পইলা সাঞ্ঝির কথা/৩২
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৩২
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
ধানটাও আসিল তে গানটাও আসিল
"এগিয়ে আসুন, এগিয়ে আসুন বন্ধুরা। আনন্দ সংবাদ ও শুভ সংবাদ।"
"কিসের এত আলন্দ সোংবাদ তো!"
রসবালা বিড়বিড় করে।
"ভাল করি শুন কেনে কিসের আলন্দ সোংবাদটা।"
সুপেন রসবালাকে বলে নিজেই কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে। ভাতের বড় একটা দলা মুখের ভেতরে ঠেলে দিয়ে সুষেণ বলে,
"উঃ, অ্যাত মন দিয়া শুনির নাগে। কিসের আরো শুনিচিত না, গান আইচ্চে। যাত্রা হবে। তারে না মাইকিন হছে।"
সকাল সকাল সুঁটকি পোড়া আলু সেদ্ধ দিয়ে একথালা করে ভাত বেড়ে দিয়েছে রসবালা। তিন বাপ-ব্যাটা মিলে ধান কাটতে বের হবে। এরমধ্যে মাইকের ঘোষণা ভেসে আসতে থাকে
"এবারে থাকছে একটি অশ্রুসজল সামাজিক যাত্রাপালা - 'সতীর বনবাস'
খেতে দিতে দিতে রসবালা বলে,
"কিসের বোনোবাস? সীতা না সতির রে বাউ?"
সুপেন বলে,
"এইলা হইল মানষির পাইসা নিগির তাল। ধানটাও আসিল তে গানটাও আসিল। এইলা টিকিস কাটা গান খালি পাইসার খরচা!"
রসবালা সুপেনকে পাত্তা না দিয়ে কান খাড়া করে। ঘোষক টেনে টেনে আকর্ষণীয়ভাবে বারবার বলতে থাকে, 'সতীর বনবাস'।
রসবালা একটু শুনে বলে,
"হ, হিটা সতীর বোনোবাস, সীতার নাহয়! ভাল হবে বোদায় গানখেনা। বাউ মোক কিন্তুক নিগির নাইগবে। এই কয়া দিলুং।"
ঘোষক তখনও বলেই চলেছে,
"প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করবেন মিস চুমকি। বোম্বাই থেকে আগত স্বনামধন্য নায়িকা মিস চুমকি।"
বোঝা গেল মাইকসহ গাড়িটা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সমানে তাড়স্বরে চেঁচিয়ে চলেছে।
"টিকিটের হার প্রথম শ্রেণি দশটাকা, দ্বিতীয় শ্রেণি পাঁচ টাকা আর তৃতীয় শ্রেণি বা সর্বসাধারণের জন্য মাত্র দুটাকা এবং বিশেষ শ্রেণি কুড়ি টাকা। দুটাকা, দুটাকা, দুটাকা। দুটাকার বিনিময়ে দেখতে পাবেন একটি সম্পূর্ণ সামাজিক যাত্রাপালা.........."
মাইকটা ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে এবার।
"কুনদিন যে ভাল করি শুনায় হইল না।"
রসবালার গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে।
"বাউরে এই বিশেষ শ্রেণিটা বোদায় চেয়ার হেনা?"
সুষেণ টেনে টেনে বলে,
"চেয়ার বোদায় আর এখেরে আগ পাশ্বে বসির দিবে বোদায়। গেইলে না দেখা যাবে কুনলা বিশ টাকিয়া।"
সবার খাওয়া শেষ। রসবালা এবার প্রসঙ্গ পাল্টায়। ছেলেদের বলে,
"একটা খোটু কাটা হইলে খবর দ্যান। আন্দি-বাড়ি থুয়া মুই এলায় উবাইম চাইট্টা।"
দুই ভাই একসঙ্গে হা হা করে ওঠে,
"তুই নানাগে। তুই ভাত চাইট্টাায় আন্দেক তো ভাল করি। হামরা এলায় ভ্যানোত করি দোনো ভাইয়ে উবামু। দেহা পিটিত বিষ হইলে এলায় ভাল করি যাত্রা শুনির যাইস।"
সুপেন টিপ্পনি কাটে।
"তোর এলা বেটা গাবুর হইসে। তোক কি আর বহনের কাজ করির দ্যায়! মোরে কাহ নাই।"
সুষেণ বলে,
"কাজ করির না মোনায়তে বইনির বাড়িত সাগাই খায়া আয়। হামারা দোনো ভাইয়ে কাটিছি গোটায় দোলাটা।"
সুপেন আর কিছু বলে না। হা হা করে হাসে।
"ইমরা খালি মোরে হিংসা করে।"
রসবালা গজগজ করতে করতে থালা নিয়ে কলপাড়ে যায়।
"নে হইসে! কায় বা কার হিংসা করে! দুপুরে এখেনা নাপা শাক আন্দেন তো।"
রসবালা কিছু বলে না। বিষেন স্বগতোক্তির মতো বলে,
"দিনাও দিনাও নাপা শাক। আজি মুই সুদায় ভাত খাইম। ধান কাটালা শ্যাষ হৌক। একদিন নদীয়ে নামির নাইগবে।"
নিজের নিজের গামছা কোমরে বেঁধে গোয়ালঘরের চালে গুঁজে রাখা যার যার কাস্তে হাতে নিয়ে তিনজনে মাঠমুখী হয়।
ওরা বেরিয়ে যেতেই বুধেশ্বরের মা এসে উঠোনে দাঁড়ায়।
"কি করিস মাই? তোমার ধানকাটা নাইগসে?"
