চা-ডুবুরি/পর্ব : ৩১
সুকান্ত নাহা
*****************
একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর
~~~~~~~~~~~~~~~~~
-" কাল রাতে বাঘ এসেছিল... মস্ত এক চিতাবাঘ..শব্দ পাননি...? "
"-বা-ঘ! বলেন কী... কখন? কত রাতে... টের পাই নাই তো! "
প্রেসার যন্ত্রের আর্ম-কাফটা জড়াতে জড়াতে ভবেশ ডাক্তার আঁতকে ওঠার ভান করেন। সুধাময়ের সঙ্গে কথা বলার সময় সচরাচর এমনটাই করে থাকেন তিনি। সুবর্ণকেও উপদেশ দেন, "এইসব পেশেন্ট হৈলো গিয়া বাচ্চাদের মতো। এইটা-সেইটা নানান কথা কইয়া তাগো একটু উৎসাহ দিতে হয়,বুঝলেন না। যতটা পারবেন উৎসাহ দিবেন। বেহুদ্দা কথা কইলেও বিরক্ত হওয়া চলব না মোটেই। তাহৈলে পেশেন্ট আরো ডিপ্রেশড হ'য়া পড়ব। কথা কইলে ক্ষতি নাই। যত কথা কইবেন তত ভাল। বাধা দিলেই দ্যাখবেন গুম মাইরা গেছেন। সেইটা আরো খারাপ।"
ডাক্তারের প্রাণবন্ত প্রতিক্রিয়ায় সুধাময়ের উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কথার তোড় খেই হারাতে থাকে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তলিয়ে যান অতীতের ঘূর্ণিপাকে। তলিয়ে ফের ঘাইমেরে উঠে আসেন অবচেতনে জড়ানো অতীত স্মৃতির জলজ গন্ধ মেখে নিয়ে।
" তখন অনেক রাত...বাঘের গন্ধ পেয়ে কুকুরটার সেকি চিৎকার...ঘেউ ঘেউ ঘেউ... ঘুম ভেঙে গেল। দেখি , তূর্য..মানে আমার নাতি...দেখেছেন তাকে? খুব সাহস তার...টর্চ জ্বালিয়ে দ্যাখে পেছনের উঠোনে বিরাট এক চিতা...দেখেই ও চিৎকার শুরু করলো...পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগল বাঘটাকে...আর ওর চিৎকার শুনে আশপাশ থেকে লোকজন সব ছুটে এলো...লাঠি সোটা নিয়ে...সে একেবারে হৈ হৈ কান্ড... আপনারা শোনেননি..!"
-" না তো! আপনি দ্যাখছেন নাকি বাঘটারে? "
বিপি মেশিনের ইনফ্লেশন বাল্বটা পাম্প করতে করতে স্টেথোর ইয়ারপিসের লাবডুবে মনোযোগী হওয়ায় ডাক্তারের গলার স্বর ক্ষণিকের জন্য স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। সুধাময় যদিও ধারাবিবরণী দিয়ে চলেছিলেন সমানে,
''দেখলাম তো... সেকি গর্জন বাঘটার... গরুটাও চিৎকার করছিল খুব...! "
" অ...তাই বুঝি.. " বারকয়েক পাম্প করেও পারদস্তম্ভের ওঠানামার সাথে হৃৎস্পন্দনের মেলবন্ধন কিছুতেই ঠাহর করে উঠতে পারছিলেন না ডাক্তার। নাক কুঁচকে চশমার অধঃপতন সাময়িক রুখে দিয়ে তাই বাইফোকাল দৃষ্টির ভেতর একটু যেন আনমনা হয়ে পড়েছিলেন । উদ্দীপ্ত গলার স্বর নেমে এসেছিল খাদে। যন্ত্রটা পুরনো। মাঝেমাঝেই বেগড়বাঁই করে। আর সেক্ষেত্রে বড় অস্বস্তিতে পড়ে যান তিনি। শ্রমিকদের যা হোক একটা বুঝিয়ে দেন। বাবু-সাহেবদের রক্তচাপ মাপতে গিয়েই নিজের রক্তচাপটা বেড়ে যায়। বেকায়দায় পড়ে বারবার আর্ম-কাফ খোলেন।আবার জড়ান। জড়ান আর খোলেন।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে। গলা শুকিয়ে আসে। কে যেন রটিয়েছিল এভাবে গৃহিনীর প্রেসার মাপতে গিয়ে নাকি বেজায় বিপত্তিতে পড়তে হয়েছিল ভবেশ ডাক্তারকে। ক্রমাগত কাফ খোলা আর জড়ানো করতে করতে গৃহিনীর 'ড্যানা' ব্যাথা হয়ে যায়। ব্যথার চোটে কাতর ডাক্তারগিন্নী নাকি প্রেসারযন্ত্রটি ছুঁড়ে উঠোনে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন " ফ্যালাও তোমার এই অকম্মার ঢেঁকিটারে, যেমন তুমি তেমন তোমার যন্তর...মরণ আমার...তখন থিকা চাইপা চাইপা ড্যানাটা ব্যাথা কইরা ফ্যালাইলো আমার...! "
