সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
35.চা-ডুবুরী-৩৫/সুকান্ত নাহা

35.চা-ডুবুরী-৩৫/সুকান্ত নাহা

34.চা-ডুবুরী-৩৪/সুকান্ত নাহা

34.চা-ডুবুরী-৩৪/সুকান্ত নাহা

33.চা-ডুবুরী-৩৩/সুকান্ত নাহা

33.চা-ডুবুরী-৩৩/সুকান্ত নাহা

32.চা-ডুবুরী-৩২/সুকান্ত নাহা

32.চা-ডুবুরী-৩২/সুকান্ত নাহা

31.চা-ডুবুরী-৩১/সুকান্ত নাহা

31.চা-ডুবুরী-৩১/সুকান্ত নাহা

30.চা-ডুবুরী-৩০/সুকান্ত নাহা

30.চা-ডুবুরী-৩০/সুকান্ত নাহা

29.চা-ডুবুরী-২৯/সুকান্ত নাহা

29.চা-ডুবুরী-২৯/সুকান্ত নাহা

28.চা-ডুবুরী-২৮/সুকান্ত নাহা

28.চা-ডুবুরী-২৮/সুকান্ত নাহা

27.চা-ডুবুরী-২৭/সুকান্ত নাহা

27.চা-ডুবুরী-২৭/সুকান্ত নাহা

26.চা-ডুবুরী-২৬/সুকান্ত নাহা

26.চা-ডুবুরী-২৬/সুকান্ত নাহা

25.চা-ডুবুরী-২৫/সুকান্ত নাহা

25.চা-ডুবুরী-২৫/সুকান্ত নাহা

24.চা-ডুবুরী-২৪/সুকান্ত নাহা

24.চা-ডুবুরী-২৪/সুকান্ত নাহা

23.চা-ডুবুরী-২৩/সুকান্ত নাহা

23.চা-ডুবুরী-২৩/সুকান্ত নাহা

22.চা-ডুবুরী-২২/সুকান্ত নাহা

22.চা-ডুবুরী-২২/সুকান্ত নাহা

21.চা-ডুবুরী-২১/সুকান্ত নাহা

21.চা-ডুবুরী-২১/সুকান্ত নাহা

20.চা-ডুবুরী-২০/সুকান্ত নাহা

20.চা-ডুবুরী-২০/সুকান্ত নাহা

19.চা-ডুবুরী-১৯/সুকান্ত নাহা

19.চা-ডুবুরী-১৯/সুকান্ত নাহা

18.চা-ডুবুরী-১৮/সুকান্ত নাহা

18.চা-ডুবুরী-১৮/সুকান্ত নাহা

17.চা-ডুবুরী-১৭/সুকান্ত নাহা

17.চা-ডুবুরী-১৭/সুকান্ত নাহা

16.চা-ডুবুরী-১৬/সুকান্ত নাহা

16.চা-ডুবুরী-১৬/সুকান্ত নাহা

15.চা-ডুবুরী-১৫/সুকান্ত নাহা

15.চা-ডুবুরী-১৫/সুকান্ত নাহা

14.চা-ডুবুরী-১৪/সুকান্ত নাহা

14.চা-ডুবুরী-১৪/সুকান্ত নাহা

13.চা-ডুবুরী-১৩/সুকান্ত নাহা

13.চা-ডুবুরী-১৩/সুকান্ত নাহা

12.চা-ডুবুরী-১২/সুকান্ত নাহা

12.চা-ডুবুরী-১২/সুকান্ত নাহা

11.চা-ডুবুরী-১১/সুকান্ত নাহা

11.চা-ডুবুরী-১১/সুকান্ত নাহা

10.চা-ডুবুরি-১০/সুকান্ত নাহা

10.চা-ডুবুরি-১০/সুকান্ত নাহা

9.চা-ডুবুরি-৯/সুকান্ত নাহা

9.চা-ডুবুরি-৯/সুকান্ত নাহা

8.চা-ডুবুরি-৮/সুকান্ত নাহা

8.চা-ডুবুরি-৮/সুকান্ত নাহা

7.চা-ডুবুরি-৭/সুকান্ত নাহা

7.চা-ডুবুরি-৭/সুকান্ত নাহা

6.চা-ডুবুরি-৬/সুকান্ত নাহা

6.চা-ডুবুরি-৬/সুকান্ত নাহা

5.চা-ডুবুরি-৫/সুকান্ত নাহা

5.চা-ডুবুরি-৫/সুকান্ত নাহা

4.চা-ডুবুরি-৪/সুকান্ত নাহা

4.চা-ডুবুরি-৪/সুকান্ত নাহা

3.চা-ডুবুরি-৩/সুকান্ত নাহা

3.চা-ডুবুরি-৩/সুকান্ত নাহা

2.চা-ডুবুরি-২/সুকান্ত নাহা

2.চা-ডুবুরি-২/সুকান্ত নাহা

1.চা-ডুবুরি-১/সুকান্ত নাহা

1.চা-ডুবুরি-১/সুকান্ত নাহা

07-December,2022 - Wednesday ✍️ By- সুকান্ত নাহা 573

চা-ডুবুরী-৩২/সুকান্ত নাহা

চা-ডুবুরি/পর্ব : ৩২
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^^
                         
 সত্যপ্রিয় ও শৌলমারীর সাধু
~~~~~~~~~~~~~~~~

"দ্রুত আলো ফুরিয়ে আসতে থাকা ধূলোওড়া এক শীতের বিকেলে দিনের শেষ বাসটা গুটিকয় যাত্রী নিয়ে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে বড় রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়ে বাঁদিকের ভাঙা, এবড়ো খেবড়ো পাকা রাস্তায়।  