সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
07-March,2025 - Friday ✍️ By- সৌগত ভট্টাচার্য 67

মায়াপথের মীড়-৩/সৌগত ভট্টাচার্য

মায়াপথের মীড়
পর্ব : তিন
সৌগত ভট্টাচার্য

একটা গান। গানটা বাড়ি ফেরার গান। সেই কোন কাল থেকে আমার পিছু নিয়েছে। নাছোড় গানটা কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ে না। সে আমাকে বাহির থেকে বাড়ি ফেরায়। 

অদ্ভূত একটা গান, যে গানটা জুড়ে এক বিস্ময়-যাত্রা আছে, জার্নি আছে। যেমন থাকে ব্যালাডে, চারণ গানে --- একটা চলা। সে চলা কখনো একাকী, আবার কখনও আমার চারপাশ আমার সাথে চলছে। একা হয়েও ঠিক একা হতে দেয় না আমাকে। 
আমাদের সকলের বুকে যে বাড়ি বাসা বেঁধে থাকে, এই গান সেইদিকে চলছে। গানটার সুরের সাথে দৃশ্যগুলো চলছে, সময় চলছে, আমার বয়স বাড়ছে... চলছে একটা স্কুল বাড়ি, নীল আকাশ, পাথুরে নদী, সবুজ চা বাগান, ছোট্ট লোকালয়, দূরের নীল পাহাড়। গানটা আমার কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না।ও... 

সে অনেক দিন আগের কথা। আটের দশক। পৃথিবী তখনও অনেক কয়টা গ্রাম নিয়ে একটা গ্রহ। আমার তখন বাল্য কাল। বসন্তের দুপুর বেলা। মামাবাড়ির বিরাট উঠোনে খেলে বেড়াচ্ছি। ছোট মামার এল পি রেকর্ড প্লেয়ার থেকে একটা ইংরেজি গান ভেসে বেড়াচ্ছে মামা বাড়ির উঠোনের আনাচে কানাচে কুল গাছের তলায় জামরুল গাছের পাতায়। গানের সুরটা কানে আসছে কিন্তু গানের একটা শব্দও বুঝছি না। উঠোনময় খেলে বেড়াচ্ছি। গানটা বেজেই যাচ্ছে। সেই ছোটাছুটি খেলার সাথে সুরটা কোথায় গিয়ে যেন একই ছন্দে বাজছে। খেলা শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, কৈশোরও শেষ হয়েছে, তারও অনেকটা আগে গানটাও শেষ হয়েছে। রেকর্ড প্লেয়ারের পিনটা থেমে গেছে। গানের একটাও শব্দ না বোঝা, শুধু সুরটুকু বালক হৃদয়ে গুনগুন করে যাচ্ছে।

আমার ছোট কাকু ছিল গান পাগল মানুষ। আরেকটু ভালো করে বললে বলা যায়, কাকু ক্ল্যাসিকাল গান শুনত, ইংরেজি গান শুনত। তাছড়া সিনেমার গান মাঝে মাঝে বেজে উঠত কাকুর ফিলিপসের রেকর্ড প্লেয়ারে। তখন রেকর্ড প্লেয়ারের যুগ। ছোট্ট একটা টেপ রেকর্ডার, ফিতা দেওয়া ক্যাসেট। আলো আঁধারির ঘর আমার ছোট কাকুর। মাঝে মাঝে সেই গানটি বেজে উঠত --- যে গানটা শৈশবে বেলায় ছোট মামার রেকর্ড প্লেয়ারে শুনতাম। অনেক ইংরেজি গানের মধ্যে এই গানটার সুর খুব চেনা। তখন ক্লাস সেভেন বা এইট। কিশোর বয়স। সাইকেলের চাকা ঘুরছে পৃথিবীর থেকে জোরে। কাকুর অফুরান ক্যাসেটের মধ্যে একটা ক্যাসেটে ছবি একজন বিদেশী যুবকের। সোনালী চুল। বানান করে পড়তে হয় জন ডেনেভারের নাম। এই লোকটি গানটা গেয়েছেন। কাকু বলে, জন ডেনেভারের গানটা খুব পরিচিত গান। সারা বিশ্বের শ্রোতারা এই গানের সাথে পরিচিত। ইউ শ্যাল ওভার কাম ছাড়া আমি আর কোনো ইংরাজি গান মোটেই শুনিনি। কিন্তু পাকে চক্রে আরো অনেকের মত এই গানটা শুনে ফেলেছিলাম --- কান্ট্রি রোড টেক মি হোম। 

