সানিয়া-৩/নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
সানিয়া
পর্ব-তিন
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
"""""""""""""""
ময়লা-ছেড়া
একটা গামছা ঘরের বেড়ায় ঝুলছে। রাতের কুয়াশা আর ভোরের শিশিরে প্রায় ভিজে
গেছে সেটা। সেটাকেই নিংড়ে নিয়ে মাথায় পাগড়ির মতো করে পেঁচিয়ে নেয় সানিয়া।
মৈষালী কাজে ওই এক টুকরো কাপড়ের কোন তুলনা নেই। আরামে, বিশ্রামে, বিপদে
গামছা যে কত কাজে আসে সেটা তাকে হাতে কলমে শিখিয়েছে ভগলু মৈষাল। ভগলু মৈষাল
খুব স্নেহ করে তাকে। অন্যান্য মৈষালরা তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে সেটা
একেবারেই ভালো লাগেনা তাঁর। ভগলুর সানিয়ার মতো একটি ছেলে রয়েছে। সে তো আর
সানিয়ার মতো দুখী নয়। মায়ের হাতে রান্না করা গরম ভাত তার মিটে যায় দুই
বেলা। তাইতো সানিয়ার দুঃখে প্রাণ কাঁদে ভগলুর। এক থোপ মহিষের মাঝে ব্যস্ত
এখন ভগলু। এক এক করে মহিষের পায়ের ডোর খুলছে সে। ডোর খুলতে খুলতে তার নজর
যায় সানিয়ার দিকে। সেখান থেকেই সানিয়া সানিয়া বলে হাঁক দেয়। উঁচু উঁচু
মহিষের মাঝে দেখা যায়না ভগলুকে। গলার স্বর ঠাহর করতে পারলেও সাড়ে তিনফুট
সানিয়ার চোখে পরেনা পিতৃতুল্য ভগলু কাকা। একমুখ হাসি নিয়ে ভগলু বেড়িয়ে আসে
মহিষের ভেতর থেকে। ভগলু-কাকার হাসিতে সানিয়া লজ্জা পায় ভীষণ। পাগড়িটা খুলে
ফেলতে গেলেই সানিয়াকে নিজের কাছে ডেকে নেয়। সানিয়ার মাথার গামছাটা খুলে
সঠিক ভাবে বেঁধে দেয়। নিজের হাতের বাঁশের লাঠিটা তার হাতে ধরিয়ে বলে-
-এটা
সাথে রাখিস। নলের জঙ্গলে বাঘ, হায়না, শুয়োর, শিয়াল আছে। ওরা কিন্তু যখন
তখন চলে আসে। খুব সাবধানে কাজ করবি। চোখ-কান সজাগ রাখবি। অলিন মৈষালের
পিঠটা দেখছিস? ওইগুলা বাঘের থাবা।
ছোট্ট
সানিয়া বাঘ-শিয়ালে ভয় পায়না মোটেই। গরুমারা জঙ্গল ঘেঁষে মহিষ চরাতে চরাতে
হাতি, গন্ডার, বাইসন, চিতা সে অনেক দেখেছে। বন্য পশুদের দেখা পেলেই সে উঠে
পড়ত গাছের উপর। ঘাপটি মেরে বসে থাকতো পাতার আড়ালে। বন্যরা দূরে সরে গেলে
আবার মহিষদের কাছে দৌড়ে চলে যেত। সানিয়ার বিচরণক্ষেত্র পরিবর্তিত। জলঢাকার
জল তিস্তায় গিয়ে মেশেনি ঠিকই তবে জলঢাকার সানিয়া আজ এসে পরেছে তিস্তায়।
তিস্তাকেও তার বেশ পছন্দ হয়েছে। তিস্তার জল-পলি-বালি-কাদা-জঙ্গল মন্দ নয়।
তবে আক্ষেপ তিস্তার পাড়ে তেমন কুলের গাছ নাই। যেক'টা আছে ঢেকে যায়
স্বর্ণলতা দিয়ে। জলঢাকার পাড়ে কত্ত কুলের গাছ। মাটিতে দাঁড়িয়েই সেই কুল গাছ