চেস্টপিসের ডায়াফ্রামে বারকয়েক হালকা টোকা দিয়ে পুনরায় কাফসন্ধিতে চেপে বসান ভবেশবাবু। উত্তেজনায় রাবার বাল্বে দ্রুতলয়ে চাপ বাড়াতে থাকেন। এই সময় কিঞ্চিৎ ব্যথাজনিত কারণেই হয়ত ধারাবিবরণী কার্যত বন্ধ রেখেছিলেন সুধাময়। অনেকক্ষণ কসরতের পর কৃতকার্য হতেই ডাক্তারের চেহারায় মেঘ সরে গিয়ে রোদ্দুর উঁকি দেয়। আর্ম- কাফ খোলা শুরু করতেই ধারাবিবরণীও ফের চালু হয়ে যায়,
" বাঘটা বেশ বড় ছিল, ...গরুটাও জোর লড়াই করলো বাঘের সাথে,...ধবলি...মানে আমাদের চারসেরি দুধের গাই, সেও ছিল এক ডানপিটে ...এককালে আমাকেও কি কম ভুগিয়েছে..! হাঃ হাঃ হাঃ...বাড়ি থেকে পালিয়ে সেই ফরেস্টে গিয়ে বাচ্চা দিয়েছিল...আমার এই যে আঙুলটা...ভাঙা...নোখ নেই...ঐ ধবলির কীর্তি...দড়ি দিয়ে খুঁটিতে বাঁধতে গেছি, দিলো টান... ব্যাস আঙুল ঝুলে গিয়ে দরদর করে রক্ত,...." আঙুলটা দেখাতে দেখাতে ফের কোথায় যেন হারিয়ে যান সুধাময়। বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলে চুপ করে যান । ডাক্তার অধীর হয়ে ওঠেন বাকিটা শোনার জন্য, " "তারপর...তারপর কী হৈলো বাঘটার...?"
" বাঘটার? কি যেন হলো? ও হ্যাঁ, রথীনবাবু গুলি করে মেরে ফেললেন...মস্ত চিতা। এক গুলিতেই সাবাড়। রথীনবাবুকে চেনেন আপনি?" ভবেশ ডাক্তার ঘেঁটে ঘ। হচ্ছিল গোয়ালে বাঘের কথা এরমধ্যে রথীনবাবু আবার ঢুকে পড়লেন কীভাবে। তাড়াতাড়ি সুধাময়কে ট্র্যাকে ফেরাতে গিয়ে হাঁ-হাঁ করে উঠতে গিয়ে ফের হোঁচট খান ডাক্তার। সুধাময় ততক্ষণে লাইন ক্লিয়ার পেয়ে এক্সপ্রেস ছুটিয়েছেন।
" ও রথীনদাকে আপনি চিনবেন কেন? আমিও যেমন...আপনি তো অন্য জায়গায় থাকেন। রথীনদা বাগানের কম্পাউনডার বাবু ছিলেন... মস্তবড় শিকারি, বাঘের খবর পেলেই হল... কাঁধে দোনলা বন্দুক আর পাঁচ সেলের টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন । আমাকেও মাঝেসাঝে ডেকে নিতেন, ' মাস্টার...যাবা নাকি। চলো, মাচা বেঁধে বসব সারারাত।" খুব সিগারেট খেতেন রথীনদা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে সিগারেট জ্বলছে...মাচায় বসে আছি দুজন। নিচে খুঁটিতে ছাগল বাঁধা। অনেক রাতে চিতাবাঘ এল ছাগল খেতে। ব্যস এক গুলিতেই খতম বাঘ। একবার একা গেছিলেন... পেছন থেকে অ্যাটাক করেছিল জানোয়ারটা। শেষ মুহূর্তে বুঝতে পেরে শুয়ে পড়ে ভাগ্যিস গুলি চালিয়ে দিয়েছিলেন বলে বাঁচোয়া... " বলতে বলতে চুপ করে কী যেন ভাবতে থাকেন সুধাময়। সেই ফাঁকে ভবেশ ডাক্তার ঢুকে পড়েন লাইনে,
" আপনার ঐ ধবলি গাই, কী করলো য্যান তারপর বাঘটারে? "
" ধবলি? তাকে দেখেছেন আপনি? দারুণ সাহসি গরু...শিং দিয়ে গুঁতিয়ে এক্কেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল,...তূর্যও খুব চেষ্টা করেছিল বাছুরটাকে বাঁচাবার...পাথর ছুঁড়ে মেরেওছিল...বাঘের সাথে কি আর পারা যায়....পারল না...ঘাড় কামড়ে চোখের সামনে থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল...."
চায়ের জল চাপিয়ে তূর্ণা সব শুনছিল ভেতর থেকে। গতরাতের ঘটনাটার সাথে সুধাময় পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার ঘটনাটা যে রিলেট করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না তূর্ণার। সুবর্ণর কাছে ঘটনাটা বহুবার শোনা। অতীত হঠাৎ করে হুবহু উঠে আসে সুধাময়ের স্মৃতিতে। কেন এমন হয় কে জানে। সামান্য যেটুকু কল্পিত তা তূর্যকে নিয়ে। শ্বশুর মশায় তার নিজের জায়গায় নাতিকে কল্পনা করে কাহিনিতে অন্যরকম ফ্লেভার আনার চেষ্টা করছেন। মূল কাহিনির পরিমার্জিত সংস্করণে হিরো অনিবার্য ভাবে তার ষোড়শবর্ষীয় নাতি। শুধুমাত্র কালকের ঘটনাই নয়, অশীতিপর বৃদ্ধের দৃঢ় বিশ্বাস নাতি তার অসমসাহসী। যে কোনও অসাধ্যসাধন সে করতে পারে। উত্তর প্রজন্মের ভেতর তিনি অনেক সম্ভাবনা খোঁজেন ।
-" সে-কি-ই-ই-ই! ইসসস! বাছুরটারে নিয়া গেল...কীইইই সাংঘাতিক...!" আচমকা উৎপল দত্তের স্টাইলে 'সে-কি-ই-ই-ই' বলে ছদ্মভীতির পারাটা একটু বোধহয় বেশিই চড়িয়ে ফেলেছিলেন ভবেশ ডাক্তার। ফলস্বরূপ যা ঘটলো তা মোটেই অভিপ্রেত ছিল না। বারান্দার এককোণে সামনের দু'পায়ে থুতনি সাঁটিয়ে কানঝোলা টমি উৎকর্ণ হয়ে এতক্ষণ দুজনের কথোপকথন শুনছিল। ডাক্তারকে এমনিতেই তার খুব একটা পছন্দ নয়। তার ওপর বেমক্কা ভলিউম বেড়ে যাওয়াতে খুশি হলো না সে মোটেই। বিরক্ত হয়ে ঘেউ করে বিকট এক হুংকার। তারপর চারপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে ক্রমাগত চেঁচিয়ে নিজের না-খুশ মনোভাব ব্যক্ত করতে থাকে। জ্বলে উঠেই ঝপ করে নিভে যান ভবেশ। নাটুকে মুহুর্তে সহসা যবনিকাপাত। কিশোরবেলায় পেটে চোদ্দ-ছুঁচের দুঃখস্মৃতি কুকুর তেড়ে এলেই চাগাড় দিয়ে ওঠে বুকের ভেতর। টমির উগ্রমূর্তি দেখে বাঘ দেখার আতংকটা এবারে যেন উল্টে চেপে বসে ডাক্তারের ঘাড়ে। চশমা নেমে আসে নাকের ডগায়। আপার-টায়ার দিয়ে টমির দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে নার্ভাস গলায় বলতে থাকেন,
-"আরে বাবা...কা-কামড়াইবো-টামড়াইবো না তো? অ বৌমা আসো তো এইদিক...কুত্তাটা অমন করে ক্যান..." তূর্ণার উদ্দেশ্যে গলা চড়ান ডাক্তারবাবু।
-" না, না...ও খুব ভাল কুকুর... কাউকে কামড়ায় না। " হাত তুলে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করেন সুধাময়। ভেতর থেকে ট্রেতে করে চা নিয়ে বাইরে আসে তূর্ণা। বেতের টেবিলটার ওপর ট্রে-টা রেখে টমির দিকে তাকিয়ে জোরে ধমক দেয় তাকে। ধমক খেয়ে শান্ত হয়ে ল্যাজ গুটিয়ে অপ্রসন্নচিত্তে বসে পড়ে টমি।
-" কেমন আসো বৌমা ? " একটু সাহস পেয়ে ভবেশ ডাক্তার সস্নেহে প্রশ্ন করেন।
-" ভাল আছি মেসোমশায়। আপনি কেমন? মাসিমা কেমন আছেন? "
-" এই চলতেসে আর কি। তোমার মাসিমার শরীরটাই যা ভাল নাই। সুগার বাড়সে। প্রেশার তো আছেই। তার ওপর ইউরিক অ্যাসিডটা জ্বালাইতেছে বড়। "কথার ফাঁকে ফাঁকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি মেলে টমিকে নিরীক্ষণ করেন ডাক্তার।
-" ওষুধ খাচ্ছেন তো নিয়মিত? " তূর্ণা জানতে চায়।
-" হ্যাঁ, ওষুধের ওপরেই তো আছে। তা, তোমরা এইবারে কিন্তু অনেকদিন পর বাগানে আসলা. "