সিডি র যুগ। গানের আর্থিক মূল্য অনেকটা কমে এলো। পাইরেটেড সিডিতে প্রচুর গান ধরে। আমাদের তখন সদ্য যৌবন। একদিন মেসে হঠাৎ আবার সেই গান বেজে উঠলো। প্রথমবারের জন্য আমি গানের শব্দগুলোর অর্থ বুঝলাম। কী বলতে চাইছে! এ তো বাড়ি ফেরার গান। 

আমাদের বিয়ের পর অনন্যা ওর ফেলে আসা বাড়ি থেকে একটা আই পড নিয়ে এসেছিল। ছোট একটা সে যন্ত্রের মধ্যে ওই সেই নাছোড় গানটা আমাদের নতুন সংসারে চলে এসেছে কে জানত!  আমার কানে ইয়ার ফোনে একদিন বেজে উঠলো কান্ট্রি রোডস! এই গান আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় বুঝিনা।

অ্যান্ড্রয়েডের যুগ আসেনি। স্মার্ট ফোনের মেমোরি কার্ডে উপচে পড়া গানগুলো শুনি বাসে যেতে যেতে। নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না সেই গানটি এখানেও হাজির। বাসের জানলার বাইরে দিয়ে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা চলে যাচ্ছে। গানটি বেজে যাচ্ছে। আমি বাড়ি ফিরছি...

বাড়ি ফিরে বিকেলে বাঁধের  হাঁটতে যাই। ইউটিউবে একটার পর একটা গান বাজে। কী ভাবে যেন ইউটিউব জানতে পারে নাছোড় গানটার কথা। তিস্তার হাওয়া, চারিদিকে চর বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটছি কানে সেই  গান বাজছে।

আমার চারপাশের পৃথিবী আটের দশকের পৃথিবী নেই। দুনিয়া পাল্টেছে। আমার চারপাশ পাল্টেছে। রেকর্ড প্লেয়ার টেপ রেকর্ডার থেকে ইউটিউব --- একটা বিরাট যাত্রা, একটা জার্নি।

শেষ দুই আড়াই বছর গানটার কথা একদম ভুলে গেছিলাম। ভুলে কী আর যাওয়া যায়। যেটা হয়েছিল, অনেক দিন গানটা কানে আসেনি। ইদানীং দরকারে আদরকারে এক বন্ধুকে ফোন করতাম, সেই বন্ধুর ফোনের রিং টোন ছিল কান্ট্রি রোডস... আমি মনে মনে ভাবতাম বন্ধু যেন ফোনটা না ধরে। তাহলে কিছুক্ষণের জন্য গানটার কাছে চলে যাওয়া যায়। আসলে শুধু গানটার কাছে না, ফেলে আসা সময়ের কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু সে এমন মানুষ, আমাকে সে গান শোনার সুযোগ দিত না। ফোনটা ধরে ফেলত। তারপর যেটা হয়, সেই না শোনা গানটার গুনগুন থেকে যায় মনে।  

একদিন খেলায় করে দেখলাম, ছোটবেলা থেকে এই অবধি যতবার গানটা শুনেছি, ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কখনও ভেসে আসা সুরে, পুরো গানটা শুনছি। কিন্তু এই প্রথম কেউ আমাকে পুরো গান শোনার আগে ওপ্রান্ত থেকে বলে ওঠে, বল সৌগত। কথা হয় ফোনে। আর মনের ভেতরে শেষ না হওয়া গানটা বাজতে থাকে। সেই গান তো কবে থেকেই বাজছে বুকের ভেতরে। কিছুদিন হল সেই বন্ধু আর গানটা যেন সমার্থক হয়ে ওঠে।

একদিন শুনলাম সেই বন্ধু আর আমাদের মধ্যে নেই। সে চলে গেছে অন্য এক জার্নিতে, সে যাত্রাপথ আমাদের কারো না, তার একার। সে অনেক কিছু ফেলে গেছে। সম্পর্ক বন্ধুত্ব স্মৃতি ভালোবাসা। আর ফেলে গেছে একটা গান... কান্ট্রি রোডস টেক মি হোম... 

প্রতিটা জার্নির শেষে একটা বাহির থেকে ঘরে ফেরা থাকে। 
বয়স বাড়ছে,ইদানীং খেলায় করি, বাহির আর ঘরের মাঝে পথের ওপর মৃত্যু গান হয়ে অসমাপ্ত সুর দাঁড়িয়ে থাকে। সে এমনই যে আমাকে বাড়ি ফেরার নাছোড় গানটা সম্পূর্ণ শুনতে দেয় না। 

যে জীবন চারণের... সেখানে মৃত্যুও যে গান হয়ে যায়, সুর হয়ে যায়... সত্যি বলছি, হে বন্ধু, হে জীবন, তোমাকে না দেখলে বুঝতাম না...

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri