পইলা সাঞ্ঝির কথা/৩৩
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৩৩
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
দোলাবাড়ির গান
"বাপোই চ্যাঙেরা রে
গাছোত চড়িয়া দুইটা হা
ও মোক জোলপোই পাড়েয়া দে,
তুইও দুইটা নেক রে বাপোই
মোকো দুইটা দে
আরো দুইটা দে রে বাপোই
ছাওয়ালার বাদে
বাপোই চ্যাঙেরা রে।।
"কার না গালাখান শুনা যাছে তো?"
মাঠ থেকে ভেসে আসা গানটা একটু কান পেতে শুনে বসমতী কান্তেশ্বরকে জিজ্ঞেস করে।
"কার আরো! হামারে মাই গান করেছে।"
বসমতীর মুখটা খুশিতে হাসি হাসি হয়ে ওঠে। কিন্তু টিপ্পনি কাটতে ছাড়ে না।
"বাপো গিদাল তার ছাওয়াও গিদাল।"
"হবে কে না তে! তোমার তো গালাত সুরে নাই। গান করা তো বাদে দিলুঙ।"
বসমতী রাগ করতে যাবে তার আগেই উঠোনে রসবালা এল।
"হ্যাঁ, দা তোমার কুস্যিটা।"
রসবালা একটা কুস্যি এনে উঠোনের এক কোণে রাখে।
"থো ওটে। তে হইসে তে, কাজ হইসে? বাউ আইচ্চে?"
"আইচ্চে কালি। আরো যাবার নাগিবে। উয়ার মাহোই বলে আসিরে না দে। নানাগে বাপোই, নানাগে বাপোই। তে ইয়ায় যে, কোনোটে যায়া এখেনা নোবার না চায়।"
রসবালার জামাইয়ের শরীর ভালো না দেখে ছোটছেলে বিষেণ গেছে এখান থেকে জমি জমাগুলো চাষে সাহায্য করতে। যাওয়ার সময় কান্তেশ্বরের বাড়ি থেকে বড় কুস্যিটা নিয়ে গেছে মাটির ঢ্যালা ভাঙার জন্য। কান্তেশ্বর হাসতে হাসতে বলে,
"বাচ্চা বাউটাও বড় হয়া গেইল। নগদে হালের মুঠি ধরিল। তে উয়ায় খাওনা ফাটের পায় এলাইতে? আর গোম চাষোতো না ভালে চাষ নাগে। এই গোম পয়রা।"
তারপর আপন মনে বলে,
"মোর কি কম খাটুনি গেইল মাই? গোম চাষে নাগে ছয় চাষ। দুই চাষ করি একবার মই দিবার নাগে। চাইর চাষে আরো একবার মই। তারপাছে ছয় চাষে আরো মই। গরুর হালে এক বিঘায় একচাষ একদিন নাগে। তে বুধেশ্বরটাক নিসুং। মোকো না হালখান ধরির নাইগসে!"
রসবালা বলে,
"হুটা তো হয় দা! কামলার পাছোত না থাকিলে কী কাজ আগায়? তে বাউও পায়! না পায় তে কী! সবলায় পায় এলা। সেমতোন হইলে উয়ায়ে তোমার জমিলাও চাষে দিবার পারিবে।"
কান্তেশ্বর এবার জানতে চায়,
"তে কী আবাদ করেছে?"
রসবালা টেনে টেনে বলে,
"পয়রা ফেলাইসে বাউ। পাকিতে ওদি এখেনা দেরি হইলেও চলিবে তাতে। গোম তো দুন বাতাসিয়া দিনোত থাকিবে না, নষ্ট হয়া যাবে। উমরা আগোতে তাঙ্কুবাড়ির ভুঁই করি ফেলাইসে। তাতে জাঙোই কনেক অসুখোত পড়িসে। বিয়াই এলা বয়েস হইসে। পায় না সেমতোন।"
"পয়রাত কষ্ট বেশি তেমনি। পয়রার বতর তো এই পুষমাসখানোতে না। এই পাঁচ ছয় তারিখে ফেলায়।"
তারপর রসবালাকে বলে,
"কতলা কইচ্চে?"