থেকে পারা যায়। এভাবেই কুল সংগ্রহ করে এক দুইবার বাবার সাথে বাজারে গিয়ে
বিক্রিও করেছিল সে। কুল বিক্রির পয়সা দিয়ে কতকিছুই না নিয়ে এসেছিল ভাই
বোনের জন্য। তিস্তার চরে চরে অনেক কুম ফলের গাছ। গাছগুলি অনেকটা বড়ই(কুল)
গাছের মত। গায়ে কাঁটা নেই, উচ্চতা কম। মহিষের দল ঘুরে ঘুরে কুমফল খেয়ে
বেরায়। মাঝে মাঝে লড়াই লাগে। সানিয়া লাঠি হাতে ছুটে যায় সেই গন্ডগোল
থামাতে।
ক্ষুদে-মৈষাল
আজ সানিয়া। মৈষালি চালে লাঠি-কাঁচি হাতে নিয়ে সে এগিয়ে যায় পাড়ে বাঁধা
নৌকার কাছে। পাড় ঘেঁষিয়ে নৌকা টানতে টানতে সে এগিয়ে চলে দক্ষিণের নলবনের
দিকে। রাজা আর রানী পিছু নেয় তার। ওরা বাথানের পোষ্য কুকুর। ভীষণ শিকারি।
চোখে মুখে হিংস্রতা থাকলেও সানিয়া ওদের মোটেই ভয় পায়না। পরুদের মতো ওরাও
তার সাথে বন্ধুত্ব করেছে। হয়তো সে ছোট বলেই ভাব জমেছে এত তাড়াতাড়ি। কিছুটা
এগিয়েই নৌকা থামায় সানিয়া। কয়েকটা বড় নলগাছের সাথে নৌকা বেঁধে ঢুকে পরে
জঙ্গলের মাঝে। রাজা আর রানী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে নৌকার কাছেই।
সূর্য
মাথার ওপর তেজ বাড়িয়েছে। কুয়াশার সাথে সূর্যালোকের সমানে সমানে লড়াই চলছে
নলবনের মাঝে। সেই লড়াইয়ের মাঝে ঠান্ডা জলের ছ্যাঁকা খেতে খেতে সানিয়া ঘাস
কেটে চলে। দু'হাতে কাটা ঘাস বয়ে এনে জড়ো করে নৌকার পাটাতনে। হাত দু'টি অসাড়
হয়েছে সানিয়ার। একটু অসতর্ক হতেই আঙুলে কাঁচির পোঁচ লাগে। কচি আঙুল থেকে
রক্ত ঝড়ে পরে তিস্তার জলে। আঙুল চেপে ধরে সানিয়া ছুটে আসে নৌকায়। রাজা রানী
ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে তার দিকে। রক্ত দেখে তারাও হাত মুখ নাড়িয়ে
শান্তনা দিয়ে চলে সানিয়াকে। ঘেউ ঘেউ করে বিপদের বার্তা পাঠায় বাথানে। লাভ
হয়না তাতে। বাকালীর চরে এখন একলা বাথান। মহিষ নিয়ে বেরিয়ে গেছে সবাই। এদিকে
রক্ত যে থামছেই না। ব্যথায় কুকরে যাচ্ছে চোখ। কি করবে ছোট্ট সানিয়া? মাথায়
আসে ভগলু কাকার কথা। তাঁর মাথার সেই গামছার কথা। নিজের মাথা থেকে গামছাটা
খুলে নেয়। পঁচা সুতোর ছেড়া ছেড়া গামছাটা দাঁত দিয়ে ছিড়ে নেয়। কে জানতো,
আঙুল বাঁধার ন্যাকড়াও মিলে যাবে মাথার গামছা দিয়েই।
হাওয়া-পাখি-জলের
কনসার্টের মাঝে বালির উপর দুইপা ছড়িয়ে বসে একাকী কিশোর। রক্ত মাখা আঙুলে
কাঁপা কাঁপা হাতে কাপড় পেঁচিয়ে চলে। রাজা রানী তখনও তার পাশেই দাঁড়িয়ে।
অবাক চোখে তারা দেখছে মনুষ্যজীবনের সর্বহারা এক জীবন্ত ক্যানভাস।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