তারপর অলস গতিতে গড়িয়ে চলে গঞ্জের ভেতর দিয়ে বাসডেরার দিকে। বাসডেরায় পৌঁছে গুচ্ছের কালো ধোঁয়ার সাথে পথশ্রমের ক্লান্তিটুকু "ফোঁস" শব্দে উগরে দিয়ে হেঁচকি তুলে সেদিনের মতো শরীরটা এলিয়ে দিয়ে থেমে যায় আরো দু তিনটে বাহনের পাশে। বাস থামতেই যাত্রীরা তড়িঘড়ি নেমে হাঁটা লাগায় যে যার গন্তব্যের দিকে। সবশেষে যে মানুষটি ধীরেসুস্থে গাড়ি থেকে নেমে আসেন তাঁকে এক ঝলক দেখেই বোঝা যায় এই হদ্দ মফঃস্বলি গন্ধমাখা গঞ্জে তিনি আগে কখনও আসেননি। হাঁটু ছাড়িয়ে খানিকটা নীচ পর্যন্ত দুফেরতা করে পরা গেরুয়া বস্ত্র। উর্ধাঙ্গে গেরুয়া চাদর। চোখে গোল চশমা। ঈষৎ পলিত মস্তক। উজ্জ্বল দৃষ্টি। দৃঢ় প্রত্যয়ী মুখজুড়ে গোঁফদাড়ির জঙ্গল। পায়ে সাদা কেডস জুতো। শরীরের বাঁধন বেশ শক্ত পোক্ত। আপাত দৃষ্টিতে বয়স বোঝা দায়। ডানহাতে পরিব্রাজকের  লাঠি, কাঁধে ঝোলাব্যাগ। গেরুয়া বসনধারী মানুষটিকে আপাতদৃষ্টিতে সন্ন্যাসী মনে হলেও বামহাতের দু আঙুলের ফাঁকে নিভু নিভু সিগারেটটি দেখে কেমন যেন বেমানান মনে হয়। সন্ন্যাসী উপর্যুপরি ধুমপান করে থাকেন। যাকে বলে চেন-স্মোকার। যাত্রাপথে বাসের ভেতর তিনি  অনবরত ধূমপান করে গেছেন এবং ছাই ফেলেছেন পেতলের একটি ছোট্ট ছাইদানে। এটি তাঁর স্টাইল। বারবার যেখানে সেখানে ছাই ঝেড়ে নোংরা করেন না তিনি। পাত্রটি ভরে গেলে নির্দিষ্ট কোনও জায়গায় ছাইদানটি উপুর করে দেন। আপাতত সেটি অবশ্য হাতে নেই। গাড়ি থেকে নেমে সিগারেটে শেষ টানটি দিয়ে জুতোর তলায় মাটিতে সেটিকে চেপে দেন। তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে চারপাশে তাকান নতুন পা রাখা জায়গাটির দিকে।"

এ পর্যন্ত লিখে সুবর্ণ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর লেখার টেবিল ছেড়ে বাইরে বারান্দায় এসে বসে।  সত্যপ্রিয়বাবুর মুখে শোনা আদ্যন্ত বাস্তব ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপট, সময়কাল এবং মুহুর্তগুলোকে অন্তর্দৃষ্টিতে ফুটিয়ে তুলতে ঘটমান সময়কালের গন্ডি ছাড়িয়ে ডুব দেয় দূর অতীতে। কল্পনার সুতো মনের লাটাই ছেড়ে পেছন দিকে ছুটে যেতে যেতে থেমে যায় পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে ডুয়ার্সের এক বর্ধিষ্ণু গঞ্জের ভেতর। যে অতীত কালখন্ডের ভেতর সুবর্ণ ঢুকে পড়ে সে সময়টিতে সবেমাত্র আধুনিকতার ছোঁয়াচ লাগতে শুরু করেছিল পিছিয়ে থাকা ডুয়ার্স অঞ্চলে। দেশভাগের পর একযুগ প্রায় কেটে গেছে । চা-বাগান গুলোর মালিকানা দেশীয় মালিকদের হাতে ছেড়ে বহু আগেই পাততাড়ি গুটিয়েছে ইউরোপিয়ান মালিকরা। সেই সঙ্গে সাহেবরাও ফিরে গেছে যে যার দেশে। কিছু বাগানে শিবরাত্রির সলতের মতো এক আধজন শ্বেতাঙ্গ সাহেব রয়ে গেছে নিভন্ত সলতের ম্রিয়মান তেজটুকু নিয়ে। যেসমস্ত চা -বাগানের অংশীদারির একটা বড় অংশ তখনও ব্রিটিশদের হাতে রয়ে গেছিল, সিংহভাগ মালিকানার টিকি বাঁধা ছিল লন্ডনে এবং সেখান থেকে তখনও কলকাঠি নাড়া হতো, সে বাগানগুলোর গালভরা নাম ছিল "এজেন্সি-হাউস"। সে সমস্ত চা-বাগানের শরীর থেকে তখনও ঔপনিবেশিকতার গন্ধ যায়নি। যেজন্য বাগানের সাহেব থেকে বাবু সকলে নিজেদের কিঞ্চিৎ এলিট-ক্লাস ভাবতেন। অন্যদিকে যে সব বাগানের মালিকরা ছিলেন বাঙালি এবং বাবুরা প্রায় সকলেই ছিলেন বঙ্গসন্তান সেসমস্ত বাগানকে বলা হত বাবু-বাগান। ডুয়ার্সে চা-বাগান ঘেরা এই ছোট ছোট বাজারগঞ্জ গুলোর উন্নতির পেছনে এই বাবু-বাগানের কিছু মালিক এবং বাবু সাহেবদের যা কিছু অবদান ছিল তার সিকিভাগও এই "এজেন্সি-হাউস" গুলোর ছিল না। সত্যপ্রিয়র কাছ থেকেই এসব বৃত্তান্ত শোনা সুবর্ণর। 

