ভাস্কর্যের আঁতুরঘর/৩
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর/পর্ব-৩
মৈনাক ভট্টাচার্য
----------------------------------
রামকিঙ্কর বেইজের ‘কলের বাঁশি’
রোমান ভাস্কর ব্রাঁকুসী (Constantin Brancusi) প্রায়শই বলতেন- ‘স্বভাবে শিশুর সরলতা না থাকলে বড় শিল্পী হওয়া যায় না।’ রামকিঙ্করের জীবন দর্শনে এই সত্য যেন পরতে পরতে। বাঁকুড়ার যুগীপাড়ার দোতলা বাজারের কোন গাছের নীচে যে কিশোর পায়ের কাছে কাঠের বাক্সের উপরে ক্ষুর, কাঁচি, নরুন নিয়ে বসে থাকত খদ্দেরের অপেক্ষায়, সে জানত ক্ষৌরকর্মে সে মোটেই পটু নয়। পৈতৃক ব্যাবসা, বাড়িতেও অনটন। পেট বড় বালাই। তাই বসতেও হত তাকে। খদ্দের টানার উৎসাহের থেকে বাক্সের উপরে রাখা নরুন দিয়ে নিজের কল্পনায় আনমনে গাছের গা কুঁদে নতুন শরীর তৈরি করতেই তাঁর বেশী মজা। ক্ষৌরকর্ম নয় কুমোরপাড়ায় অনন্ত জ্যাঠার মূর্তি গড়া দেখতেই তাঁর আনন্দ। জাত ব্যবসার ক্ষুর কাঁচি ফেলে তাই পড়শি অনন্ত জ্যাঠার দাওয়ায় পড়ে থাকত কিশোর কিঙ্কর। এই কাজ দেখতে দেখতেই ওঁর ভেতরে ভেতরে আন্দোলিত হতে থাকে মূর্তি গড়ার এক প্রক্রিয়া। শেষ পর্যন্ত রামানন্দ বাবুর চোখে পড়ে শান্তিনিকেতন চলে আসা, নন্দলাল বসুর সামীপ্য এসব আজ ইতিহাস।
‘সাঁওতাল পরিবার’ নিয়ে চারিদিকে হৈ হৈ পড়ে যাওয়ার পর কিঙ্করকে এখন সবাই ভারতবর্ষের অন্যতম একজন ভাস্করের মান্যতা দিতে শুরু করেছে। কিঙ্কর কাজের একটা দিশাও পেয়ে গেছে। সিমেন্ট কংক্রিট এখন চেনা মাধ্যম, আউটডোরের জন্য শান্তিনিকেতনের এই আর্থিক পরিস্থিতিতে যাকে বলে ‘সস্তায় পুষ্টিকর’। পরিবেশের সাথে খাপও খায় বেশ এই ঘরানা। এতে অবশ্য শ্রম আছে কোন সন্দেহ নেই; একটা মজা যে আছে সেটাও তো অস্বীকার করা যায় না। সে মজা সৃষ্টির মজা, এই মজা যখন জমতে থাকে স্রষ্টাকে তখন নেশায় চেপে ধরে এত এক ধ্রুব সত্য। রামকিঙ্কর তাই আবার মেতে উঠলেন। আর একটা কাজ করে ফেলতে হয়। কিন্তু বিষয় ভাবনা? পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে থাকা গাঁ গঞ্জের খেটে-খাওয়া মানুষ বারে বারে এসেছে তাঁর কাজে। সাঁওতালরা তো রামকিঙ্করকে যেন কিছুতেই ছাড়তে চায়না। সাঁওতাল শিশুর পশুশাবকের মত অকৃত্রিম পুষ্টি, সোমত্ত পুরুষের পেশি আর সাঁওতাল নারীর অংশক যৌবনের সাথে সাথে বাঁকুড়া বীরভূমের রুক্ষ প্রকৃতির আকর্ষণ রামকিঙ্করের রক্তের ভেতর মিশে গিয়েছিল। এর প্রভাব তাই বার বার এসেছে ওঁর কাজে। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল গুরুদেবের দেওয়া খুশীমত কাজ করার স্বাধীনতা আর বেদমন্ত্র ‘‘রাতের স্বপ্নগুলোকে মনে রাখবি কিঙ্কর। স্বপ্নে ছবি আসে, প্রতিমা আসে। তেমন হলে, স্বপ্ন ভেঙে গেলে, উঠে স্বপ্নের কথা লিখে রাখবি। স্বপ্ন আঁকবি, স্বপ্ন ভাস্কর্য বানাবি ভুলে যাবিনা না। এভাবেই তাই কিঙ্করের কাজগুলিতে মিশে যায় স্বপ্ন আর বাস্তবতা। সত্যের বিমূর্তে মিলেমিশে থাকা সব সৃষ্টি। তাই তো রামকিঙ্কর আজও ভারতীয় ভাস্কর্যের এক উজ্জ্বল জোতিষ্ক। রামকিঙ্করের অনুভবে- ‘স্কাল্পচারে খোদাইয়ের কাজে ছেনির প্রত্যেক ঘাকে মিনিংফুল হতে হয়। মুছে ফেলে আরম্ভ করবে, উটি হবে না হে। মেটিরিয়ালের সঙ্গে লড়াইয়ে দারুণ স্ট্রেন। ভুল করেছো কি কাজটাই নষ্ট।’ ১৯৫৮ সালে সেই সিমেন্ট কংক্রিটেই আর এক স্বপ্ন আঁকলেন গল্প করলেন সাঁওতাল রমণীদের এক বিকাশের গল্প “কলের বাঁশি”। সময়ের সাথে সাথে তারা এখন ধানকলে কাজ করে। সেই কারখানার বাঁশি শুনে কাজে ছুটে চলেছে ওরা, বাঁশি হাতে পিছু নিয়েছে এক দেবশিশু। বাতাসের বিপরীতে ছুটছে দুই সাঁওতাল যুবতী, উড়ছে আঁচল, পায়ে পায়ে ধুলো। পিছনে একটি ছেলে ছুটতে ছুটতে হাতের বাঁশিটা দিয়ে উড়ন্ত আঁচলটা আগলে ধরার চেষ্টা করছে। যাওয়ার পথে তারা ভেজা কাপড় উড়িয়ে শুকিয়ে নিচ্ছেন যেন। এ যেন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বার এক মুক্তির আনন্দ। একজনের দৃষ্টি সামনে আর একজনের পেছনে। বাঁকানো ঘাড়ে ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট ছাপ। ধানকলের বাঁশির ডাকে তারা যেন বাঁধন হারা ঝঞ্ঝা। নিরেট কংক্রিটের কোনায় কোনায় যেন ঝড়ের ছন্দ। তাই এই মূর্তির নাম প্রথমে রেখেছিলেন ‘ঝড়’। নিভৃত আলাপচারিতায় রামকিঙ্কর বলতেন, ‘এই কাজ করে খুব আনন্দ পেয়েছি হে। রোজ ঘরে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় বেশ এক চোট বাঁশি বাজাতাম মনের খুশীতে। মাষ্টারমশাই আসেন কাজ দেখেন প্রতিদিন। একদিন যাবার সময় বলেই ফেললেন দুটো ফিগারের মুখ সামনের দিকে না রেখে একটার মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারনা? আমারও মনে ধরল কথাটা। দিলাম ঘুরিয়ে। কাজের মাত্রাটাই বদলে গেল। ওই যে উড়ন্ত শাড়ির ফোল্ডগুলি, ভার জানো? ওর মধ্যে কতটা লোহা আর কংক্রিট ভাবো দেখি? ছবিতে এই সব ঝামেলা নেই।’
কাজটা দাঁড় করাতে গিয়ে উনি খুব নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন। কোন সাপোর্ট না দিয়ে ফোল্ডগুলি কিছুতেই রাখতে পারছিলেন না। অথচ সাপোর্ট দিলে ভাস্কর্যটায় আর প্রাণ থাকেনা। ভাবনাটাই পাল্টে যায়। আবার সেই স্রোতের পাঁকে আটকে যাওয়া। কি করা যায় কি করা যায় ভাবতে ভাবতে ছেলেটাকে সাপোর্ট হিসেবে জুড়ে দিলেন। হাতে জুড়ে দিলেন সেই টিপার বাঁশি । হয়ে গেল মা সন্তান মায়া সব জড়িয়ে নিয়ে একটা পূর্ণতা। জন্ম নিল শান্তিনিকেতনে রামকিঙ্করের আর এক অধরা কীর্তি-‘কলের বাঁশি’।।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