রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^
একসময়ে এখানকার বৈভব দেখে চক্ষু চড়কগাছ হত অনেকেরই। বলিউড-টলিউডের নায়ক নায়িকাদের অভিনীত একাধিক ছবিতে ফুটে উঠতে দেখা গিয়েছে ডায়না পাড়ের এই বাগানেরই দৃশ্যপট। আস্ত চিড়িয়াখানা থেকে ঝাড়বাতির আলো ঝলমলে ডিরেক্টরস বাংলো। ফি বছর দুর্গাপুজোয় এলাহি আয়োজন। অতীতের ওইসব সোনালি স্মৃতিকে দূরে ফেলে রেখে বন্ধ রেডব্যাংক চা বাগানে শুধুই হতাশা আর দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। এবারের বাগিচা সফরে এসেছি রেডব্যাঙ্কে। কারণ রেডব্যাঙ্ক ঘিরে অনেকগুলি স্মৃতি জড়িত। আমার বেশকিছু সামাজিক-অর্থনৈতিক কাজের সাক্ষী এই রেডব্যাঙ্ক চা বাগান। কথা হচ্ছিল বাগানের প্রবীণ কর্মচারী সুশীল সরকারের সঙ্গে। জানালেন ‘নিজের চোখে মালিকের বাংলোর চিড়িয়াখানা দেখেছি। সেখানে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, অজগর সবকিছুই মজুত ছিল। অশোককুমার-বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত বনজোছনা ও হাটেবাজারে সিনেমার শুটিং তো এখানেই হয়েছে। সবই এখন ইতিহাস’। বাগানটিতে খোলা-বন্ধের সাপলুডো খেলা চলছিল ২০০২ সাল থেকে। পাকাপাকিভাবে বাগানে তালা ঝোলে ২০১২-র অক্টোবরের শেষে। তারপর নেতা-মন্ত্রী কিংবা আমলাদের আনাগোনা লেগে থাকলেও ফ্যাক্টরির মরচে ধরা তালার চাবির সন্ধান কিন্তু মেলেনি। শুধু সমান তালে বেড়েছে তাদের সমস্যা। রেড ব্যাংকে এখন অপ্রাপ্তির তালিকা বেশ লম্বা চওড়া। যে অগতির গতি একশো দিনের কাজ ছিল শ্রমিকদের বেঁচে থাকার অন্যতম সম্বল সেটাও বন্ধ হয়ে আছে দীর্ঘ কয়েকমাস। সরকারি দু’টাকার রেশন মিলছে বটে, তবে তা পেতে গেলে যেটুকু টাকা লাগে সেটাও নেই বহু পরিবারে। অনেকদিন ধরে মিলছে না ক্যাশ জি আর। গত ৭ বছর ধরে বন্ধ থাকা রেডব্যাংকের শ্রমিকদের অনটনের সমস্যা আরও বেড়েছে। আপার লাইনের এক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললাম। জানালেন শ্রমিকদের বেহাল দশা। রোজগারের সব রাস্তাই বন্ধ। অভাব অনটনের কারণে প্রায় প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে বাগানের নানা জায়গায় একের পর এক ছায়াগাছ লোপাট হয়ে যাওয়া। কাটা পড়ছে একের পর এক পরিণত ছায়াগাছ। মেশিন দিয়ে ছায়াগাছগুলিও কেটে পাচার করার চেষ্টা চলছে অভাবের তাড়নাতেই।
স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যা অনিতা ওরাওঁ এর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। আর্থিক সংকটে জেরবার শ্রমিকরা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ফাওলাই এর নামে সরকারি মাসিক অনুদান একসময় ৮৫০ জন স্থায়ী শ্রমিক পেতেন। নিয়ম অনুযায়ী ৫৮ বছরের বেশি বয়স হয়ে যাওয়ার ফলে বহু পরিবারের নাম ফাওলাইয়ের তালিকা থেকে বাদ যাওয়ায় তাদের অনেকেই সেই অনুদান পাচ্ছেন না। খাতায়-কলমে ৮৮৬ জন শ্রমিকের মধ্যে অনেকের মৃত্যু ঘটার ফলে এখন সেখানে ফাওলাইয়ের টাকা পাচ্ছেন ৫৫০ জনের মত। অথচ সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলি কিন্তু রয়েই গিয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন তারা। শুনলাম একশো দিনের কাজ চলতি আর্থিক বর্ষে একদিনও হয়নি। পঞ্চায়েতের কাছে জানতে পারলাম ১০০ দিনের কাজের জন্য সবাই এসে তাগাদা দিচ্ছে। শীতের শুখা মরশুমে আশপাশের বাগানগুলিতে অস্থায়ী বা বিঘা শ্রমিকের কাজ প্রাপ্তিও বন্ধ হয়ে যায়। লড়তে হয় পানীয় জলের সমস্যার সঙ্গেও। পরিচর্যার অভাবে জঙ্গলে পরিণত হওয়া চা বাগানের একাংশে এখন হাতির ডেরা। ভরদুপুরেও মাঝে মাঝেই বুনোদের দলকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সন্ধে হলেই শুরু হয়ে যায় বিস্তীর্ণ শ্রমিক মহল্লা জুড়ে তাণ্ডব। জঙ্গল ও ঝোপঝাড় সাফাই করার দাবি থাকলেও সেটা করা হয় না। কাজের মধ্যে শুধু হয়েছে বনদপ্তরের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের নিয়ে দুটি হাতি তাড়ানোর দল গঠন। মিলেছে চারটি সার্চ লাইট ও কয়েক বাক্স পটকা। তার পরিবর্তে এখন বেঁচে থাকার লড়াই। বাগানের পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। আর্থিক সংকটে পড়ে ক্রমশ বাড়ছে ছায়া গাছ কেটে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা। ফের নতুন করে শুরু হয়েছে কাজের সন্ধানে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার ঘটনা। পরিস্থিতি এমনই দু’টাকা কিলোর সরকারি রেশন ছাড়াতে যে পঞ্চাশ টাকার মত প্রয়োজন হয় সেটাও জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশের ডায়না নদীর বালি-পাথরই এখন অনেকের রুটিরুজির মূল ভরসা। তবে সবার পক্ষে ওই কাজ করা সম্ভব হয় না।
এবারে রেডব্যাঙ্কে দেখলাম অন্য স্লোগান। ‘হয় বাগান খোলো, নয়তো লিজের দাবি ছাড়ো’। বন্ধ চা বাগানগুলির মালিকানা পরিবর্তন করে যোগ্য মালিকদের হাতে সেগুলির পরিচালনা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে এখন। জলপাইগুড়ি জেলাতে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ মানাবাড়ি, সুরেন্দ্রনগর, ধরণীপুর, রেডব্যাংক এবং আলিপুরদুয়ার জেলায় বান্দাপানি, ঢেকলাপাড়া, মধু। এছাড়াও রায়পুর, কালচিনি, রায়মাটাং, তুরতুরী, শ্রীনাথপুর ইত্যাদি রুগ্ন চা বাগানের সংখ্যা কম নয় যেগুলি মাঝেমাঝেই ঝাপ গোটায়। বন্ধ চা বাগানগুলির মালিকপক্ষের লিজ বাতিল করে উদ্যোগী মালিক দিয়ে এই বাগানগুলি চালু হলে দুই জেলা মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কর্মচারী উপকৃত হবে। জলপাইগুড়ির উন্নয়ন বিষয়ক কমিটিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধি তথা তৎকালীন বিধায়ক সৌরভ চক্রবর্তী যখন ছিলেন তখন কথা বলেছিলাম তাঁর সঙ্গে। জেনেছিলাম বাগান হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আইনগত কোনো অসুবিধা নেই। আগ্রহী প্রার্থীরা যদি বাগান পরিচালনায় রাজি থাকেন তাহলে সরকার নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে মালিকপক্ষের পাশেই থাকবে। আগ্রহী এবং দক্ষ চা শিল্পপতি এনে তাকে দিয়ে বাগান পরিচালনায় অংশগ্রহণ করানো এবং সেইসঙ্গে তাকে সরকারিভাবে সহযোগিতার প্রশ্নে সেই সময় জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ফাইল নবান্নে পাঠিয়েছিল। ভূমি এবং ভূমি সংস্কার দপ্তর প্রতিটি বন্ধ চা বাগানের সম্পদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করে রাজ্য সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল বলে জানতে পেরেছিলাম। তখনই দাবি উঠেছিল বকেয়া মেটানোর দায়িত্ব না নিতে পারলে বাগানের দায়িত্ব নতুন হাতে তুলে দেওয়া হোক। বন্ধ এবং রুগ্ন চা বাগানগুলির মালিকপক্ষের লিজ বাতিল করে মালিকানা বদল করার দাবি তুলে বাগান খোলার এই সরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিল শ্রমিক সংগঠনগুলিও।
এসে দাঁড়ালাম ডায়নার ধারে। রুটিরুজির অন্যতম অবলম্বন ডায়না নদী থেকে ট্রাকে বোল্ডার বোঝাইয়ের কাজও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বালি মাফিয়াদের প্রতি রাজ্য সরকার কঠোর মনোভাব নেওয়ার ফলে এই অঞ্চলে হিতে বিপরীত হয়েছে বেশি। শুনলাম বর্ষার মরশুমে রয়্যালটি প্রদান বন্ধ থাকায় অথবা একশো দিনের কাজের প্রকল্প বা ডায়না নদী থেকে ট্রাকে বালিপাথর বোঝাইয়ের কাজ খুইয়ে রোজগার হারিয়ে সম্পূর্ণ বেকার হয়ে গেছে প্রায় পাঁচশো শ্রমিক। এমন পরিস্থিতিতে অনেকের পকেটে একটি টাকাও নেই। স্মৃতিতে এল ২০১৭ সাল। তখন ‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকার পক্ষ থেকে অবৈতনিক বিশেষ সংবাদদাতা হিসাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি বাগিচা থেকে বাগিচাতে উত্তরের চা বাগিচার সেই সময়কালীন দারিদ্র্য, অনাহার, অনশন, মৃত্যুর অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদন এবং ডুয়ার্সের চা শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরতে সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে। এরকমভাবেই একদিন ডায়না নদীর তীরে পাথর ভাঙ্গারত অবস্থাতে আবিষ্কার করি রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচার জয়ন্তী, অঞ্জলি এবং নিকিতা, বাসন্তী ওঁরাওদের যারা বানারহাট স্কুলের নবম বা দশম শ্রেণীর ছাত্রী হলেও পড়াশুনা থেকে প্রায় ড্রপআউট হয়ে গিয়ে নিদারুণ দারিদ্র্যের কারণে পাথর ভাঙতে বাধ্য হচ্ছিল ডায়না নদীতে। তুলে ধরি ওদের করুণ কাহিণী ‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকাতে। মানবিক এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সাড়া পড়ে যায় চারিদিকে। অনেকেই ব্যাক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বিস্তাড়িতভাবে জানতে চান আমার কাছে, কেউ কেউ সরাসরি সাহায্য করতে চান মেয়েগুলিকে, কেউ আমাকে সঙ্গী করে এদের কাছে যেতে চান। যেটুকু সহযোগিতা করার সেটুকু করেছিলাম সকলকে। কিন্তু সেই সাহায্য ছিল এককালীন। জানতাম তাতে দুচারদিন অভাব মিটবে, কিন্তু চিরস্থায়ী সমাধান হবে না কোনপ্রকারেই। আবার তিনদিন বাদে পাথর ভাঙতে চলে যাবে মেয়েগুলো। তবে ‘অসির চেয়ে মসী বড়ো’- কথাটা যে কতোবড়ো সেটার প্রমাণ পেয়েছিলাম অর্পিতাদি যোগাযোগ করতে। অর্পিতা বাগচী। জলপাইগুড়িতে থাকতেন এবং এখনো থাকেন।