-" হ্যাঁ, এতদিন ছেলের পড়াশোনা ছিল। আসতে পারতাম না। এখন পরীক্ষা শেষ। তাই ভাবলাম যাই ক'টা দিন কাটিয়ে আসি বাগানে। " তূর্ণা বলে।
-" ভাল করসো। আসলা বলে তোমার শ্বশুর মশায়রেও দেখতে পা'লাম। কি মানুষ কি হয়া গেছেন! সুবর্ণবাবুর কাছে সব খবর পাই। দ্যাখতে খুব ইচ্ছা করত। একসময় কতই না গল্প করসি উনার সাথে। একসাথে তাস খেলা, দাবা খেলা। ফুটবল টূর্ণামেন্ট দ্যাখতে যাওয়া। খুব বেশিদিন অবশ্য উনার সাথে কাজ করি নাই। আমি যখন 'টেরাই' থিকে এইখানে আসলাম তার পরের বছরই উনি রিটায়ার করলেন। কিন্তু যে কদিনই পাইছি খুব সুন্দর দিনগুলো কাটাইসি আমরা। আর অখন তো বাগানে... " ডাক্তারের কথা শেষ হয় না বাইকের চেনা শব্দ ভেসে আসে। শুনে কানখাড়া হয় টমির। সুবর্ণর বাইক এসে থামে গেটের কাছে।
-" ঐ তো আইসা পড়সে আপনার ছেলে... " ডাক্তারের কথায় সুধাময় মাথা তুলে তাকান। মৃদু হাসি ফোটে তার মুখে। বাইক রেখে বারান্দায় উঠে এসে আরেকটা চেয়ার টেনে নিয়ে বাবার পাশে বসতে বসতে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে সুবর্ণ বলে, " আপনি কতক্ষণ? "
-" এই তো আধা ঘন্টা হৈলো আর কি। আপনের বাবার মুখে বাঘের গল্প শুনতেসিলাম। কাল নাকি বাঘে আপনাদের গরু নিয়া গেসে... সেই গল্প... "
গতরাতে টমি কোনও কিছুর শব্দ পেয়ে অস্বাভাবিক চেঁচাচ্ছিল। কিছুতেই চুপ করানো যাচ্ছিল না ওকে। বাধ্য হয়ে টর্চ নিয়ে বাইরে বেরিয়েছিল সুবর্ণ। কিছুই পাওয়া যায়নি। কদিন আগে নাইট শিফটের লেবাররা ফ্যাক্টরিতে কাজে যাওয়ার সময় সুবর্ণর বাসার পাশের রাস্তায় নাকি বাঘ দেখেছে। একটা চিতা নাকি ঘোরাফেরা করছে কদিন ধরে। দিন পনের আগে বিচলাইনে ঘরে ঘরে হানা দিচ্ছিল বাঘ। বাধ্য হয়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে চিঠি লিখে বাঘ ধরার খাঁচা আনিয়েছিলেন বড়সাহেব। ছাগলের টোপ লাগিয়ে খাঁচা ফেলাও হয়েছিল কদিন। কোথায় কী! খাঁচা পাতার পর থেকে বাঘ উধাও। এইসব নিয়ে রাতে ডাইনিং টেবিলে বসে কথা হয়। তূর্য সেসবে আরো রঙ চড়িয়ে দাদুকে শোনায়। কালকের ঘটনা আর ঐ বাঘের খাঁচা পাতার গল্প সব মিলিয়ে বাবার মনে রেখাপাত করেছে হয়ত। ভাবতে ভাবতেই সুবর্ণ একটু অবাক হয়, বাঘের গল্পে আবার গরু এলো কী করে!
-" গরু...! আমাদের আবার গরু কোত্থেকে...! " কথাটা শেষ করার আগেই ভবেশ ডাক্তার ইশারায় সুবর্ণকে থামতে বলে বুঝিয়ে দেন তিনি সবই জানেন। তারপর বলেন,
-" আরে আপনাদের গরু... ধবলি না কি নাম... যেইটা ফরেস্টে বাচ্চা দিসিলো.. সেই বাচ্চাটারেই তো বাঘ উঠায়ে নিয়া গেল না কা'ল রাইতে.. " ভবেশ ডাক্তার চোখ টেপেন। তারপর তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলেন,
- বৌমা দাঁড়ায় ক্যান... বসঅ। "
-" আমি ওর জন্য চা নিয়ে আসি। আপনারা চা খান। বাবা তুমিও খাও। ঠান্ডা হয়ে যাবে। " বলে তূর্ণা ভেতরে চলে যায়। "