যে সময়কালের বৃত্তে গঞ্জটিকে ধরার চেষ্টা করছিল সুবর্ণ সেটি ততদিনে গ্রাম্য জনপদের তকমা ঝেড়ে দ্রুত শহর বাজার হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। জায়গাটির নাম বীরপাড়া। যেখানে ততদিনে রাস্তার দুধারে গড়ে উঠেছে বেশকিছু আধুনিক দোকানপাট। কয়েকঘর মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী যাদের লোহালক্কড় অথবা মুদির পাইকারি থেকে খুচরো ব্যবসা। কিছু দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে ভেসে আসা হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাঙালি যাদের অধিকাংশই খুচরো ব্যাপারি। কারোর জুতোর দোকান, কারো বা ওষুধের ব্যাবসা, কারোর আবার মিষ্টির দোকান। মনোহারীর কারবারও ফেঁদে বসেছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ আবার গঞ্জে ডেরাবেঁধে পরিবার নিয়ে থাকেন বটে তবে বাণিজ্য করতে যান অন্যত্র।  আশপাশের চা বাগানের সাপ্তাহিক তলবের হাটে সাইকেলে তামাক, চুন, মশলা, কিংবা শুঁটকির পসরা নিয়ে ছোটেন তারা। কয়েকঘর তাগড়াই পশ্চিমা মানুষ যারা গায়ে গতরে খাটতে দড়, ঠেলা করে মোট বয়ে গঞ্জ থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত আনা নেওয়া করেন। তাদের কেউ কেউ আবার পান বিড়ির গুমটি দোকান খুলেছেন রাস্তার ধারে। দু একজন 'ভুজাওয়ালা'  যারা হাটে-হাটে ছোলা, মটর, ছাতু, তেলেভাজা বেচেন। মুষকো চেহারার গুঁফো  বাথানওয়ালারা মোষ অথবা গরুর দুধ অ্যালুমিনিয়ামের ক্যানেস্তারায় ভরে সাইকেলের ক্যারিয়ারে ঝুলিয়ে গাঁ গঞ্জ, চা-বাগান গুলোয় ছোটেন পেটের দায়ে। এই ছিল এক ঝলকে জায়গাটির চালচিত্র । 

এহেন গড্ডালিকা প্রবাহে বয়ে চলা নিস্তরঙ্গ জায়গাটিতে আশপাশের চা বাগানের কিছু সহৃদয়, বিত্তবান, শিক্ষিত মানুষের উদ্যোগে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। এছাড়া সরকারি দপ্তর বলতে কাছাকাছি একটি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এবং পোস্ট অফিস ছাড়া আর কিছুই তেমন ছিল না। বৈদ্যুতিক আলো তখনও আসেনি। বৈদ্যুতিকরণের জন্য কাজকর্ম সবে শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ দপ্তরের ঘরটি গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বাইরে থেকে কেউ এলে রাতে থাকার মতো জায়গাও তেমন ছিল না বললেই চলে। বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার  জন্য কিছু শিক্ষক যারা এসেছিলেন বাইরে থেকে তারা খানিক দূরে স্কুল সংলগ্ন কোয়ার্টারেই থাকতেন। বিকেলের দিকে তাদের কেউ কেউ হাঁটতে হাঁটতে গঞ্জের কেন্দ্রে গাছের নিচে ওষুধের দোকানটার কাছে চলে আসতেন। এই দোকানটাই ছিল তখন একমাত্র ওষুধের দোকান। দোকানের পাশের চাতালে দুপুর নাগাদ এক ভদ্রলোক এসে চট পেতে বসে পড়তেন। দুপুরের বাসে শহর থেকে একদিনের বাসি খবরের কাগজের বান্ডিলগুলো এসে পৌঁছত তার কাছে। খবরের কাগজের এজেন্সি ছিল তার।ভদ্রলোক দ্রুত হাতে সেই বান্ডিল খুলে কাগজ গুলো বাছাই করে বেঁধে রাখতেন গ্রাহকদের নামে। আশপাশের প্রায় কুড়িখানা বাগানের ডাকওয়ালারা পোস্ট অফিস থেকে ডাক নিয়ে সেই ব্যক্তিটির কাছে চলে আসত। ভদ্রলোক কাগজের বান্ডিলগুলো তুলে দিতেন ডাকওয়ালাদের  হাতে। কাগজ নিয়ে তারা  সাইকেলে কিংবা হেঁটে ফিরে যেত যে যার বাগানে। এই ছিল সেইসময়ের ঐ গঞ্জবাজারটির নৈমিত্তিক ছবির একটুকরো অংশ। 

কাগজ বিলি হয়ে গেলে সেই ভদ্রলোক চট গুটিয়ে চলে যেতেন বাড়িতে। খানকয়েক কাগজ স্কুলের শিক্ষকদের নামে রেখে যেতেন ওষুধের দোকানের মালিকের হেফাজতে। বিকেল নাগাদ মাস্টার মশায়রা আসতেন। কাগজ হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ আড্ডা দিতেন দোকানের সামনে। তারপর সন্ধে নামার আগে ফিরে যেতেন স্কুল লাগোয়া ডেরায়। স্মৃতি থেকে সুবর্ণকে এভাবেই বলেছিলেন সত্যপ্রিয়। প্রথম দিন বীরপাড়ায় পদার্পণ করা সন্ন্যাসীর কথা বলতে গিয়ে সত্যপ্রিয় যে অদ্ভুত ঘটনাটি শোনান সুবর্ণ তা লিখে যেতে থাকে, 