"এই তো আজি থাকি নাগিল হামারাও কারেকামাল।"
বুধেশ্বরের মা একটু স্তিমিত হয়। বলে,
"আসিনু একখান কাঁচি নিগির ত্যানে। হামারখানোত ধারে নাই। আর একখান তো বাউ নিগাইসে। পুবদোলাত যে ধানকাটা নাইগসে!"
বুধেশ্বরের মার কথায় রসবালা অবাক হয়ে বলে,
"আর একখান কাঁচি কি করিবেন তে ফির?"
"অয় বৌমা কছে কাঁচি একান থাকিলে মাষ্টারের দুইটা খোটু আউশ দিসে। আধঘান নিলেক হয়। গরু দুইটাক ভালে খ্যার নাগে। কেমন ফোইজ্যত দেখিন্না বাইষ্যাখানোত!"
তারপর বেরোতে বেরোতে বলে,
"যাং ওদি কার পাং, সগাকে পুছোং। এই হাটে বুড়া কাঁচিখান চোকা করি আনিবে বাউ। খালি আজিকার আর কালিকার দিনটা কনেক নাগে। কাঁচি একখান চোকা করিবু তাকো পাইসা নাগে। পাইসা ছাড়া কোনোয় হয়না বা!"
হাঁটতে হাঁটতে সুন্দরমণির উঠোনে এসে দাঁড়ায় বুধেশ্বরের মা। সুন্দরমণি সম্বচ্ছর ঘাস কাটে। ওর কাছে কাস্তে থাকেই। কিন্তু বাড়ি ফাঁকা। কেউ নাই। হতাশ হয়ে বেরিয়ে আসে।
"নাই, ধান কাটাত গেইসে বোদায়। এলা কি আর বসিনা মানষি আছে বারে! সোগায় কামোত নাগি পইচ্চে।"
হাঁটতে হাঁটতে স্বগতোক্তির মতো বলে বুড়ি। সরেনের বাড়ির পাশ দিয়ে আসতে দেখে মালতীর মা বাড়িতে। একটু দাঁড়ায়।
"কাজোত যাইন্নাই মাই?"
"না যাং দি আজি মুই। কালি নেঙুলটা কাটা গেইসে বিষাছে। কাঁচিত ত্যাল গরম করি নাগে দিলুং তাও নেঙুলটা কনেক ফুলিসে আজি আরো। সাকালে যায়া ওঝা বুড়াটার ঠে ঝাড়ি আনলুং। কনেক কমিসে। তাও দেহাটা জ্বর জ্বর নাগেছে। কেনে তে দি? আয়। বইস।"
বুধেশ্বরের মা বলে,
"একখান কাঁচি চান্দে ব্যারের ধোচ্চুং। তে কাহোরে নাই। সোগায় ধান কাটাত ধইচ্চে।"
মালতীর মা অবাক হয়ে বলে,
"তে তোমার কাঁচি কি হইল?"
"হামার একানে কাঁচি। আর একখান ভোতোরা নাগি পড়ি আছে। উয়ার বাপ তো এইবার আর কাজোত যাবার না পাবে। বস হইসে। বৌমাও তো ছাওয়া ধরি গুরুপোত খাটির না পায়। তে আদাবিঘা আউশ নিসি। দোনো শাশুড়ি-বউয়ে আস্তে আস্তে কাটিমো। এলা কাঁচিয়ে নাই।"
"তুই এলা ধান কাটির পাবু?"
মালতীর মার কথায় বুধেশ্বরের মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে।
"কাটির না নাগিবে। বৌমায় ফাইকখান কাটিবে। সাঞ্জোত বাউ আসি ধরিবে। মুই এলায় ছাওয়া দেখিম।"
কথাটা ঠিক। এভাবে না কাটলে সম্ভব নয়। মালতীর মা বলে,
"হামরা দুই বিঘা নিসি বাবা ঘরের। আতি আতি কাটি। দিনোত হাজিরা না কইল্লে হামার চলে না। হিদি গরু-বুছুর অবলা জীবগিলার কাথাও না ভাবির নাগে।"
তারপর গলাটা তুলে বলে,
"মোরে কাঁচিখান আজি নিগা তে দি। কালি সাকালে কিন্তুক মোক নাইগবে। কালি থাকি কাজোত বিরাইম আরো।"
বুধেশ্বরের মা কাস্তে হাতে হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। বাড়ি ঢুকে বৌমাকে বলে,
"মুই তাবত্তে ধরং বারে। তোমরা সেলা আইসো।"
বুধেশ্বরের মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখে ছোট ছেলেগুলো চাঁদা তুলেছে বোধহয়, ক'টা পেঁয়াজ রসুন, ছোট্ট শিশিতে সর্ষের তেল নিয়ে যাচ্ছে। দেখে হাঁক দিল,
"কি আন্দিবেন রে? পাইসা কি চান্দা তুলিলেন?"