সুধাময় দুহাতে যত্ন করে কাপটা উঠিয়ে হাসি হাসি মুখে তৃপ্তির সাথে বেশ জোরে ফুড়ড়ুৎ করে একটা চুমুক দেন। বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে গিয়ে অর্ধেকটা ভেঙে গায়ে পড়ে যায়। বাবার এ জিনিসগুলো দেখে সুবর্ণর আজকাল বড় কষ্ট হয়। চা খেতে গিয়ে এমন বিদঘুটে আওয়াজ কোনোদিন করতেন না বাবা। চা খেতে যদিও বরাবর ভালবাসতেন। কিন্তু এই হ্যাংলামোটা ছিল না। খেতে ভালবাসলেও লোভ ছিল না কোনোদিন। এখন ঠিক উল্টোটা হয়েছে। আগে যেগুলো খেতেন না এখন সেগুলো দেখলেই হাত বাড়ান। বিশেষ করে তূর্য যা খাবে সেটা তারও চাই। তূর্ণা আপত্তি করলেও তূর্য লুকিয়ে চুরিয়ে দু একটা খাবার মুখে তুলে দেয়। ক্যাডবেরি দেখলে তো কথাই নেই। মুখে পুরে চোখ বুজে চুষতে থাকবেন পরম আহ্লাদে।
-" কেমন দেখলেন? প্রেসার কত? বেড়েছে? "সুবর্ণ প্রশ্ন করে।
-" না, তেমন বাড়ে নাই... ঠিকই আছে..." চায়ে চুমুক দিতে দিতে দায়সারা উত্তর দেন ভবেশ ডাক্তার।
-" কাল একবার যদি ব্লাডের পি. পি আর ফাস্টিংটা করিয়ে নেয়া যেত... দুমাস তো প্রায় হতে চললো... "সুবর্ণ বলে।
-" কইলে নার্সরে পাঠায়ে দিব নে ...ব্লাড স্যাম্পল নিয়া যাইব । "
-" আহা, কি সুন্দর... কি চমৎকার দৃশ্য... " নিমেষে চা শেষ করে সুধাময়ের দৃষ্টি সরে যায় দূর পাহাড়ের দিকে। ঘন্টাখানেক আগে এক পশলা তুমুল বৃষ্টির পর পাহাড়ের বুক থেকে সরে যাচ্ছে মেঘের আঁচল। উত্তুঙ্গ নীল পাহাড়শ্রেণী ক্রমশ সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে চোখে। এতটাই স্পষ্ট যে পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে ফিতের মত ঝর্ণার শরীর পর্যন্ত দৃষ্টি এড়ায় না। আদিগন্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি স্নান সেরে পড়ন্ত বেলার রোদে শুকিয়ে নিচ্ছে তার সবুজ আঁচল। চা- ঝোপের ভেতর মুখ ডুবিয়ে "লুপার" পোকা শিকারে মগ্ন সাদা বকের ঝাঁক। মাঝে মাঝে ডানা মেলে ওরা জায়গা বদল করে নিচ্ছে। খাওয়া সারা হলে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের দিকে।
বারান্দায় বসে এমন মনোরম দৃশ্য দেখলেই সুধাময় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান। আপন মনেই প্রকৃতির রূপের তারিফ করতে করতে ধ্যানস্থ হয়ে পড়েন যেন। যেন এই প্রথম এমন দৃশ্য দেখছেন তিনি। এখানেই যে তার কেটে গেছে কর্মজীবনের অনেক গুলো দিন সেকথা প্রায়শই মনে পড়ে না তাঁর। নীলপাহাড়ি নামটা তখন হাতড়াতে হয় তাঁকে। অথচ কী আশ্চর্য, আজ হঠাৎ ধবলির কথা কীভাবে মনে পড়লো বাবার! সুবর্ণ মনে মনে অবাক হয়। স্বপ্নপুর থেকে নীলপাহাড়িতে আসার পর লোয়ার স্বপ্নপুরের একজনের কাছ থেকে বাবা ধবলিকে নিয়ে এসেছিলেন। ধবলি তখন গর্ভবতী। লোকটার টাকার দরকার ছিল বলে বেচে দিয়েছিল। নীলপাহাড়িতে এসে দুধের কষ্ট দেখে বাবা গরুটা কেনেন। লোকটা সাবধান করে দিয়েছিল বাবাকে, " মাস্টারবাবু গাইঠো লেকিন খচ্চর আছে। একটু হুঁশিয়ার থাকবেন। " গায়ে হাত বুলিয়ে সুধাময় বলেছিলেন, "নাহ্, কিছু করবে না মনে হয়। আমার কাছে ভালই থাকবে।"
