পইলা সাঞ্ঝির কথা/৩০
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৩০
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
পুষুনা
"মাই একখান চটি হবে? হামারলা তামানে ফাড়ি গেইসে।"
রসবালা গোয়ালঘরের পাশে 'গৈটা' বানাচ্ছিল। উঠোনে একটা চটে অল্প ধান শুকোতে দেওয়া। হাত না থামিয়েই জিজ্ঞেস করল,
"কি করিবেন? পিটার ধান শুকাবেন?"
"শুকি থং চাইট্টা। ত্যালেরে যে দাম মাইও। অল্প কয়খান যুদি ভাজিম তে ভাজিম, না ভাজিম তে আলোয়া ভাতে আন্দি খামো।"
রসবালা দ্রুত হাত চালাতে চালাতে বলে,
"আছে একখান। নন, এই দুইখান বানে এখেরে উটোং। না হলে আর দুকিনার জন্যে বসিরে মনটা না যাবে।"
রসবালা
গৈটা বানানো শেষ করে পিঁড়িটা তুলে রেখে হাতটা পরিষ্কার করে ধুয়ে আসে।
তারপর রান্নাঘরের একপাশে বানানো ছোট একটা বাঁশের চাংরা থেকে চটটা উঠিয়ে
সুন্দরমণির হাতে দিয়ে গলা তুলে বলে,
"আনি দ্যান কিন্তুক বারে। নাহলে মোর ফমে না থাকিবে সেলা নাগিলে জিনিসখান আওদে চান্দে বেড়াইম।"
উত্তরে সুন্দরমণি উঠোনের ধানগুলো দেখিয়ে প্রশ্ন করে,
"বাড়িতে ভুকাবু না মিশিঙোত নিগাবে?"
রসবালা হাসে।
"এই চাইট্টা ধানের বাদে আরো মিশিঙ নাগে। বাড়িতে না ভুকাইম!"
তারপর থেমে বলে,
"মোর ধান চাইট্টা শুকাইসে আর। বসদির গিলা আর দুইদিন খাবে বলে ওউদ। একটেখেনায় ভুকামু এলায়।"
সুন্দরমণি বলে,
"উমার তো বেশি হবে ধান। উমরা টাকাওলা মানষি! পিটাও অনেকলা করি ভাজে। তে
মাইটার মনটা খিবে ভাল। বুড়া-বুড়ি কিন্নাক ছাড়ি না খায়। ছাওয়ালাকো দেয়।"
বসমতীর ভালো মনের পরিচয় রসবালা জানে। তাইতো এত ভালোবাসে।
পৌষপার্বনের
দিন সকাল থেকেই ব্যস্ততা একটু বেশিই থাকে। খুব সকালে স্নান করেই বসমতী আগে
পিঠের চালগুলো বড় একটা ধোয়া সাদা কাপড় চালুনের উপর পেতে জল ঝড়তে দেয়।
চালুনটা বসিয়ে রাখে বালতির মুখে। আগের দিন ভিজিয়ে রেখেছে চাল। তারপর
রান্নাঘরের কাজে মন দেয়। কিন্তু বাচ্চাগুলোর অত্যাচারে কিছুক্ষণের মধ্যেই
অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। একটু আড়াল হলেই মুঠো মুঠো ভেজানো চাল নিয়ে লুকিয়ে মুখে
পুড়ছে। ওদের বকতে বকতেই বসমতী সাম-গাইন বের করে। সামটাকে ভালো করে ধুয়ে
উপুর করে দেয়। গাইন দুটো বের করে ঘষে ঘষে ধুয়ে শুকোতে দেয়।
দুপুর
দুপুরেই চারদিক থেকে চাল গুঁড়ো করার সাম-গাইনের ছন্দোবদ্ধ ধুপ-ধাপ শব্দে
পাড়া সচকিত হয়ে ওঠে। রসবালা চট করে কলার পাতা কেটে এনে একটু সমান দেখে
মাটিতে পেতে যত্ন করে সামটাকে বসায়। হাত দিয়ে নাড়িয়ে দেখে নড়ছে নাকি। তারপর
নিশ্চিন্ত হয়ে ডাক দেয়,
"আনো বারে কার কার বাটুয়া খুচি আছে। কার চাউল আগোত ভুকাবেন।"
বুধেশ্বরের
বউ নিজের চালের বাটুয়াটা পাশে রেখে একটা গাইন তুলে নেয়। প্রথমে বসমতীর
চালটাই আগে সামে দিয়ে দেওয়া হল। রসবালা নিজেও একটা গাইন হাতে নিয়ে
বুধেশ্বরের বউকে বলে
"ন্যাও বৌমা, দ্যাও পাড় দ্যাও। সামার পাকে ভুকাও।"
বুধেশ্বরের বউ মুখ নিচু করে হাসে।
"জানোং বারে জানোং। চেংরিতে বাড়িত ভুকা-কুটার কাজ শিকি আচ্চুং বারে।"
সবাই পালা করে চালগুঁড়ো করায় হাত লাগাল। এরমধ্যে গল্পও চলল সমাল তালে। রসবালা মালতীর মাকে জিজ্ঞেস করল,
"তোমার মাইর বিয়াওখান কি হইল দি? আও বাও তলে গেল যে!"
"হিকান যে পুষ মাস? পুষ মাসোত কি বিয়ার আল্লাপ করে?"
ঝাঁজিয়ে উত্তর দিয়েই গলাটা স্বাভাবিক করে মালতীর মা আবার বলে,
"পাছিলা ঘরটা না এখেনা পছন্দ টছন্দ কইচ্চে। তে মাঘ মাসখান না পইল্লে উমুরা কোনো কবার না চাছে।"
রসবালা বলে,
"হউক আস্তে আস্তে। বেটি আছে তে দিবারে না নেগিবে!"
বিকেল হতে হতে সবার চালগুঁড়ো করা শেষ হলে যে যার বাড়ির দিকে হাঁটে। রসবালা বসমতীকে বলে
"আদা নেকাসিস দি? আন, এদি আদা কালাজিরাখান ভুকি দিয়া যাং। মোর খানো আনিসুং। এখেরে ভুকি নিগাং।"
আদা কালোজিরা সাম গাইনে থেঁতলে মিশিয়ে দিয়ে রসবালা সাম গাইনগুলো ঘরে তুলে দিতে দিতে বলে
"চাইট্টা আগরা নইলকে দি। হলদির আগরা আর চাউলের আগরার পোনোচ মরে না!"
বসমতী
উনুন লেপে রেখেছিল। পিঁড়ি টিরি পেতে একেবারে গুছিয়ে বসে পিঠে ভাজতে। আগে
আদা, কালোজিরা পুর দিয়ে ঘিয়ে ভেজে তোলে। এই পিঠাটা দেখতে কতকটা কানের মতো
আকার। বলে, 'কানমুচুরি' পিঠা। এটা শুধু পুজোর জন্য। তারপর খুব পাতলা করে
চালের গুঁড়ো গুলে বড় বড় গোল গোল পাতলা সাদা পিঠা ভাজে। আস্তে আস্তে পাটি
সাপ্টা, মালপোয়ায় গামলা ভরে ওঠে। এক হাঁড়িতে পুলি আর পায়েস একসঙ্গে তৈরি
করে।
সন্ধ্যা হতেই বাড়ি বাড়ি উলুধ্বনি, শাঁখ বেজে
ওঠে। শুকনো চালের গুঁড়ো তুলসী তলায় আল্পনার মতো ছড়িয়ে বসমতীও পুজো দিতে
বসে। ছেলে-মেয়েগুলো এরমধ্যে অনেক পিঠে খেয়ে ফেললেও কানমুচুরি পিঠের জন্য
উঁকিঝুঁকি মারছে। বসমতী বুজতে পারে। তবু মুখটা গম্ভীর করে রাখে। তুলসীতলার
পুজো শেষ করে মহাবীর ঠাকুরের জন্য কোনো উঁচু জায়গায় প্রসাদ দিয়ে রাখতে হবে।
অনেক কাজ। এখনি ওদের হুড়পাড় করে প্রসাদের থালায় হাত দিতে দেওয়া যাবে না।
"পূজা হইল দি?"
উঠোনের প্রবেশ পথে রসবালার গলা বেজে ওঠে।
"দা নাইটটা দেখা তো। তোমার সুলকিটা কেনে বা আন্ধার করেছে।"
কান্তেশ্বরের হাতেই টর্চ থাকে। জ্বেলে পথ দেখিয়ে দিয়েই মহা উৎসাহে রসবালার হাত থেকে পিঠের থালাটা টেনে নিয়ে মালপোয়াতে কামড় বসায়।
বসমতী রসবালার থালায় সবরকম পিঠে যত্ন করে সাজিয়ে দেয়।
"তুই এখেরে এত ইচিত বিচিত পিঠা বানাইস দি। মোরঠে হয়ে না। ওই পুয়া আর সাদা পিঠাকোনা ছাড়া কোনোয় ভাজির না পাং।"
রসবালা
চলে যাওয়ার পরে আরো দুই এক বাড়ি থেকে পিঠে আসে। বসমতী সবাইকেই নিজের মতো
করে সবরকম পিঠে সাজিয়ে থালা ফেরৎ দেয়। সবার বাড়িতে পিঠে হলেও এর ওর বাড়িতে
পিঠে দিয়ে আসাটাই রেওয়াজ। বসমতী কারো বাড়ি যেতে পারে না, থালায় করে সাজিয়ে
কান্তেশ্বরকে দিয়ে পাঠায়।
সকাল বেলা বাসি পিঠে
খাওয়ার মজাই আন্যরকম। উঠোনের মাঝখানে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বসমতী স্নান করে আসে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু হাত-পা গুলো গরম করে নিয়ে চা বসায়। বাচ্চাগুলোকে
আগুনে ধারে বস্তা পেতে পড়তে বসিয়ে দুধ, পিঠা খেতে দেয়। একটু পড়েই অবশ্য
আগুনের ধার সরগরম হয়ে যায়। এই ঠান্ডাতেও লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে বুধেশ্বরের
বাপ আসে। আগুনে হাত-পা সেঁকতে সেঁকতে বৌমার হাতের চা আর পিঠে খায়। গল্প
করে। কান্তেশ্বরকেও গল্পের নেশা পেয়ে বসে। বাচ্চাগুলো বই খুলে রেখে হাঁ করে
গল্প শোনে। বসমতী দেখলেও আজ আর কিছু বলে না। মনে মনে বলে,
"পূজার দিনটা থাউক আজি।"
................................................................
পুষুনা - পৌষ পার্বণ
আওদে - হয়রাণ হয়ে খোঁজা
বাটুয়া -খুচি - বাঁশের তৈরি ছোট টুকরি জাতীয় জিনিস।
সামা - গাইনের যে দিকটায় লোহা লাগানো থাকে।
আও বাও - কথা-বার্তা
আগরা - গুঁড়ো না হওয়া আধভাঙা অবশিষ্টাংশ।
পোনোচ - শেষ অংশ।
সুলকি - রাস্তা থেকে বাড়ি ঢোকার প্রবেশ পথ।
................................................................
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