শালসিঁড়ি-৩০
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
দাউ
দাউ করে জ্বলছে চিতা। এই চিতা জ্বলবে সারা রাত… এমন কি দিনেও। আগুনের তাপ
এত বেশী যে চিতার কাছাকাছি যাওয়া যাচ্ছেনা। এই আগুনে বার বার কাঠ দেওয়া
অসাধ্য কাজ। তাই বিসরাম মণ্ডল এক ট্রাকের বদলে কয় ট্রাক লাকড়ি দিয়েছে কে
জানে! বুলবুলের বিটবাবু ঠিক জানবে। পশ্চিম আকাশের সূর্য বলে দেয় আজকের
দিনটা চলে যাবে অল্পক্ষণের মধ্যে পরাজিত হাতি কাঁধে নিয়ে। চিতার আগুন
ম্লান করে দেয় গোধূলির আলো। চোখ ধাঁধানো চিতার আলোয় অস্পষ্ট গোচর হয় ঘরে
ফেরা গৃহপালিতের পিঠে বসে থাকা সাদা গো-বক। প্রতিযোগিতায় শেষের দিকের
গো-বকেরা গৃহপালিতের কান গলা থেকে খুঁটে খুঁটে তুলে নেয় বেঁচে থাকা
রক্তচোষা- এঁটুলি, যথা সম্ভব খেয়ে নেয় রাতের খাবার। গরু আর গো-বকের এই এক
অসাধারণ অন্যোন্যজীবিতা। কত কী বলে দেয়। আগুনের চারপাশে উড়ে ঘুরে ফিরে
ফিঙে কেশরাজ ছোট ভিমরাজ ও বড় ভিমরাজ। কীটপতঙ্গ যারা চিতার আগুনে পুড়ে মরতে
চায়, মরতে পারেনা; চলে যায় পাখিদের পেটে । মরণ কী এত সহজ যে মরতে চাইলে
মরতে পারবে। শালসিঁড়ির এই এক অমোঘ নিয়ম। মরেও করে যেতে হবে শৃঙ্খল নিবদ্ধ
কাজ। শৃঙ্খল রক্ষা করতে জীবন যাবে তবুও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা যাবেনা- যুদ্ধে
সৈনিকের মতো। মৃত্যু হতে পারে জেনেও যুদ্ধ করতে হবে। পলায়ন তো দুর্বল বা
কাপুরুষরা করে। বহুগামিতার জন্য জীবন দিতে হয় জীবন নিতে হয়! অনেক কিছুই
মেনে নেওয়া যায় না! অনেক মানুষতো কত কিছু মেনে নিয়ে চলে, বেঁচে থাকার কী
আকুল আকাঙ্ক্ষা! এই হাতির মতো হতে পারে কয় জন! চিতার উপরে দলা দলা কালো
ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেন শালসিঁড়ির সহজ সরল দম্ভ দণ্ড।
বিকাশ
নিজেকে প্রশ্ন করে, মানুষ- সে পুরুষ বা নারী, কি বহুগামী? চিতার আগুনের
সামনে কি কপটতা করা যায় বা মিথ্যা বলা যায়। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ওপারে
দিনের সব শেষ আলো শুষে নিয়ে যেন রাই হেসে ওঠে…
- হি হি হি… এই বাবু তুমি আবার হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে ছুটে এলে। দেখছনা গা ধুচ্ছি…
চকিতে
কাঁধ পর্যন্ত নদীর জলে ডুবিয়ে নিয়ে বলে-রাই। নদীর টল টলে সবুজ জল ঠেলে
উঁকি মারে বুকে জমে ওঠা অসূর্যম্পশ্যা যৌবন। রাই-এর লাল পাড়ের সাদা শাড়ি
জলের স্রোতে যেন পুরো খুলে গিয়ে ঢেউ তোলে নদীর জলে। বিকাশ জীবনে প্রথম
অনুভব করে – নদী আর নারী এক। হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে নদী দ্যাখে বিবশ বিকাশ।
আদরের ধমকে রাই বলে-
- এই বাবু সর দেখি, আমি উঠবো জল থেকে।
বিকাশের
অবস্থা পাকা তালের মতো কালো। লজ্জায় ধুপ করে পড়ে গেল গাছ থেকে। এই প্রথম
কেউ বিকাশকে বাবু বলে ডাকে। সরলতায় কী সাহস! নদী দ্যাখার নেশা কাটিয়ে দূরে
গিয়ে বসে একটা বড় বোল্ডারের ওপর বনের দিকে মুখ করে। বিকাশ এক অদ্ভুত ভাবনায়
নিজের হাতের তালু দ্যাখে। হাতের তালু যেন আয়না। নিজে নিজের মুখ দেখে চমকে
যায় বিকাশ। ভুলে যায় পৃথিবীর সব চাওয়া পাওয়া। মনের ভিতরে যেন ঢুকে যেতে
থাকে ঘন সবুজ বন ঘূর্ণি পাক খেয়ে। ঘূর্ণি পাকের কেন্দ্রে রাই হাসে খিল খিল
করে…
- বাবু আজ কেন আবার আমার দিকে ছুটে আসলে?
- মোটেওনা। আমি তোমাকে দ্যাখে ছুটে আসিনি।
-
সেদিন দুপুরে আমাকে একা পেয়ে জল খেতে চাইলে আর আজ একা সান করতে দেখে আবার
আমার কাছে চলে এলে। আজকে তোমাকে একানে গেরামের মানুষ দেখলে কি হতো জান…
বিকাশ
লজ্জাবতী গাছের মত চুপসে যায়। আপদকালীন সময়ে কেন যে বার বার এই মেয়েটির
সামনে এসে পড়ে। কিছু সময় এমন হয় বসন্ত বাতাসের মতো- বেয়াড়া। নির্লজ্জ ভাবে
ছুঁয়ে যায় শরীর মন। বিকাশ চোখ তুলে তাকায়। বনের ধারে একটি সিন্দুরি গাছের
ডাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাই। কালো গায়ে লাল পাড়ের সাদা ভিজা শাড়ি লেপটে আছে।
সিন্দুরি ফল হাতের তালুতে ঘসে তৈরি করে লাল রঙ। চকচকে বোল্ডারের চ্যাপটা
বুককে আয়না করে কপালে দেয় লাল টিপ। লাল সিন্দুরি ফল-কে দুল করে কানে লাগায়।
মনে ধরলে ছায়াতেও সম্ভব শৃঙ্গার। বিকাশের বাতাসকে বাউণ্ডুলে মনে হয়।
লজ্জা ভয় সব ভুলে তাকিয়ে থাকে রাই-এর দিকে।
- বাবু, তুমি জানতে এই সময়ে এইকানে নদীতে আমি সান করতে আসি। বলি, তোমাকে কে বলেছে; কাবু কাকু। ওতো তোমার আসল লোক।
কাবুর
নাম শুনে বিকাশের সম্বিত ফিরে আসে। ঘোর কেটে যায়। ছোট বেলায় যে লাট্টু
ঘোরাতো সেই লাট্টু ঘূর্ণনের শেষে যেমন ঢলে পড়ত ঠিক সেই ভাবে সব চিন্তা ঢলে
ঢলে গড়িয়ে চলে যায় নদীর জলে। চার দিকে ঘুরে ঘুরে দ্যাখে, খোঁজে কাবুদের-
বাজ পাখির মতো।
- কী দেখছো ওমন ঘুরে ঘুরে? আমি তো এই দিকে।
- না কাবুদের দেখছি, ওরা কোথায় গেল!
-
কাবু কাকু আসবে? আসুক আমি জিজ্ঞাসা করবো, তোমাকে কেন একা এই দিকে পাঠাইছে।
আজকে তোমাকে একানে এই ভাবে গেরামের লোক দেখলে কী কাণ্ড হতো ও কি জানেনা।
- সেরকম কিছু নয় রাই।
- তা হলে কি হয়েছে?
- রাই এখান থেকে তোমাদের গ্রাম কত দূর?
- এই তো ঐ দিকে, কাছেই।
- চলো তোমাদের গ্রামে যাই, কাবুরা হয়তো তোমাদের গ্রামে গ্যাছে। এখানে এই ভাবে আর বেশী ক্ষণ থাকা ঠিক নয়।
- সবাই যদি গেরামে যায় তুমি কেন একা এদিকে এলে, এই বারও কি রাস্তা ভুলে…
- সব বলছি। চলো হাঁটা শুরু করি।
- চল। বল।
-
আর বলো না। সকালে আমরা বেরিয়েছি বন টহলে। এদিকে আসার পর কাবু বলল- সেই দিন
তোমাদের বিটবাবুর সাথে দ্যাখা হয়নি। আজকে এতটা রাস্তা আসার পর আর একটু
গেলে তোমাদের বিট।
- সে তো ঠিক, কিন্তু আমার দিকে কেন ছুটে এলে।
- সেটাই তো বলছি।
হাঁটতে
হাঁটতে রাই-এর ভিজা শরীর বিকাশের হাতে লাগে। গরম ছেঁকায় বিকাশ চমকে উঠে।
যৌবন জলেও জ্বলে উঠে! রাই দুই তর্জনীতে শাড়ির আঁচলের কোণা পেঁচিয়ে মন খুলে
হাসে মুক্তো দাঁতে। বিকাশের মনে হয় এই মুহূর্তটি পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর
মুহূর্ত। সৌন্দর্যের একটা মায়াজাল থাকে। মুহূর্তের জন্য ভুলিয়ে দেয় সব
কিছু। রাই বলে-
- বাবু বল…
-
আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। আমি সামনে আমার পাশে কাবু। পিছনে আরো সবাই। হঠাৎ
বাঁদিকের বন থেকে একটা মস্ত হাতি রাস্তার উপর এসে দাঁড়ায়। আমাদের দিকে
তাকিয়ে শুঁড় তুলে গন্ধ নেয়। এক পা দুই পা এগিয়ে আসে। কাবু গলা মোটা করে
বলে- হেই থাম। থাম। হাতিটি দাঁড়িয়ে যায়। তারপর হাতিটি কান খাঁড়া করে শুঁড়
গোল করে গুটিয়ে নেয়। সামনের ডান পাটি তুলে রাস্তার উপরে জোরে লাথি মারে।
পিছনে তাকিয়ে দেখি পিছনের সবাই পড়িমরি করে দৌড় শুরু করে। সেই দেখে আমিও
ছুটতে শুরু করি। কাবুরা যে কে কোথায় গেল! পিঠের বাঁ দিকে একটা বজরি
বন্দুকের গুলির মতো লাগে। কী ব্যথা!
রাই খিল খিল
করে হাসতে গিয়ে, ঠোঁট চেপে ঢোক গিলে নেয়। মেয়েদের মন কি ছেলেদের মন দ্যাখার
এক্স-রে মেশিন! না হলে একটা বন বস্তির যুবতী কী করে সাহস পায় তাৎক্ষনিকতায়
বিকাশের টি শার্ট তুলে আঘাত দেখে! বলে-
- বাবু,
জায়গাটা কালো হয়ে সুপারির মতো ফুলে আছে, ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। এখানে দাঁড়া।
গাছের পাতার রস লাগাই দিই। রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে, ব্যথা কমে যাবে।
রাই
নদীর চরে একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে হাতের তালুতে ডলে লাগিয়ে দেয় বিকাশের
ক্ষতে। সেই গাছের নীল ফুল গুঁজে নেয় শুকিয়ে ওঠা ভিজা চুলে। তিল কালো শরীরে
লাল পাড় সাদা শাড়ি, লাল টিপ কানের লাল দুল; চুলে নীল বুনো ফুল। আহা! বন
বাংলার কী অপরূপ রূপ। নদীর চরে গৃহপালিতদের ঘরে ফেরার ধুলোভরা রাস্তায়
রাইয়ে পায়ের ছাপ পড়ে। সেই পায়ের ছাপে ছাপে বিকাশ হাঁটে। এ যেন হাঁটা নয়
পৃথিবীর সব মায়া ভুলে বয়ে চলা। বিকাশের মনে হয় পিঠের ব্যথা একটু কম। ব্যথা
কমার কারণ কি বিকাশ বুঝতে পারেনা। পাতার রসের গুণ নাকি মনের রসের ম্যাজিক।
বিকাশ জিজ্ঞাসা করে-
- ওটা কী গাছ ছিল। ফুলগুলো কী সুন্দর, নীল।
- নিসিন্দা।
উত্তরের
অচল নীল পাহাড়কে পিছনে ফেলে ওরা বয়ে চলে নদীর জলের মতো- স্বচ্ছ নিষ্পাপ
সহজ সরল। মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যায় বুড়ো কাশ। খোঁচা লাগে বিরক্তিকর। নদীর চর
ছেড়ে ডান দিকে বেঁকে যায় ধুলো-পথ। রাই বলে-
- বাবু এই ধাদিনা খুব খাড়া। এটা দিয়ে উঠে কিছুটা জারুলের বন পার করলে আমাদের গেরাম।
বিকাশ
দেখে, নদীর পাড় ছেড়ে পাকদণ্ডী উঠে যায় উঁচু বনে। উঁচু জমির খাড়া ঢাল বুনো-
প্রাণী আর গৃহপালিতদের ক্ষুরের ধারে কেটে কেটে এই ধাদিনা (hill slope)
তৈরি হয়েছে। ধাদিনাতে বেশ বড় একটা হাতির পায়ের ছাপ দেখে বিকাশ দাঁড়িয়ে পড়ে।
বলে-
- রাই দেখ হাতির পায়ের ছাপ।
- সে আবার এমন কী। ওটাতো আমাদের মাকনা হাতির পায়ের ছাপ।
- মানে, তোমাদের আবার হাতি আছে নাকি?
- না, আমাদের মানে; আমাদের এই বনের।
- তুমি হাতিটিকে চেন?
-
কেন চিনবোনা। হাতিটি প্রায় রাত্রিতে আমাদের গেরামে আসে। কলা গাছ বাঁশ গাছ
খায়, গাছ থেকে কাঁঠাল পেড়ে নিয়ে যায়। বাবা তো দুই বিঘা জমিনে ভুট্টা ধান
এমনি এমনি করে রেখে দেয় হাতির জন্য।
- বল কী!
-
হ্যাঁ বাবু। তুমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করো। বাবা বলবে। মাঝ মাঝে হাতিটি দিনের
বেলাতেও আসে। মনে হয় দেখা দিয়ে যায়। মনে হয় বলে যায়, তুরা ভয় পাইসনা, আমিই
রাতে আসি।
- তাই!
- হ্যাঁ, গো বাবু। তবে হাতিটি বেশ দুষ্ট আছে।
- কি করে বুঝলে?
-
একদিন বিকালে হাতিটি গেরামের পাশের বাঁশ ঝাড়ে বাঁশ ভেঙ্গে খাচ্ছিল।
গেরামের ছেলেগুলা হৈ হল্লা করছিল। তখন হাতিটি একটি বাঁশ ভেঙ্গে এমন ভাবে
শুঁড় দিয়ে ছুঁড়ে মারলো যে একটি ছেলের আর একটু হলে মাথা ফেটে যেত।
- বল কী!
- হ্যাঁ। আচ্ছা বাবু তোমাদের যে হাতিটা তাড়া করেছিল সেটার কি দাঁত ছিল।
- নাতো!
- তাহলে সেটা আমাদের মাকনা হাতি। মাকনা হাতির দাঁত থাকেনা। ওহ তুমাদের সাথে খেলছিল। তুমরা শুধু শুধু ভয় পাইছিলা।
- তুমি কেন দাঁতাল হাতির কথা বললে। এখানে কি দাঁতাল হাতিও আসে।
-
আসে। মাঝে মধ্যে কোথায় থেকে এসে হাজির হয়। তখন মাকনা হাতিটি আর আসেনা।
কোথায় যেন চলে যায়। দাঁতাল হাতিটি খুব অত্যাচার করে। ঘর বাড়ি ভাঙ্গে।
মানুষকে ধাওয়া করে। তবু সবাই ওকে গণেশ বলে।
- কেন?
- হাতিটার যে একটা দাঁত। বাঁ দিকে শুধু দাঁত আছে ডাইন দিকে দাঁত নাই। ওকে বাঁয়া গণেশ বলে।
- দল হাতি আসেনা?
- দল হাতিও আসে। বর্ষাকালে পঁচিশ তিরিশটা হাতির দল আসে আর গরমকালে পাঁচ সাতটার দল আসে।
- কেন এই রকমের দল হয়।
- বর্ষাকালে অনেক খাবার থাকে বলে ওরা একসাথে থাকে আবার গরমকালে খাওয়া কম থাকে বলে ওরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে থাকে।
বনবস্তির
একটি মেয়ে বনের সাথে বেড়ে উঠতে উঠতে বনের কত কী জেনে নিয়েছে কত সহজ ভাবে।
বন যেন ওর সহজ পাঠ। কোন গাছে কী গুণ, কোন গাছের রঙ হয়; কোন হাতির কেমন
ব্যবহার…
হাতির কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ধাদিনার
খাড়া চড়াই ওঠে যায় বিকাশ বুঝতেই পারেনি। চড়াই ওঠে ঢুকে যায় জারুলের বনে।
বিকাশ জানে জারুল গাছ মানেই মাটিতে জল। যেখানে জল জমে সেখনে যে জারুল গাছ
ভালো হয়। জলের জোগান থাকলেই তো বসতি বসে। জারুল গাছে গাছে বেগুনি ফুল ফোটা
শুরু হয়েছে। জারুলের ফুল যেন বর্ষার আগমনী গান। রাইসুন্দরী যেন বর্ষা রাণী।
বর্ষায় বন যে অপরূপ হয়ে ওঠে। এবার বর্ষায় এই জারুল বন দেখতে হবে, নাকি
রাইকে! গ্রামের সীমানা থেকে দ্যাখা যায়, কাবু বিদ্যা মুন্ডা এবং আরো অনেকে
জড় হয়েছে। সবাই হই হই করছে। নতুন অফিসারের জন্য হা হুতাশ করছে। তারপর
গ্রামের আল পথে রাইয়ের সাথে বিকাশকে আসতে দেখে সবাই বিস্ময়ে চুপ হয়ে যায়।
সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। বিদ্যা জিজ্ঞাসা করে-
- রাই তুই ওনার সাথে কী ভবে এলি?
-
দেখ না বাবা। আমি সান করছিলাম। নদীর পুব পাড় থেকে তিনটা ছেলে এসে আমাকে
বিরক্ত করছিলো। তখন নতুন বাবু ছুটে এসে বন্দুক দেখিয়ে এমন তাড়া করল যে
ছেলেগুলো নদীতে নাকে মুখে জল খেয়ে ডুবতে ডুবতে ভেসে গেল।
বন্দুকের
কথা শুনে বিকাশ বাঁ কাঁধে হাত দিয়ে দেখে তার কাঁধে দোনলা বন্দুক তখনো
ঝুলছে। এতক্ষণ মনেই ছিলোনা তার কাঁধে বন্দুক আছে। প্রথমে হাতির ভয় তারপর
সবুজ বনের কালো মোহ… মনেই পড়েনি বারুদের গন্ধ। কাবু কতবার বলেছিল বন্দুকটি
বনরক্ষী নন্দুকে বইতে দিতে। বিকাশ কিছুতেই রাজি হয়নি। চাকুরীর শুরুর দিন যে
কয়টি জিনিষ বিকাশকে নিজের নামে নিতে হয়েছিল পরিষেবা প্রদানের প্রযোজনে
অপরিহার্য বলে, তার মধ্যে এই দোনলা বন্দুকটি অন্যতম ছিল। ঊর্ধ্বতনের
উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে গিয়ে নন্দুকে বন্দুক বহন করতে দেয়নি বিকাশ।
বিকাশের মনে হয় যে জিনিষ বিপদে কাজে লাগেনা সেটা মূল্যহীন। বন্দুকটিকে
বিকাশের খুব ভারি মনে হয়। বন্দুকের ভারে পিঠের বাঁদিকের ব্যথাটা যেন বেড়ে
যায়। তখন কাবু এত করে বলছিলো, এখন একবারও বন্দুকটা অন্য কাউকে দিয়ে দিতে
বলছেনা। বিকাশের মনে জ্বালা হয়। সেই জ্বালা বাড়িয়ে দেয় রাই-এর দুষ্টুমিতে
ভরা মিট মিট হাসি। মেয়েরা কি সব একই রকমের হয়, সে শহর থেকে বনে। মনের খোঁজ
পেলে কাঠ ঠোকরার মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাসা বানিয়ে নেয়। উদ্দীপকের প্রভাবে
ইন্দ্রিয়ের স্বতঃ স্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া খুলে দেয় মনের তালা। এই রকম সময়ে মন
লুকানো বড় কঠিন কাজ। সহজ সরল মনের মানুষের পক্ষে তো অসম্ভব। রাই কী তবে
ধরা পড়ে গ্যাছে! শালসিঁড়ির ফুলের মতো ফুটে উঠে মনের কথা। বিকাশ ব্যর্থ
চেষ্টা করে শক্ত হতে শাল গাছের মতো ।
মেয়ের কথা শুনে বিদ্যা বাঘের মতো গজরাতে গজরাতে বলে-
- কই তুই আগে তো কোন দিন বলিসনি।
-
কেন বলব। ওরাতো কোন দিন নদী পার হয়ে এপাড়ে আসেনি। ওপাড়ে গরু চরাতো আর
পাতার বাঁশি বাজাতো। আজকেই তো পরথম এলো। আর তক্ষনি বাবু ছুটে আসে।
- তবে কাবুবাবু যে বলল হাতি ধাওয়া করছে।
- সে আমি কি করে বুঝবো। বাবুতো ছুটেই আসলো।
সব
মেয়েরা মনে হয় মনের সময়ে এইরকম মিথ্যা কথা বলে। যাকে মনে লাগে তাকে
বীরপুরুষ করে নেয়। নীল নিসিন্দা ফুলের মতো বিকাশের মনে শ্রদ্ধা নেমে আসে
রাই-এর জন্য। বিদ্যা বলে –
- বিফাই, কালকে নদীপাড়ের
শিলডাঙ্গা গ্রামে যাবি। দেখবি কে জোয়ান মেয়ের সানের সময় বাঁশি বাজায়। ওর
কাঁধে বড় হালের জোয়াল তুলে দিতে হবে। দেখবো কেমন হাল মারে।
- বারে আমি কী করলাম যে আমাকে এখন বিয়া দিবে- রাই মুখ ভারি করে বলে।
বড় হালের জোয়াল কথাটা বিকাশ প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে রাইয়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে বিকাশের মনে কেন যেন ছেঁকা লাগে…
স্যার
উঠুন। চিতাতে মনে হয় মোটা শালের লগগুলোতে আগুন ধরেছে। আগুনের ছাঁচ অনেক
বেড়ে গেছে। ছেঁকা লাগবে। - নির্মলবাবু বলে। বিকাশ উঠে আসে। ভাবে রাই-এর কথা
তো কোন দিন বলা হয়নি অপরূপাকে। অপরূপার ফোন আসে - কখন ফিরবে। মাধুরী ফোন
করেছিল, অনেক অনুযোগের পর বলল টি ভি তে দেখাচ্ছে তোমাকে আর বলছে – ত্রিকোণ
প্রেমের লড়াইয়ে দাঁতাল হাতির মৃত্যু… বিকাশ বলে- সে তো বলবে হাতি বলে কথা।