চা-ডুবুরি/পর্ব - ৩৩
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^^
চা-বাবুদের মুছে যাওয়া দিনগুলি ( ১)
---------------------------------------------------
বইয়ের প্রথম পাতাটি ওল্টাতেই ঝকঝকে মুক্তাক্ষরে শুভেচ্ছা পংক্তিগুলি চোখে পড়ে সুবর্ণর, 'সজীব ডুয়ার্সের চালচিত্রে চলার গতি আজ স্তিমিত,তবু অতীত সততই সুখের। সুবর্ণকে শুভেচ্ছা সহ-' নিচে সত্যবাবুর স্বাক্ষর। বন্ধু অতীনের সাথে যুগ্মভাবে এই বইটি লিখেছিলেন সত্যপ্রিয়। চা-বাগান তথা ডুয়ার্সের ওপর চমৎকার তথ্যপূর্ণ,ঘটনাবহুল লেখা। বইটি পড়ে অনেক অজানা বিষয় জানা গেছিল। উপন্যাসটি শুরু করার পর বিভিন্ন সময় বইটি খুব কাজে লেগেছে সুবর্ণর। তেমনি অবাক হতে হয়েছে সে যুগের বাবুদের কথা পড়ে। যেমন এই অংশটা পড়তে পড়তে সুবর্ণ অতীতের ধূসর প্রেক্ষাপটে নিজেকে কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হতে থাকে।
সত্যবাবু লিখেছেন," চল্লিশের দশকের সূচনাপর্বে ডুয়ার্সের বিস্তির্ণ অঞ্চল ছিল গভীর জঙ্গলাকীর্ণ। অরণ্য এতটাই গভীর ছিল যে দিনের আলোও সেখানে প্রবেশ করতে পারত না। বন্য জন্তুর অবাধ বিচরণস্থল ছিল সেসব বনভূমি। নেহাৎ ঠেকায় না পড়লে দিনের বেলায় পারতপক্ষে কেউ অরণ্যের শুঁড়িপথ ধরে যাতায়াত করত না। অথচ সেদিন সেই ছেলেটির ঐ পথ ধরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায়ও ছিল না। ।
পূর্ববঙ্গ থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে চাকরির সন্ধানে ছেলেটি এসেছিল ডুয়ার্সে। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছে। দিদিমার কাছে মানুষ। দিদিমাই তাকে চা-বাগানে চাকরির পাওয়ার আশায় পাঠিয়ে দেন ডুয়ার্সে। কেননা সেসময় এ অঞ্চলে একের পর এক গড়ে উঠছিল চা-বাগান। চা-বাগানে একটু আধটু ইংরেজি জানা কর্মচারীর বিশেষ কদর, এ কথা ছড়িয়ে পড়েছিল অবিভক্ত বঙ্গের আনাচে কানাচে। যুদ্ধের আবহে অন্যত্র চাকরির বাজারও তখন বিশেষ মন্দা। চা-বাগানে তবু চাকরি মেলে। ছেলেটির হাতে তার মায়ের তৈরি নকশিকাঁথাটি তুলে দিয়ে দিদিমা বলেছিলেন," তর মায়ে বড় শখ কইরা বানায়সিলো,এইডা তার আশির্বাদ মনে কৈরা সঙ্গে রাখ্। বিপদ আপদ হইবো না।" ছোট্ট পুঁটুলিতে মায়ের স্মৃতি, সামান্য চিঁড়ে-গুড় আর এন্ট্রান্স পাশের সার্টিফিকেটটা সঙ্গে করে সে নেমে পড়ে দলগাঁও স্টেশনে। মুখচোরা ছেলে। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করে পূবের দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখে দুধারে যতদূর চোখ যায় শুধুই চায়ের গাছ। ছড়ানো ঘন সবুজ গালিচা যেন। গালিচার শেষপ্রান্তে চোখে পড়ে বাড়িঘর। ছেলেটির মনে পড়ে যায় দিদিমার কথা। ওখানে গেলেই হয়ত চাকরি মিলতে পারে। এই ভেবে রেললাইন ছেড়ে ছেলেটি সোজা ঢুকে পড়ে সেই চা-বাগানে। পথে বাগানের বড়বাবুর সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "খোকা,যাচ্ছ কোথায়?" ছেলেটির তখনও দাঁড়িগোঁফ ভাল করে গজায় নি। পরনে ধুতি আর হাফহাতা সার্ট। নবীন ছেলেটিকে তাই "খোকা" সম্বোধন অসঙ্গত ছিল না কোনোদিক থেকেই।
ছেলেটির মুখে সব শোনার পর তাঁর শুকনো মুখ দেখে বড় বাবুর মায়া হয়। তিনি বলেন," দেখে তো মনে হচ্ছে কিছু খাওয়া দাওয়া হয়নি তোমার। এসো আমার সাথে। " বলে তিনি তাঁকে নিয়ে গেলেন নিজের বাসায়। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর তিনি একটি চিঠি তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন দলসিংপাড়া চা বাগানে গিয়ে সেখানকার বড়বাবুকে দিতে। ওখানে অফিসে একটি করণিকের পদ খালি আছে। ভুটান সীমান্তের কাছাকাছি সেই চা-বাগান। বলে দিলেন রেল লাইন ধরে এগোতে। ও'পথে গেলেই দিনের আলো থাকতে পৌঁছে যেতে পারবেন। ছেলেটি তাড়াতাড়ি পা চালায় রেললাইন ধরে। কিছুটা দূর যেতেই মাদারিহাটের জঙ্গল। বড়বাবু একবার বলেছিলেন এই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আড়াআড়ি পথে এগোলে তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যাবে গন্তব্যে। তবে অচেনা সে পথে নতুন আসা মানুষের না যাওয়াই ভাল। ছেলেটি বনের কাছাকাছি এসে দোটানায় পড়ে যায়। পদ্মাপারের মাটিতে কোথাও এত ঘন জঙ্গল দেখে নি সে। একটু যেন ভয়ভয়ও করে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটি আদিবাসী পুরুষকে। কাঁধে টাঙ্গি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকছে। তাকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন কোন পথে গেলে তিনি দলসিংপাড়া পৌঁছতে পারবেন। আদিবাসী মানুষটি ছেলেটির ভাষা না বুঝলেও আকারে ইঙ্গিতে ও বাগানের নাম শুনে আন্দাজ করে ছেলেটিকে তাকে অনুসরণ করতে বলে।
হেমন্তের মিঠে রোদ তখন সামান্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। ছোট ছোট ঝোপঝাড় পেরিয়ে শুঁড়িপথ ধরে জঙ্গলে ঢুকতেই আলো আঁধারি ঘিরে ধরে চারদিক থেকে। আগে আগে কোমরে ল্যাঙোটের মত কাপড় পরা, মাথায় পেঁচানো সাদা আধময়লা কাপড়, কৃষ্ণবর্ণ খালি গা, কাঁধে কাঠ কাটার অস্ত্রটি নিয়ে আদিবাসী ছেলেটি এগিয়ে চলেছে দ্রুত উদোম পা দুটি ফেলে । তার চলার সাথে তাল মিলিয়ে পা ফেলছিল অরণ্যে প্রথম পা রাখা মানুষটিও। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে নিচ্ছিল অগ্রবর্তী কৃষ্ণকায় পুরুষটি। দেখছিল আর পিছিয়ে পড়া আগন্তুকের চলার গতির সাথে নিজেকে মেলাতে শ্লথ করছিল গতি।