রসবালা বলে,
"বেশি নাই করে। এক বিঘা। উমরা তাঙ্কু গাড়ে বেশি। তাঙ্কুতে পাইসা।"
কান্তেশ্বর মনে মনে হিসেব করে। বলে,
"এক বিঘাত পয়রা নাগিবে পাঁচ কেজি। গোম নাগিল হয় দুই কেজি মতোন। বিছোন কি বাড়িরে?"
"বাড়িরে। নাউয়ের বসোত থুসে। ওইলায় ফেলাইসে। আরো গাজা বেড়াইলে এই মাসখানেক বাদে না আরো যাবে। জল দিবার।"
কান্তেশ্বর বলে,
"পয়রাত বেশি জল নানাগে। জমিত অস থাকিলে তো একবারও নানাগে। না থাকিলে গাজা বিড়িবার তিরিশ, পঁয়তিরিশ দিন বাদে একেনা হালকা করি সেচ দিলেই চলে। জলের ফেস্টি বেশি গমবাড়িত আর তাঙ্কু বাড়িত। গোমবাড়িত তো দুইবার জল দিবারে নাগে। একবার গাজা বিড়িবার পরে, একবার ঢেসাইলে। পয়রাত হিদি কষ্ট নাই তে পয়রা ভুকাইতে কষ্ট মাই।"
রসবালা হাসে।
"উমরা না গোমে করে। কিন্তুক এইবার জমি চাষের পায় নাই সোমাইতে। জাঙোইর শরীলটা খারাপ হইল। নমলা গাড়িলে যে পাকিতে দেরি হলে দুন্দোতে গোম পড়ি যাবে। মাইর কনেক যাবে কষ্ট।"
কান্তেশ্বর রেডিওতে কিছু একটা শুনছিল। বন্ধ করে বলে,
"আয়, এদি পিঁড়াখান নিয়া বইস।"
রসবালা শশব্যস্ত হয়ে বলে,
"না বোইসোঙ দা। মাই কোটে? দেখেছোঙকে না আজি আরো?"
কান্তেশ্বর গলাটা উঁচু করে বলে,
"ওয় যে শুনিছিত না? গান করির ধোইচ্চে। বাপোই চেঙেরা রে। গোমবাড়িত প্যাটে দিসুঙ পকি পিট্টির জইন্যে। ওটে সুকারুর বেটিও আছে। গামছা দিয়া শাড়ি পিন্দিয়া নাচি নাচি গান করেছে।"
বসমতী হাতে চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে বলে,
"মাই হামার গালা ছাড়ি দিসে এখেরে। নেক মাই চা কনেক। তোর দাদা বলে না যায় আজি। আরো চা খাবে। আজি ভাত হামার দেরি আছে।"
রসবালা চা হাতে নিয়ে সসংকোচে বলে,
"তে মোরো জইন্যে করির নাগে এখেরে?"
বসমতী ও কথার উত্তর না দিয়ে বলে,
"বোইস তো পিঁড়াখানোত।"
তারপর ঘর থেকে নিজের চা-টাও হাতে নিয়ে এসে বলে,
"ততকরায় মাই, পয়রাত খিবে ভেজাল তো। আগোত হামার কইচ্চে। মুই এলা ওইলা ফেস্টি না করোং বা।"
তারপর একটু থেমে বলে,
"গোমের থাকি পাকেও দেরিত কনেক। তে গোম তো মনে কর ডাঙেয়ায় পরিষ্কার হয়। পয়রা গরু দিয়া মাড়া মারির নাগে। তার পাছে সামোত ভুকা কষ্ট করি। ভুকাইতে ভুকাইতে চকচকা হবে, সেলা ঝাড়েক। তার পাছে অল্প জলের ছিটা দিয়া সাটেক। সাটিয়া আরো ভুকা। এমতোন করি চাইর ভুকা দিলে তবেসিনি পয়রার দেকা পাবু। দ্যাখ তো কেমতোন পেরাসনিখান!"
