লে পাঙ্গা-৩/শুভ্রজ্যোতি দাস
লে পাঙ্গা/৩
শুভ্রজ্যোতি দাস
মার্কার
ফাইনালের দুদিন আগে - টিফিন পিরিয়ডে স্কুল লাগোয়া হোস্টেলে নিরিবিলিতে সিগারেট টানছে মিহির। হঠাৎ সেখানে নিতাই উপস্থিত। ওর চোখ মুখের উত্তেজনা বলে দিচ্ছে - ফার্মার লাস্ট থিওরেম এর সমাধানটা এইমাত্র ও করে ফেলেছে! হাত বাড়িয়ে সিগারেট চাইল। ও সচরাচর সিগারেট খায় না। সিগারেট চাওয়ার ধরণ দেখে মিহির বুঝল - সমাধানটা এক্ষুনি বুঝতে হবে। অনভ্যস্ত উত্তেজিত হাতে তিনটা দেশলাই কাঠি নষ্ট করে অবশেষে সিগারেটটা ধরাল। তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল - "একটা দারুণ প্ল্যান ভেবেছি। দেখো, ফাইনালটা বের করে আনব।"
মিহির হাসল একটু।
-"আরে হেসো না। শোনো, ঠিক করেছি দেবজিতের পিছনে মার্কার লাগাবো। দেখো, দেবজিৎকে আটকে দিলে ওদের টিম কিন্তু কানা হয়ে যাবে।"
খারাপ আইডিয়া না। বেশ ভালোই বলতে হবে। অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা জেনেও নিতাই যে হাল ছেড়ে দেয়নি- এটা জেনে মিহিরের মনটা খুশিই হল। আগ্রহ নিয়ে বলল - "কিন্তু কাকে মার্কার রাখবি? ওর যা খেলা, তাতে যে কেউ কিন্তু ওকে মার্ক করতে পারবে না। মার্কার গায়ে নিয়েও দিব্যি খেলে যাবে।" কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিতাই বলল - "শুভঙ্কর।"
-"তুই পাগল হয়েছিস? ও টিমের ক্যাপ্টেন, টিমের সব থেকে সিনিয়ার। ও রাজি হবে? মার্কার জিনিসটা কী বুঝতে পারলে কিছুতেই রাজি হবে না।"
-"তাহলে কাকে করবে বল।'"
মিহির অথৈ জলে পড়ল। টিমে গৌরাঙ্গ, শাজাহান আর কিছুটা শুভঙ্কর ছাড়া আর এমন কেউ নেই দেবজিৎকে আটকানোর। বলল - "কিন্তু ও কি রাজি হবে?"
নিতাই একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল - "ভোকাল টনিক।"
ওইদিনই পাঁচ পিরিয়ডের পর একটা ফাঁকা ঘরে, নিতাই টিমের সব প্লেয়ারদের ডাকল- টিম মিটিং হবে। ফাইনালে ওঠার জন্য সবার পিঠ চাপড়ে দিয়ে, নিতাই কাজে লেগে পড়ল। ফাইনালে প্রতিটা প্লেয়ারের দায়িত্ব আলাদা আলাদা ভাবে ডেকে বুঝিয়ে দিল। সবার শেষে শুভঙ্করকে ডেকে বলল -"শুভঙ্কর, তোর ওপর ফাইনালে সব থেকে বড় দায়িত্ব থাকবে। তোর কাজ হবে দেবজিৎকে আটকানো। ও যাতে বল ধরতে না পারে।"
শুভঙ্কর ঠিক বুঝতে পারল না ব্যাপারটা - "আমাকে কী করতে হবে স্যার?"
নিতাই বিস্তারে মার্কারের কাজ ওকে বোঝালো। সব ঠিক ঠাক চলছিল। কিন্তু বল পায়ে না থাকলেও ওকে দেবজিতের সাথে সেঁটে থাকতে হবে - এটা বলার পর শুভঙ্করের মুখ দেখে নিতাই বুঝল - চিঁড়ে ভেজেনি।
শুভঙ্কর মিনতি করতে লাগল,-" স্যার, এটা আমি পারব না। অন্য কাউকে দিন।" নিতাই মিহিরের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাল।
মিহির চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে গিয়ে শুভঙ্করের সামনে দাঁড়াল। ওর মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলা শুরু করল -" ফুটবলকে সব খেলার সেরা কেন বলা হয় জানিস? কারণ ফুটবলটা বিভিন্ন ভাবে খেলা যায়। এটাই একমাত্র খেলা যেখানে কোচকে প্লেয়ারের থেকেও বেশি দাম দেওয়া হয়। কেন? না, কোচ খেলার স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে। ম্যান মার্কিং কিন্তু বহু পুরোনো সফল একটা স্ট্র্যাটেজি। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল জার্মানি। কাকে হারিয়ে জানিস? মেসির আর্জেন্টিনাকে। ওই ম্যাচে মেসি একটা বল ধরতে পারেনি। জার্মানির ক্যাপ্টেন, সোয়েনস্টাইগার ছিল মেসির মার্কার। মেসি খেলতে পারলে কাপটা কিন্তু আর্জেন্টিনা জিততো। তুই লং জাম্পে ডিস্ট্রিক্ট খেলেছিস না? তাও স্কুলে সেভাবে তোকে কেউ চেনে না। পরশু ফাইনালে কেউ তোকে দেখতে আসবে না, দেবজিৎকে দেখতে আসবে। কিন্তু দেবজিৎকে তুই যদি আটকে দিতে পারিস- গোটা স্কুল কিন্তু ম্যাচের শেষে তোর জন্য হাততালি দেবে, সে ম্যাচের ফল যাই হোক। সবাই জানবে- দেবজিৎকে আটকানোর দম একজনেরই আছে। ভেবে দ্যাখ, কী করবি। সিদ্ধান্ত তোর।" ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসল মিহির। শুভঙ্কর মাথা নিচু করে আছে। ধীরে ধীরে মাথা তুলে বলল - "পারব স্যার।" ওর চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। দৃষ্টি যেন ঘরের গন্ডি ডিঙিয়ে সবুজ মাঠটায় পাড়ি দিয়েছে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