কিছুটা পথ পেরোনোর পর একটা ঢালু, জলাভূমির কাছাকাছি এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সেই আদিবাসী পুরুষটি। সভয়ে পিছিয়ে এসে সে ঘুরে দাঁড়ায় । তারপর ঠোঁটে আঙুল রেখে ইঙ্গিতে থেমে যেতে বলে অনুগমনকারীকেও। থেমে যেতেই আঙুল দিয়ে দেখায় কয়েক হাত দূরে পড়ে থাকা সদ্য ত্যাগ করে যাওয়া হাতির মলের দিকে । তখনও মল থেকে গরম বাষ্প উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অদূরে সশব্দে গাছের ডাল ভাঙার শব্দ পাওয়া যায়। গাছের আড়ালে চোখে পড়ে অতিকায় প্রাণীটিকে। একদন্ত মহাকায় জীবটি আপনমনে পেছন ফিরে একা অরন্যের ডালপালা ভেঙে চলেছে। বিস্ফারিত চোখে ছেলেটি লক্ষ্য করে হাতিটিকে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা গেছে ভেবে বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে থাকে তার। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর হাতিটি গভীর অরণ্যে মিলিয়ে যেতেই দুজনে ফের দ্রুত পা পাড়ায় গন্তব্যের দিকে। দলসিংপাড়া বাগানে পৌঁছে চিঠিটি বড়বাবুকে দিতেই পরদিন ছেলেটিকে মাসিক বারোটাকা বেতনের করণিকের চাকরিতে বহাল করা হয়। পরবর্তীতে ছেলেটি ঐ বাগান ছেড়ে চলে আসেন কাজলিডাঙায়। সেখান বড়বাবুর পদে একাদিক্রমে সত্তরের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চাকরি করে। সুঠাম চেহারার, পরোপকারী, সজ্জন এই ব্যক্তিটির নাম ছিল শ্রীনাথবন্ধু বসু। "
সহজ গদ্যে এভাবেই লিখেছেন সত্যপ্রিয়। সত্যপ্রিয় ঘোষ, চা বাগানের প্রত্যন্তে বসে নিভৃতে সাহিত্যসেবা করে যাওয়া প্রচারবিমুখ একটি মানুষ। চা-বাগানের প্রাচীন ইতিহাস অনুপুঙ্খ জেনেও কোথাও ইতিহাসের চর্বিত চর্বণ করেন নি তিনি। সে সব ইতিহাস অনেকেই জানেন। অনেক বই ও পত্র পত্রিকায় লেখাও হয়েছে সেসব কথা। সত্যপ্রিয় শুধু ভালবাসা দিয়ে লিখে গেছেন চা বাগানের মানুষের কথা। বহু অজানা ঘটনার কথা। শুধু এই বইটিতেই নয়, বিভিন্ন পত্র পত্রিকা সত্যপ্রিয় ঘোষের চা বাগান বিষয়ক লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে। বহু বিচিত্র মানুষকে কাছ থেকে যেমন দেখেছেন, তেমনি জারিত করেছেন নিজেকে চা রসের সাথে। চা-সবুজের আদিগন্ত জলে ডুব দিয়ে নিজের চা-যাপনের অভিজ্ঞতা ও পরিচিত মানুষের কাছ থেকে জোগাড় করা তথ্য দিয়ে লিখেছেন চা জীবনের অজানা সব বাস্তব কাহিনি।
