সামসিং চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
সামসিং চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
--------------------
শিলিগুড়ি বা জলপাইগুড়ি থেকে দুই আড়াই ঘণ্টা দূরত্ব পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাওয়া যায় গহন অরণ্য আর সবুজ আর ধূসরে মেশানো ছায়া ছায়া পাহাড়ের জগতে। নির্মেঘ সকালে যে দিন আকাশ আয়নার মতো ঝকঝকে থাকে সে দিন যে কোনও ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়েই নজরে আসে রুপোলী রঙের কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই অমল ধবল পাহাড়ের দিকে তাকালে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। সে কারণেই হয়তো পাহাড় পছন্দ করেন না এমন লোক পাওয়া মুশকিল। গ্রীষ্মের দহনজালা জুড়াতে পাহাড়ের হাতছানি উপেক্ষা করা সহজ কাজ নয়। তাই গরম পড়বার সঙ্গে সঙ্গেই মংপং, রোহিণী, বিন্দু, সামসিং, সুনতালেখোলার দিকে হুড়মুড় করে ছুটে যায় তাপিত মানুষ দহনজ্বালা জুড়াবার জন্যে। সারাদিন ধরে সবুজ পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে নিজের ভেতর আহরণ করে নেওয়া যায় প্রকৃতিকে। গাছের পাতা যেমন করে শুষে নেয় সূর্যের আলো, তেমনি করে প্রকৃতির তীব্র সবুজ শুষে নিয়ে পূর্ণ করে নেওয়া যায় প্রাণশক্তিকে। জলপাইগুড়ি থেকে চালসা পর্যন্ত একটানা এসে গোলাইতে থামলাম। সেখান থেকে বাঁ-হাতি পথ চলে গেছে মালবাজারের দিকে। চালসা ছাড়ালাম। ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক গেছে লাটাগুড়ি হয়ে ময়নাগুড়ি। হাইওয়ে খুনিয়া মোড় হয়ে চলে গেছে মাদারিহাটের দিকে। চালসা থেকে গোলাই হয়ে কিছুটা চড়াই ওপরে ওঠার রাস্তাতেই মেটেলি হয়ে সামসিং। পথের দুধারে মখমলি চায়ের বাগিচা জুড়িয়ে দিচ্ছে চোখ। কিলকট, ইনডং, আইভিল চা-বাগান ছাড়িয়ে এগোচ্ছে গাড়ি। এদিকে যাত্রীর তুলনায় গাড়ি অপ্রতুল। চালসা মোড় থেকে কিছু ট্রেকার সামসিং যায় দেখলাম। সেসব গাড়িতে বাদুড়-ঝোলা হয়ে রয়েছে মানুষজন। তাদের পিছুপিছু একটু বাদেই এসে পড়লাম মেটেলিতে। কেজো জগৎ থেকে যখন নিষ্কৃতি চায় মানুষ, তখন হঠাৎ করেই বাউল হয়ে ওঠে তার মন। সে সময় প্রকৃতির কাছেই আশ্রয় চায় সে। কেউ সেই আশ্রয় খুঁজে পায় সাগরে, কেউ অরণ্যে, কেউ পাহাড়ে। আমিও সেই নিভৃতি খুঁজে নিয়েছি মেটেলি সামসিঙের উজ্জ্বল সবুজের ভিতর।
বেড়িয়েছি বাগিচা সফরে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ। চালসা থেকে ৭ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করলে গাড়ি পৌঁছয় মেটেলি নামের ছোট্ট শহরে। এই জনপদের জীবনযাত্রা চা বাগানকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। অকৃপণ প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত আছে তাপিত মনের শুশ্রুষার চাবিকাঠি। মেটেলি মানে মাটির আলয়। ছোট্ট জনপদ। স্থানীয় ভুটিয়া, নেপালি এবং লেপচাদের সাথে চা বাগানের উপজাতি সম্প্রদায়ের শ্রমিকেরা মিলেমিশে একাকার। বেশিরভাগই চা বাগানে বংশানুক্রমে কাজ করে চলেছে। ঘিঞ্জি বসতি। পুরনো আমলের বাজার। মুদির দোকানের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে পাইন গাছের নিচে গাছতলার সেলুন, এসটিডিবুথ আর ফটোশপের দোকান। বোঝা যায় দিন বদলাচ্ছে। মেটেলি থেকে এগিয়ে এলে বাঁ দিকের একটা পথ চলে গেছে সবুজ পাহাড়ি পথে জুরান্তির দিকে। নদীর ধারে সুন্দর জায়গা জুরান্তি এক নির্জন সৌন্দর্য। বেশ চোখ জুড়ানো জায়গা। চা-বাগান, চা-কারখানা, বাগানের কর্মীদের বাড়িঘর ছাড়িয়ে এলাম। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ঝুম চাষের ধানের জমি নেমে এসেছে চোখের সামনে। পাহাড়ের গায়ে রোদ এসে পড়ছে, ঝলমল করছে পাহাড়। রিনরিন নিক্কণের শব্দ তুলে উপর থেকে নেমে আসছে পাহাড়ি ঝোরা। কাঠের বাড়িগুলো দূর থেকে দেশলাই বাক্সের মতো লাগছে। এই অঞ্চলে এখনো অনেক জায়গা সৌন্দর্যের অহঙ্কারে মোরা। ট্রেকিংয়ের জন্য দারুণ সব জায়গা। শুধু দরকার পর্যটন দপ্তরের সহানুভূতি এবং আন্তরিকতা। জনপদ থাকলেও যোগাযোগের অভাবে সেভাবে গড়ে ওঠেনি পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের সব মসলা এখানে মজুত। মেটেলি বেশ বড় জায়গা। এখানে থানা, বিডিও অফিস, বাজার, হাট ইত্যাদি সবকিছুই আছে। মেটেলি শহর ছাড়ালেই শুরু হয় চা বাগান। মেটেলি পর্যন্ত রাস্তা বেশ ভালো। কিন্তু মেটেলি থেকে সামসিং এর রাস্তা মাঝে মাঝে খুবই খারাপ।
আমরা এখন নেওড়াভ্যালির একাংশের পাশ দিয়ে সামনের পথে চলেছি। দুপাশে শুধু সবুজের মেলা। অসংখ্য চা বাগান সাজানো ছবির মত। সবুজের ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া চা বাগিচাগুলো যেন চিরযৌবনা। এই চা বাগানের শ্রমিকেরা কিন্তু টিকে আছে বড়ই কষ্টে। নানান চা-বাগানের নিচে চাপা পড়ে আছে তীব্র হতাশা এবং চাপা কান্না। চায়ের উৎপাদন আর মুনাফা এই দুইয়ের অভাবে বিপর্যস্ত চা শিল্প। তার উপর ডুয়ার্সের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বড়ই অসহায় এখানকার নির্লোভ আদিবাসীরা। যারা প্রকৃতির লোভে ছুটে আসি এসব জায়গায় হৃদয়ের টানে, তারা কখনোই উপলব্ধি করতে পারব না ওদের যন্ত্রণা। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে যে প্রাকৃতিক রূপের বর্ণনা করা অসম্ভব। প্রকৃতির অকৃপণ উৎসব জারি সামসিঙ উপত্যকাতে। মন ভালো হয়ে গেল সামসিঙে পেীছে। সামসিঙে সেবার এসেছিলাম শীতে। মণ্ডলগাঁও উপত্যকায় তখন চলছিল সামসিং-জলঢাকা কমলা উৎসব। জায়গাটা পতাকা দিয়ে ছয়লাপ করে তৈরি করা হয়েছিল একটি মূলমঞ্চ | সেই মূলমঞ্চটিকে ঘিরে রেখেছিল অনেকগুলো কমলালেবুর স্টল। পাশে হাতের কাজের পসরা নিয়ে বসে ছিলেন বেশ কিছু স্থানীয় শিল্পী। বাঁশ দিয়ে তৈরি ভারী সুন্দর একটা দোলনা ছিল। বেশ মনে আছে, তাতে দোল খাচ্ছিল ফুটফুটে এক নেপালি কিশোরী। ভলিবলের আসর বসেছিল একখানে। কিছু দূরে পাহাড়ের গায়ে চাঁদমারি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে হয়েছিল তির ছোড়ার প্রতিযোগিতা। সেই আসরে অংশ নিতে এসেছিলেন ভুটান থেকে নামীদামি তিরন্দাজরা। অপূর্ব সুন্দর সামসিং অরণ্যে ঘেরা, পাহাড় ঘেঁষা। থাকার জন্য আছে অনবদ্য বনবাংলো। সামসিং পাহাড়ি এলাকাতে বছরভর মনোরম আবহাওয়া থাকে। এখানে তাই বর্ষা বাদে আসতে হয়। পর্যটকদের ভিড়ে ক্লান্ত নয় এখানকার প্রকৃতি। সবুজ নিসর্গ আর পাখির কলতানে প্রধান সম্পদ আরণ্যক প্রকৃতির শোভা।
সামসিং টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী সামসিং অরগানিক টি কোম্পানি লিমিটেড। বর্তমান কোম্পানি ২০০৯ সালে বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে। প্রায় ১৩ বছর ধরে কোম্পানি ব্যাবসা করছে। তবে মালিকানার বারেবারে হাতবদল হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে গৌতম বোস অ্যাডিশনাল ডাইরেক্টর, ২০১৭ সাল থেকে কালিচাঁদ দাস, ২০২০ সাল থেকে ব্রজেশ চন্দ্র সিনহা পার্টনার শিপের ভিত্তিতে বাগান চালাচ্ছেন ডাইরেক্টর হিসাবে। শিলিগুড়ির ২ মাইল সেভক রোডে অবস্থিত কোম্পানির হেড অফিস থেকে বাগানটির পরিচালনা হয়। ডিবিআইটিএ এর সদস্যভুক্ত বাগানটির ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৭ জন, প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন তিনটি। এগুলি হল এনইউপিডব্লিউ, ডিটিডিপিএলইউ, পিপিপিডব্লিউইউ। সামসিং চা বাগানের আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ১২৫৬.৬৮ হেক্টর। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৫৬.১৩ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ১৩.৭২ হেক্টর। সাম্প্রতিক সফরে ম্যানেজারের কাছ থেকে শুনলাম এটা অনেকটাই বেড়েছে। এককথাতে বলা যায় মোট চাষযোগ্য উৎপাদন ক্ষেত্র ১২৫৬.৬৮ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য আবাদি জমি থেকে ১৫০০ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। সামসিং চা বাগিচায় নিজস্ব উৎপাদিত চা ১৮ থেকে ২০ লাখ কেজি এবং ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত বিক্রয়যোগ্য চা গড়ে সাড়ে ৪ থেকে পাঁচ লাখ কেজি। বহিরাগত বাগান থেকে কোন কেনা চা পাতা সংগ্রহ করে ফ্যাক্টরিতে আনা হয় না। উৎপাদিত চা এর প্রকৃতি অনুযায়ী এই বাগানে ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা প্রস্তুত হয়। সামসিং চা বাগানটি চরিত্রগত দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল এবং রুগ্ন বাগান। তবে বাগানটি আর্থিকভাবে ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ নয়। বাগান পরিচালনার কার্যকর মুলধন আসে কোম্পানীর নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স থেকে। বাগানটির লিজ হোল্ডার অর্গ্যানিক টি কোম্পানি। ২০১৬ সালে বাগানটি প্রথম যখন ভিজিট করেছিলাম তখন বাগানের ম্যানেজার ছিলেন জয়ন্ত বিশ্বাস এবং দুই সহকারি ম্যানেজার ছিলেন প্রদীপ বিশ্বকর্মা এবং দীপক বান্দা।
চা বাগানের মজুরি বরাবরই কম। দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম মজুরির চেয়ে অনেক কম দৈনিক মজুরি পান চা শ্রমিকরা। মালিকদের বক্তব্য, দৈনিক মজুরির পাশাপাশি একাধিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় চা শ্রমিকদের। সেই বিষয়টিকেও হিসেবের মধ্যে আনতে হবে। বস্তুত ব্রিটিশদের তৈরি চা বাগানের মূল কাঠামো এখনো একই আছে। কর্মবিভাজন থেকে শুরু করে শ্রমিকদের জন্য ব্যবস্থা, সবই ঔপনিবেশিক আমলের নিয়মে চলে। দৈনিক মজুরির পাশাপাশি চা শ্রমিকদের বাসস্থান দেওয়া হয়, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, বাড়ি সংস্কারের টাকা, জ্বালানি-সহ আরো বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার বিষয়টিও চা মালিকদের দেখার কথা। একসময় শ্রমিকদের রেশনও দেওয়া হতো। এখন সরকার বিনামূল্যে রেশন দেয় বলে মালিকরা তা দেওয়া বন্ধ করেছেন। শ্রমিকদের বক্তব্য, খাতায় কলমে এইসব সুযোগ সুবিধার কথা বলা হলেও বাস্তবে এর অধিকাংশই মিলছে না। সুযোগ সুবিধা দেওযার নামে দুর্নীতি হচ্ছে বলেও অভিযোগ করছেন কেউ কেউ। সামসিং চা বাগানের কর্মী দুর্গা ওরাও এর কাছ থেকে জানতে পারলাম পরিস্থিতি এমনই যে স্বামীর চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারেননি। চা বাগান কোনোরকম সাহায্য করেনি। ইউনিয়নের নেতাদেরও দেখতে পায়নি। চা বাগানের ধারে ছোট্ট দোকান বানিয়েছেন দুর্গা। দোকানের পাশে প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলের পতাকা। সে দিকে তাকিয়ে রাজনীতিবিদদের প্রতি নিজের ক্ষোভ উগড়ে দিলেন দুর্গা।
