পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৩১
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
দুই টাকার খাবার ত্যাল
"খাবার ত্যাল দেও তো মোক দুই টাকার।"
টেনে
টেনে কচি গলায় কথা ক'টা বলেই ছেলেটার চকচকে আধুলীর মতো চোখদুটো দোকানের
উপর ঘুরে বেড়াতে থাকে। পেটমোটা, টাকমাথা অমায়িক মুদি দোকানী তখন অন্য আর
একজনকে চাল মেপে দিতে ব্যস্ত। একজন বয়স্ক আধবুড়ো মানুষ হুঁকোর তামাকে মাখবে
বলে পাতলা কমদামের গুড়টা কিনতে এসেছে। আর একজন বয়স্কা খদ্দের, গায়ে
কোনোরকম একটা আধময়লা সাদা থান জড়ানো। বঙ্কেটের কাগজ কিনবে, সঙ্গে পাতলা
গুড়, ছেলেটাকে দেখে রসিকতার সুরে বলে,
"কার বেটারে তুই? সরেনের না হরেনের?"
ছেলেটা সংকোচ নিয়ে অস্ফুটে বলে,
"সরেনের।"
আসলে কাউকেই ও চিনতে পারছে না। সেজন্য ঘন ঘন লজ্জা পাচ্ছে।
খদ্দের তেমন নেই এই দুপুরবেলায়। দোকানের যত্রতত্র মাছি মহোদয়গন ভনভন
করে নেচে বেড়াচ্ছেন। ছেলেটার নিষ্পাপ চোখদুটো আলগা করে লাগানো চকলেটের
কাঁচের বয়ামটায় আটকে গেল। হাতের মুঠোটা খুলে পয়সাগুলো গুণলো আর একবার। দশ
পয়সা বেশি আছে। দুটো চকলেট হবে।
"দুই টাকার খাবার ত্যাল দিয়া তোর মাও কি আন্দিবে বাউ? ডিমা না মাছ?"
ন্যান্দো
দোকানের পাশে বস্তা থেকে নুন বের করে মাপছে আর সটির পাতায় মুড়ে সুতলি দিয়ে
বেঁধে রাখছে। এই দোকানেই ওর কাজ বাঁধা থাকে সারাবছর। নুন মেপে রাখা,
মালপত্র নিয়ে আসা।। আগে ভ্যান চালাত। এখন আর চালায় না। মেয়ের বিয়ের সময় সেই
যে ভ্যানটা বেচতে হল আর কেনেনি। এখন একটা ঠেলা কিনেছে। দোকানের মালপত্র
নিয়ে আসে ধূপগুড়ি হাট থেকে। আর অন্যদিনগুলোয় নুন মাপার কাজ করে, দোকানের
জিনিসপত্র মেপে দেবার কাজও করে মাঝে সাঝে। ভিড় প
ড়লে ওকেও দোকানদারী করতে হয়। এখানে কাজ করেই ওর সংসার দিব্বি চলে যায় এখন। ছেলে বড় হয়েছে, হাজিরা টাজিরা সবই করে।
ন্যান্দোর
কথা শুনে ছেলেটা শিশুসুলভ লজ্জা আর সংকোচে হাত - পা এদিক ওদিক নাড়িয়ে
অন্যদিকে তাকিয়ে নানান ভঙ্গিতে কসরৎ করে তারপর একটু যেন স্থির হয়ে বলে,
"মুই জানোঙে না। আজি বোলে হামার সাগাই আসিবে। তে মাও কছে কনেক খাবার ত্যাল আনির।"
ওর কথা শুনে উপস্থিত সবাই হাসে। ন্যান্দো রসিকতা করতে ছাড়ে না। বলে,
"তোমার না মেলা হাঁসের ডিমা আছে। ডিমার ঝোল করিবে?"
ছেলেটা আরো সংকুচিত হয়ে বলে,
"কচোং বোলে মুই জানোঙে না তো। মোক খালি খাবার ত্যাল আনির কইল।"
দোকানী এবার ডাকে,
"নে বাউ, তোর তেলের শিশিটা দে।"
শিশি হাতে নিয়ে আর একবার জিজ্ঞেস করে,
"কয় টাকার বললি? দু টাকার?"
ছেলেটা
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললে দোকানী শিশিতে সাবধানে তেল ভরে আঙুল দিয়ে মেপে দু
আঙুল তেল দেয়। তেলের টিনের গায়ে নানা মাপের টিনের তৈরি তেল মেপে দেওয়ার
পাত্র ঝুলছে। সেখান থেকে সবচেয়ে ছোটটা দিয়ে দোকানী শিশিতে তেল ভরে দেয়।
তারপর শিশির গায়ে লেগে থাকা তেলটুকু হাতে মুছে শিশিটা ছেলেটার হাতে দেয়।
এবার টাকা দিতে দিতে ছেলেটা গলায় একসাথে লজ্জা এবং সংকোচ মিশিয়ে বলে,
"মোক দশ পাইসার দুইটা চকোলেট দ্যাও তো।"
দোকানী হাত থেকে পয়সাগুলো গুণে দেখে দশ পয়সা বেশি। দুটো চকলেট দিয়ে বলে,
"একলায় খাবি না বাড়ি নিয়ে যাবি?"
