চালৌনি চা বাগান /গৌতম চক্রবর্তী
চালৌনি চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
----------------------
বর্তমান আঞ্চলিক ইতিহাসকে যদি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে কোনও কিছু মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুম্ফা, মিনার গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে আর্থ-সামাজিক ইতিহাস। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বর্তমান জল্পেশ মন্দির ইংরেজ শাসনকালে ধর্মীয় কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে শিবপুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসত তিন সপ্তাহ ধরে এবং এই অঞ্চল ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবসার কেন্দ্র যেখানে তিব্বত এবং ভুটান থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা নিয়ে আসত। তেমনি চা বাগিচাগুলির নামকরণের পিছনেও ছিল সুগভীর ইতিহাস। বর্তমানে যেখানে চিলৌনি বা চালৌনি চা বাগানটি অবস্থিত সেখানে ছিল চিলৌনি গাছের জঙ্গল যা এই চা আবাদ অঞ্চল জুড়ে পরিব্যাপ্ত ছিল। এই চিলৌনি গাছের জঙ্গল থেকেই চা বাগিচার নামকরণ হয়েছে চিলৌনি বা চালুনি। অত্যন্ত সুন্দর একটি বাগান। এর উত্তরে কালিম্পং জেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পর্বতশৃঙ্গের সমাহারে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা বাগানের সৌন্দর্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। চিলৌনি চা বাগিচার পাশেই সামসিং, মেটেলি, নাগেশ্বরী, এঙ্গো এবং জুরাস্তি চা বাগান সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অবস্থিত। চিলৌনি অত্যন্ত সুন্দর একটি বাগান। এর উত্তরে কালিম্পং জেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চল। পর্বতশৃঙ্গের সমাহারে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা বাগানের সৌন্দর্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। চিলৌনি চা-বাগানের পাশেই সামসিং, মেটেলি, নাগেশ্বরী, এঙ্গো এবং জুরান্তি বাগান সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অবস্থিত। একাধিক ঝরনা পর্বতগাত্র থেকে নৃত্যরতা হয়ে অফুরন্ত বারিরাশি নিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত এবং বর্ষাকালে এক অসাধারণ দৃশ্যকল্প রচিত হয় চা-বাগিচা এবং পর্বতবেষ্টিত এই ভূখণ্ডে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই বাগানটির কাছেই বাগডোগরা বিমানবন্দর এবং রেল স্টেশন নিউ জলপাইগুড়ি। কাছের শহর মালবাজার যেখান থেকে কলকাতা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যাবার বাস পাওয়া যায়।
খুব আশ্চর্য লাগবে ওদলাবাড়ি হয়ে মালবাজার-মেটেলির দুশো বছর আগেকার আরণ্যক রূপের কথা ভাবলে। সেবক রোড ধরে কিছুটা এগলেই শুনশান। শালুগাড়া অতিক্রম করলেই যখন-তখন বাঘ, হাতি, লেপার্ডের দল। অরণ্যপথে জঙ্গল ভেদ করে গেলে সরস্বতীপুর চা-বাগান। এখানে-ওখানে ঝোপেঝাড়ে শেয়ালের গর্ত। কোথাও সবুজ মাঠ, রাশি রাশি বনফুল। জলাশয়ে, গাছের কোটরে, ডালপালায় পাখিদের ডাকাডাকি। সরস্বতীপুর হয়ে গজলডোবা। তখন ব্যারেজের সৃষ্টি হয় নি। প্রায় পৌনে দু’শো বছর আগে বিখ্যাত লেখক, পরিব্রাজক এবং উদ্ভিদপ্রেমী স্যার জোশেফ ডালটন হুকার গজলডোবা ছুঁয়ে লালটং, চুমুকডাঙ্গী হয়ে দূর্ভেদ্য বৈকুণ্ঠপুর বনভূমি পরিক্রমা করেছিলেন। চা-বাগান নিয়ে যখন সার্ভের কথা লিখব তখন প্রসঙ্গক্রমেই আসবে পৌনে দুশো বছর আগেকার গজলডোবার হুকারের চোখে দেখা দৃশ্যপট। সেই সময়ে গজলডোবা এলাকা জনশূন্য ছিল না। গজলডোবার আদি অধিবাসী মেচরা এখান থেকে উৎখাত হয়ে আসাম সহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে জলপাইগুড়ি জেলার প্রথম চা-বাগানের পত্তন হয় গজলডোবায়। বাগানটি বারে বারেই তিস্তার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ওদলাবাড়ি টি কোম্পানির কাছ থেকে কৈলাসচন্দ্র রাহুত গজলডোবা চা-বাগানটি কিনে নেন। বারবার তিস্তার বন্যায় বাগানটি ভাঙতে থাকলে কৈলাসচন্দ্র বাগানটি ‘দি ফ্রেন্ডস টি কোম্পানি লিমিটেডকে’ কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে বিক্রি করে দেন। ক্রয়মূল্য দিতে না পারায় মামলায় জিতে রাহুতরা পুনরায় ওই বাগান ফিরে পান। ওই পরিবারের কামিনীকান্ত রাহুত বাগানটির মালিকানা পেলে তার নিজস্ব অবদানে সম্পূর্ণ বাগান গড়ে ওঠে এবং গজলডোবার নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় কৈলাসপুর চা-বাগান। কামিনীবাবু চমৎকার এবং দক্ষ চা-কর ছিলেন। কৈলাসপুর গড়ার সময় তিনি তাঁর সমস্ত অভিজ্ঞতা সেখানে প্রয়োগ করেন। কিন্তু গজলডোবার ইতিহাস এখন নদীগর্ভে।
চা-বাগিচা শিল্প শ্রমিক এবং জমি নির্ভর। এই শিল্পের জন্য জমি এবং শ্রমিক একে অপরের পরিপূরক। তাই বাংলার অন্য জেলাগুলির জন্য প্রযোজ্য ভূমি আইন দার্জিলিং এবং ডুয়ার্স এলাকায় প্রয়োগ করা হল না। এই দুই অঞ্চলকে ঘোষণা করা হল নন-রেগুলেটেড এরিয়া হিসাবে। চালু হল ওয়েস্টল্যান্ড রুল। এই ওয়েস্টল্যান্ড রুল অনুযায়ী জমিকে পতিত ঘোষণা করে সেই জমি চা-বাগিচা স্থাপনের জন্য মালিকের হাতে নামমাত্র দামে তুলে দেওয়া হতে লাগল। পশ্চিম ডুয়ার্সে ডঃ ব্রহাম গজলডোবায় প্রথম যে চা-বাগিচা স্থাপন করেছিলেন তার অস্তিত্ব আজ আর নেই। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল ডুয়ার্সে চা-বাগিচা শিল্পের অগ্রগতির ইতিহাস। চা-বাগিচাগুলির মালিকানার চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দুই ধরনের চরিত্র। এ দুটি হল ব্যক্তি মালিকানা এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বা অংশীদারিত্ব। লিমিটেড কোম্পানির চা-বাগিচা ছিল দুই ধরনের। একটি রুপি কোম্পানি এবং অপরটি স্টার্লিং কোম্পানি। যে সমস্ত চা-বাগিচার রেজিস্ট্রেশন হত ভারতে সেগুলি ছিল রুপি কোম্পানি। যে সমস্ত বাগিচার রেজিস্ট্রেশন হত ইংল্যান্ডে সেগুলি ছিল স্টার্লিং কোম্পানি। যেহেতু চা-বাগিচার মালিকরা অধিকাংশই ছিল ইউরোপিয়ান তাই দার্জিলিঙের চা-বাগিচাগুলি সহ অধিকাংশ চা-বাগিচাক্ষেত্রেই স্টার্লিং কোম্পানি ছিল। ডুয়ার্সের বেশির ভাগ বাগানই ছিল রুপি কোম্পানির পরিচালনাধীন। চা-বাগিচা স্থাপনের লক্ষ্যে জমি বণ্টনের উদ্দেশ্যে কৃষিকাজ হয় না। অর্থাৎ আবাদহীন জোতজমি এবং জনবসতিহীন অঞ্চলের জমিগুলিকে ওয়েস্টল্যান্ড রুলের আওতায় আনা হয়। তৎকালীন দার্জিলিং জেলা ও ডুয়ার্সের এক বিশাল অঞ্চল ওয়েস্ট ল্যান্ডের আওতায় এলে জমি বন্টিত হল ওয়েস্টল্যান্ড রুল অনুযায়ী। আগে পতিত জমি বলে ঘোষণা করে পরবর্তীকালে জমিগুলিকে নিলামের মাধ্যমে তুলে দেওয়া হল। ওয়েস্টল্যান্ডগুলো ছিল সরকারি খাসজমি। খাসজমি বন্টনের সুযোগ চলে যাবার পর প্রথম দিকে জোত বা চাষযোগ্য জমিতে চা-চাষের অনুমতি দেওয়া হলেও পরবর্তীকালে জোত জমিতেও চা-চাযের অনুমতি প্রদান করা হয়।
চা চাষের জমি বন্টনের নিলাম ব্যবস্থার মধ্যেও কারচুপি বা আগাম বন্দোবস্তের ব্যবস্থা ছিল। কারণ বাগিচা স্থাপনের নামে নামমাত্র মূল্যেই ইউরোপীয়রা জমি হস্তগত করে সেগুলি অনেক বেশি দামে চা কোম্পানিকে বিক্রি করে দিত। এইভাবে ফাটকাবাজির মাধ্যমে দার্জিলিঙের চা-বাগিচাগুলির মালিকেরা প্রায় বিনামূল্যে এইসব জমির অধিকারী হয়েছিল। ডঃ ব্রহাম পার্বত্য অঞ্চলে চা-বাগিচা স্থাপন করেছিলেন। তিনিই এবার জলপাইগুড়ি-ডুয়ার্স এলাকায় বাগিচা স্থাপনের মধ্য দিয়ে সমতলে চা-বাগিচা প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু করলেন ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে। রাজ্যের ভূমি ব্যবস্থায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ অন্য যেসব আইন চালু ছিল তার আওতা থেকে চা-বাগিচার জন্য জমি বণ্টনের লক্ষ্যে দার্জিলিং এবং ডুয়ার্স এলাকাকে বাইরে রেখে চালু করা ‘ওয়েস্টল্যান্ড অ্যাক্ট’-এর সুযোগকে ডুয়ার্সেও সম্প্রসারিত করা হল। ওয়েস্টল্যান্ড বলতে ঘন জঙ্গল পরিপূর্ণ জলাজঙ্গল, আবাদী চাষবিহীন পতিত জমিকে বোঝায় যেখানে চাষের সুযোগ ও সম্ভাবনা খুবই কম। সিদ্ধান্ত হয় চায়ের জন্য গৃহীত ওয়েস্টল্যান্ডের লিজের পরিমাণ ১৫০০ একরের বেশি হবে না। চা-চাষের জন্য জমি নিলে তার জন্য খাজনা দেবার আইন পরবর্তীকালে পরিবর্তন করা হয়। ডুয়ার্সের এই ওয়েস্টল্যান্ড অ্যাক্টে ডঃ ব্রুহাম ১৮৭৪ সালে গজলডোবায় চা-বাগিচা স্থাপন করবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম থেকে গঞ্জ, গঞ্জ থেকে শহর গড়ে ওঠার ফলে জনবিন্যাসের পরিবর্তন ঘটল। বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চলের অন্তর্গত গজলডোবা ডুয়ার্সের আদি চা-বাগান। শতবর্ষ আগে তিস্তার দুই পারে ছিল গভীর, গহন, গা-ছমছমে জঙ্গল। আকাশ-ছোঁয়া শালবন, নানা প্রকার বনজ সম্পদ, লতাপাতা, তন্তুজালে ঢাকা। জঙ্গলের ভিতর ছিল বিভিন্ন প্রকার ভেষজ। দু’পাশে দেবদারু, পাইন, আম, কাঁঠাল, ঘন বাঁশবন। গজলডোবার জঙ্গলমহলে বসবাস করত মেচ, রাভাদের মত আদিবাসীরা। ঝুম চাষের মাধ্যমে এরা উৎপন্ন করত চা এবং তুলো। ডুয়ার্সের নিম্ন অঞ্চলে স্থায়ী চাষের মাধ্যমে উৎপাদিত হত চাল, সরষে, তামাক এবং নানা প্রকার দুগ্ধজাত দ্রব্য, যার অধিকাংশই ভুটানে যেত কর হিসাবে।
চিলৌনি বা চালৌনি মেটেলি ব্লকের অন্তর্গত গুডরিকস গ্রুপ লিমিটেডের একটি বাগান। মালবাজার মহকুমার গুডরিক গ্রুপ লিমিটেড পরিচালিত চিলৌনি টি গার্ডেনটিকে ম্যানেজমেন্ট সহায়তা প্রদান করে থাকে ডিবিআইটিএ। চা বাগিচার তথ্য অনুযায়ী জানা যায় বাগিচার প্রথম ম্যানেজার ছিলেন পি.সি. ওয়ালিচ যিনি নিজে এবং স্থানীয় একজন মানুষের সহযোগিতায় চিলৌনি টি এস্টেটটি প্রতিষ্ঠা করেন। চিলৌনি এবং হোপ ও জিতি চা-বাগান হোপ টি কোম্পানির অধীনে ছিল এবং এই কোম্পানিটি ছিল ডানকান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোং এর একটি বাগান যেটা ১৯৭৭ সালে গুডরিক গ্রুপ লিমিটেডের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ ঘটে। ১৮৮৫ সালে চালৌনি টি গার্ডেনটি স্থাপিত হয় এবং ধীরে ধীরে ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠে। চিলৌনি গুডরিকসের বাগান। সেবার চিলৌনিতে গুডরিক টি পট লঞ্চের এক্সক্লুসিভ টি টেস্টিং অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে গিয়েছিলাম। এসেছিলেন অভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্য। এক প্রশ্নের জবাবে অপরাজিতা আঢ্য জানিয়েছিলেন রোজ তিন থেকে চারবার দার্জিলিং চা পানের মধ্য দিয়ে তাঁর দৈনন্দিন কাজ শেষ হয়। দার্জিলিং চায়ের বিশেষ ভক্ত তিনি। জানিয়েছিলেন যেদিন সকালবেলা চা খান সেদিন গ্রিন টি খান। সকালবেলা অন্য কিছু খাওয়ার আগে এক কাপ গরম চা দিনটাকে ঠিকঠাক শুরু করতে সাহায্য করে। তা সে দার্জিলিং চা-ই হোক না কেন, বা গ্রিন টি হোক বা পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের চা-ই হোক। সকলের জীবনে চায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। অনেকে চা পান করেন এনার্জি ড্রিঙ্ক হিসাবে। রোজকার ব্যস্ততম জীবনে এক কাপ চা যেন নিমিষেই কাটিয়ে দেয় সব ক্লান্তি। তাই চাকে আরও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে বিশ্ববাজারে পৌঁছে দিতে প্রয়াসী হয়েছে গুডরিকস। লিস নদী এবং ডেঙ্গুয়াঝাড়ের বাগানের চা-ও অত্যন্ত জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক মার্কেটে। ডুয়ার্সে সংকোশ, ডেঙ্গুয়াঝাড়, আইভিল, কুমারগ্রাম, জিতি, মিনগ্লাস বাগানের চা সুনামের অধিকারী।
গুডরিকসের দার্জিলিংয়ের মার্গারেট হোপ, ক্যাসলটন, বাদামটাম, বানেসবার্গ, থার্বো, ইত্যাদি বাগানগুলি থেকে চা জাপান, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হয়। আসামের বাগিচাগুলির চা মধ্য প্রাচ্য, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির বাজারে প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। চালৌনি বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৪ জন। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, গুডরিকের নামে ক্যামেলিয়া হাউস, ১৪ গুরুসদয় দত্ত রোড, কলকাতা-১৯ থেকে কোম্পানির কাজকর্ম পরিচালিত হয়। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন এনইউপিডব্লিউ, পিটিডব্লিউইউ, টিটিপিডব্লউইউ, ডিটিডিপিএলইউ। চালৌনি চা-বাগানের আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৭৭৮.৯৬ হেক্টর। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ২৬.৪৬ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদীক্ষেত্র ৫৬২.৯৩ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং ড্রেন ও সেচযুক্ত ‘প্ল্যান্টেশন এরিয়া’ থেকে ১৫২৯ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। চালৌনি চা-বাগিচার সাব স্টাফের সংস্থা ১৪ জন। করণিক ৯ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ১৪ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৮১৯। মোট জনসংখ্যা ৪৬৫২। স্থায়ী শ্রমিক ১০৯৭ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৩৯ জন। কম্পিউটার অপারেটর নেই। সর্বমোট সাবস্টাফ ৯৪ জন। ক্ল্যারিকাল, টেকনিক্যাল এবং শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ২৭ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১২৮৯ জন। শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৩৩৬৩ জন। চালৌনি চা-বাগিচার নিজস্ব উৎপাদিত কাঁচা চা পাতার পরিমাণ ৩৪-৪০ লাখ কেজি এবং ফ্যাক্টরিতে প্রস্তুত ইনঅরগ্যানিক সিটিসি কোয়ালিটি মোট বিক্রয়যোগ্য চা উৎপাদিত হয় ৬-৭ লক্ষ কেজি। চালৌনি বাগানটি চরিত্রগত দিক থেকে অত্যন্ত উন্নত মানের বাগান। ব্যাঙ্কের কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। বাগানটির লিজ হোল্ডার গুডরিক গ্রুপ লিমিটেড। বর্তমান লিজের ভ্যালিডিটির সময়সীমা ২০২৫ সাল পর্যন্ত। চালৌনি চা বাগিচায় ৭০০ টি পাকা বাড়ি ক্লাস্টার মিটার যুক্ত। বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাস নেই বললেই চলে। চা বাগিচায় শৌচাগারের সংখ্যা ৩০৮টি।
বাগানে সার্ভে করতে গিয়ে পেলাম শ্রমিক নেতা বিপুল চিকবরাইককে। বিপুল মেটেলি হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষিত ছেলে। রবিবারের মেটেলি হাটে বিপুলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন মেটেলি হাইস্কুলের এক মাস্টারমশাই। জানালেন শ্রমিক সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য বিপুলের কাছ থেকে পাব। পেলামও। বিপুলের কথার নির্যাস থেকে যেটা বেরিয়ে এল সেটা হল চা শিল্পে শ্রমিকদের অবস্থা আদিম ও সেকেলে। বাংলার পর্বতেই হোক বা সমতলে—সর্বত্রই চা বলয়ের শ্রমিকরা সবদিক দিয়ে পিছিয়ে। ১৯৫১ সালে প্ল্যানটেশন অ্যাক্ট চালু হলেও চা শ্রমিকরা আজও জানে না প্ল্যানটেশন অ্যাক্টে তাদের কি কি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। প্ল্যানটেশন অ্যাক্টে মহিলা শ্রমিকদের মেটারনিটি লিভ, চিকিৎসার উন্নতি, বাসস্থানের উন্নতি, জীবানুমুক্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা, বাসস্থানের সঙ্গে উন্নত ল্যাট্রিন এবং প্রস্রাবাগারের ব্যবস্থা, শ্রমিকদের সন্তানদের দেখাশোনার জন্য ক্রেশের ব্যবস্থা, কাজের সময় শ্রমিকদের ওয়াটারপ্রুফ বা ছাতা এবং শীতকালে কম্বল প্রদানের কথা বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে শ্রমিকদের সেইভাবে জোটে না কিছুই। চা-বাগিচায় হাসপাতাল স্থাপন এবং শ্রমিকদের চিত্ত বিনোদনের জন্য উন্নত ব্যবস্থা নেবার কথা বলা হলেও কতটা জোটে তা সকলেই জানে। সরাসরিভাবে বলে রাখা ভাল যে উত্তর-পূর্ব ভারতসহ জলপাইগুড়ি-ডুয়ার্সের যে জনপদ ও জনবিন্যাস এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনযাত্রা তা কিন্তু চা-বাগিচাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। তাই সংগত কারণেই আজ এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির যুগে বাগিচা শিল্পের পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমেই নিজেদের দায়কে স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন এই কারণেই যে, যেসব বহিরাগত শ্রমিকের জীবন ও জীবিকার বিনিময়ে একদিন জঙ্গল কেটে বাগিচা স্থাপন এবং একের পর এক জনপদ গড়ে উঠেছিল আজও তাদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে স্বাধীন ভারতের সরকার পক্ষ, রাজনৈতিক দলগুলি, ট্রেড ইউনিয়নগুলির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
বেরিয়ে পড়লাম চিলৌনি বাগান সার্ভেতে। প্রথমেই এলাম হাসপাতালে। চা-বাগিচায় বেশ বড়ই হাসপাতালটি। ভিতরেই ডিসপেনসারি, পুরুষ-মহিলা-আইসোলেশন ওয়ার্ড, মেটারনিটি ওয়ার্ড আছে। তবে মেটারনিটি বা মাতৃত্বকালীন চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগিনীকে সরকারি হাসপাতাল বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেল ওয়ার্ড ৪ টি, ফিমেল ওয়ার্ড ৪ টি, আইসোলেশন ওয়ার্ড দুটি আছে। অপারেশন থিয়েটারও আছে, তবে তা কাজ চালাবার মতো। অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা সচল। বাগিচায় ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় পেলাম এল.এম.এফ ডাক্তার এ সি সাহাকে। সাবেক বাড়ি বাংলাদেশে। বেশি কিছু বলতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। চালৌনিতে প্রশিক্ষিত নার্স ২ জন। একজন মিড ওয়াইফ, একজন স্বাস্থ্যকর্মী। অনুমোদিত চার্ট অনুযায়ী পথ্য সরবরাহ করা হয় বলে দাবী জানালেও রোগী বা পথ্য কোনওটাই চোখে পড়ল না। গড়ে বাগানে ১০-১২ জন মহিলা শ্রমিক প্রতিবছর মাতৃত্বকালীন সুযোগসুবিধা লাভ করে। বাগিচায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। আবাসিক হিসাবে ডাক্তারবাবু বাগিচায় থাকেন। নার্সের নাম অঞ্জু প্রধান। বাগিচায় পর্যাপ্ত কাজ চালাবার মতো ওষুধ পাওয়া যায়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকেও প্রয়োজনভিত্তিক সহযোগিতা পাওয়া যায়। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল হাসপাতাল পরিষেবা সম্পর্কে তাদের সেই ধরনের কোনও অভাব অভিযোগ নেই। চিলৌনি চা-বাগানে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার আছেন। বোনাসের শতকরা হার ২০ শতাংশ। বাগিচায় ক্রেশের সংখ্যা একটি। ক্ৰেশে শৌচাগার, পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা আছে। দুধ, বিস্কুট, পোশাক বা খাবার ক্রেশের শিশুদের সরবরাহ করা হয়। পানীয় জল পর্যাপ্ত পরিমাণ। ক্ৰেশে মোট আ্যাটেনডেন্ট ২ জন। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় নেই। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেওয়ার জন্য বাসের ব্যবস্থা আছে। বাগানে বিনোদমূলক ক্লাব আছে, খেলার মাঠ আছে। বোনাস, প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, মজুরী, জ্বালানি/ চপ্পল/ ছাতা/ কম্বল নিয়ে শ্রমিকদের কোন অভাব অভিযোগ নেই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