"পকি ধোচ্চি ঠাকুমা। সোগায় মিলি আন্দি খামু।"
"কি পকি? ভাটি পকিগিলা? এইলা পকি ভালে যেমন উড়ির না পায়। দৌড়ি ধোইচ্চেন বোদায়। কয়টা ধোইচ্চেন?"
বুধেশ্বরের মা'র কথায় একটা ছেলে বলে,
"উড়ির না পায় তে হয়, দৌড়ায় যে! আরো নুকি নয়! কতখান ঘামিয়া তিনটা পকি ধোচ্চি। আজি ভোজ খামু।"
"তিনকেনা পকি আর তোমরা কতলা চেংরা। ওটে কতকেনা মসং হবে এলায়।"
বলে হাসতে হাসতে বুধেশ্বরের মা ধানক্ষেতের দিকে আগায়। ছেলেগুলোও সহাস্যে জবাব দেয়,
"ওকিনায় নিস্টি নিস্টি খামু।"
সুন্দরমণি মাঠ থেকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরছে দেখে বুধেশ্বরের মা বলে,
"কাজ থাকি এলাইতে বাড়ি আসিছিত মাই?"
"না আইসোং দি। গরুটা সাকালে বাড়ির বগলোত বান্দিসুং। এত্তি ঘাসে নাই। ওদি একপাশে বোঝা বান্দি উবাছি তে দোলাখান ফাঁকা হইল কনেক। গরুটাক নিগি বান্দোং। দেখিন্না ধানবাড়িলাত কেমন নাফরা ঘাসগিলা হইসে। খাবে এলায়।"
হাঁটার গতি একটুও না কমিয়ে উত্তর দিতে দিতে সুন্দরমণি চলে যেতে থাকে। আসলে এটাই কর্মব্যস্ততার সময়। ধানকাটা ফুরিয়ে গেলে আর কাজ থাকবে না। আবার সেই অপার দারিদ্র্য আর প্রতিদিনকার বেঁচে থাকার লড়াই। তাই এসময় কথা বলে, কোথাও দাঁড়িয়ে সময় নস্ট করার মতো সময় কারো হাতেই নেই।
তবু এই জীবনে আনন্দ আছে। কেননা সুখের দাবী বড্ড কম। রাত জেগে 'দিগ্বিজয় অপেরার' টিকিট কাটা সামাজিক যাত্রাপালা থেকে কুষাণ যাত্রা, তুক্ষা, বিষহরা, পালাটিয়া মায় কীর্তনের হরিবাসর। সবই সমান গ্রহণযোগ্য, সমান আনন্দের। তারপরেও এই মানুষগুলো রাতজাগার ক্লান্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পরদিন দলবেঁধে মাঠে নেমে পড়ে, নিজেদের মধ্যে সেসব গান, যাত্রাপালার আলোচনা ঘুরে ঘুরে আসে। কেউ বা আগের দিনের শোনা দু'কলি গান গেয়ে ফেলতে পারে অনায়াসে, কেউ বা কোনো একটি বিশেষ ডায়লগ বলে সঙ্গীদের তাক লাগিয়ে বাহবা কুড়োয়। আবার যাত্রাপালার গল্পের ভেতর উঠে আসে সমাজে ন্যায় অন্যায়ের গল্প। সবটাই খোলা মাঠে, ধান কাটতে কাটতে, ধান বাঁধতে বাঁধতে এক চলমান জীবনের সাক্ষী হয়ে।
............................................................
কারেকামাল - সবাই মিলে কোনো কাজের ব্যস্ততা বোঝায়
ভোতোরা - ভোঁতা
চোকা করি আনিবে - ধার বা ধারালো করে আনবে
আতি আতি - রাতে রাতে
ভাটি পকি - আগে পৌষের দিকে ধান কাটা হত। এ সময় একধরণের পাখি পাওয়া যেত যেগুলো ওড়ে কম দৌড়ায় বেশি আর ঝোপে ঝাপে লুকিয়ে থাকতে ভালোবাসত। এই পাখিগুলো ধরে এনে অনেকেই রান্না করে খেত। এগুলোকেই ভাটি পকি বা পাখি বলত।
নিস্টি নিস্টি - খুব সামান্য পরিমাণ করে
............................................................
ছবি : ময়ূখ রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