলার জন্য হাঁপিয়ে উঠতেন তারা। বাইরে থেকে তাই কেউ গেলে তা সে চেনা হোক বা অচেনা বাবুরা ছাড়তেই চাইতেন না।"
সত্যপ্রিয় আরও বলেছিলেন সুবর্ণকে, "হাট বাজার বলতে তো কাছাকাছি প্রায় কিছুই ছিল না। সপ্তাহান্তে হাটবারে কাছে পিঠের গঞ্জে যেতে হতো হয় গরুর গাড়িতে নয় হেঁটে। পরের দিকে কেউ কেউ সাইকেলে যেত। কোনও কোনও বাগানে কর্তৃপক্ষ ট্রাক্টরের ব্যবস্থাও করেছিল। মাছ প্রিয় বাঙালিকে এক টুকরো মাছের জন্য হা-পিত্যেস করে বসে থাকতে হত ঐ হাটের অপেক্ষায়। একজন বা দুজন মাছওয়ালা বাঁশের ঝাঁকায় করে মাছ এনে বাজারে ফেলতে না ফেলতেই কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। বড় মাছটা কেনা নিয়ে বাবুতে-বাবুতে মন কষাকষি পর্যন্ত হয়ে যেত। আর সপ্তাহান্তে ঐ একদিন পাতে মাছ পড়ার আশায় বাড়িতে অপেক্ষায় বসে থাকত বাবা, মা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সকলে। সেসময় পরিবার ছিল বড়। স্বল্প বেতনে পরিবারের দশ পনের জন সদস্যর মুখে অন্ন তুলে দিতে হত বাড়ির কর্তাকে। বড় পরিবার হওয়ায় বাগানের ছোট বাবু,মেজবাবু যারা ছিলেন তাদের অনেকেরই প্রতি হাটে মাছ কেনার সামর্থ্যও ছিল না। কোয়ার্টার সংলগ্ন মালিবাড়ি, যাকে তোমরা কিচেন গার্ডেন বলো সেখানে ফলানো হতো ঢেড়স, বরবটি, কাকরোল, কুমড়ো, লংকা শীতে কপি। এসবের ওপর সারা সপ্তাহ প্রায় নির্ভর করতে হতো। মাংস তো ন'মাসে ছ'মাসে বাড়িতে ঢুকতো,তাও কোনও উৎসবে। বেশভূষাও ছিল সাদামাটা। একটা জামা তিন ভাই হয়ত পালা করে পড়ত। একটা শাড়ি তিন বোনে। যে জন্য এমনও দেখা যেত সংসারের হাল ধরতে পরিবারের বড় ছেলে একটা পাশ করেই লেখাপড়া ছেড়ে দিল পরিবারের স্বার্থে। বাবা তাকে ঢুকিয়ে দিলেন সাহেবকে বলে কয়ে বাগানে করণিকের চাকরিতে।"
-" তবু সকলে মিলে একসাথে থাকা। তাতে আনন্দও তো ছিল।" - সুবর্ণ বলে।
-" তা ছিল। তবে অভাবের ভুলে থাকার জন্য যে মনোরঞ্জন তাও তো প্রায় কিছুই ছিল না। শহরের মতো নিত্যদিনের আনন্দ উৎসব তো চা-বাগানে ছিল না। রিক্রিয়েশন বলতে ভালমন্দ খাওয়া আর তাস দাবা এইসব। বাড়ির বৌ-ঝিদের জীবন সেলাই ফোঁড়াই, রান্না আর সন্তান জন্ম দিয়েই কেটে যেত। না ছিল সিনেমা, না থিয়েটার,না মেলা, না কোথাও বেড়াতে যাওয়া। বর্ষাকালে একটানা দিনের পর দিন বৃষ্টি, শীতে তীব্র ঠান্ডায় ঘর বন্দি হয়ে দিন কাটাতে হত। পরবর্তীতে অবশ্য বাবুরা যাত্রা,থিয়েটার এসব করে সময় কাটাতেন। আরো পরে বাগান থেকে কর্তৃপক্ষ গাড়ি দেওয়া শুরু করল। গাড়ি বলতে চা পাতা বহনকারী লরি বা ট্রাক। সেই ট্রাকের পেছনে ত্রিপল খাটিয়ে বাবুরা সপরিবারে সিনেমা কিংবা যাত্রা দেখতে যেতেন কাছাকাছি শহরে।"
-" তাতেও কিন্তু মজা ছিল, বলুন। আমরাও তো কত গেছি এভাবে গাড়িতে চেপে পুজো, সিনেমা বা যাত্রা দেখতে। মনে আছে মালবাজার কিংবা ময়নাগুড়িতে যাত্রা এলে গাড়িতে করে এসে অ্যানাউন্স করে যেত বাগানে বাগানে। গাড়ির জানালা দিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে যেত যাত্রার হ্যান্ডবিল।আমরা ছোটরা পেছন পেছন হৈ হৈ করে দৌড়তাম সেগুলো কুড়িয়ে আনতে।" সুবর্ণ অতীতচারী হয়ে ওঠে।
-" দ্যাখো, আসলে সে যুগে আমরা এসবের মধ্যেই আনন্দ খুঁজেছি। এখন তোমার ছেলে এসব শুনে হাসবে। তার ছেলে একদিন এসব শুনে মনে করবে রূপকথার গল্প শুনছে। কিন্তু এটা হয়ত ঠিক মনোরঞ্জনের আয়োজন বেশি হলেই যে মানুষ আনন্দে থাকবে এটা ভুল। আজ এত কিছু থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন তবে অবসাদে ভোগে।" সত্যপ্রিয়র স্বরে উদাস সুর খেলে যায়।
-" তখন কিন্তু রোগভোগও কম হত। অসুখ করলে হুটহাট বাইরের হাসপাতালে পাঠানোরও তো রেওয়াজ ছিল না। বাগানের হাসপাতালের ওষুধের সারত।" সুবর্ণ সত্যপ্রিয়র মুখ থেকে আরো যেন কিছু জানতে চায়। ।
" আমার একটি লেখা আছে এ বিষয়ে। তুমি পড়েছ সেটা? একটি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। তাতে লিখেছিলাম যে কাজলিডাঙা হাসপাতালে তিনটি বড় বড় গাছ ছিল। কী গাছ তা মনে নেই। তবে দেখতাম সেই গাছের পাতা শীতকালে সংগ্রহ করে ভরে রাখা হতো একটি কাঠের বাক্সে। বাক্সটি চিনা কাঠমিস্ত্রীর তৈরি। বাক্সটির বিশেষত্ব ছিল তাতে কোনও পেরেক ছিল না। কালাজ্বর হলে সেই পাতা সেদ্ধ করে জল খাওয়ানো হত দেখেছি। পরবর্তীতে এলো মিক্সচারের যুগ। কলকাতা থেকে পাউডার ওষুধ আসত। কম্পাউন্ডার বাবু ও তার সহযোগীরা মিলে সেই পাউডার দিয়ে তরল মিক্সচার বানিয়ে বড় বড় কাচের বোতলে ভরে রাখত। এলকালিন মিক্সচার, কারমিনেটেড মিক্সচার,সেনিসালস মিক্সচার,কুইনাইন ইত্যাদি। রোগভোগ হলে হাসপাতালের সেই সর্বরোগহর মিক্সচার আর সাদা ট্যাবলেটই ছিল ভরসা। একজন দাওয়াইওয়ালা থাকত হাসপাতালে যে কাঁধে ঝোলানো বাক্স নিয়ে ঘুরে বেড়াত লাইনে লাইনে। অসুস্থ শ্রমিক ও তাদের বাচ্চাদের মেজারিং গ্লাসে মেপে তরল মিক্সচার ঢেলে দিত মুখে। কাছে পিঠে বড় কোনও হাসপাতালও ছিল না। বাগানে বাগানে জলপাইগুড়ির জ্যাকসন মেডিকেল স্কুল থেকে পাশ করা এল.এম. এফ ডাক্তারবাবুরা থাকতেন। তারা কেউ কেউ বেশ দক্ষ ছিলেন চিকিৎসায়। অনেকগুলো বাগানের মাঝে ছিল সেন্ট্রাল হসপিটাল। সেখানে দু একজন পাশ করা ডাক্তার থাকতেন। যারা চিকিৎসক হিসেবে বেশ ভাল ছিলেন। ছোটখাটো অপারেশনও করতে পারতেন তারা।"
কথাগুলো শুনতে শুনতে সেদিন অনেকগুলো দৃশ্য মনের পর্দায় কোলাজের মত ভেসে আসছিল সুবর্ণর। কাঁধে ওষুধের বাক্স নিয়ে সদা হাস্যোজ্জ্বল জেঠা দাওয়াইওয়ালা যাচ্ছে বাগানের পাকদন্ডি দিয়ে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে। পেছন পেছন মিষ্টি কাফ মিক্সচার খাওয়ার লোভে শ্রমিকদের ঘরের বাচ্চারা ঘ্যানঘ্যান করে পিছু নিয়েছে। জেঠা-বাজে(দাদু) ঘুরে ওদের তাড়া করছেন, "ঐলে...হিরকাঞ্ছু, ঘর যা..." (মারব,ঘরে যা)। হাসপাতালে গেলে চোখে পড়ত কাগজ কেটে 'দাগ' দেওয়া কাঁচের শিশিতে মার্গারেট নার্স ওষুধ ঢেলে দিচ্ছে মেজারিং-গ্লাসে করে। কত যত্ন নিয়ে কাটতেন তিনি কাগজের 'দাগ'গুলো। বড় বড় কাচের বোতলে লাল নীল মিক্সচার। টনসিল দেখাতে গেলেই ডাক্তারদাদু বাজখাঁই গলায় হুকুম দিতেন, "অ্যাই মার্গারেট এই ছেলেটাকে থ্রোট-পেইন্ট করে দাও।" ডগায় তুলো জড়ানো লম্বা কাঠিটা ওষুধে চুবিয়ে হাঁ করতে বলতেন মার্গারেট নার্স। বড়...আরো বড়...হাঁ.. আ..আ। ব্যাস, আলজিভ অবধি টনসিলের গ্ল্যান্ড গুলোয় পড়ে গেল ওষুধের প্রলেপ। মুহুর্তে 'ওয়াক' উঠে আসত মুখে। আর হাসপাতালের স্টোর রুমের তাকে বড় কাঁচের জারে ফরম্যালিনে চুবিয়ে রাখা সেই মানবভ্রূণটি, যেটি দেখে কেমন যেন গা শিরশির করত! কাছে গেলে আঁশটে গন্ধ লাগত নাকে। কেন ওটা রাখা ছিল? কী প্রয়োজনে? সাদা ফটফটে ভ্রূণ শিশুটিই বা কার, কোনও সাহেবের,নাকি অন্য কারো? নানা প্রশ্ন ভীড় করত মাথায়। আজও অজানাই রয়ে গেছে সেই ভ্রূণের ইতিহাস।
ওভারল্যাপ করে ঢুকে পড়ে আরও একটা ছবি। বিবর্ণ অথচ কি উজ্জ্বল! মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। যাত্রা দেখতে যাওয়া হবে মালবাজারে। শেষবিকেলে বড়বাবুর বাড়ির সামনে ত্রিপলে ঢাকা টাটা-লরি টা এসে দাঁড়াতেই হাতে খবরের কাগজ নিয়ে দৌড় দৌড়। কে কার আগে জায়গা রাখবে। পেছনের ডালাটা খোলা। নিচে টুল পাতা। মা কাকিমা,জেঠিমারা ওতে পা রেখে উঠবেন গাড়ির পেছনে। গাড়ির ভেতর কাঠের মেঝেতে বিছানো চা-পাতা ঢাকা দেয়ার পরিস্কার তারপোলিন শিট। সুবর্ণ ও তার বন্ধুদের লক্ষ্য থাকতো কে কার আগে গিয়ে মায়েদের জায়গাটা রাখবে। রেখেই কে আগে গিয়ে গাড়ির সামনে হুডের নিচের জায়গাগুলো দখল করবে । যেখানে দাঁড়ালে সামনের রাস্তাটা পরিস্কার দেখা যায়। এক একে বাবু-মাঈজিরা সকলে এসে গাড়িতে বসতো। বড়বাবু আর ডাক্তারদাদু বসলেন সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে। উঠতি যুবক বাগানের দাদারা ট্রাকে উঠতেই পেছনের ডালা বন্ধ হল। দাদারা তাদের হিম্যানশিপ দেখাতে বসে পড়লেন ডালার ওপর বড়দের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই। কেননা ভেতরে ত্রিপলের নিচ থেকে হয়ত কোনও আয়ত চোরা চাহনি ততক্ষণে তাদের এই বিপজ্জনক শরীরী ভাষায় বিমোহিত হয়ে পড়েছে। মঙ্গল ড্রাইভার স্টার্ট দিল গাড়িতে। গাড়ি উঠে এল বড় রাস্তায়। হু-হু করে গাড়ি যত ছুটছে কিশোরমনের অবাস্তব নানান কল্পনা ছুটে চলেছে পাল্লা দিয়ে।
ফেরার পথে রাত তখন গভীর। ঠান্ডার কামড়ে সবাই ত্রিপলের নিচে ঢুকে পড়েছে। ডাকাবুকো দাদারাও। তাদের দিকে বিবশ, মুগ্ধতামাখা চোরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করার কেউ নেই। চোখগুলো যে হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। হয়ত ততক্ষণে সে চোখেও নেমে এসেছে ঘুমের আবেশ। বন্ধুরাও ঘুমে কাদা। সুবর্ণর চোখেই শুধু ঘুম নেই। সে চেয়ে আছে ত্রিপলের ফাঁক দিয়ে দূর আকাশের দিকে। অঘ্রাণের পরিস্কার আকাশে মিটমিট করা তারাগুলো ছুটে চলেছে গাড়ির সাথে। ছুটে চলেছে ঝলমলে চাঁদটাও। যাত্রার দৃশ্যগুলো কল্পনা করতে কখন যেন চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। ঘুম ভাঙে বাবার ডাকে, "সোনা উঠে পড়। বাড়ি এসে গেছে।"