" সন্ন্যাসীর বেশধারী মানুষটির চোখে পড়ে কিছুটা দূরে একটি নামি কোম্পানির জুতোর দোকান। সেদিকে লক্ষ্য করে তিনি হেঁটে যান।" ছবির মতো  দৃশ্যগুলো কল্পনায় ধরা দিতেই সুবর্ণর লেখার স্রোত যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়ে যেতে থাকে।

"দোকানের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মালিকের চোখ পড়ে দীর্ঘদেহী সন্ন্যাসীটির মুখের দিকে। খানিকক্ষণ চেয়ে থাকতেই কেমন যেন চমকে ওঠেন তিনি। কথা সরে না মুখ থেকে। ঘোরের মধ্যে বিচারবুদ্ধি জড়িয়ে গিয়ে তিনি শুধু বিড়বিড় করে বলেন,"এ-কি,    এ কীভাবে সম্ভব...কে ইনি!" কাউন্টার ছেড়ে উঠে জুতোর দোকানের মালিক দাঁড়িয়ে পড়েন। তারপর এগিয়ে যান সন্ন্যাসীর দিকে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখেই সন্ন্যাসীর দৃষ্টি পড়ে তার ওপর। জ্যোতির্ময়, প্রখর সেই চোখের দৃষ্টি। দোকানের মালিক  ভদ্রলোক হাত জোড় করে বলেন, " আসুন বাবা, ভেতরে আসুন। বলুন আপনার জন্য কী সেবা করতে পারি?" 

সন্ন্যাসীটি কয়েক মুহুর্ত একদৃষ্টে চেয়ে থেকে সংক্ষিপ্ত উচ্চারণে বলেন, " একজোড়া কাপড়ের জুতো...। "

-" নিশ্চয়ই। আগে আপনি ভেতরে এসে আরাম করে বসুন, বাবা। তারপর দিচ্ছি। "
পায়ের মাপটুকু জানিয়ে দিয়ে সন্ন্যাসী তখনও স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি বুঝে যান ইনি স্বল্পভাষী। বৃথা কালক্ষেপ করতে চান না। আসনগ্রহণেও তাঁর আপত্তি। ব্যস্ত হাতে কাপড়ের জুতোটি এনে সামনে রাখেন তিনি। নিজের বসার কাঠের টুলটি এনে দেন বসতে। সন্ন্যাসী তবু দাঁড়িয়ে। মালিকটির দিকে তাকিয়ে বলেন, " একটা কোদাল হবে? "

মালিক ভদ্রলোক এবারে অবাক চোখে তাকান, "কোদাল! কেন বাবা? "
সন্ন্যাসী জানান তিনি তার পায়ের ছেঁড়া জুতোটি মাটিতে পুঁতে দিয়ে যেতে চান কেননা তিনি চান না তাঁর পরিত্যক্ত জুতো কোনও মানুষ কিংবা জীবজন্তু স্পর্শ করুক। মালিক ভদ্রলোকটির বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। তিনি বলেন এ কাজটি তিনি নিজে করে ধন্য হতে চান। সন্ন্যাসী দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন সেই প্রস্তাব। কোদাল আসে। সন্ন্যাসী টুলে বসে জুতো পাল্টান। তারপর নিজে ঝোলা, লাঠি রেখে জুতো জোড়া সমেত কোদাল হাতে অনতিদূরে বটগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। গাছের নিচে গর্ত খুঁড়ে পরিত্যক্ত জুতোটি সমাধি দিয়ে ফিরে আসেন দোকানের সামনে। দোকানি হাত ধোয়ার জল দেন তাঁকে। হাত ধুয়ে জুতোর দাম মিটিয়ে তিনি আবার হাঁটা শুরু করেন তাঁর গন্তব্যের দিকে। 

হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা পেরিয়ে সন্ন্যাসীটি যখন অনেকটা পথ চলে এসেছেন দিনের আলো তখন নিভে গেছে। রাতের আশ্রয়ের কথা ভেবে সন্ন্যাসীর মন কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তিনি লক্ষ্য করেন গঞ্জ ছাড়িয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছেন তিনি। কোথায় যাবেন তেমন কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই তাঁর। তবে সামনেই ফালাকাটা নামে একটি শহর রয়েছে। সেখানে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাছাড়া পথঘাটও চেনেন না তিনি। তার আগেই কাছাকাছি কোথাও আশ্রয় নিতে হবে তাঁকে। সন্ন্যাসী দেখেন হাঁটতে হাঁটতে তিনি একটি চা-বাগানের কাছাকাছি চলে এসেছেন। চা বাগানের বাড়িঘরগুলোর আলো চোখে পড়ছে। ওখানে কোথাও কি আশ্রয় মিলতে পারে। ভাবতে ভাবতে সন্ন্যাসী দেখেন একজন আদিবাসী শ্রমিক দ্রুত হেঁটে আসছে উল্টো দিক থেকে। তিনি তাকে ডেকে জানতে পারেন বাগানটির নাম কাজলিডাঙা। সন্ন্যাসী তাঁর মনের কথা ব্যক্ত করেন। উত্তরে শ্রমিকটি আঙুল তুলে দূরে একটি বাড়ির দিকে নির্দেশ করে বলেন ঐ বাড়িটি বাগানের বড়বাবুর। সেখানে গেলে আশ্রয় মিলতে পারে। সন্ন্যাসীটি এগিয়ে যান সেই বাড়িটির দিকে। "