‘দুটি পাতা একটি কুড়ি/ মেয়েরা নয় হাতের চুড়ি’। হ্যা, সত্যি এই স্বপ্ন এখনো সক্রিয়ভাবে দেখে চলেছে জলপাইগুড়ি তথা ডুয়ার্সের একটি সামাজিক সংস্থা ‘টু লিভস অ্যান্ড এ বাডস’। কর্ণধার একজন সমাজসেবী নারী অর্পিতা বাগচী যিনি দিদি হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন ডুয়ার্সের বন্ধ রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচার ছ ছয়টি মেয়েকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করার সাধনা নিয়ে। অর্পিতাদি আমাকে একদিন সকালে ফোন করলেন। শুনলাম তিনি এলআইসি র সঙ্গে যুক্ত। আমাকে জানালেন ‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকাতে আমার লেখা পড়ে তিনি এতটাই মর্মাহত যে তিনি এই ধরনের বন্ধ বাগিচাগুলির কয়েকজনের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিতে চান। তখনও বুঝতে পারিনি যে তিনি তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার ব্রতে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন এবং যতদূর পর্যন্ত তারা পড়াশুনা করতে চায় তিনি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করবেন। তিনি আমার কাছে এই ধরণের তিনজন মেয়ের নামের তালিকা চান যাদের তিনি সাহায্য করবেন। আমি সবিনয়ে জানালাম মাত্র একদিন বাগিচা সফর করে কে সত্যিকারের দরিদ্র সেটা কেমন করে বুঝব? তাই শরণাপন্ন হলাম তৎকালীন টাই এর ডুয়ার্স শাখার সম্পাদক রাম অবতার শর্মাজীর। তাঁর পরামর্শেই পরবর্তীকালে অর্পিতাদির সঙ্গে প্রাথমিক সমীক্ষা করতে যাই রেডব্যাঙ্কে। সেখান থেকেই প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হল জয়ন্তী, সোনিয়া, অঞ্জলীকে যারা তিনজনেই ছিল সেই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনী। তখন সম্ভবত পরীক্ষার মাস পাঁচেক বাকি ছিল। শুরু হল অর্পিতাদির একক লড়াই এবং জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য মেয়েগুলির সমষ্টিবদ্ধ লড়াই। প্রত্যেকমাসে অর্পিতাদি ১০০০ টাকা করে পাঠাতেন এদের তিনজনের পড়াশুনার জন্য। মনে রাখতে হবে সমীক্ষা করতে গিয়ে জেনেছিলাম ডায়না নদীতে সকাল সাতটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত রোদে পুড়ে পাথর ভেঙে অঞ্জলি এবং তার পরিবারের পাঁচজন মিলে এক ট্রাক পাথর বোঝাই করে দিতে পারলে সাকুল্যে মিলতো একেকজনের গড়ে ১০০-১২০ টাকা। তাই প্রতিমাসে ১০০০ টাকা ডুয়ার্সের একজন নারী চা শ্রমিকের কাছে যে কতটা আর্থিক সাহায্য সেটা হয়তো আলাদা করে বলে দিয়ে হবে না।