রসবালা মাথা নাড়ে।
"হুটা তো হয়। তার পাছে খাইতেও পেরাসোনি। বালাত ভাজি সামোত গুন্ডা করি গুন্ডাখেনা খাবার নাগে। এত কষ্ট করি কী পালু?"
বসমতী হাসে। বলে,
"মিশিঙোত গুন্ডা করি আটা ভাঙে আনি উটিও না খাবার পাইস। তে হিলা তোর গোমের আটার উটির মতোন করি না ভাজে। আটার মতোন ডল্লের নানাগে। হাতোতে তালুত করি দোনো হাতে গোল করি উটির মতোন বানে ভাজির নাগে।"
তারপর থেমে বলে,
"মেলাদিন পয়রা খাওয়া নাই। মাই ঘরের চাইট্টা আনিস তো। ভাজিয়া গুন্ডা খামু।"
রসবালা বলে,
"মুই বাউক কসুং। অল্প চাইট্টা আনিস হামারো বাদে। ওটে থাকি নিসখেনে দি।"
কান্তেশ্বর বলে,
"তে পয়রাত তেমন লাভ আছে। যতোই দুন-বাতাসখান আসুক। উয়াক ঝড়ের না পায়!"
রসবালা বলে,
"কাথাটা হয় দা! ইমারে পয়রাখান নমলা হইল। ফাগুনোত তো হবে। হইতে হইতে ওই চৈতমাস যাবে। তাতো দেরি হবার পারে। পয়রা আরো একদায় পাকে না। তে চৈতের শ্যাষ আর বৈশাখোত পইল্লে তো দুনের নাগাল পাইল। হয় কি নাহয়?"
রসবালা কাপগুলো তুলে নিয়ে কলপাড়ে মেজে রাখে, বসমতীর কোনো নিষেধ শোনে না। এরমধ্যেই দুটো গামছার একটা কোমরে একটা আঁচল বানিয়ে শাড়ি পরে মল্লিকা হাজির। ওকে দেখে রসবালা হেসে বলে,
"বায় মাই, বেইশ তো ঢক হোসিস!"
মল্লিকা লজ্জা পেয়ে হাসে। বলে,
"গোমবাড়িত পকি পিট্টাছি মামি। তে খেলাও খেলাছি। জল নিগির আসিলুং। তিস্যা নাগাইসে।"
কান্তেশ্বর হেসে বলে,
"গান করি বেটির মোর গালা ভাঙি গেইসে!"
রসবালা যাওয়ার আগে মল্লিকাকে সাথে নিয়েসগল্প করতে করতে বের হয়। পাশের গম খেতে তখন আরো কিছু বাচ্চা জুটে গেছে। ওখানেই একটা খেলার আয়োজন হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দড়ি টেনে শব্দ করে পাখি তাড়ানো হচ্ছে।
...........................................................
কুস্যি - বাঁশের ডাঁটি লাগানো কাঠের চৌকোণা বা একটু গোল কিন্তু লম্বাটে গড়নের জিনিস। মইয়ের সাথে মাটির ঢ্যালা ভাঙার জন্য কাজে লাগে।
দুন-বাতাস - ঝড়-বৃষ্টি
অস - রস
ঢেসাইলে - প্রথম শিষ বেরোনোর সময়টা
ততকরায় - সত্যি
ভেজাল - ঝামেলা
ফেস্টি - ঝামেলা অর্থেই ব্যবহৃত হয়
সেলা - তারপর
সাটেক - অল্প জলে হাত দিয়ে মেখে নেওয়া
ইমারে - এদেরই
একদায় - ঝট করে বা তাড়াতাড়ি
তিস্যা - তৃষ্ণা
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