এ পর্যন্ত লিখে সুবর্ণ সত্যপ্রিয়র বর্ণনানুসারে সেদিনের সেই সন্ধেবেলার ছবিটা যেন স্পষ্ট দেখতে পায়। কাজলিডাঙার বড়বাবু শ্রীনাথবাবুর কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে সেই সন্ন্যাসী। তাঁকে দেখে বারান্দায় বসে থাকা কুকুরটা দুবার চিৎকার করে থেমে যায়। শব্দ শুনে ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে আসেন। তিনি শ্রীনাথবাবু নন। বড়বাবু তখনও অফিসে। বেরিয়ে আসা মানুষটি ঐ বাড়িতে আসা একজন অতিথি। সন্ন্যাসীকে দেখে তার ভ্রূযুগলে ভাঁজ পড়ে, " কী চাই?"

সন্ন্যাসী তার মুখ দেখে হয়ত মনের ভাবটি বুঝতে পারলেন যে তিনি অপ্রসন্ন। তবু বললেন, " আজকের রাতটুকু কি এখানে আশ্রয় পেতে পারি? "
উত্তর এলো, " আপনাকে তো আমি চিনি না। তাছাড়া আমি বাড়ির মালিক নই। গৃহকর্তাও বাড়িতে নেই। আপনি বরং অন্য কোথাও... " কথা ফুরোনোর আগেই সন্ন্যাসী হাত তুলে থামিয়ে দিলেন তাকে। কোনও কথা না বলে বেরিয়ে এসে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। 

শ্রীনাথবাবু ধার্মিক মানুষ। বাড়ি ফিরে সব শুনে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। কী করেন, কোথায় গেলে পাবেন সেই সন্ন্যাসীকে, পেলে যে করেই হোক ফিরিয়ে আনবেন তাঁকে। এসব ভাবতে ভাবতে অফিসের পোষাকেই তিনি চলে আসেন ডাক্তার বিণয়ভূষণের কোয়ার্টারে। তাঁকে সব ঘটনা জানিয়ে অনুরোধ করেন একবার সঙ্গে আসতে। সন্ন্যাসীকে খুঁজে বের করতেই হবে যে করে হোক। আশ্রয়প্রত্যাশী অতিথি এভাবে ফিরে গেলে বাড়ির অকল্যাণ হবে। ভেবে ভীষণ উচাটন হয়ে পড়েন তিনি। ডাক্তারবাবুও তৎক্ষণাৎ রাজী হন তাঁর সঙ্গে যেতে। দুজনে মিলে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। খুব বেশীক্ষণ হয়নি সন্ন্যাসী বেরিয়ে গেছেন বাড়ি ছেড়ে। নিশ্চয়ই বেশিদূর পৌঁছতে পারেননি। ফালাকাটার দিকে যেতে যেতে হঠাৎ তাঁদের নজরে পড়ে রাস্তার ধারে ভাঙা একটি বাড়ির বারান্দায় বসে ধ্যানরত সেই সন্ন্যাসী। চার দিকে অন্ধকার নেমে এসেছে ততক্ষণে। 

শ্রীনাথবাবু সন্ন্যাসীকে দেখেই ছুটে যান তাঁর কাছে। গিয়ে জানতে চান তিনিই কি একটু আগে তার বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন আশ্রয় না পেয়ে? সন্ন্যাসী কোনও উত্তর না দেওয়ায় তাঁরা বুঝে যান মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। শ্রীনাথবাবু হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেন তাঁর কাছে। তারপর অনুরোধ করলেন তাঁর সাথে তাঁর বাড়িতে ফিরে যেতে। সন্ন্যাসী জানান, একবার যেখান থেকে তিনি প্রত্যাখ্যাত হন সেখানে দ্বিতীয় বার আর ফিরে যান না। গেলে সেই বাড়ির অকল্যাণ হয়। শুনে শ্রীনাথবাবু মরিয়া হয়ে ওঠেন। যে করেই হোক সন্ন্যাসীকে বাগানে ফেরাতেই হবে। নইলে বাগানের অকল্যাণ হবে। এই কথা ভেবে তিনি প্রায় পায়ে ধরার মতো করে বলেন, " বাবা আমার বাড়িতে না যান আপনি ডাক্তারবাবুর বাড়িতে চলুন, বাবা। ওখানে আপনার বিন্দুমাত্র অসম্মান হবে না। আপনি না গেলে যে বাগানের অকল্যাণ হবে, বাবা! "

কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না  সন্ন্যাসী। শেষে বিণয়ভূষণ আকুল অনুরোধ করতেই তিনি সম্মত হন। নিয়ে আসা হলো তাঁকে ডাক্তার বাবুর বাড়িতে। সন্ন্যাসী জানালেন তিনি ঘরে ঢুকবেন না। বাইরের বারান্দাতেই রাত্রিযাপন করবেন। শুনে অস্বস্তিতে পড়ে যান ডাক্তারবাবু ও তাঁর স্ত্রী। মাঘ মাসের শীতে কিভাবে তিনি বাইরে থাকবেন। সন্ন্যাসী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। বারান্দায় খাটিয়া পেতে দেওয়া হলো। সন্ন্যাসী জানালেন তিনি স্বপাকে খান। ডাক্তারগিন্নির একটা তোলা উনুন ছিল। সেইটে মাটি দিয়ে লেপে আনা হলো। নিরামিষ বাসনপত্র বের করা হলো। চাল ডাল আনাজপাতি বের করে দেওয়া হলো। সন্ন্যাসী জানালেন তিনি স্নান করবেন। বাড়ির চাকর বাইরের টিউবকল পাম্প করে বড় বালতিতে জল ভরে দেয়। সন্ন্যাসী সেই বালতির প্রায় দশ বালতি জলে স্নান সারেন ঐ কনকনে শীতের রাতে। এরপর তিনি রান্না চাপান। ভৃত্যটি  তাঁকে সাহায্য করে। খাওয়া দাওয়ার পর তিনি জানান বাড়ির লোক যেন শুয়ে পড়ে। তাঁর জন্য অপেক্ষা করা বা রাত জাগার কোনও প্রয়োজন নেই। বাড়ির ছেলেমেয়েরা কৌতূহলী হয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে যায় সন্ন্যাসীকে। রাতে কখন যে সন্ন্যাসী ঘুমোতে যান কেউ জানে না। এমনকি ভোররাতে কাকপক্ষী জাগার আগে কখন যে তিনি চলেও যান কেউ টের পায় নি। কেবল গৃহভৃত্যটি জানায় রাতে উঠে বেশ কয়েকবার স্নান করেছিলেন সেই সন্ন্যাসী। সে বলে, " মাই রে মাই, মাঘ মাসের ঠান্ডার রাইতে কুনো মানুষ ঐরকম স্নান করে! জল পাম্প করতে করতে আমার ড্যানা খুইলা যাইতেসিলো। "

" সন্ন্যাসীর কথা পরদিন সকালে আমি জানতে পারি",  সত্যপ্রিয় বলেন। 

" তার মানে আপনি তাঁকে দেখেননি?" সুবর্ণ যেন হতাশ হয়। 

-" দেখেছি। তবে বেশ কিছুদিন পর। সেদিন সন্ন্যাসী চলে যাওয়ার পর বাগানে তাকে নিয়ে বেশ কিছুদিন চর্চা চলে। সেদিন প্রথম দেখায় রাতের অন্ধকারে তাঁর চেহারার সাথে নেতাজির চেহারার মিলটা কারও চোখে পড়েনি। এমনকি নেতাজি ভক্ত আমাদের ডাক্তার বাবুরও না। আসলে অতটা খুঁটিয়ে কেউ দেখেনি তাও হতে পারে। "

-" তাহলে কথাটা ছড়ালো কীভাবে। "সুবর্ণ উদগ্রীব হয় জানতে। 

-"বেশ অনেকদিন বাদে আমরা জানতে পারি এক সন্ন্যাসী জটেশ্বর আর ফালাকাটার মাঝখানে শৌলমারী বলে একটা জায়গায় আস্তানা গেড়েছেন। পরে শুনতে পাই এই সন্ন্যাসীই তিনি যিনি সেদিন রাতে ডাক্তারবাবুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শৌলমারীতে ডাক্তার রমণীমোহন দাস বলে এক ভদ্রলোক থাকতেন। তিনি তাঁকে জমি জায়গা দেন থাকার। আসলে এই রমণীবাবু ছিলেন নেতাজির অন্ধভক্ত। তিনিই সম্ভবত প্রথম সন্ন্যাসীর চেহারার সাথে মিল খুঁজে পান নেতাজির।" সত্যপ্রিয় বলেন। 

-" সাধুর আসল নামটা যেন কী ...? " সুবর্ণ আগ্রহী হয় জানতে। 

-" উনার আসল নাম সারদানন্দ। কিন্তু ওখানে উনি কে. কে ভান্ডারি  নামে থাকতেন।"

-" আচ্ছা, উনি ঐ শৌলমারীতেই আস্তানা গেড়েছিলেন কেন? তাঁর উদ্দেশ্যে কী ছিল? " সুবর্ণ প্রশ্ন করে। 

-" আদতে ব্যক্তিটি ছিলেন বিশেষ জ্ঞানী । দশ বারোটি দেশি বিদেশী ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। তিনি কোত্থেকে এসেছিলেন কেউ জানতো না। বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এদিকে এসেছিলেন কিনা জানা যায় নি। তবে রমণী বাবুর সাথে দেখা হওয়ার পর তাঁরা দুজনে কিছু পরিকল্পনা করেন। এবং তারপর অমৃত বাজার পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপনও দেন যে শৌলমারীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হবে।"

-" তখনও যেহেতু উত্তরবঙ্গের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, সুতরাং তার এই ইচ্ছেটা সদর্থকই ছিল বলা যায়। "সুবর্ণ বলে। 

-" হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যাপারে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ও তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। তবে সাধু বাবা এসেই কিন্তু ওখানে একটা স্কুল গড়ে তুলেছিলেন, একথা ঠিক। আশপাশের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়তো। শরীরচর্চা,বাগানকরা এসব করতো। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিশিষ্ট মানুষজন সারদানন্দজীকে ডোনেশন পাঠাতেন। সেই টাকায় ওখানে তিনি আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিজ্ঞাপনটি যে নেহাৎই ফাঁকা আওয়াজ ছিল না, বলা যেতেই পারে। তবে এরই মধ্যে নেতাজির বিষয়টি চাউর হতেই দলে দলে লোকজন আসতে লাগলো তাঁর সাথে দেখা করতে। উনি অবশ্য কারো সাথে বিশেষ দেখা করতেন না। থাকতেন আশ্রমের ভেতর এক গর্ভগৃহে। একসময় এত বেশি লোক আসতে শুরু করে যে আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার যোগাড়। নেতাজি-আবেগ মাত্রা ছাড়া হয়ে পড়ছে দেখে আশ্রম সংলগ্ন অঞ্চলে একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করতে হয়। প্রশাসন হ্যান্ডবিল ছাপায় যে কেউ যদি গুজব ছড়ায় যে শৌলমারীর সাধু নেতাজি তবে তাকে অ্যারেস্ট করা হবে"

"- আপনি তাঁকে দেখলেন কবে, কীভাবে? "

-" সেকথা পরে বলছি। তখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন দলে দলে লোক আসতো প্রায় রোজ দিন। আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রাক্তন সৈনিকদের মধ্যেও অনেকে এসেছিলেন তাঁকে দেখতে। তিনি দেখা করেন নি। খুব বেছে বেছে মানুষদের সাথে দেখা করতেন তিনি। একদিন সাধু ডাক্তারবাবুকে খবর পাঠালেন উনি দেখা করতে চান তাঁর সাথে। ডাক্তার বাবু যেদিন যাচ্ছেন সেদিন বাগানের ট্রাকে করে বাবুরা অনেকেই গেছিলেন তাঁকে দেখতে। তিনি ডাক্তার বাবু ছাড়া কারো সাথে দেখা করেননি। ডাক্তারবাবু উনাকে দেখে বেরিয়ে আসার পর জোর দিয়ে বলেছিলেন, 'ইনি নেতাজি না হয়ে যান না'। 

-" পরে তো শোনা গেছে ভারত সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের লোকও তাঁকে দীর্ঘদিন যাবৎ ছায়ার মতো অনুসরণ করে গেছে। এখান থেকে রিপোর্ট পাঠাতেন তারা দিল্লির স্বরাষ্ট্র দপ্তরে। এমনকি নেহেরুও তাঁর সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ নিতেন। এসব তথ্য তো পরবর্তীতে ফাঁস হয়ে গেছে। " সুবর্ণ একনিঃশ্বাসে বলে যায়। 

-" হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে মুখার্জী কমিশন কিন্তু ব্যাপারটা পুরোপুরি অস্বীকার করে। দেরাদুনে মৃত্যুর পর উনার দেহের হাড় পরীক্ষা করেও নেতাজির সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে দেরাদুনের কিছু মানুষ তাঁর মৃত্যুর পর দাবি তোলে তাঁকে গার্ড অফ অনার দিতে হবে। শেষমেশ জনগণের চাপের মুখে পড়ে একজন বিশিষ্ট দেশসেবক হিসেবে তাঁকে গার্ড অফ অনার দেওয়া হয়। "

-" উনি এখান থেকে চলেই বা গেলেন কেন? "সুবর্ণ প্রশ্ন করে। 

-"দেখো, আশ্রমের পক্ষে যেমন মানুষ ছিল, বিপক্ষেও তো ছিল কম না। তারা প্রচার করতে লাগল যে আশ্রমের নামে আশপাশের বহু জমি দখল করে নিচ্ছেন সাধু ও তার আশ্রমের মানুষ। এতে সাধুবাবা মনঃক্ষুণ্ণ হন। তাছাড়া যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে উনি কাজ শুরু করেছিলেন তা পদে পদে ব্যাহত হতে থাকে। তাই একদিন উনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আশ্রম ছেড়ে হঠাৎ চলে যান। এই যাওয়ার দিনই তাঁকে সামনা সামনি দেখি আমি। "