দুজন লোক পৌঁছে দিয়েছিল ধবলিকে নীলপাহাড়ির কোয়ার্টারে। মালি ঘাস এনে দিত। সুধাময় টেনে নিয়ে গিয়ে সামনের মাঠে খুঁটে বেঁধে আসতেন। প্রথম দুদিন সে শান্তশিষ্টই ছিল। বাবুদের বাগাল যেদিন প্রথম তাকে নিতে এলো চড়াতে নিয়ে যাবে বলে, ধবলি ঢুঁশ মেরে ফেলে দিল তাকে। সেই শুরু হল ওর দৌরাত্ম্য। দুদিন বাদেই হঠাৎ ধবলি বেপাত্তা। খোঁজ খোঁজ। খবর এলো সে পৌঁছে গেছে স্বপ্নপুরে পুরনো মালিকের ডেরায়। সুধাময় লোকজন নিয়ে ছুটলেন। গিয়ে দেখেন সেখানেও সে নেই। নিখোঁজ। একটা বাচ্চা ছেলে খবর দিল আগের দিন বিকেলে একটি সাদা গর্ভবতী গরুকে সে চড়তে দেখেছে জলঢাকার এপারে। শীতে নদীতে যখন জল কমে যায়, রাখালেরা গরু নিয়ে নদীর মাঝের চরায় ঘাস জমিতে চড়াতে নিয়ে যায়। কখনও ওপারে ফরেস্টের ধার ঘেঁষে যে ঘাস জমি সেখানেও পৌঁছে যায় ওরা গরু নিয়ে। খবর পেয়ে নদী পেরিয়ে যাওয়া হলো ওপারে। দিনের আলো তখন প্রায় নিভু নিভু। ওপারে গিয়ে 'ধবলি....ধবলি' বলে ডাকাডাকি করতে করতে সুধাময় লোকজন নিয়ে ফরেস্টের ভেতরে ঢোকেন। জঙ্গলের কিছুটা ভেতরে যেতেই চোখে পড়ে ঝোপের আড়ালে বসে বকনা বাছুরটার গা চেটে দিচ্ছে তার সাদা-মা । সবাই মিলে বাছুরটাকে কোলে তুলে নিয়ে এগোতেই ধবলিও পিছু নেয়। মশাল জ্বালিয়ে রাতের অন্ধকারে নদী পেরিয়ে স্বপ্নপুরের ভেতর দিয়ে মা-মেয়েকে নিয়ে আসা হয় নীলপাহাড়িতে।
বাছুরটা তখন বছর খানেকের হবে। সুবর্ণর মনে আছে নীলপাহাড়ির কোয়ার্টারের পেছনের চা-জঙ্গল থেকে হানা দিয়েছিল চিতা এক হেমন্তের রাতে। গোয়াল ঘরের বেড়ার ফাঁক গলে ঢুকে বাছুরটাকে কামড়ে ধরে পালাতে চেষ্টা করে চিতাবাঘ। ধবলি দড়ি ছিঁড়ে আক্রমণ করে বাঘটাকে। অবলা জীবটার পরিত্রাহী চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছিল বাবার। পাশে শুয়েছিল সাত বছরের সুবর্ণ। নিমেষে বুঝে যান বাবা গোয়ালে বাঘ ঢুকেছে। বিছানা থেকে নামতে নামতেই চেঁচাতে থাকেন তিনি। লুঙ্গির কষিটা শক্ত করে কোমরে বেঁধে টর্চ আর দরজার ডাঁশা নিয়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসেন। পেছন পেছন সুবর্ণও উঠে এসে দাঁড়ায় দরজার আড়ালে। পাশের ঘরে মায়েরও ঘুম ভেঙে গেছে ততক্ষণে। ঘুম ভেঙে উঠে এসে মা সাবধান করতে থাকে বাবাকে। বাধা দিতে থাকেন বারেবারে। মাকে জড়িয়ে ধরে সুবর্ণ সভয়ে বাইরে তাকায়। বাইরে কার্তিকের জোৎস্নাভরা রাতে চাঁদের আলোয় উঠোনের একপাশটা ভরে আছে। অন্যপাশে বাতাবি গাছের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে নামছে চাঁদের আলো। আলো -আঁধারি যেন আলপনা দিয়েছে শিশির ভেজা উঠোনের বুকে। অকুতোভয় সুধাময় খালি গায়েই বারান্দা থেকে লাফিয়ে সেই উঠোন পেরিয়ে ততক্ষণে ছুটে গেছেন পাকঘরের দিকে। সুবর্ণ দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে পাথর খুঁজে খুঁজে টর্চের আলোয় ক্রমাগত ছুঁড়ে দিচ্ছেন বাবা গোয়ালের দিকে আর প্রাণপন চিৎকার করে বাঘটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছেন। গোয়ালের দিক থেকে গরুটার কাতর চিৎকার আর ধস্তাধস্তির শব্দ ভেসে আসছিল। বোঝা যাচ্ছিল কিছু একটা ঘটে চলেছে সেখানে। মাকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল সুবর্ণ আর মা সমানে চিৎকার করে চলেছিল, "সামনে যেও না সামনে যেও না, চলে এসো বলছি...।"
চিৎকার শুনে পাশের কোয়ার্টারের রমেশকাকার ঘুম ভেঙে যায়। বল্লম নিয়ে ছুটে এসেছিলেন রমেশ কাকা আর তার বিশ্বস্ত চাকর মছিন্দর। বাবাকে পাকঘরের পাশ থেকে টেনে নিয়ে এসে বলেছিলেন, "মাথাটাথা খারাপ নাকি আপনার... অত কাছে কেউ যায়!"
