সামসিং চা বাগান ( দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
সামসিং চা বাগান ( দ্বিতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
--------------------------------------
বেড়িয়ে পড়েছি ডুয়ার্সের সবুজ সমুদ্রে। যাচ্ছি সামসিং। জলপাইগুড়ি থেকে বাসে চালসা গোলাই। চালসা থেকে স্থানীয় জিপে সামসিং। ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি। চালসাতে পুরি সবজি আর চায়ের রাজ্যে প্রবেশ করে চা না খেলে কি হয়? ব্রেকফার্স্ট শেষ করে গোলাই থেকে একটা জিপে উঠলাম। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। যাচ্ছি আর যেতে যেতে ভাবছি ভুটান থেকে নেমে আসা ঘন জঙ্গল ও দুর্গম পথগুলিই তো ছিল ভারত ও ভুটানের প্রবেশদ্বার বা দুয়ার। সেই থেকেই ডুয়ার্স। মন চলে গেল ইতিহাসের পাতায়। ভুটান রাজ্যের সঙ্গে বর্তমান উত্তরবঙ্গের ভূখণ্ডের সমতল প্রদেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তিস্তা ও সংকোশ নদীর মধ্যবর্তী পাঁচটি পথ ছিল জলপাইগুড়ি জেলায়। ইংরেজ কোম্পানির শাসকরা ভুটান সীমান্তে তাদের প্রশাসনিক দপ্তর স্থাপন করার জন্য সরকারি নথিপত্রে ডুয়ার্স কথাটা ব্যবহার করার প্রয়োজন অনুভব করল। ফলে ভূখণ্ডটি ডুয়ার্স নামেই পরিচিতি লাভ করল। তিস্তার পশ্চিম পাড় থেকে হিমালয়ের পাদদেশে সুবিস্তৃত বনভূমি এলাকা তরাই অঞ্চল এবং তিস্তার পূর্ব পাড় থেকে হিমালয়ের পাদদেশের এলাকা পরিচিত হল ডুয়ার্স নামে। ডুয়ার্স শব্দের অর্থ ডোর বা দুয়ার। ডুয়ার্স শব্দের আভিধানিক অর্থ কিন্তু ভৌগোলিক মানচিত্রে পাওয়া যাবে না। উত্তরবঙ্গ নামেরও কিন্তু সরকারি স্বীকৃতি নেই, সরকারি প্রশাসনেও সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। আন্তর্জাতিক বা দেশীয় মানচিত্রে ডুয়ার্সের অস্তিত্ব না থাকলেও বাণিজ্যিক পথ বা আঠেরোটি প্রবেশদ্বারের সূত্র ধরে উত্তরের ভূখণ্ড ডুয়ার্স নামেই পরিচিতি লাভ করল আমাদের মননে এবং তা সর্বজনস্বীকৃত হয়ে মুখে মুখেই। জলপাইগুড়ি জেলায় প্রথম চা আবাদ শুরু হয় পশ্চিম ডুয়ার্সে। ১৮৭৪-৭৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স বা পশ্চিম ডুয়ার্সে জে আর হাউটন ওদলাবাড়ির কাছে গজলডোবাতে প্রথম টি এস্টেট স্থাপন করলে জলপাইগুড়ি তথা ডুয়ার্সে চা-শিল্পের আত্মপ্রকাশ এবং বাণিজ্যিক যাত্রাপথ শুরু হল।
আচমকা জোর শব্দে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায় তীব্র ব্রেক কষে। চিন্তার জাল ছিন্ন হয়। প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ি। মাথা ঠোকাঠুকি হয় আর কি। ব্যাপারটা কি? গাড়ি থেকে ঠিক হাত পাঁচেক দূরে একটা বাচ্চা আদিবাসী ছেলে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে। হাতে একটা প্লাস্টিকের বল। জোর বাঁচা বেঁচে গেছে। পাশেই খেলছিল হয়ত। বল গড়িয়ে রাস্তায়। তাই ছেলেটিও চলে এসেছে রাস্তাতে। হইহই করে স্থানীয়রা ছুটে আসে। বেগতিক বুঝে গাড়ি থেকে নেমে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয় ড্রাইভার। আমরাও কয়েকজন নেমে পড়ি। ওর মুখে অমলিন হাসি। যেন কিছুই হয়নি বা হতো না। বাচ্চাটাকে ওর মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়ে আবার গাড়িতে এসে বসি। সামসিং বাগিচা সফর যাওয়ার পথে এক অপ্রীতিকর ঘটনার সামনে পড়লাম বলে মনটা খিচড়ে গেল। চা বাগিচাগুলির সবুজ শোভা দেখতে দেখতেই আসছিলাম। অতর্কিতে এই দুর্ঘটনা। চা বাগিচাতে ঘেরা পথ চলতে চলতে কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি হঠাৎ খাড়াইতে উঠতে শুরু করল। সামসিং ফরেস্ট বাংলোর পথ হতে লাগল আরো বেশি অরণ্যময়। চালসা থেকে সামসিং প্রায় ২৫ কিলোমিটার। এই পথে শেয়ার ট্রেকার বা জিপ ভাড়া করা যায়। ঝালং থেকে অনেক পর্যটক সামসিং আসে। এ পথে বাস যোগাযোগও আছে। তবে কম। খুব ভিড় হয়। গাড়ি ভাড়া করে আসতে পারলে নিজের মত ঘোরা যায়। এই পথের শোভা অসাধারণ। তবে পথ খুব একটা ভালো নয়। সারাদিনের টুরে সামসিং এবং সুনতালেখোলা বেরিয়ে আসা যায় ভালোভাবে। যাতায়াত নিয়ে দুরত্ব ১০০ কিলোমিটারের মতো। চারিদিকে জঙ্গল। তাই উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা বাড়তে লাগল। শুদ্ধ হিমশীতল হাওয়া শরীর ও মনকে তরতাজা করে দেয়। মাইলের পর মাইল গাঢ় সবুজ চা বাগান। ঢেউ খেলানো ছন্দে সমতল এবং পাহাড় যেন মিশে গেছে। রাস্তা উঁচু নিচু। কখনও পাহাড়ের গা বেয়ে উঠছে তো কখনও এমন প্রশস্তস্থানে নেমে আসছে যে দেখে মনে হচ্ছে বুঝি বা সমতলে এলাম। আবার কোথাও কোথাও বহুদূর পর্যন্ত একটা পাহাড়ি টিলাও চোখে পড়ে না। মনে মনে ভাবলাম ডুয়ার্স প্রকৃত অর্থে হিমালয়ের দুয়ার বটে।
সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের দামামা বাজতে চলেছে। তাই আজকের সামসিং চা বাগানের দ্বিতীয় পর্বে একটি বারোমেশালি লেখা লিখব বলে ঠিক করেছি যাতে বাগিচা সফরের আর্থ-সামাজিক দিকের পাশাপাশি রাজনৈতিক কিছু আলাপচারিতাও থাকবে আমার সিরিয়াসধর্মী পাঠকের জন্য। কারণ যারা নিছক বিনোদনের দুনিয়া হিসাবে বাগিচাকে দেখেন ওপর থেকে তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া প্রয়োজন প্রাতঃকালীন সুস্বাদু গরম তরল ঐ পাণীয়ের মধ্যে রয়েছে বহু মানুষের কান্নামিশ্রিত চোখের জল যা আপনি আমি আমাদের অজান্তে পান করছি। আছে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, হাহাকার। তাই সামসিং চা বাগিচার দ্বিতীয় পর্বে আমার এবারের বিচার্য বিষয় হচ্ছে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে কেমন আছে উত্তরের চা বাগিচার শ্রমিক সম্প্রদায় তার তত্ত্ব তল্লাশ করা। কিছুদিন আগেই মালবাজারে রাজ্যের শাসক দলের সফল শ্রমিক সমাবেশের দাবিকে সামনে রেখে একটু চনমনে শাসক দল। শ্রমিক সমাবেশ সমাপ্ত হবার পর পঞ্চায়েত ভোটের দামামা বেজে উঠবে। কিন্তু বাগিচা শ্রমিকদের সমস্যার কতটা সমাধান হবে সেটা বলবে ভবিষ্যত। তার আগে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে মনে পড়ল প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেকার এক আদিবাসী বীরাঙ্গনা সানজিদার কথা। পরপর তিনবার মগধের রাজা অজাতশত্রুকে পরাজিত করে রুখে দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন আদিবাসীদের দুর্গ। তিনি ছিলেন বীরাঙ্গনা আদিবাসী নারীদের চোখে। কাউকে এই সম্মান আদিবাসী সমাজ দেয় নি। কিন্তু ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করবেন এই প্রত্যাশায় স্বাধীনতার পর প্রথম ডুয়ার্সের আদিবাসী সমাজের মেয়েরা ক্ষমতায় আসার পর মালবাজারের প্রথম সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে কলসি করে জল নিয়ে তার পা ধুয়ে সাদা তোয়ালে দিয়ে পা ধুয়ে মুছে তার কপালে টিপ পরিয়ে গালে চুমু খেয়ে সাদরে বরণ করেছিল। নিজের চোখে দেখেছিলাম সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মালবাজারেই।