-" কীরকম? " 
-" সেদিন ছিল ডাক্তারবাবুর মেয়ের বিয়ে। গায়ে হলুদ হয়ে গেছে। হঠাৎ খবর আসে সাধু বাবা চলে যাচ্ছেন এবং বাগানের সামনের রাস্তা দিয়েই তিনি যাবেন। শোনা যায় তিনি রওনা দিয়েছেন এবং তাঁর পেছনে কয়েক শো মানুষ। তারাও চলেছে তাঁর সাথে। বাগানের সামনে দিয়ে তিনি যখন চলে যাচ্ছেন তাঁকে দেখতে পাই। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রঙ। দাড়ি গোঁফের আড়ালেও বোঝা যায় অদ্ভুত সাদৃশ্য নেতাজির সাথে। তিনি দ্রুত হেঁটে ডাক্তারবাবুর বাড়ি ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছিলেন। পেছন অসংখ্য মানুষ। রমণী বাবুকেও দেখা গেল তাঁর পাশে। পরে শোনা গেছিল সপরিবারে তিনিও চলে গেছেন সারদানন্দজীর সাথে। আর ফেরেননি। ডাক্তারবাবুর মেয়ে অপর্ণা গায়ে হলুদের শাড়ি পড়েই ছুটতে ছুটতে এলো সাধুবাবার সামনে। পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলো সে। সারদানন্দজী তাকে আশীর্বাদ করলেন। সেই শেষ দেখা। "

-" শৌলমারীর সেই সাধু আর আশ্রমের নামে নাকি পরবর্তীতে আশপাশের কিছু মানুষ কেস করেছিল শুনেছি? "সুবর্ণ বলে। 

-" হ্যাঁ, একথা ঠিক। জমি দখলের কেস। এবং সেই কেসে আশ্রমের পক্ষে উকিল নিযুক্ত করা হয়েছিল সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে। উনি অবশ্য তখনও মুখ্যমন্ত্রী হননি। হাইকোর্টের দুঁদে ব্যারিস্টার। আলিপুরদুয়ার কোর্টে যেদিন কেসের ডেট পড়ল স্ত্রী মায়া রায়কে নিয়ে উনি এলেন। উনাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল নিমতিঝোরা চা বাগানের বাংলোতে। ঘটনাচক্রে আমি এবং আমার বন্ধু অতীনও সেদিন ঐ বাংলোয়। "

-" তাই নাকি! তাহলে ওঁদের তো খুব কাছ থেকে দেখেছেন। কথাও হয়েছিল নিশ্চয়ই। " সুবর্ণর গলার স্বরে উত্তেজনা প্রকাশ পায়। 

-" নিমতিঝোরা বাগানে একজন স্টাফের সাথে ম্যানেজমেন্টের ঝামেলা চলছিল। সেই ব্যাপারে নিষ্পত্তি করার জন্য আমি গেছিলাম ইউনিয়নের তরফ থেকে। সঙ্গে অতীন গেছিল বাগানটি দেখতে। ওর উদ্দেশ্য লেখার রসদ সংগ্রহ করা। আমরা উঠেছিলাম ওখানকার ইন্সপেকশন বাংলোর ওপর তলায়। দুপুরে ম্যানেজারের সাথে দেখা করে রাতটা ওখানে কাটাব তেমনই ঠিক ছিল। সন্ধেয় বাগান লাগোয়া একটি জুনিয়র হাইস্কুলে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা রবীন্দ্রনাথের 'বাল্মীকি প্রতিভা' অভিনয় করবে। নির্দেশনা যিনি দিয়েছেন সেই শিক্ষিকা এসে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন। হঠাৎ খবর এলো সিদ্ধার্থ বাবু সস্ত্রীক আসছেন। "

-" তিনি তো আলিপুরদুয়ারে কেসের জন্য এসেছেন। তাহলে ওখানে না থেকে নিমতিঝোরার বাংলোয় কেন? ' সুবর্ণ প্রশ্ন করে। 

-" আশ্রম কর্তৃপক্ষ ওখানেই ব্যবস্থা করেছিল। তাছাড়া সেসময় চা বাগানের বাংলো গুলো যে কোনও পাঁচতারা হোটেলের চেয়ে কম ছিল না। আলিপুরদুয়ারে সেরকম থাকার জায়গা ছিল না হয়তো। যা হোক, উনাদের জন্য ওপর তলার ঘরটা ছেড়ে দিয়ে আমরা নিচের তলায় চলে এলাম। সন্ধে নাগাদ উনারাও এলেন নাটক দেখতে। সঙ্গে বাগানের ম্যানেজার, আরও বিশিষ্ট মানুষজন। আমরা একসাথে বসে নাটক দেখলাম। কী বলব সুবর্ণ, ছোট ছোট আদিবাসী ছেলেমেয়েদের অত সুন্দর অভিনয় আমাদের অভিভূত করেছিল। সিদ্ধার্থ রায় সস্ত্রীক শেষ পর্যন্ত দেখেছিলেন। দেখে ভূয়সী প্রশংসাও করেন। পরদিন উনারা চলে যান জলদাপাড়া। সেখান থেকে তারপর দিন কেস অ্যাটেন্ড করে ফিরে যান কলকাতায়। "

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri