বাগানিয়া জার্নাল
পর্ব।।তিন।।
শিশির রায়নাথ
*******************
চিনাদের
একচেটিয়া চা-ব্যবসার হাত থেকে থেকে মুক্তি পাবার জন্য ১৭৭৮ সালে বৃটিশ
উদ্ভিদ বিজ্ঞানী জোসেপ ব্যাঙ্কস ভারতে চা-চাষের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
১৭৮০
সালে রবার্ট কিড চিনের ক্যান্টন থেকে চোরাপথে চায়ের বীজ এনে কলকাতায়
লাগিয়ে গাছ জন্মানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হল না। সেসময়ে আসামের দেশী চা
গাছের খবর বৃটিশদের কাছে ছিল না। এমনকি আসামও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে
ছিল না। তাই চিনা চা গাছ লাগানোর জন্য বিহার এবং কুচবিহারকে উপযুক্ত বলে
মনে করা হয়েছিল।
রবার্ট
ব্রুসের অনুসন্ধানের পথ ধরে শেষ অবধি আসামের চাবুয়ায় দেশীয় চা গাছের
(এ্যাসামিকা) ভিত্তিতে প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান জন্ম নিল।প্রথম ভারতীয়
দেশজ চা নিলাম হল লন্ডনে ১৮৩৯ সালে।এবং তা খুব বড় সাফল্য পেল।
তারপর
আসামে একে একে অনেক চা বাগানের জন্ম হতে লাগল।ইতিমধ্যে আসামের সাদিয়া এবং
আরও অন্য জায়গায় জংলী দেশী চা গাছের খোঁজ পাওয়া যেতে লাগল।এমন কি
কাছাড়েও।চা চাষ ছড়িয়ে পড়ল ত্রিপুরা, সিলেট, চট্টগ্রামে।
কিন্তু চিনা চা গাছ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা তখনও চলছিল।
লন্ডনের
হর্টিকালচারাল সোসাইটির হয়ে রবার্ট ফরচুন বলে এক ভদ্রলোক চিনে প্রায় আড়াই
বছর কাজ করেছিলেন। তিনি নানা উপায়ে চিন থেকে চায়ের বীজ আর চারা চোরাপথে
পাঠাচ্ছিলেন ভারতে। কলকাতার পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর বোটানিকাল
গার্ডেন, কুমায়ন,কুলু এবং গাড়োয়াল হিমালয়ে সেসব চারা গাছ লাগিয়ে
পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিলই।
সে
সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে জঙ্গল মোড়া দার্জিলিং পাহাড়কে বৃটিশদের
গ্রীষ্মাবাস তৈরির কাজে নিযুক্ত ছিলেন সিভিল সার্জেন ড. আর্চিবল্ড
ক্যাম্পবেল।দার্জিলিঙ-এ ক্যামেলিয়া ফুলের প্রাচুর্য দেখে ক্যাম্পবেল সাহেব
কুমায়ুন থেকে চায়ের বীজ এনে ক্লকটাওয়ারের নীচে তার বাংলোর চারিদিকে (যা
‘বিচউড গার্ডেন’ নামে পরিচিত) এবং জলাপাহাড়ে পরীক্ষামূলক ভাবে
লাগালেন(১৮৪১)। সে জায়গার উচ্চতা ছিল প্রায় সাত হাজার ফুট।শীতকালে ফ্রস্ট
আর বরফ এবং বসন্ত কালের শিলাবৃষ্টিতে সে সব গাছ বাড়তে পারল না ঠিকমতো –
নষ্টই হয়ে গেল।
এরপর, ১৮৪৬
সালে, মেজর ক্রোমেলিন (Major Crommelin) দার্জিলিং থেকে প্রায় একহাজার ফুট
নীচে লেবং-এ চিনা চায়ের চারা লাগালেন এবং সেখানে তা খুব ভালো ভাবে বাড়তে
লাগল।রেকর্ড বলছে সে সব চা গাছ প্রায় কুড়ি ফুট লম্বা হয়েছিল। সেখানে আসাম
চায়ের চারা লাগালে তাও বেঁচে গেল কিন্তু চিনা চায়ের মত অত হৃষ্টপুষ্ট হল
না।বোঝা গেল দার্জিলিং চা চাষের এক আদর্শ জায়গা এবং এর উচ্চতা আর ঠান্ডার
বিচারে চিনে চা গাছই উপযুক্ত । আর আসাম চা গাছের জন্য লাগবে অপেক্ষাকৃত গরম
ও ভেজা ভেজা অঞ্চল।
অবশেষে দার্জিলিং-এর তাকভর,
আলুবাড়ি আর স্টেইন্থাল-এ চিনা চা গাছ দিয়ে শুরু হল চা চাষ(১৮৫২)।তখন চায়ের
বীজ থেকে চারা তৈরি করে লাগানো হত। এই বাগানগুলোতে যত চারা লাগানো হয়েছিল
সবই তৈরি করা হয়েছিল তৎকালীন সরকারী নার্সারিতে।১৮৫৬ সালে দার্জিলিং চা
বাণিজ্যিক ভাবে বাজারে এল।
তাকভর
চা বাগান তৈরি করেন ক্যাপ্টেন ম্যাসন(Captain Masson)। আলুবাড়ি চা বাগান
তৈরি করেন প্রাক্তন বৃটিশ ক্যাপ্টেন সিমলার (Simlar)- যার হাতে তৈরি
