বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং-৩/রূপন সরকার
বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং /পর্ব - ৩
ড. রূপন সরকার
---------------------------------------------
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিগ্রহণের পূর্বে দার্জিলিং ছিল সিকিম রাজার অধীনে এবং সংস্কৃতির দিক থেকে অঞ্চলটির সাথে তিব্বত ও ভুটানের অনেকটা মিল ছিল। সমগ্র অষ্টাদশ শতক ধরে নেপালের গোর্খা সৈন্যরা দফায় দফায় এই অঞ্চলে হামলা চালায়। এই হামলায় সিকিম প্রতিবারই পরাস্ত হয়েছে। নেপালরাজ পৃথ্বীনারায়ণের সময়কালে গোর্খা নৃপতি নিজ বাহুবলে এতদঞ্চল দখল করে নেয়। ফলে উত্তরের হিমালয় প্রান্তে তিব্বত ও চীন রাজ্যের কিছু অংশ এবং দক্ষিণে ত্রিহুত ও সারন জেলা পর্যন্ত স্থান নেপালের অধিকারে আসে।
ইতিমধ্যে ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভ করে কোম্পানি বাংলা-বিহার ও ওড়িষা রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। সিকিম রাজ্যহারা হয়ে কোম্পানির শরণাপন্ন হয়। ইংরেজরাও এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিতে কালবিলম্ব করেনি। এই সময়কাল থেকে তরাই-ডুয়ার্সের প্রতি নানা কারণে ব্রিটিশদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তাই সুযোগ পেয়েই কোম্পানি নেপাল ও সিকিম রাজ্যের বিরোধের মধ্যে ঢুকে পরে। অন্যদিকে, রাজ্যের সীমানা ও বাণিজ্য নিয়ে ১৮১৪ সাল থেকেই নেপালের সাথে কোম্পানির বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষের পরিণতিতেই পরাজিত গোর্খারাজ ১৮১৬ সালে সগৌলির চুক্তি স্বাক্ষরের বাধ্য হন। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নেপাল দার্জিলিং সহ মেচী নদীর পূর্বাংশ এবং তিস্তা নদীর পশ্চিমাংশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়। নেপাল থেকে প্রাপ্ত ভূখন্ড ১৮১৭ সালে তেতুলিয়া চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি সিকিম রাজাকে হস্তান্তরিত করে এই শর্তে যে, ভবিষ্যতে সিকিম রাজা গোর্খাদের প্রতি কোন শত্রুতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করবে না এবং উভয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে সিকিমরাজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যস্ততা প্রার্থনা করবেন। এই চুক্তির পর থেকেই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও সিকিম রাজের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হয়, পরবর্তীতে যা উভয়ের জন্যই লাভজনক প্রমাণিত হয়। এর প্রায় ১০ বছর পর ১৮২৮ সালে সিকিমরাজ এবং নেপালের মধ্যে পুণরায় সংঘর্ষ দেখা দেয়। তেতুলিয়া চুক্তির শর্ত অনুযয়ী কোম্পানির কাছে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আসে। কোম্পানি ক্যাপ্টেন জর্জ উইলিয়াম, এলমার লয়েড এবং মালদা জেলার তৎকালিক কমার্শিয়াল রেসিডেন্সি মিঃ গ্রান্টের ওপর বিষয়টি নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেয়। ক্যাপ্টেন লয়েড ও জে. ডাব্লিউ. গ্রান্ট সিকিমের কুলহাইট উপত্যকার রিনচিংটং পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং ১৮২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টানা ছয় দিন গোর্খাদের পুরনো জনবসতি দার্জিলিং-এর ঘুমে অবস্থান করেন এবং উক্ত বিবাদের মীমাংসা করেন। এই সময়কালেই দার্জিলিং-এর ওপর মিঃ গ্রান্ট ও লয়েড সাহেবের নজর পড়ে এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার আশ্চর্য ঐশ্বরিক সৌন্দর্য তাদের মুগ্ধ করে। তাঁরা দুজনেই দার্জিলিং-এর প্রতি এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন যে কোলকাতায় ফিরেই কোম্পানিকে দার্জিলিং অধিগ্রহণ ও স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