আসলে এই লড়াই একদিকে চা বাগিচার নারী শ্রমিকদের লড়াই নয়। এই লড়াই মানবদরদী শুভানুধ্যায়ী মানুষের লড়াই যে লড়াইতে একজন সংবেদনশীল এবং চা শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন মানুষ হিসাবে, একজন শিক্ষক হিসাবে, একজন লেখক হিসাবে কিভাবে যেন জড়িয়ে গিয়েছিলাম অর্পিতাদির সংগঠনের জন্মের প্রথম লগ্নে। এরপর ডায়না দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। মাঝখানে অর্পিতাদি হয়েছিলেন প্রচন্ড অসুস্থ। শুনেছিলাম তিনি যেতে পারেন না বাগিচা সফরে। তাই ভেবেছিলাম সম্ভবত প্রজেক্টের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর যা হয়, বাস্তবতার নিরিখে কর্মব্যাস্ততাতে বেশি আর খবর রাখতে পারিনি। তারপরে তো ভয়ঙ্কর সেই সময়কাল আমাদের গৃহে অন্তরীণ করে দিয়েছিল। সেদিন সকালে হোয়াটস অ্যাপ মেসেজে ‘দুটি পাতা একটি কুড়ি, মেয়েরা নয় হাতের চুড়ি’ শীর্ষক একটি ছবি চোখে পড়ল। বুঝলাম প্রজেক্ট আবার শুরু হয়েছে। বিস্তাড়িত জানতে চাইলাম দিদির কাছে। সামগ্রীক পরিকল্পনা শুনে শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে, ভালোবাসায় আপনা থেকেই এক অদ্ভূত অনুভূতি কাজ করল। এবার আমার বাগিচা সফরের লেখার বিষয় ছিল নেওড়ানুদী চা বাগিচা। ব্যাতিক্রমীভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম রেডব্যাঙ্ক নিয়ে লিখব। এর কারণ দুটো। প্রথমটা রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচা খোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে চলছে নিরন্তর প্রয়াস। আর দ্বিতীয়টা অঞ্জলিদের এই লড়াই ডুয়ার্সের অন্য ছাত্রীদের যাতে প্রভাবিত করে সেটাকে তুলে আনা। ২০১৭ সালে রেডব্যাঙ্কের জয়ন্তী, অঞ্জলী এবং চ্যাংমারীর সোনিয়াকে মাসে ১০০০ টাকা আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কাজ শুরু হয়। শুরু হয় ওদের পড়াশুনা। প্রতিমাসে টাকা পাঠানো হতে থাকে। কিন্তু মাস দুয়েক পরে চা বাগান থেকে সোনিয়া নিরূদ্দেশ হয়। প্রশাসনকে জানানো হয়। চলে খোজাখুঁজি। কিছুদিন পরে সে ফিরে আসে। মনে রাখতে হবে সোনিয়ার নিরূদ্দেশ এবং ফিরে আসা দীর্ঘ আট মাসের লড়াইতে ছিল প্রশাসনের নেতিবাচক মনোভাব এবং চা বাগিচার হারিয়ে যাওয়া একটি মেয়েকে খুঁজে আনার এক অদম্য লড়াই যে লড়াই লড়েছিলেন অর্পিতা দি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমস্ত ঘটনা জানানোর ফলে তাঁর নির্দেশে তামিলনাড়ু থেকে প্রশাসনের সহযোগিতাতে ফিরে এসেছিল সোনিয়া।
সোনিয়ার কাছ থেকে জেনেছিলাম তার আর্থিক দুরবস্থার কথা ফেসবুকে আমাদের পাঠানো লেখালেখি থেকে বহু মানুষ জানতে পেরে তাকে প্রচুর টাকা পয়সা পাঠিয়েছিল। তার হাতে বেশ কিছু পয়সা জমে গিয়েছিল। তার ফলে ভালো চাকরির প্রলোভনে একজনের সঙ্গে সে চলে গিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে খারাপ জায়গাতে। পরে সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু চা বাগিচার উপজাতি সমাজের মেয়ে একবার যদি সমাজের বাইরে চলে যায় তার যা পরিণতি হবার সেটাই হয়েছিল। সোনিয়ার সঙ্গে আবার কথা বলা হয়। সে জানায় পড়াশুনা করবে, কিন্তু তার চ্যাংমারী স্কুলে সে আর যাবে না বলে জানায়। সে লজ্জা পাচ্ছিল আবার মুল স্রোতে ফিরে আসতে। ‘টু লিভস অ্যান্ড এ বাড’ উপলব্ধি করেছিল একবার যদি টাকা বা বৃহত্তর স্বপ্নিল জীবনের স্বাদ চা বাগিচার কিশোরী