ইনডং চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
ইনডং চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
---------------------
আমরা সচেতন ও শিক্ষিত মানুষেরা ডুয়ার্স নিয়ে সত্যিই ব্যথিত, চিন্তিত এবং ভাবিত। আমাদের প্রিয় ডুয়ার্স সর্বক্ষেত্রেই শোষিত এবং বঞ্চিত। বঞ্চিত উত্তরবঙ্গের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, শিল্প এবং সর্বোপরি টি, টিম্বার, টোব্যাকো, টুরিজম এবং ট্রান্সপোর্ট। তাই টি, টিম্বার, টুরিজমকে জলপাইগুড়ির প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করা যায় না। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব নিয়ে চলে যাবে আর উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিক মানুষগুলি ভুখা পেটে থাকবে চায়ের ফুল, কচু গাছের কন্দ, পিঁপড়ের ডিম, নুন-ভাত বা শাক-ভাত খেয়ে আর অপুষ্টিতে মারা যাবে এটা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলতে দেওয়া যায় না। তাই আমাদের সকলের দায় ও দায়িত্ব আছে। এই দায় ও দায়িত্বকে অস্বীকার করতে পারে না তাই কোন বাগিচাই যাদের দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা আছে। আইটিপিএ সংগঠনের সদস্য ইনডং চা বাগানটির পরিচালক গোষ্ঠী ইনডং টি কোম্পানি লিমিটেড ১৯৭৫ সালে বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে। পূর্বতন কোম্পানির মালিকের নাম ছিলো দেবব্রত গুপ্ত। তাঁর কাছ থেকে হাতবদল হয়ে কোম্পাণীর নতুন মালিকানা হস্তান্তরিত হয়। ২০১৪ সালের ১৪ ই আগস্ট হরিরাম গর্গ, ২০১৫ সালে মদনলাল গর্গ, ২০১৬ সালে রাজেশ গর্গ ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসাবে বাগানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ২১-২২ সাল নাগাদ সীমা মিত্রুকা, সুশীল কুমার নেভাটিয়া এবং অখিল কুমার মাঙ্গলিক বাগান পরিচালনার কাজে এগিয়ে আসেন। বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৫ জন। ইনডং চা বাগানের সুপারিনটেন্ডেন্ট সিনিয়ার ম্যানেজার রজত দেব অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে চা বাগিচা চালাচ্ছেন। বাগানে প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৩ টি। এগুলি হলো এনইউপিডব্লিউ, পিটিডব্লিউইউ এবং ডব্লিউবিটিজিইএ।
ইনডং চা বাগিচাতে কাজ করতে গিয়ে পেয়ে গেলাম রাজ্যের শাসক দলের চা বাগিচার দোর্দন্ডপ্রতাপশালী নেতা রাজেশ লাকড়াকে। রাজেশজীর কাছ থেকে জানতে পারলাম চা-বাগানগুলিতে এখন থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের চা বাগান শ্রমিক ইউনিয়নের একটিমাত্র শ্রমিক সংগঠন থাকবে। বাগানগুলিতে থাকবে জেলা ইউনিটের ১০ থেকে ১২ জন সদস্য। থাকবে সাংগঠনিক ইউনিট। প্রতিটি চা বাগানের ইউনিটকে রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে। জানতে পারলাম উত্তরবঙ্গের চা-বাগান সংশ্লিষ্ট জেলাগুলিতে সংগঠনের জেলা ইউনিট গঠনের তোড়জোড় চলছে। আরো জানলাম ইতিমধ্যে শাসকদলের চা বাগিচা শ্রমিক সংগঠনের অফিসও খোলা হয়েছে শিলিগুড়িতে। আসলে তৃণমূলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ২০১১ তে ক্ষমতায় এসেই চেষ্টা করছিলেন চা-বাগানগুলিতে দলের শ্রমিক সংগঠনগুলিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে। এজন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। বারবার তদানীন্তন শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটককে মুখ্যমন্ত্রী দলের ইউনিয়নগুলির মধ্যে ঐক্য ফেরাতে উত্তরবঙ্গে পাঠিয়েছেন। তৃণমূলেরই একাধিক শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মলয়বাবু বৈঠকও করেন। তৃণমূল দলের একটিমাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলার বিষয়ে জোরও দেন তিনি। তার রূপরেখাও তৈরি হয়ে যায়। শিলিগুড়িতে অফিস করে একমাত্র ইউনিয়ন গড়ার কথা জানিয়েও দেওয়া হয় দলের শ্রমিক নেতাদের। কিন্তু ইউনিয়ন গড়া হলেও তার রেজিস্ট্রেশন হয়নি। ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের বাগিচা অধ্যুষিত অঞ্চলে কাজ শুরু করেন আইএনটিটিইউসির নবনিযুক্ত রাজ্য সভাপতি ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। ঋতব্রত দলনেত্রীর আস্থা অর্জনে সফল হন এবং তারই স্বীকৃতি হিসেবে দলের কাজের দায়িত্বে থেকে ঋতব্রত চা-বাগান এলাকাগুলিতেও গিয়ে দলের শ্রমিক সংগঠনগুলিকে এক ছাতার তলায় আনতে কাজ শুরু করেন। তিনি রাজ্যের চা-বাগানগুলিতে দলের শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যে ঐক্য ফেরাতে সচেষ্ট হন এবং জানিয়ে দেন কোনও অনৈক্য এক্ষেত্রে বরদাস্ত করা হবে না এবং দলের সব শ্রমিক নেতাকে একটিমাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণেই থাকতে হবে।
ইনডং চা বাগিচাতে ক্ষেত্রসমীক্ষা করার সময় পরিচয় হল বাগানের সিনিয়র ম্যানেজার রজত দেবের সঙ্গে। বাগিচা শিল্পে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রজতবাবুর। জানলাম চা বাগানটির আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৭৪০.৩৮ হেক্টর, এক্সটেন্ডেড জমি নেই। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ২৯.৫৫ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ২১৬.৬৮ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে প্রতি হেক্টর জমি পিছু ১৩৫২ কেজি করে চা ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয়। ইনডং চা বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ৪১ জন। করণিক ৪ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ৭ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৮৫১। মোট জনসংখ্যা ৪২৫৭ জন। স্থায়ী শ্রমিক ১১২৮ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৩২ জন। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক নেই। কম্পিউটার অপারেটর ১ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১২১৪ জন। অ-শ্রমিক সংখ্যা ৩০৪৩ জন। ইনডং চা বাগানে নিজস্ব চা পাতা উৎপাদনের গড় ২৫ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উৎপাদিত চা ৫-৬ লাখ কেজি। বাইরের বাগান থেকে কাঁচা পাতা সংগৃহিত হয় না। মোট বাৎসরিক উৎপাদিত চা ৫-৬ লাখ কেজি। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাগানে ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা উৎপাদিত হয়। বাগানটি ছোটো হলেও চরিত্রগত দিক দিয়ে উন্নতমানের বাগান। এলাহাবাদ ব্যাংকের কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে ব্যাংক এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স থেকে। বাগানটির লিজ হোল্ডার ইনডং টি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। লিজের ভ্যালিডিটির সময়সীমা ১৩.৬.২০৩০। বাগিচায় ব্যক্তিগত ইলেক্ট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ৪৬৭ টি। বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাসের সংখ্যা ২২৬। আধা পাকাবাড়ির সংখ্যা ৪৮। মোট শ্রমিক আবাস ৭৪১ টি। মোট শ্রমিক ১২১৪ জন। বাগানে শতকরা ৬১ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। শ্রমিক আবাস নির্মাণ, মেরামতি এবং রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ কোম্পাণী বছরে গড়ে ৫ লাখ টাকা খরচ করে। বাগিচায় শৌচাগারের সংখ্যা ২০৭ টি।
চা বাগিচাগুলিতে উত্তরবঙ্গের সামাজিক, আর্থিক, শিল্প, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল সর্বত্র তার নিজস্ব স্বমহিমায় উপস্থিত। চা বাগিচার ৫০% এর অধিক শ্রমিক মহিলা এবং বাগিচার প্রায় ৮০% এস.টি./এস.সি./ও.বি.সি.অন্তর্ভূক্ত জনগোষ্ঠী। ইনডং চা বাগিচায় হাসপাতাল আছে। ডিসপেনসারিও আছে। আবাসিক ডাক্তার আছে। প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা ২ জন। বাগিচায় নার্সের সহযোগী মিড ওয়াইভস নেই। কম্পাউন্ডার অথবা স্বাস্থ্য সহযোগী ১ জন। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৬ টি, ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৮ টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড ১ টি, মেটারনিটি ওয়ার্ড নেই। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার আছে। অ্যাম্বুলেন্স আছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বাগানেই। চিকিৎসার জন্য শ্রমিকদের বাগানে অবস্থিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেফার করা হয়। তবে এই একবিংশ শতকেও চা বলয়ে নারী শিক্ষার বিকাশ হলেও নারীরোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে মহিলা চিকিৎসকের অভাব একটি গভীর সমস্যা। বাগিচা শ্রম আইন, ১৯৫১ এ স্বাস্থ্য, সেনিটেশন, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি শ্রম কল্যাণকারী আইনী ব্যবস্থা থাকলেও নারী চিকিৎসা কিম্বা নারী রোগ চিকিৎসক রূপে মহিলা ডাক্তারদের নিয়োগ সংক্রান্ত কোন আইনী ব্যবস্থা নেই। চা বাগিচার ইতিহাসে মহিলা সংক্রান্ত রোগের পরীক্ষাই হয় না। তাহলে চিকিৎসা কি করে হবে? সত্তর দশক পর্যন্ত চা বাগানে এল.এম.এফ, ডাক্তাররা নিয়মিত চাকরী করেছেন। তখনও অবশ্য মহিলাদের সমস্যা সত্যি বিশেষভাবে নজর কাড়েনি আর বর্তমানে পাশ করা এম.বি.বি.এস. ডাক্তার তো গ্রামাঞ্চলে সরকারী উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রেই থাকতে চায় না, তো চা বাগানে কি করে এবং কেনই বা থাকবে? চা বাগিচার মহিলাদের সুস্থ সবল স্বাস্থ্য এবং উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছাড়া চা বাগানগুলি চলবে কি ভাবে? সরকারী স্বাস্থ্য ছাড়া এর কোন সমাধানও নেই। চা বাগিচাগুলির স্বাস্থ্য পরিষেবা ফেরানোর জন্য পাহাড় এবং ডুয়ার্সে তিনটি হাসপাতাল চা বাগান মালিকেরা তৈরি করবে বলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৯ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সময়কালে। কিন্তু তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা, কালজানি, লিস, ঘিস, চেল দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেছে। বাগিচা অঞ্চলে গ্রুপ হাসপাতাল এখনও স্বপ্ন।
ইনডং চা বাগিচাতে ক্রেশের সংখ্যা ১টি। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা, শৌচালয় আছে। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের দেওয়া হয় না। পর্যাপ্ত পানীয় জল ক্ৰেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয় না। পানীয় জল সময়ে সময়ে ব্যবহারযোগ্যও নয়। বহু বাগানে ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছি। কিন্তু দেখলাম ইনডং বাগানের মোবাইল ক্রেশ শ্রমিকদের ভরসা। কোথাও মাথার ওপর টাঙানো ছেঁড়া প্লাস্টিক, কোথাও আবার চা গাছের এক ঝোপ থেকে আরেক ঝোপে ঝোলানো জীর্ণ শাড়ি। তাতেই দোল খাচ্ছে চা বাগানের শ্রমিকদের শিশুরা। ক্রেশের নামে এমন ব্যবস্থা ডুয়ার্সের বহু বাগানেই চোখে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে মেটেলির ইনডং চা বাগান কর্তৃপক্ষের শিশুবান্ধব মোবাইল ক্রেশ আইন ও মানবিকতা দুটিই মেনে চলার দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে এসেছে চা বলয়ে। বাগানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হরিরাম গর্গ ও সুপারিন্টেন্ডেন্ট ম্যানেজার রজত দেবের কাছ থেকে জানলাম প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো সমৃদ্ধ মোবাইল ক্রেশটি বহু দিন ধরেই তাদের বাগানে রয়েছে। বাগানে একটি স্থায়ী ক্রেশের নতুন ভবন তৈরির কাজও এখন প্রায় শেষের পথে। কাজের সময় শিশুরা যত্নে থাকায় খুশি ওই বাগানের শ্রমিকরাও। ইনডং বাগানে এখন এরকম ৩০ জন শ্রমিক রয়েছে। তাদেরকে একসঙ্গে বাগান কর্তৃপক্ষ কাজ দিয়ে থাকে। ওই মহিলা শ্রমিকদের শিশুদের রাখার জন্য মোবাইল ক্রেশটি কাজের জায়গার সামনেই রেখে দেওয়া হয়। একটি ট্রাক্টরকে সাজিয়ে-গুছিয়ে এই ক্রেশ তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রদের ছবি আঁকা রয়েছে ক্রেশের বাইরের অংশে। ভেতরে খেলনা রয়েছে, দুধ-বিস্কুট মাঝেমাঝেই জোগান দেওয়া হয়। মায়েরা কাজে ব্যস্ত থাকলে শিশুদের যত্ন থেকে শুরু করে খাবার খাওয়ানোর জন্য মোবাইল ক্ৰেশে দুজন করে দাইমা নিয়োগ করা রয়েছে। দুধ খাওয়ানোর সময় হলে আশপাশে থাকা মাকে খবর দিয়ে নিয়ে আসেন তিনি। ক্রেশের ভিতরে সন্তানকে স্তন্য পান করিয়ে ফের মা নিজের কাজে ফিরে যান।
বাগানের অন্যতম পরিচালক রাজেশ গর্গের কাছ থেকে জানতে পারলাম যেদিন মহিলা শ্রমিকদের যাদের বাচ্চা আছে তাদের যেখানে কাজ দেওয়া হয় সেখানেই মোবাইল ক্রেশটি নিয়ে যাওয়া হয়। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকরাও খুশি। শান্তা মাহালি, সুশীলা ওরাওঁ, নিমা ওরাওঁ-এর মতো শ্রমিকরা জানান তাদের সন্তানরা আদর-যত্নে থাকায় তারা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন। সারহা মুন্ডা নামে এক দাইমা প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এই কাজ করছেন। তাঁর মতে, অনেক বাগানেই এত সুন্দর ক্রেশের ব্যবস্থা নেই। ইনডং চা বাগানের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ম্যানেজার রজত দেবের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম স্থায়ী ক্রেশের পাকা ভবনের কাজ প্রায় শেষের পথে। সেখানে একটি শিশু উদ্যান গড়ে তোলার পাশাপাশি শিশুদের পড়াশোনা করার ব্যবস্থার কথাও তারা ভেবেছেন। বাগিচায় ২০০৬ সাল থেকে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। বাগিচায় ওষুধ সরবরাহ হয়। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় আছে। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে একটা ট্রাক্টর আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব আছে। খেলার মাঠ আছে। ইনডং টি গার্ডেনে নিয়মিত পি এফ বা গ্র্যাচুইটির টাকা জমা পড়ে। বোনাসও চুক্তি অনুযায়ী মিটিয়ে দেওয়া হয়। পি এফ বা গ্র্যাচুইটি বকেয়া থাকে না। শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। কিন্তু চা বাগিচার বাসিন্দারা কার্যত নিজভূমে পরবাসী। তাদের কারোর জমির পাট্টা নেই। দীর্ঘদিন ধরেই চা বাগিচার বাসিন্দাদের জমির পাট্টা নিয়ে দাবি রয়েছে। অধিকাংশ চা বাগিচা অঞ্চলে শ্রমিকেরা কেউ পঞ্চাশ বছর, কেউ বা সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে এলেও আজ পর্যন্ত তাদের জমির পাট্টা দিতে কেউই এগিয়ে আসেনি। এর আগেও বিষয়টি নিয়ে জয়েন্ট ফোরামের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে দাবিপত্র দেওয়া হয়েছিল।
ইন্ডং চা বাগিচার শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম চা শ্রমিকেরা যুগের পর যুগ এবং বংশপরম্পরায় ভূমিহীন শ্রমিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। কয়েকযুগ ধরে এইসব অঞ্চলে চা শ্রমিকদের বসবাস। অথচ কারো কাছেই জমির কোন নথিপত্র নেই। তাই এনআরসি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা শুনে চা শ্রমিকরা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এবং সেই কারণেই জমির পাট্টা চা বাগিচা অঞ্চলের একটি জ্বলন্ত সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে প্রায় দেড়শ বছর ধরে চা-বাগানে বসবাস করলেও এখনো ভিটেমাটির দলিল নেই। বাস্তুজমির পাট্টা প্রদানের দাবিও দীর্ঘদিনের। তাই আড়াই লক্ষ শ্রমিক পরিবারকে পাট্টা প্রদানের দাবিতে উত্তাল সমগ্র ডুয়ার্স। আসলে চা শ্রমিকদের জীবন পেন্ডুলামের মতো। বাগানের যে বাড়িতে বংশপরম্পরায় ইংরেজ আমল থেকে বসবাস, মালিকের মর্জি হলে সেখান থেকে উচ্ছেদ হতে এক মিনিটও সময় লাগবে না। জমির পাট্টা না থাকার ফলে একদিকে যেমন চা বাগিচা শ্রমিকেরা কোন ছোট ক্ষুদ্র শিল্প গড়তে চাইলে ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছেন না, অন্যদিকে বসবাসের জন্য নতুন বাড়ি তৈরি অথবা পুরনো বাড়ির সম্প্রসারণের জন্য কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে। যে সকল জমিতে বছরের পর বছর চা শ্রমিকরা বসবাস করছে সেই চা বাগিচার জমি সরকারের মালিকানাধীন হলেও পার্শ্ববর্তী অনেক জমি খাসজমি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। অথচ জমির চরিত্র কি ধরনের সেই বিষয়ে ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তর থেকে কোনরকম সমীক্ষা হয় নি। চা বাগিচার পার্শ্ববর্তী বহু জমি আছে যেগুলি আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত জমি বলে চিহ্নিত। তাই জমির পাট্টা পেলে দুস্থ শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান অনেকটাই বদলে যাবে। কিন্তু জমির পাট্টা এখনো দুর অস্ত। তার উপর ঠিকঠাক নেই নথিপত্র। এটাই এখন ডুয়ার্সের চা বাগানের শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