সেদিন মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে ওঠার আগে ছয় জন আদিবাসী মহিলা হাজির ছিলো ঘরা ভর্তি জল নিয়ে। প্রথমে একটি বড় পাত্রে এক এক করে দুটি পা রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপর ডুয়ার্সের আদিবাসী সমাজের মেয়েরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে কলসি করে জল নিয়ে তার পা ধুয়ে দিয়ে সাদরে বরণ করেছিল তাঁকে। মালবাজারের সভায় ঘোষণা করা হয়েছিলো মমতা ব্যানার্জী আদিবাসীদের মুক্তিদাতা। আদিবাসী নারীদের আবেগের জিৎ হয়েছিলো। মুখ্যমন্ত্রীর লড়াকু মনোভাব এবং আদিবাসীদের দাবিদাওয়া পূরণের জন্য আন্তরিকতা দেখে ওই সম্মান দেওয়ার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে নেওয়া হয়। প্রত্যাশা থেকে আদিবাসীরা চেয়েছিলেন জমির অধিকার, পাট্টার অধিকার, চা বাগিচায় ন্যূনতম মজুরীর অধিকার, আদিবাসীদের কাজের অধিকার এবং যথাযথ মজুরীর অধিকার। মুখ্যমন্ত্রী আদিবাসীদের জমির পাট্টা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাদের আদি ভাষা সাদরিতে পড়াশুনার কোন ব্যবস্থা হয় নি একথা জেনে সেই দাবিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, বন্ধ চা বাগানে দুই টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন। তাই সঙ্গত কারণেই দাবিগুলি আজো পূরণ হোক চাই না হোক, ডুয়ার্সের আদিবাসী সমাজের বড় অংশ সঙ্গতকারণেই তৃণমূল সরকারপন্থী। সেই সময় আদিবাসী নেতারা জানিয়েছিলেন আগামী দিনে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর পাশে থাকতে চান সকলে। কিন্তু চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরীর দাবিকে সামনে রেখে ডুয়ার্সে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিতে চলেছে। ডুয়ার্সের আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো তা সুখ দুঃখের মিলিত প্রতিচ্ছবি। বন্ধ ও রুগ্ন বাগানগুলির মধ্যে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে পানীয় জল এবং রাস্তাঘাট এর জন্য নেওয়া হয়েছে প্রকল্প। শুরু হয়েছে চা বাগানের বিভিন্ন বস্তিতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবার কাজ। ইতিমধ্যেই খুলেছে বিভিন্ন বন্ধ চা বাগান। ডানকান, মধু ইত্যাদি চা-বাগানগুলির অচলাবস্থা নিরসনের চেষ্টা চলছে। অপেক্ষাকৃত উন্নত হয়েছে পরিস্থিতি। কিন্তু মজুরী বৃদ্ধি সহ সার্বিক উন্নয়ন কোথায়?
ডুয়ার্স স্বর্ণগর্ভা। ডুয়ার্সের মাটিতে সবুজ সোনার ঢেউ। এই সবুজের ঢেউয়ের মাঝে রয়েছে দুটি পাতা একটি কুড়ির হাসিকান্না, সংগ্রাম, শোষণ, অত্যাচার, অনাচার ও বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। শাল, সেগুন, ধুপি, টুনের মাঝে ডুয়ার্সের সবুজ বনভূমির শান্তি মাঝেমধ্যেই বিনষ্ট হত গজরাজের বৃংহতিতে, ভয়ংকর বিষধর কিং কোবরার হিমশীতল চাহনি আর হিসহিস শব্দের শাসানিতে, ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গির বাহক মশককুলের অপ্রতিহত দাপাদাপিতে আর মহামারী এবং কালাজ্বরের ভয়ংকর দাপটে। তবুও ডুয়ার্সের তুলনা ডুয়ার্স। ডুয়ার্সের আর এক নাম চা। চা সাম্রাজ্যই জন্ম দিয়েছিল আজকের ডুয়ার্সকে। ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে চা সাম্রাজ্য গড়তে জানকে বাজি করে এসেছিল আদিবাসীরা। ডুয়ার্স সংলগ্ন এলাকা জুড়ে রাজবংশী জনজাতির বসতি হলেও চা বাগিচার শ্রমিকের তালিকায় এই সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব চোখে প্রায় পড়ে না বললেই চলে। একদিকে গহন বন, অপর দিকে পাহাড় থেকে নেমে আসা অসংখ্য নদী নিয়ে ঘেরা আমাদের এই ডুয়ার্সের একই অঙ্গে বহু রূপ। গ্রীষ্মকালে নদীগুলির অধিকাংশই শীর্ণ। বর্ষাকালে ভয়ংকরী। ডুয়ার্সের একদিকে যেমন গড়ে উঠেছে নদীর পলির স্তরের মত নানা প্রাণীবৈচিত্র্য, অন্যদিকে নানান জনবিন্যাস। জনবিন্যাসের উৎসভূমি দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ির সাম্রাজ্য স্থাপনের ইতিহাস। আজকের ডুয়ার্সকে জানতে হলে, চিনতে হলে জানতে হবে অতীতের ডুয়ার্সকে। শুনতে হবে চা বাগিচা স্থাপনের ইতিহাসের পাশাপাশি এখানকার জনবসতির বৈচিত্র্য। স্থানীয় মানুষের ব্যস্ততাকে ঘিরে মেটেলি হয়ে সামসিং পাহাড়তলীর এক মনোরম জনপদ। এখানকার বেশিরভাগ মানুষের জীনবনযাত্রা চা বাগিচাকেন্দ্রিক। সামসিং থেকে স্থানীয় মানুষজন নিচে নেমে এসে প্রয়োজনীয় রসদ কেনাবেচা করে। জনমত সমীক্ষা যাচাই করতে বেরিয়ে পড়লাম চা বাগিচা বলয়ে।