বা নারীরা যদি পায় তাহলে মূলস্রোতে তার ফিরে আসাটা খুবই প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ায়। সেই বছরে জয়ন্তী, অঞ্জলি, সোনিয়া তিনজনেই ফেল করেছিল মাধ্যমিক পরীক্ষাতে। জয়ন্তী পড়াশুনা ছেড়ে দিল। অর্পিতাদি অসুস্থ হবার পরে সেভাবে আর যেতে পারতেন না ডুয়ার্সের বাগিচাগুলিতে। কিন্তু প্রতি বছরের ২৫ শে ডিসেম্বর তাঁর টিম পৌঁছে যেত ডুয়ার্সের কোন এক বন্ধ চা বাগিচাতে সেখানকার মানুষের জন্য জামাকাপড়, খাদ্যসামগ্রী বা অন্য কোন উপহার সামগ্রী নিয়ে। এইভাবেই একদিন পরিচয় হয় বানারহাট গার্লস হাইস্কুলের জয়িতা ম্যাডামের সঙ্গে। তিনি অর্পিতাদির প্রজেক্টের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সামিল হলেন। তাঁদের হাত ধরে চলল এক অন্য ধরণের লড়াই।
মাধ্যমিকে ফেল করার পরে অঞ্জলি বলেছিল সে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে, রোজগার করতে না পারে তাহলে তার পিতাজী মরে যাবে। কারণ গার্ডেন বন্ধ। তাই সে ফেল করলেও আবার পড়াশুনা করতে চায়। সে জোর দিয়ে বলেছিল অবশ্যই সে পাশ করবে এবং রোজগার করে সংসারের দায়িত্ব নেবে। ২০১৮ সালে অঞ্জলি মাধ্যমিক পাশ করল। ইতিমধ্যেই ‘টু লিভস অ্যান্ড এ বাড’ সাহায্য করতে শুরু করল আরো পাঁচটি আর্থিক দিক থেকে অনগ্রসর মেয়েকে যারা বানারহাট স্কুলের মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থিনী ছিল। আর ২০২২ সালের মার্চ মাসের সূচনাকালে যখন এই প্রতিবেদন লিখছি তখন অঞ্জলি মালবাজার পরিমল মিত্র কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আর রিম্পা ওঁড়াও, রোশনী গুরুং, প্রতীক্ষা মারাং, পাখি ওঁরাও, অনুজা ওঁড়াও বানারহাট স্কুলে কেউ একাদশ আবার কেউবা দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ছে। জয়িতা ম্যাডামের মাধ্যমে বানারহাট স্কুলে এরা কে কেমন পড়াশুনা করছে, কার কোথায় কি অসুবিধা হচ্ছে তার মূল্যায়ণ করাও সম্ভব হয়ে উঠছে। প্রত্যেক রবিবার বা কোন ছুটির দিন অর্পিতাদি এদেরকে ফোন করে কারো কোন ধরণের সমস্যা হচ্ছে কিনা তা শুনে নেন। অর্পিতাদি মনে করেন সমাজে এখনো লিঙ্গ বৈষম্য প্রবল। এর ফলে মেয়েরা অর্থনৈতিক অবহেলা এবং শোষণের শিকার। মেয়েরাও পড়াশুনা করতে চাইলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার থেকে সমর্থন এবং সহযোগিতা পাওয়া যায় না। পারিবারিক সম্পদ এখনো উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের হাতে যায়। তাই অর্পিতাদি অঞ্জলিদের শিখিয়েছেন ১০০ টাকা হলেও পরিবারের হাতে তুলে দিতে যাতে তারা মনে করেন আগামী দিনে তাদের মেয়ে রোজগার করলে এইভাবেই তাদের সাহায্য করতে পারবে। দারিদ্র্য থেকে অভাবগ্রস্ত পরিবার মেয়ে সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছে ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। তাই পরিবারে নারীশক্তির আত্মমর্যাদার যে লড়াই শেখাচ্ছেন অর্পিতাদিরা তার গুরুত্ব কম নাকি?
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