-" নিয়ে গেল বাছুরটাকে রমেশ....বিরাট বড় চিতা...বেরোতে গিয়ে বেড়ার ফাঁকে আটকে গেছিল..." হাঁফাতে হাঁফাতে বাবা বলতে থাকেন।
-" সে যাক... আরেকটু হলে আপনার প্রাণটাই যে চলে যেত।"
রমেশকাকার গলায় যেন শাসনের সুর।
-" বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারলাম না, রমেশ। বেচারা ধবলিটা আপ্রাণ লড়াই করল..." বলতে বলতে পাকঘরের বারান্দায় বসে পড়েছিল বাবা। পরদিন সকালে ধবলিকে দেখতে গিয়ে বাবা আবিস্কার করেন গরুটার গায়েও বাঘের থাবার আঁচড় পড়েছে। দগদগে হয়ে উঠেছে জায়গাটা। সেই ঘা-টাই অবশেষে সেপটিক হয়ে কেড়ে নিয়েছিল ধবলির প্রাণ।
-" তা, এখন কটা দিন থাকবা তো বৌমা? " চায়ের কাপটা রেখে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করেন তূর্ণাকে। সুবর্ণর হাতে কাপটা তুলে দিয়ে তূর্ণা বলে, " যে কদিন ছেলের রেজাল্ট না বের হয়। "
-" তারপর কি আবার ফিরা যাইবা? "
-" না, এবারে ভাবছি ছেলেকে বাইরে কোথাও হস্টেলে রাখব। বাবার শরীরটাও ভাল নেই। ওরা এখানে থাকলে আমিও নিশ্চিন্ত। " চায়ে চুমুক দিতে দিতে সুবর্ণ বলে।
-"সেই ভাল। এইখানেই থাকো তোমরা। আমি যদিও আর বেশিদিন নাই এই বাগানে। এখন শরীর আর দেয় না। আর বড়জোর বছর খানেক, তারপর বাড়ি যাব গা। বাড়িতেই ডিসপেনসারি খুইলা বইলে দিনে দু একশো যা পাই তাইতেই বুড়াবুড়ির চইলা যাইব। নিজের বাড়ি, নিজের কিনা মাটি, সেই মাটিতে মইরাও শান্তি, কী কও? " ভবেশ ডাক্তারের গলার সুর বিবাগী শোনায়।
-" একসময় এই বাগান ছেড়ে যেতে মন চাইতো না। প্রতিটা বাসায় তখন কত মানুষজন। গমগম করতো বাড়িগুলো। আর এখন, পুরনো মানুষজন সব চলে গেছে একে একে। বাড়িগুলো দেখলে মনে হয় পোড়ো বাড়ি। খাঁ খাঁ করে। তাকালেই কষ্ট হয়।" তূর্নার গলায় বিষন্নতা ফুটে ওঠে।
-" সেই লাগ্যাই তো আরও ভাল লাগে না। তোমার মাসীমা তো বাড়ি যাওনের লাইগ্যা এক পায়ে খাড়া। আমি কেবল ভাবি মাস গেলে যে কটা টাকা পাই সেইটাই বা কে দেয়। বাড়ি গেলে ছেলেদের ঘাড়ে বইসা খাইতে হইব। ছেলেরা আমার খারাপ না। বাপ মায়েরে ফালায় দিব না। তবু বেকার বাপের চেয়ে রোজগাইরা বাপের কদর বেশি, না কি কন সোনাবাবু। "
ইঙ্গিতটা সুধাময়ের পেনশনের দিকে কিনা বোঝা গেল না। ভবেশচন্দ্র আপাত সহজ মানুষ হলেও সুযোগ পেলেই হুল ফোটাতে ছাড়েন না। সুবর্ণ মুখে কিছু না বলে " হুম" করে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে।
-" আইজকের পাতি কত হৈলো, সোনাবাবু? " কথাটা জমলো না দেখে প্রসঙ্গ পালটে চা বাবুদের ট্রেডমার্ক খেজুরে গপ্পে জাম্প করেন ভবেশ ডাক্তার।
-" ছাব্বিশ হাজার কেজি মতো। "সুবর্ণ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে বাবার দিকে তাকায়। এসব আলোচনার কিছুই যেন স্পর্শ করছে না সুধাময়কে।
-" ভালই তো হইতেসে। গতবারের থিকা অ্যাহেড না বিহাইন্ড? "
-" অ্যাহেড, ওয়ান লাখ প্লাস... গ্রিন লিফ। "
- হেঃ হেঃ...হৈয়াও হইবোটা কি। মালিক তো বোনাস আইলেই সেই নাকে কান্দবো। এই বছর চায়ের দামও তো ভাল, তাই না? "
-" হুম্" সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে চুপ করে থাকে সুবর্ণ। সারাদিন পাতার গল্প সেরে বাড়ি ফিরেও সেই গল্পে ঢুকতে আর ভাল লাগছিল না তার। ভবেশচন্দ্র তবু নাছোড়,
-" আচ্ছা, কাঁচা পাতিও তো দেখতেসি রোজ দুই তিন গাড়ি বাইরে বিক্রি হইতেসে। ক্যান্ এইখানে পাতা কাটন যায় না, নাকি! নাকি ঐ পাঠক ব্যাটা গ্যাঁড়াকল কইরা রাখসে। ওর তো চাইর আঙুল অখন ঘিয়ে ডুইবা আছে ... খবর তো সবই পাই...। " বলে চশমার ফাঁকে সুবর্ণর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে ভবেশ ডাক্তার।
-" বাদ দ্যান ওসব কথা। ওসব ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারে নাক গলিয়ে লাভ নেই। আমরা সামান্য কর্মচারী। " সুবর্ণ এড়াতে চায় প্রসঙ্গ।
-" তা কইলে কি আর হয়। বড় সাহেব তো পুতুল হইয়া বইসা আছে। মালিকের আসল লোক তো ঐ পাঠক। কাঁচা পাতাই খালি না, আরও কামাই আছে ঐ ব্যাটার। ইউনিয়নের ন্যাতাগোরেও তো পকেটে পুইরা ফেলসে। এক সাথে তো কাম করেন। ট্যার পান না ? " কথা শুনেই বোঝা যায় ভবেশ ডাক্তার তলে তলে ইনফরমেশন ব্যূরো খুলে বসে আছেন। এমন ভাব করে থাকেন যেন ভিজে বেড়াল, এত খবর পান কোত্থেকে কে জানে!