ন্যান্দো বলে,
"ঘাটাতে এলায় শ্যাষ করিবে দুকিনা চকলেট!"
ছেলেটা
মুখে কিছু বলে না। তেলের শিশিটা সাবধানে হাতে নিয়ে কাগজে মোড়া চকলেটদুটো
হাতের মুঠিতে নেয়। চোখদুটিতে খুশি ঝিকিয়ে ওঠে। তারপর ন্যান্দোর দিকে
তাকিয়ে,
"যাছোং পিসা"
সুর
করে বলেই হন হন হাঁটা দেয় বাড়ির পথে। খালি গা, আধময়লা একটা ছেঁড়া প্যান্ট
কোমড় থেকে ঝুলছে প্রায়। পায়ের পাতা দুটো শক্ত পোক্ত। হাটখোলার শুকনো,
পাথরকুচি মেশানো বালিমাটি পথটার ওপর অনায়াসে লাফাতে লাফাতে এক ছন্দে হাঁটছে
ছেলেটা।
"এ বাউ তুই সরেনের বেটা না?"
লাফ
বন্ধ হয়ে গেল। পা দুটো নিমেষে থেমে গেল মাটিতে। চটলেট ধরা হাতটা দিয়েই
নাকের নিম্নমুখী সিকনিটাকে মুছে নিয়ে কিছুটা সহজ হবার চেষ্টা করে ছেলেটা
লোকটার দিকে তাকাল। তারপর যুগপৎ মাথা নেড়ে মুখদিয়ে একসঙ্গে বলল,
"হ্যাঁ"
"তোর বাপ কাজোত গেইসে? সাঞ্জোত কনেক আসির কইস তো।"
ছেলেটা একটু ভাবল। তারপর লাজুক হেসে বলল,
"তোমাক মুই চিনোঙে না। মুই কবার পাইম না।"
লোকটা হাসি মুখে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
"কেনে না চিনিস? মোক দেখসিস না তোমার বাড়ি যাং যে আরো!"
ছেলেটা তবু লাজুক হেসে মাথা নেড়ে না জানায়। লোকটা এবার হতাশ হয়। তারপর বলে,
"তোমরা হদ্দ খান করিবেন বারে বাপ। কইস বলে পুবটারির শিবেন জ্যাটো, কল বসা শিবেন জ্যাটো সাঞ্জোত যাবার কইসে।"
বাড়ি ফিরে দিদি মালতীকে একটা নিজে একটা চকলেট মুখে ফেলে চুষতে চুষতে ছেলেটার বাবার কথা মনে পড়ে। মালতীর মা বলে,
"তোর বাপ হাজিরা গেইসে, দুপুরে খাবার আসিবে। কি তে?"
"ওয় যে একটা মানষি বাবাক আরো সাঞ্জোত যাবার কইসে।"
"কায় আরো তোর বাপোক যাবার কইসে?"
মালতীর
মার কথার মধ্যেই সরেন বাড়িতে আসে। নদী থেকে একেবারে স্নান করেই এসেছে।
সঙ্গে মালতীর পিসা। একসঙ্গেই দুজনে কাজ করছে আজকে। সেজন্যই দুপুরে আজকে
ডিমের ঝোল হচ্ছে। ওদের ঢুকতে দেখে কথা তখনকার মতো চাপা পড়ে যায়। মালতীর মা
আঙুল দিয়ে শিশির মুখটা চেপে ধরে নিপুণ দক্ষতায় খুব সামান্য পরিমাণ তেল
কড়াইয়ে দিয়ে হাতটা মাথায় মোছে। তারপর খুন্তি দিয়ে তেলটা কড়াইয়ের চারধারে
ছড়িয়ে নুন-হলুদ মাখানো সেদ্ধ ডিমের ফালিগুলো আস্তে করে কড়াইয়ে দিয়ে
উল্টে-পাল্টে ভেজে নামিয়ে আলু ভাজতে থাকে। ডিমভাজার গন্ধে বাতাস চঞ্চল হয়ে
ওঠে।
"আন্দা হয় নাই বৌদি?"
মালতীর মা হেসে টেনে টেনে বলে,
"না হইসে তে কি! হইসে না। ভাত-শাক তামাল্লায় হইসে। খালি ডিমাখান ঝোল করির
আছে। বইসোখেনে। তামনটায় উসা। বসিতে বসিতে এলায় হয়া যাবে।"
ছেলেটা খুব অশান্ত। পিসাকে বলে,
"পিসা। হামার মাও আরো সুতা দিয়া ডিমা কাটে। কাটাই দিয়া কাটিরে না পায়।"
মালতীর মা একটু লজ্জা পায়। বলে,
"ডিমা তে কম হামার বা, ভাগ করি খাবার নাগে। সুতা দিয়া কাটিলে তে সামান হবে!"