ভোটের পর ভোট পেরোলেও আজও জলপাইগুড়ির বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের দূর্দশা মেটেনি। আসলে ভোটের মরশুমে আদিবাসীদের কদর বেড়ে যায়। এমন বেশ কিছু লোকসভা আসন রয়েছে যেখানে আদিবাসীদের মতদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাপের নেত্রীকেও জন বারলার মতো অকিঞ্চিৎকর নেতাকে আক্রমণ করতে হয়। এমনিতেই সারা বছর আদিবাসীরা এত গুরুত্ব পান না। পরিসংখ্যান বলছে অন্য রাজ্যের আদিবাসীদের তুলনায় এই রাজ্যের আদিবাসীরা যেমন সাক্ষরতা, স্বাস্থ্য, এবং কৃষিমজুরের নিরিখে পিছিয়ে রয়েছেন, তেমনি অন্য অনেক সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। যদি গোটা দেশের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে সাধারণ শ্রেণীতে সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৩ শতাংশ সেখানে তপশিলি উপজাতিদের সাক্ষরতার হার ৫৯%। আর সাক্ষরতার বিচারে তপশিলি উপজাতিরা আমাদের রাজ্যে আরও পিছিয়ে। তাই সাক্ষরতার নামে এতদিন ধরে এই রাজ্যটার হচ্ছেটা কি? নাকি তাদের অন্ধকারে ফেলে রাখাটা একটা পরিকল্পিত সামাজিক প্রক্রিয়া। এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন সামাজিক অর্থনৈতিক সূচক এর বিচারে বেশ কয়েকটা ক্ষেত্রে আদিবাসীরা পিছিয়ে রয়েছে। ভোটের সময় এইসব কথা ওঠে। কারণ এই বাজারে ভোটের দাম কম নয়। কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকার ফলে বাগানের ছেলেমেয়েরা ভিনরাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়। অর্থনৈতিক দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে চা বলয়ের সহজ সরল যুবতীদের বিপথে চালিত করা হয়। চা শ্রমিক পরিবারগুলিতে বাসা বেধেছে দারিদ্র্য ও অপুষ্টি। চা বাগানের ভোট গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক ভূমিকা নিচ্ছে সাম্প্রতিককালে। জলপাইগুড়ি বা আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের চা বাগিচা বলয়ে আদিবাসী বিকাশ পর্ষদের পাশাপাশি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার মজদুর ইউনিয়ন আছে। কংগ্রেস অনুমোদিত ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স আছে। তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন বাগানে ইউনিয়ন রয়েছে। নিজেদের কোন শ্রমিক সংগঠন না থাকলেও গেরুয়া শিবির ধীরে ধীরে সংগঠিত হচ্ছে। কিন্তু এত সংগঠন থাকলেও ন্যূনতম মজুরি চুক্তি না হওয়ার ফলে সাধারণ চা শ্রমিকেরা আগের মত শ্রমিক সংগঠনগুলির উপর ভরসা রাখতে পারছে না।
চা বাগানগুলিতে আরএসএসের স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠিয়ে বিজেপি রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে বাকি রাখেনি। প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্টকে মান্যতা না দিয়ে বাগিচা শ্রমিকদের প্রতি শোষণ, অবিচার ও অত্যাচারের কাহিনী, ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের শোষণ, মালিকপক্ষের সীমাহীন অমানবিকতা, এমনকি সরকারের উদাসীনতাতে কিলকট চা-বাগিচার সেই বীভৎস শ্রমিক সংঘর্ষ এবং রক্তাক্ত অধ্যায় আজ ইতিহাস। রেড ব্যাঙ্ক চা-বাগিচার ১৫ জন শ্রমিককে পুড়িয়ে মারার সেই বীভৎস দৃশ্যপট আজও চোখের সামনে উন্মোচিত। এই লেখা লিখতে বসে আজও চোখের সামনে ভাসে তারকেশ্বর লোহারদের মত অত্যাচারী, শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের জেহাদ। পরবর্তীকালে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের চোখ ওলটানো। চা বাগানের সংগঠিত ভোটের ক্ষেত্রে বামপন্থীরা এখন আর সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তি না পাওয়া নিয়ে কৃষকদের মধ্যে যথেষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে। চা বাগানে পিএফ এর মোটা অংকের টাকা বকেয়া রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা বাগিচার সংগঠনগুলির বর্তমান শক্তির ভিত্তিতে সেজন্য ভোট ভাগাভাগি হচ্ছে। পাশাপাশি জাতিসত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে দিনদিন। সামসিং চা বাগিচাতে গিয়ে একটা কথা মনে হল চা বাগানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে এখনও পর্যন্ত শাসক দল তাদের দায় ও কর্তব্যের যে খতিয়ান কথায় ও কাজে রাখতে সচেষ্ট হয়েছে তার কোনও বিকল্পই বিরোধীরা তুলে ধরতে পারেনি। যদিও জয়েন্ট ফোরাম মজুরি বৃদ্ধির দাবি নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন করে শ্রমিকদের আস্থাভাজন হয়েছে। কিন্তু তার প্রতিফলন পড়েনি ২০২১ এর বিধানসভার ভোটের বাক্সে। বেশিরভাগ চালু বাগানগুলিতেই শ্রমিক মহল্লায় পানীয় জল থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য পরিষেবার মান আগাগোড়াই অত্যন্ত নিম্নগামী। মালিকপক্ষ শ্রমিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে উৎপাদনেই ব্যস্ত। সেইসব চিত্র কিন্তু বদলায়নি।
আজ যখন বিরোধীরা শ্রমিক স্বার্থ থেকে শুরু করে পানীয় জল, বিদ্যুৎ সরবরাহ, স্বাস্থ্য পরিষেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন কিন্তু চা বাগান শ্রমিক-কর্মচারীরাই অতীতের সঙ্গে আজকের অবস্থানের কোনও ফারাক খুঁজে পান না। বিরোধীদের মতে, রাজ্যের অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে ঋণ নিয়ে পাইয়ে দেওয়ার উন্নয়নই বর্তমান শাসক দল করে চলেছে। এর আগেই বাগান ঘুরে দেখা গিয়েছে দান খয়রাতিতে আপাতত খিদের যন্ত্রণা মিটলেও চা-বাগানের মানুষগুলি চায় বাগান ফের চালু হওয়ার মতো স্থায়ী সমাধান। কারণ এতদিনে তারা সবাই জেনে গেছে এ সমস্যা বাগান মালিকদের নিজেদের তৈরি, চা-শিল্পের নয়। শুরু হয়েছে বন্ধ এবং রুগ্ন চা বাগিচাগুলিকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। আপাতদৃষ্টিতে চা বাগিচা শ্রমিকদের জন্য বহুবিধ জনকল্যাণকর কর্মসূচী গ্রহণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলন কিন্তু চলছে। বোনাস সমস্যা এবার চা বাগিচাতে প্রায় সর্বসম্মতভাবে হয়েছে। বাগানগুলিতে যাচ্ছি প্রকৃত চিত্র চাক্ষুষ করার বাসনায়। তবে তার আগে এটুকু অনুমান করাই যায় দীর্ঘ বঞ্চনার ক্লেশ ও শ্রমিক নেতাদের ভণ্ডামি-গুণ্ডামি সহ্য করার পর ডুয়ার্সের চা বাগানে যে আশার আলো তৈরি হয়েছিল নতুন সরকারকে ঘিরে গত দশ বছরে তা অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে। সেদিনও মালবাজার ফেরত শাসক দলের সমাবেশে শ্রমিকদের ঢল নিজের চোখে দেখে এসে কলম ধরছি। তবুও মনে হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম সমাবেশের উন্মাদনার ছিঁটেফোটাও নেই। সমাবেশ বৃহৎ হলেও যান্ত্রিক।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