এবারে একটু রুক্ষতা প্রকাশ করতেই হয় সুবর্ণকে, " আমি নিজের কাজের বাইরে অন্যদিকে মন দিই না। দিইও নি কোনও দিন। সেটা ভাল করেই জানেন। তাছাড়া এত খবর যে জোগাড় করেছেন তার সত্যতাই বা কতটুকু আর সত্যি জেনেও বা আপনি কি করতে পারবেন। চাকরি তো করছেন ভাউচার পেমেন্টে। এসব ম্যানেজমেন্টের কানে গেলে কী হবে বুঝতে পারছেন তো... "
জোঁকের মুখে যেন নুন পড়ে। ওষুধের শেষ ডোজটা কাজ করে। ডাক্তার উঠে পড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তূর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, " বৌমা, আইসো একদিন বাড়িতে। তোমার মাসীমা খুশি হইব। পোলা কই। অনেকদিন দেখি নাই তারে। "
-" ও কি আর এখানে এলে বাড়িতে থাকে। পুরনো বন্ধুদের সাথে গেছে ফুটবল খেলতে। শুনতে পাচ্ছেন না... ঐ যে ডিপালাইনের মাঠে দর্শকদের হৈ চৈ। আজ নাকি ওয়ান ডে ট্যূর্নামেন্ট না কি যেন আছে। " তূর্ণা বলে।
-" হাঃ হাঃ, ভাল ভাল..পোলাপান তো এখন খেলাধূলা করেই না। তোমার পোলা তাও তো ফুটবল খেলে...দাদুর রক্ত যাইব কই। উঠি তা'ইলে, যাইও একদিন। অখন তো বাগানে বাঙ্গালি বাবু বলতে আমরা কয়টা মাত্র ঘর। কারো লগে বইয়া যে আড্ডা মারব, সেইটাও গেছে গা। যাই দাদা..." সুধাময়কে লক্ষ্য করে ভবেশ ডাক্তার জোরে বলে ওঠেন।
সুধাময় যেন সম্বিৎ ফিরে পান। তারপর ডাক্তারের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকেন একদৃষ্টে। প্রেসার যন্ত্র গুটিয়ে রাবারের জুতোটা পায়ে গলিয়ে ভবেশ ডাক্তার যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, সুধাময় হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন, " কোথায বাড়ি যেন আপনার? অনেক দূর? যাবেন কীসে ?"
ভবেশ ডাক্তার থমকে দাঁড়ান। খানিকক্ষণ চেয়ে থাকেন সুধাময়ের দিকে। তারপর বলেন, " এই তো কাছেই। হাঁইটাই যাইব গা।" তারপর গলার স্বর নামিয়ে স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করতে করতে মাথা নেড়ে হাঁটা লাগান, " হায় ভগবান, কি আছিলো এই মানুষটা.. "
ভবেশ ডাক্তার ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে থাকেন গেটের দিকে। চলার ছন্দ যেন ছন্নছাড়া। পুরু গ্লাসের ভেতর দিয়ে শূন্য দৃষ্টি মেলে একবার আকাশের দিকে তাকান। বিস্তর মেঘ জমেছে ফের আকাশে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে চারদিকে। রাতে ফের বৃষ্টি হবে মনে হয়। সদর গেটটা খুলে বন্ধ করার সময় ডাক্তার ঘুরে তাকান। সদ্য প্রৌঢ়ত্ব পেরোনো বৃদ্ধের মুখে ফুরিয়ে আসা মেঘাচ্ছন্ন দিনের আলো পড়ে যেন থমকে আছে। গত দুবছর ধরে চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। অথচ কোথায় যাবেন কার কাছে যাবেন, সেই গন্তব্যই বড় অনিশ্চিত মানুষটার কাছে। রাজ্যের মানুষের তথ্য যার ভাঁড়ারে তিনি হয়ত নিজেই জানেন না, তার নিজের অবস্থানটুকু পুরোপুরি বেআব্রু অন্যের কাছে। যে নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার গল্প শোনান বারবার সেখানকার মাটি যে কতটা আলগা, কতটা লবনাক্ত তা তিনি বুঝেও কাউকে বুঝতে দিতে চান না। না চাইলেও ম্যানেজার থেকে সাধারণ শ্রমিক সকলেই তার বাস্তব পরিস্থিতি,সীমাবদ্ধতা সব জানে। জেনেও তারা তাকে করুণার চোখে দেখে। কেউ বিশেষ ঘাঁটায় না তাকে। একথা হয়ত তিনি নিজেও উপলব্ধি করেন। করেও ভান করেন এ মাটিতে তার আর ভাল লাগছে না বলে। অন্য কোথাও অন্য কোনও মাটিতে শেকড় গাঁথার গল্প শোনাতে ভালবাসেন।
দিন ফুরনোর আলোয় সুবর্ণ উপলব্ধি করে মানুষের শেষ শয্যার মাপ বড় জোর পাঁচ হাত। কোথায় যে সেই মাটির বিছানা অপেক্ষা করে আছে তা কেউ বলতে পারে না। নিশ্চিত করে হয়তো বলা সম্ভবও নয়।