সামসিং চা বাগানের অধিকাংশ চা বাগানের কর্মীর বক্তব্যের সঙ্গে দুর্গার কথা মিলে যায়। জানলাম মালিক বদলেছে। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্যের চাকা ঘোরেনি। শ্রমিকেরই মজুরি থেকে কেটে নেওয়া গ্র্যাচুইটির টাকা দিচ্ছে না মালিক। ওই টাকাই অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। একাধিক অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক মারা গেলেও বহুদিন পর্যন্ত তাদের গ্র্যাচুইটির টাকা ঢোকে নি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা হয় অনেকের। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে অনেকের। ঘরের চাল ফুটো, বাড়ি পাকা হয়নি, ছেলে মেয়েকে পড়ানো যাচ্ছে না -- এমন ঘটনা চা বাগানের ঘরে ঘরে। সামসিং চা বাগানের অনিল প্রধান বলছিলেন, 'মালিক বদলালেও চা শ্রমিকদের কোনো সুবিধা হচ্ছে না। পুরনো বাগান নতুন মালিক কিনছেন ঠিকই, কিন্তু পুরনো মালিকের দায় তিনি নিচ্ছেন না। কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে, শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে শেষ পর্যন্ত চা শ্রমিক গরিব থেকে আরো গরিব হচ্ছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে। কোনো শ্রমিক পরবরতী প্রজন্মকে বাগানে পাঠাতে চান না। চা বাগান যৌথ সংগ্রাম সমিতির জিয়াউল আলমের মতে, ''ঔপনিবেশিক গঠন থেকে চা বাগান বেরিয়ে আসতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বাগান বাঁচানো অসম্ভব। চা শ্রমিকদের উন্নতি করতেই হবে। নইলে পরবর্তী প্রজন্মকে পাওয়া যাবে না। আর শ্রমিক ছাড়া চা বাগান চলবে না।'' গত কয়েক বছরে বাগানে বাগানে নারীপাচারের ঘটনা ঘটছে। নাবালক ছেলেমেয়েদের লেবারের কাজে পাঠিয়ে দিয়েছেন বহু চা শ্রমিক। চা শ্রমিকদের সার্বিক দুর্দশা দৃশ্যত প্রকট। চা বাগানের সমস্যা একটা নয়, অনেক। আবহাওয়াও সমস্যা তৈরি করছে। আগে যে পরিমাণ চা পাতা পাওয়া যেত, এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন মালিকরা বাগানে বিনিয়োগ করে চটজলদি লাভের কথা ভাবছেন। শ্রমিকদের উপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে এক ভযাবহ পরিস্থিতি। এখান থেকে উত্তরণ হবে কীভাবে, তা কেবল অদৃষ্টই জানে।
অনেক কসরত এবং কৈফিয়ত এর পর লেবার অফিস থেকে পেলাম সামসিং চা বাগিচা সংক্রান্ত তথ্য। সামসিং চা বাগিচায় সাব স্টাফের সংখ্যা ১০০ জন। করণিক মাত্র ১ জন। ১২ জন ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ। বাগানের শ্রমিক পরিবারের সন্তান ১২৩১ জন। মোট জনসংখ্যা ১১১৫ জন। স্থায়ী শ্রমিক ৩৩০ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত এবং অস্হায়ী শ্রমিক সংখ্যা ৮০। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক, কম্পিউটার অপারেটরসহ সর্বমোট ১০১ জন। টেকনিক্যাল এবং অস্থায়ী শ্রমিক সংখ্যা ১৯। কর্মরত শ্রমিক ১৫০০। অশ্রমিক সদস্যদের সংখ্যা ৪৬১৫। সামসিং চা বাগানে ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ কোন পাকা বাড়ি নাই। বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাসের সংখ্যা ১২৩৮। বাগানে শতকরা ৯৪ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ থাকলেও বাসস্হান নির্মাণ, মেরামত, এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাৎসরিক কোন টাকাও বরাদ্দ করা হয় না। সামসিং চা বাগানে শৌচাগারবিহীন শ্রমিক আবাসের সংখ্যা প্রচুর। বাৎসরিক বোনাসের শতকরা হার ২০ শতাংশ হলেও অতটা বোনাস দেওয়া হয় না। গত অর্থবর্ষে কত টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা পড়েছে কিনা তাও জানা যায় নি। মজুরি চুক্তি অনুযায়ী দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে কোনো কোনো সময় শ্রমিকদের মজুরি অথবা রেশন অথবা জ্বালানি অথবা বকেয়া মজুরি এরিয়ার হিসাবে দিয়ে দেওয়া হয়। বিগত অর্থবর্ষে গ্র্যাচুইটি বাবদ বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ জানা যায়নি। বছরে গড়ে কতজন শ্রমিক গ্র্যাচুইটি পেয়ে থাকেন সেটাও জানা যায়নি। অর্থাৎ শুধুমাত্র মজুরি ছাড়া আর অন্য কোনো সুযোগসুবিধা শ্রমিকেরা পায় না বললেই চলে। সামসিং চা বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। বাগিচায় ক্রেশ থাকলেও ক্রেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা এবং শৌচালয় নেই। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার বা পোশাক ক্রেশের শিশুদের দেওয়া হয় না । পর্যাপ্ত পাণীয় জল ক্রেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয় না। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বেশ কিছুটা দূরে।
বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয়ও বেশ অনেকটা দূরে। সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। বাগিচায় কোনও হাসপাতাল নেই। ডিসপেনসরির সংখ্যা একটিমাত্র। আলাদাভাবে পুরুষ এবং মহিলা আইসোলেশন ওয়ার্ডের ব্যবস্থা নেই। বাগিচায় অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নেই বলে বাইরে চিকিৎসার জন্য শ্রমিকদের রেফার করা হয়। বাগিচায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। কোনও সরকারি বা বেসরকারি ডাক্তার নেই। বাগিচায় নার্স নেই। কম্পাউন্ডার নেই, স্বাস্থ্য সহযোগী নেই। বাগিচায় পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ হওয়ার দাবি উঠলেও শ্রমিকদের অভিযোগ কেবলমাত্র জ্বর, পেট খারাপ, মাথা ধরার ওষুধ দেওয়া হয়। ওষুধের তালিকা স্টক অনুযায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নোটিশ বোর্ডে দেওয়া হয় না। বর্তমানে চা বাগানের মেটারনিটির কেসগুলিকে সব গ্রামীণ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। বিনোদনমূলক ক্লাব নেই, নেই খেলার মাঠও। সামসিং চা বাগিচার নরেন ভুজেলরা সেই কারণেই দান-অনুদান সাহায্য-সহযোগিতা কোনটাই মাথা পেতে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা চান নিয়মিত মজুরি, সম্মানের সঙ্গে শ্রমদান করে বাঁচতে। অনুদান নিলেও তারা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে এ হল সামান্য কিছু টাকাপয়সা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখার প্রচেষ্টা। সাইরেন বেজে উঠুক, ফের চালু হোক রোজগারের কাজ। এটাই কিন্তু প্রতিটি চা শ্রমিকের অন্তরের কথা। তার সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ন্যায্য সুযোগ সুবিধা আর ন্যায্য মজুরী। কিন্তু সেদিক দিয়ে বিচার করলে সামসিং চা বাগানটি একটি পরিকাঠামোহীন বাগান।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