মকাইবাড়ি চা বাগানও।
স্টেইন্থাল চা বাগান তৈরি করেন
জোয়াকিম স্টোয়েক (Joachim Stoelke) নামে এক জার্মান ধর্মযাজক।স্টেইন্থাল-এ
চা বাগান করার জন্য তাঁকে সবাই ফাদার স্টেইন্থাল বলত।
১৮৫৪
সালে তিনি সিংতম(Singtom) অঞ্চলেও চা বাগান তৈরি করেন।ফাদারের ধারণা ছিল
সিংতম(Singtom) অঞ্চল সিংহদের বসবাসের আদর্শ জায়গা। তিনি প্রায়ই দার্জিলিং
শহর থেকে সেখানে যেতেন সিংহ খোঁজার জন্য। ফলে স্থানীয় লোকেরা সেখানকার চা
বাগানটার নাম সিংতম(Singtom) থেকে করে নিল ‘সিংতাম (Singtam)’ – যার মানে
সিংহদের আবাস।
কয়েক বছরের মধ্যেই দার্জিলিং-এ আর চা বাগান তৈরির জায়গা না থাকায় বৃটিশদের চোখ পড়ে তরাই অঞ্চলে।
জেমস
হোয়াইট তরাই-এর চাম্পটাতে (Champta –এখনকার চামটা) প্রথম চা বাগান তৈরি
করেন (১৮৬২)। এবং রিচার্ড হাউটন (Richard Haughton)-এর হাতে গজলডোবায়
(Gazalduba/ Gazeldubi/Gazilduba ) জন্ম নেয় ডুয়ার্সের প্রথম চা বাগান
(১৮৭৬ সালে। ডি.এইচ.সান্ডার্স-এর সেটেলমেন্ট রিপোর্ট অনুসারে ডুয়ার্সে চা
বাগানের পত্তন শুরু হয়েছিল ১৮৭৪-৭৫ সালে)।
১৮৪৮
সালের এক ‘ফিজিবিলিটি সার্ভে’ (feasibility survey)-তে দেখা গেল কাংড়া
অঞ্চল চিনা চা গাছের পক্ষে উপযুক্ত। ১৮৫২ সালে ড. জেমসনের তত্বাবধানে
কাংড়ার ধৌলাধা্র রেঞ্জের ঢালু পাহাড়ে চা গাছ রোপন করা হল। কিন্তু পালামপুর ও
ধর্মশালা ছাড়া অন্য জায়গায় সেসব সাফল্য পেল না। ফলে শুধু এই দুই জায়গাতেই
বাণিজ্যিক ভাবে চা বাগান চালু হল।
ওদিকে,
দক্ষিণভারতে, কেরালার নীলগিরি পাহাড়ে ড.ক্রিস্টি সেই ১৮৩২ সাল থেকেই
চেষ্টা করে যাচ্ছেন চিনা চা গাছ চাষ করার।উদ্ভিদবিজ্ঞানী জর্জ সামুয়েল
পেরোট্টেট (George Samuel Perrottet) তামিলনাড়ুর কেট্টিতে লাগালেন চিনা
চায়ের বীজ।সেখানে গাছ জন্মাল এবং বড় হল।
এইভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে অবশেষে ১৮৫৪ সালে জন্ম হল কুন্নুর চা বাগানের। ১৮৫৯ সালে কুলহাট্টিতে।
এখন
ভারতবর্ষে চা তৈরি হয় আসাম,পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরালা,ত্রিপুরা,
অরুণাচল প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, কর্নাটক, সিকিম,নাগাল্যান্ড, উত্তরাখন্ড,
মণিপু্র, মিজোরাম, মেঘালয়, বিহার এবং উড়িষ্যায়।
ওপরে
উল্লেখ করা প্রথম পর্যায়ের সবকটা চা বাগানই এখনও অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রেখেছে।
কোথাও কোথাও নাম পাল্টেছে কিন্তু মূল বাগানটা আছে – যেমন
ফুলবাড়ি(১৮৭৬),মানিহোপ(১৮৭৮) এবং পাতাবাড়ি (১৮৭৮)চা বাগানগুলো এখন লিশ
রিভার চা বাগানের ডিভিশান। বড় রিংটং চা বাগান হয়েছে মার্গারেট হোপ, তাকভর
এখন পুট্টাবং, শাওগাঁও হয়েছে সোনালী, রূপালী আজ রাজা চা বাগান ইত্যাদি...
কিন্তু
ডুয়ার্সের প্রথম চা বাগান গজলডোবা্র কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।অনেকে বলেন
তিস্তার বন্যায় তা ধুয়েমুছে গ্যাছে। কিন্তু ধ্বংস হয়ে গেলেও তার কিছু না
কিছু উল্লেখ কোথাও না কোথাও পাওয়া যাওয়ার কথা। শুধু ১৯১১-র EASTERN BENGAL
AND ASSAM DISTRICT GAZETTEERS বলছে ‘পশ্চিম ডুয়ার্সের পশ্চিমে’ অর্থাৎ
তিস্তার পূর্ব পারে ছিল এর অবস্থান এবং ১৯০২ সালের ভয়াবহ বন্যায় খোদ
গজলডোবা অঞ্চলের কোন ক্ষতি হয় নি – ক্ষতি হয়েছিল তার নীচের অঞ্চল দোমহনি,
মন্ডলঘাট ইত্যাদি। তাই সে বাগানটা যে কোথায় গেল সে রহস্য রয়েই গেল...
-----------------------------------------------------------
ছবিঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে....