শিলিগুড়ি কলেজের সাথে জড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন পাঠন শুরু হবার ইতিহাস। প্রথম আলো নিয়ে যে কয়েক জন শিক্ষকেরা এসেছিলেন তাঁরা তখন নবীন অধ্যাপক। অধিকাংশই এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আর অন্য কোথাও যাননি। তাঁদের বয়স আর প্রজ্ঞার সমাহারে বিশ্ববিদ্যালয়ও বড় হয়েছে। সেদিনের শিক্ষকেরা ও ছাত্র ছাত্রীরা সবাই এই স্মৃতিকাতর ইতিহাসের অংশ। সব ইতিহাস তো আর সবার সামনে আসে না, অনেক সুখ-দুঃখ-স্বপ্ন বা স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাসও আড়ালে রয়ে যায়, একটু খুঁজে সেসব যদি সামনে আনা যায়, তবে শিকড়ে টান লাগে।
শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যক্ষ দুর্গা কিংকর চট্টোপাধ্যায় সেদিন যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিতেন, তবে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন শুরু হতে আরও অনেক দেরি হয়ে যেত । ষাটের দশকে উত্তরবঙ্গের ইতিহাসের দুটি বড় ঘটনা - এক, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন আর দুই, ফারাক্কা ব্রিজ নির্মাণের সূচনা। ১৯৬২র আগে পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের কলেজগুলি ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, সেসময় এখনকার কলেজের ভালো ফল করা ছাত্র-ছাত্রীদের কলকাতায় গিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করা সবার পক্ষে সহজ ছিল না। ফারাক্কা ব্রিজ হবার পর কলকাতা খানিকটা কাছে এসেছিল, অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের যাতায়াতের জন্য। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও ফারাক্কা ব্রিজ কলকাতার রেনেসাঁকে উত্তরবঙ্গে ছড়িয়ে দেবার কাজকে সুগম করেছিল। প্রান্তিক উত্তরবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নতুন স্বপ্ন ভবিষ্যতের রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিল সেদিনের বিশ্ববিদ্যালয়।
শিলিগুড়ি কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের সূচনা হলো ওই নির্ধারিত দিনেই ৫ই নভেম্বর ১৯৬২তে। সেইসব দিনের স্মৃতি কথা কিছু লিখেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম যোগদানকারীদের অন্যতম অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মানস দাশগুপ্ত ও ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর অনিন্দ্য পাল। দুজনেই উত্তরবঙ্গকে গভীরভাবে ভালোবেসে ছিলেন। দুজনের স্মৃতিকথাতেই আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমপর্বের কথা।
রাজা রামমোহনপুর ক্যাম্পাস সেনাবাহিনীর হাতে হস্তান্তরিত করবার পর শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা লরিতে চেপে এলেন শিলিগুড়ি কলেজের নবনির্মিত ছাত্রাবাসে। ছাত্রাবাসের দোতলার ঘরগুলি ব্যবহৃত হবে ক্লাসরুম হিসেবে। ইংরেজি, অর্থনীতি, ভূগোল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, অংক - প্রতিটি বিভাগের জন্য একটি করে ঘর। নিচের তলায় ছাত্রদের হোস্টেল, এর উপরের তলায় শিক্ষকদের থাকার ঘর। লাইব্রেরীর জন্য একটি ঘর ছিল। শিক্ষক ও ছাত্ররা ছাত্রাবাসের ডাইনিং হলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতেন। শিলিগুড়ি কলেজ ময়দানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রাস্তার ওপারের একটি বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডক্টর সত্যপ্রসাদ সেনগুপ্ত , ডক্টর মানস দাশগুপ্ত, সুধাংশু চন্দ্র ভট্টাচার্য, শান্তি রঞ্জন দাসগুপ্ত , মহাদেব দত্ত, সুজন বান্ধব চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল কান্তি দত্ত, অনিন্দ্য পাল, বিমলকুমার বাজপেয়ি, তরুণ কুমার বন্দোপাধ্যায় সকলেই নিজ নিজ বিভাগে গভীর নিষ্ঠা আর আন্তরিকতায় অধ্যাপনা শুরু করলেন। ছাত্রদের সঙ্গে গড়ে উঠল নিবিড় সংযোগ। সেসময় শিলিগুড়ি কলেজের কয়েকজন অধ্যাপকও বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিষয়গুলোতে আংশিক সময়ের জন্য অধ্যাপনা করতেন, বস্তুতঃ তাঁদের সহযোগিতা, ল্যাবরেটরী ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা না পেলে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিভাগগুলির পড়াশোনা চালানো সম্ভব হত না । কয়েক বছর পরে রাজা রামমোহনপুর ক্যাম্পাসে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় যখন একটু সাবালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল, তখন শিলিগুড়ি কলেজের একাধিক অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক বিনয়েন্দ্র দাশগুপ্ত ছিলেন লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্সের অধ্যাপক, তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় আর নিরলস পরিশ্রমে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা , তিনিও মাঝেমধ্যে আসতেন কলেজ মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস বাড়িতে । বিধানসভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের Act পাস করার সময় মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় অধ্যাপক বিনয়েন্দ্র দাশগুপ্তের উপর ভরসা রেখে বলেছিলেন -"Mr Dasgupta , I place in your hands the entire matter of making a good campus and a great Educational Centre " মুখ্যমন্ত্রী নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে আরও বলেছিলেন-" Do not trouble me anymore - I leave it to you entirely" (সূত্র :স্মৃতি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়/ অনিন্দ্য পাল। রিফ্লেকশন ।1962 -2011 পৃষ্ঠা. 3-4)
১৯৬২- ২০২১ এই কাল সীমায় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালযয়ে ১৫ জন উপাচার্য এসেছেন, কিন্তু যিনি উত্তরবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা আনয়নের ভগীরথ তাঁর কথা একটু বিশেষ করে বলতেই হয়। সেইসঙ্গে মনে হয় উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে জলপাইগুড়ি - শিলিগুড়িতে একটি কথা প্রায় প্রবাদ পর্যায়ে চলে গেছে, তা হল পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্য মন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় এই এলাকাগুলির উন্নয়নে যথেষ্ট মনোযোগী হননি । মনে হয় এ কথা সর্বাংশে ঠিক নয়, অন্তত সেদিনের উগ্র বামপন্থী আন্দোলনের হঠকারিতায় মুখ্যমন্ত্রীকে যে নিগ্রহ ও অপমান করা হয়েছিল, তাও যে উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভুল ছিল তা স্বীকার করবার দায় আজ বিস্মরণের অতলে তলিয়ে গেছে। কিন্তু ওই বড় মাপের মানুষটির মহিমা একটুও ক্ষুন্ন হয়নি ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের পরিসর বৃদ্ধি হওয়াতে সমস্যা হচ্ছিল অনেক, "ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী" , শিক্ষকদের জন্য কলেজের কাছে কয়েকটি বাড়ি নেওয়া হল "অন্নপূর্ণা কুটির" ,"আনন্দধারা", "কুলদা ভবন", "মুখার্জী ভবন" এইসব বাসাবাড়িতে কলেজ হোস্টেল ছেড়ে ঠাঁই নিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। চীন-ভারত যুদ্ধের দামামাও থেমে আসছে , বিশ্ববিদ্যালয়কে এবার ফিরে যেতে হবে নিজস্ব আবাস রাজা রামমোহনপুর ক্যাম্পাসে। ১৯৬৩তে বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে গেল নিজস্ব ক্যাম্পাস রাজা রামমোহনপুরে। ...