সরেন প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
"হ, খাবার বসিল যে! গাও ধুসে?"
ছেলেটা অবাক হয়ে বড় চোখ করে বলে,
"ধুসুং না তে। নাহালে মুই ভাত খাং!"
তারপর হঠাৎ মনে পড়াতে বলে,
"বা, তোক না একটা মানষি সাঞ্জোত যাবার কইসে।"
"কায়"
"ওয় যে......., মুই চিনোং না।"
ওর বাবা অবাক হয়। পিসা বলে,
"চিনিন নাই তে পুছির পাইস নাই পাগলা?"
ছেলে ভাতে আলু আর ঝোলটুকু যত্ন নিয়ে মাখতে মাখতে বলে,
"পুছিসুং তো!"
"কি কইল তে ফম নাই?"
"ফম আছে! তে মুই মানষিটাক চিনোঙে না!"
ওর বাবা এবার অবাক হয়ে বলে,
"হিটা আরো কেমন পাগলা চেংরা তে। ফম আছে তে আগোত ক, কি কইল মানষিটা।"
"মোক কইল তোক কোবান্না পুবটারির শিবেন জ্যাটো তোক সাঞ্জোত যাবার কইসে।" এবার মালতীর মা চিন্তিত হয়ে বলে,
"কায় আরো তোর জ্যাটো হোটে?"
সরেন মুখে কিছু বলে না। মনে মনে ভাবতে থাকে হয়ত। এবার মালতীর মা হঠাৎ যেন কিছু বুঝতে পেরে বলে,
"হ! কেমন মানষিটা বাবা! হারায়-মোটায়, গোড়া ধ্যাগধেগা?"
ছেলে মাথা নাড়ে। এবার ওর মা বলে,
"চিনিলেন না? ফেন্নার না দাদা!"
সরেন না বোঝা মুখ করে বলে,
"কুন আরো তাউকসা-ফেন্না!"
মালতীর মা দা দিয়ে সুপারি কাটতে কাটতে বলে,
"পুবটারিন্না! তোমার নামে নাম যে! উমারে দাদা মোন্তায়। কল বসায় যে!"
ছেলে এবার চেঁচিয়ে বলে,
"হ্যাঁ হ্যাঁ কলবোসা শিবেন জ্যাটো কইসে।"
ওর বাবা হেসে বলে,
"তুই কি তে বুড়া হসিস বাউ? এলাইতে মানষি একটা কাথা কইলে ফমে না থাকে!"
ছেলেটা লজ্জা পায়। হাসে। মালতীর মা বলে,
"কলও বোসায়, চুয়াও না বোসায়! এত্তিকেনা আর কায় আছে তে উমরা ছাড়া। তো কনেক নেশা করে মানষিটা। হয়না?"
সরেন মুখে পান ফেলে বলে,
"আরে, এইলা হইল বহনের কাজ। কনেক-আদেক না খাইলে বলে চলে না। খাইলে কি
দেহা-পিটির বিষ টানে। ভ্যান চালা মানষিলাক দেখিন্না? যেখিনা কামাই করে আদেক
খায়ায় শ্যাষ।"
একটু থেমে বলে,
"তে বহনের কাজ হইলেও পাইসা আছে এইলা কাজোত। চুয়া বোসা তো ইস্কেরও কাজ, নাহয়?"
মালতীর মার এসব কথা ভালো লাগে না। বলে,
"তোমরা এত্তি এইলা হাজিরা মুজুরা করি চল। নানাগে ওইলা কাজোত যাবার না। হামরা না হয় কষ্টে মষ্টে চলিমু।"
সরেন মালতীর পিসাকে সাক্ষী মেনে বলে,
"তোর বৌদির কাথাটা শুন। না যাইতে ভয় খাছে নিশা করিবার।"
মালতী আর মালতীর মা খেতে বসে। সরেনরা আবার কাজে বেরিয়ে যায়। বাচ্চা ছেলেটা মাঠের দিকে বেরিয়ে যায় খেলতে। ওর মা খেতে খেতে চেঁচায়,
"ওদি চাইট্টা গোবরও কুড়াইস বাউ দোলাবাড়িত। তোর দিদিও যাছে কনেক পরে। তুই তাবত্তে আলির গোড়োত গোটো করিস।"
মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে লাফাতে লাফাতে পকেটে মার্বেল নিয়ে ছেলে মাঠের দিকে আগাতে থাকে।
...............................................................
মোন্তায় - মনে হয়
চুয়া - কূয়া
বহনেরসকাজ - পরিশ্রমের কাজ
কনেক-আদেক - অল্প স্বল্প
ইস্কের - রিস্কের
এত্তি - এদিকেই
তাবত্তে - ততক্ষণ