তিরিশ কিংবা চল্লিশের দশকে কিংবা তারও আগে যেসমস্ত বাঙালি যুবক রোজগারের আশায় স্বজন পরিজনদের ছেড়ে এই প্রত্যন্ত পান্ডববর্জিত চা-বাগান গুলোতে এসেছিলেন সেই আসাও ছিল বড় কষ্টকর। সত্যপ্রিয়র লেখায় সেই কথাগুলো ফুটে উঠেছে এভাবে, "সে আমলে যাতায়াতের জন্য মূলত রেলগাড়ির ওপর নির্ভর করতে হত। মোটামুটি তিনটি পথ এ জন্য ব্যবহার করা হত। যাঁরা বর্ধমান, বীরভূম, কলকাতা কিংবা পূর্ববঙ্গের যশোর, খুলনা, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আসতেন, তাঁরা রেলগাড়িতে জলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে নেমে নৌকোয় তিস্তা পেরিয়ে বার্নেশঘাট হয়ে ডুয়ার্সে প্রবেশ করতেন। রেলের ব্যবস্থাপনায় তিস্তা পারাপার করতে হত। নৌকোয় ওঠার জন্য রেলের টিকিট কাটতে হত। বার্ণেশঘাট থেকে পুনরায় ট্রেনে চেপে তবেই ডুয়ার্সের পথে পাড়ি দিতে হত। অন্য পথ ছিল অধুনা বাংলাদেশের পার্বতীপুর স্টেশনে নেমে মিটারগেজের গাড়িতে লালমণিরহাট, চ্যাংড়াবান্ধা, ময়নাগুড়ি রোড স্টেশন হয়ে লাটাগুড়ি স্টেশনে নামা। সে সময় ডুয়ার্সের লাটাগুড়ি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশন। ডুয়ার্সের চা-বাগান থেকে ইংরেজ ম্যানেজার বাগানে কর্মচারীর প্রয়োজন মেটাতে ঘোড়ায় চেপে বনজঙ্গল ঘেরা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে রেলস্টেশনে হাজির থাকতেন। ট্রেন থেকে কোনও বাঙালি যুবককে নামতে দেখলেই ইংরেজ ম্যানেজারের দল তাকে ঘিরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করত। কোথায় যাবে, চাকরি খুঁজতে এসেছে কিনা, ইত্যাদি। তারা চা-বাগান কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখাত। যাঁরা প্রকৃতই চাকরি খুঁজতে আসত, তাঁরা সহজেই কোনও-না-কোনও বাগানের ম্যানেজারের কথায় রাজি হয়ে নির্দিষ্ট বাগানের পথে রওনা দিত বা স্টেশনে উপস্থিত ইংরেজ ম্যানেজার নিজের বাগানের গরু বা মোষের গাড়িতে সেই যুবককে বাগানে পাঠাত। একসঙ্গে তিন,চার বা তারও বেশি গরু বা মোষের গাড়ি যাতায়াত করত। স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট বাগানে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় লেগে যেত.... পরপর পাঁচ ছ'খানি গরুর গাড়ি, পাথর বিছানো এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা, প্রতিমুহূর্তে প্রচন্ড ঝাঁকুনি, দু'পাশে ঘন জঙ্গল, সূর্যের আলো প্রায় পড়েই না.... ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে কলতান, সেইসঙ্গে বলদের গলায় বাঁধা ঘন্টার টুংটাং শব্দ, বন্য প্রাণীর ভয়, সব মিলিয়ে এক দুর্বিষহ যাত্রা। "
শ্রীনাথবাবু যখন বড়বাবু সে সময়েই কাজলিডাঙার ফ্যাক্টরিতে চাকরিটা পাকা হয়েছিল সত্যপ্রিয়র। ভদ্রলোক তাঁকে স্নেহ করতেন খুব। বড়বাবুদের প্রসঙ্গ উঠলেই শ্রীনাথবাবুর কথা উঠে আসবেই সত্যপ্রিয়র মুখে। আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চা- বাগানের বড়বাবুরা যেখানে দোর্দণ্ডপ্রতাপ,সুবিধেভোগী, সাহেব তোষনকারী, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপছন্দের শ্রমিক কর্মচারীদের শায়েস্তা করতে সিদ্ধহস্ত, শ্রীনাথবাবু ঠিক সেই গোত্রের ছিলেন না। ক্ষমতা যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও পারতপক্ষে ক্ষতি করেন নি কারো। তাঁর কথা বলতে গিয়ে সত্যপ্রিয় বলেছিলেন, "শ্রীনাথবাবুর কোয়ার্টারটা অন্যান্য কোয়ার্টারের চাইতেও ছিল বেশ বড়। প্রায় দুটো কোয়ার্টার মিলিয়ে একটি। ছোটখাটো বাংলো বলা যায়। বাগানের বাবুদের কারো বাড়িতে সামাজিক অনুষ্ঠান হলে তিনি তাঁর বাংলোর ঘরগুলো ছেড়ে দিতেন। বাইরে থেকে কোম্পানির গেস্ট কেউ এলে বড়বাবুর বাড়ির বৈঠকখানাতেই থাকত তারা। সেখানে বড় একটি খাট পাতা থাকত। ঘরটাকে আমরা বলতাম 'রেডিওঘর'। পেল্লায় সাইজের একটা রেডিও ছিল সেখানে। গাড়ির ব্যাটারির সাহায্যে চলত সেই রেডিও। বাবুরা কেউ কেউ সন্ধে নাগাদ জড়ো হত সেই রেডিও ঘরে। শ্রীনাথবাবুর ছিল একটা ছোট ট্রাকের মত গাড়ি। অনেকটা এখনকার, পিক-আপ ভ্যানের মতো। সেই গাড়ি করে তিনি মাঝে মাঝেই স্ত্রী কে নিয়ে সিনেমায় যেতেন ফালাকাটায়। বিয়ের পর সত্যপ্রিয়কেও ডেকে নিতেন সাথে। বলতেন, 'সতু, তাড়াতাড়ি চলে যাও বাড়িতে। বৌমাকে বলো হাতের কাজ চটপট সেরে নিতে। নাইট শোয়ে সিনেমায় যাব।' সিনেমা দেখতে বড্ড ভালবাসতেন শ্রীনাথবাবু। "
সত্যপ্রিয়র মুখে সুবর্ণর শোনা যে শ্রীনাথবাবুর একটি দোনলা বন্দুকও ছিল। ছিলেন শখের শিকারী। আসলে তখনও বন্য প্রাণ সংরক্ষণ আইন হয়নি। বন্দুকের লাইসেন্স সহজলভ্য ছিল। তাই চা বাগানের বাবুদের অনেকের বাড়িতেই বন্দুক ছিল স্ট্যাটাস সিম্বল। শীতকালে ছুটির দিনে শ্রীনাথবাবু ডিমডিমা, দলগাঁও বাগানের বাবুদের সাথে ঐ গাড়িতে করেই যেতেন শিকারে। কাছাকাছি মুজনাই নদীর চরে অথবা কাজলি নদীর ধারে ঝোপঝাড়ে। মেরে আনতেন হরিয়াল, তিতির, বনমোরগ। একবার ডিমডিমার শিববাবুদের সাথে গিয়ে মেরে ফেলেছিলেন একটা মাদি হরিণ। হরিণটি যে গর্ভবতী ছিল জানা যায় পরে। সেটির পেট চিরে বাচ্চাটিকে জ্যান্ত বের করে কিছুদিন রাখা হয় শিববাবুদের বাড়িতে। কিন্তু বেশিদিন সেটি বাঁচেনি।
সত্যপ্রিয়র মুখে চা বাগানের বাবুদের এইসমস্ত শিকারের গল্প, বিখ্যাত শিকারী চা বাগানের বাবু পটা গুহ যাঁর পোষাকি নাম ছিল সুধাংশু তাঁর শিকার কাহিনি, বানারহাট বাগানের শিকারী ডাক্তার রায়নাথের কথা, আরো অনেকের কথা শোনে সুবর্ণ। সেই সঙ্গে চোখে ভাসে নীলপাহাড়ির কম্পাউন্ডার রথীনবাবু যিনি চা বাগানে ম্যালেরিয়ার মশা মারার কাজের তদারকি করতেন বলে লোকে বলত 'মচ্ছরবাবু' তাঁর কথা। ভদ্রলোক তার ডাবল ব্যারেলে লাল আর বাদামি রঙা কার্তুজ ভরে কত যে শিকার করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। সেই মচ্ছরজেঠুর নাতিরা ছিল সুবর্ণর ছেলেবেলার বন্ধু। ওদের বাসায় গেলে দেখা যেত দেয়াল জুড়ে হরিণের চামড়া, চিতাবাঘের চামড়া, বাইসনের স্টাফ করা মাথা, কাঁচের আলমারিতে স্টাফ করা বাঘের মাথা, বাঘনখ আর দেয়ালে টাঙানো মরা বাঘের গায়ে পা তোলা জেঠুর ছবি।
সুবর্ণর মনে পড়ে সেই সকালটার কথা। তখন সে প্রাইমারীর ছাত্র। সাতসকালে বাইরে শোরগোল শুনে বাবা বেরিয়ে যান। ফিরে এসে মাকে বলেন," শুনছো, রথীনদা কাল রাতে আবার একটা বাঘ মেরেছেন। ঠুলে- চৌকিদারকে দেখলাম দুজন লোককে দিয়ে বাঁশে বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। " চিতাবাঘকে চা বাগানের লোক সংক্ষেপে 'বাঘ'ই বলে থাকেন। সুবর্ণর মনে আছে একবার রথীনজেঠু স্বপ্নপুর চা বাগান থেকে একটি রয়েল বেঙ্গলও মেরে এনেছিলেন। সে সময় ডুয়ার্সে রয়েল বেঙ্গলও ছিল। বাবার কথাটা কানে যেতেই সেদিন সুবর্ণ বুঝে যায় কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মৃত বাঘটিকে। তড়াক্ করে বিছানা ছেড়ে উঠে জামাটা গায়ে গলিয়েই দে ছুট। পেছন পেছন মা চেঁচিয়ে উঠলেন," কোথায় যাচ্ছিস সোনা, কোথায়....। " কে কার কথা শোনে। সুবর্ণ ততক্ষণে হাওয়া।
রথীনজেঠুর বাড়ির উঠোনে ফেলা হয়েছে চিতাবাঘটাকে। লোকে ভীড় করে আছে দেখতে। ওদিকে কুকরিতে ধার দিচ্ছে ঠুলে চৌকিদার। খানিক বাদেই শুরু হলো অপারেশন। রথীনজেঠু দাঁড়িয়ে থেকে নির্দেশ দিয়ে কাটালেন বাঘের মাথা শুদ্ধ চামড়াটা।
সেটিকে আলাদা করে রাখা হলো। আরক মাখিয়ে পাঠানো হবে শহরে 'ট্যান' করাতে। এরপর শুরু হল চামড়া ছাড়ানো বাঘের মাংস কাটা। যে মাংসের প্রত্যাশায় মানুষের জমায়েত। নিমেষে ভোজবাজির মতো উড়ে গেল মাংস হাতে হাতে।
"তোমায় আরেকজন বড়বাবুর গল্প শোনাই।" সত্যবাবুর মুখে মধ্য ডুয়ার্সের একটি চা-বাগানের ক্ষমতাশালী, জাঁদরেল বড়বাবু কথা শোনে সুবর্ণ। তিরিশের দশকের বহু আগে থেকেই তিনি ছিলেন বড়বাবু। সেকালের চা বাগানের বড়বাবু বলে কথা। চা বাগানে সাদা চামড়ার সাহেবদের শাসন তখন তুঙ্গে। তারা কেবল বড়বাবুদের সাথেই কথা বলতেন। অন্য বাবুদের সাথে বিশেষ কথাই বলতেন না। স্বভাবতই বড়বাবুদের স্বতন্ত্র ক্ষমতা থাকত। সাহেবরা বড়বাবুদের কাছ থেকেই সব পরামর্শ নিতেন। খবরাখবর পেতেন। সাহেবদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তারাও বিশেষ কিছু সুবিধে ভোগ করতেন। সাহেবদের জন্য সেকালে লন্ডন থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র আসত। বিশেষ করে কাপড় চোপড়, অন্তর্বাস, মোজা ইত্যাদি। যখন সেসবের অর্ডার করা হতো এই বড়বাবু ভদ্রলোকটি নিজের জন্যও কয়েক প্রস্থ আনিয়ে নিতেন। আনিয়েছিলেন ব্যাটারী চালিত মাছ ধরার হুইলছিপ। যাতে ব্যাটারীর সাহায্যে ছিপের ফাতনা কাঁপত আর মাছ আকৃষ্ট হত বঁড়শির দিকে। সেসময় জলপাইগুড়ি শহরে কোনও কংক্রিটের ছাদ দেওয়া বাড়ি ছিল না। বাড়ি করার সময় তিনি কলকাতা থেকে লোহার রড দিয়ে স্ট্রাকচার বানিয়ে সেটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে ট্রেনে চাপিয়ে নিয়ে আসেন। তারপর তা দিয়ে ছাদ ঢালাই হয়। সেই বাড়ি ছিল সেযুগে রীতিমত ঈর্ষনীয়।
"শুধু তাই নয় সাহেবদের জন্য কলকাতা থেকে দর্জি আসত প্লেনে চেপে।" সত্যপ্রিয়র মুখে কথাটা শুনে অবাক হয়েছিল সুবর্ণ "দর্জি, কলকাতা থেকে! "
"হ্যাঁ,আসলে সে যুগে সাহেবদের জন্য স্টাইলিশ স্যুট-প্যান্ট বানানোর মতো দর্জি এ তল্লাটে ছিল না। থাকলেও তাদের দিয়ে বানাবেন কেন তাঁরা। কলকাতার বড় বড় দর্জিরা আসতেন। তাদের খাতিরেই ছিল আলাদা। তারা এসে বাংলোয় রাত্রিবাস করতেন। সেসময় ডুয়ার্সে বেশ কতকগুলি ছোট ছোট এরারফিল্ড ছিল। যেমন, এদিকে ঘাসমারি,তেলিপাড়া, ওদিকে কুচবিহার। কোনোও কোনও সাহেবদের নিজস্ব এয়ারফিল্ড ছিল সে তো আগেই বলেছি। জামিয়ার কোম্পানির ছোট ছোট ডাকোটা প্লেন নামত এ অঞ্চলে। তাতে মূলত মাল পরিবহনের সাথে অল্প সংখ্যক যাত্রীও চলাচল করত। ঐ প্লেনেই আসতো চা বাগানের ডাক,পার্শেল। এছাড়াও সাহেবদের জন্য কলকাতার নামি বেকারির পাঁউরুটি, কেক, পেস্ট্রি,চিজ, বাটার ইত্যাদি। যদিও পরবর্তীতে সাহেবরা তাদের বাবুর্চিদের শিখিয়ে নিয়েছিলেন কিভাবে কেক তৈরি করতে হয়। বাবুর্চিদের মধ্যে মূলত আসাম, চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আসা "বড়ুয়া"পদবীধারী বৌদ্ধ বাবুর্চিরা ছিলেন রান্না ও বেকিংয়ের কাজে দড়। যা হোক, কলকাতার দর্জিরা বিভিন্ন চা বাগান ঘুরে ঘুরে সাহেবদের জামাকাপড়ের মাপ নিয়ে যেত। তারপর কিছুদিন বাদে সেই জামাকাপড় ডেলিভারি দিত সঠিক সময়ে। সাধারণত সাহেবরা ছাড়া অন্য কারও জামা কাপড় তারা না বানালেও সেই বড়বাবু ছিলেন ব্যতিক্রম। ঐ সমস্ত দর্জিদের দিয়ে তিনিও অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিলেন স্যূট। পরবর্তীতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে কোম্পানি কলকাতায় রেখে তার চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেছিল। তার কোয়ার্টারে দু তিনটে সার্ভেন্ট কাজ করত। সে এক রাজকীয় ব্যাপার।"
-------------------------------------------------------------
পর্ব ৩২ এর সংশোধনী
গত পর্বে শৌলমারী আশ্রমটির অবস্থানগত তথ্য সম্পর্কে কিছু ভুল ছিল। আশ্রমটি কুচবিহার জেলায় অবস্থিত হলেও ফালাকাটা শহরের লাগোয়া ও মুজনাই নদীর তীরে অবস্থিত। জটেশ্বর ও ফালাকাটার মধ্যবর্তী স্থানে নয়। এই ত্রুটির জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।