পইলা সাঞ্ঝির কথা/৩
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৩
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
বতোর
~~~~
ঘুম থেকে উঠে মুখে জলটুকু দিয়েই কান্তেশ্বর ছুটল হালের খোঁজে। বিছন ধানের চারা বেরিয়ে গেছে আজকেই না ফেলতে পারলে সমস্যা হবে। কয়েকদিন থেকেই হালের চেষ্টা চলছে, কিন্তু বুধারুর বাপ কথা দিয়েও আসতে পারেনি, বাঁ দিকের গরুটার পা কেটে গেছে, লাঙলের ফলায়। বুধারুর ছেলে সকালে খাবার নিয়ে গেছে। বাবাকে খেতে দিয়ে ইচ্ছে হয়েছে একটু হালের মুঠি ধরাটা শেখে, কিন্তু কাজের চেয়ে উলটে বিপদ বাঁধিয়ে রেখেছে। এখন ওই গরু তো চলবে না, হালও বসা, হালুয়াও বসা। এদিকে কান্তেশ্বরও মুস্কিলে পড়ল। কান্তেশ্বর তবু একবার গিয়ে দেখল গরুর পায়ে তেল-হলুদ গরম করে লাগিয়ে বেঁধে রেখেছে।
কান্তেশ্বর বেরিয়ে গেলে বসমতী ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরপর আবার বিছন ধানগুলো বের করে দেখে নিতে হবে। নানা জাতের বিছন ধান নানাভাবে রাখা। কোনোটা লাউয়ের বসে, কোনোটা খলুইয়ে, হাঁড়ি-পাতিল সবখানে ভাগ ভাগ করে রাখা। উত্তর দিকে ঠাকুর ঘর, তারই একপাশে বিছন ধান, খাওয়ার ধান ভাগে ভাগে রাখা। আর কয়েকদিনের মধ্যেই উঠবে বিতিরি ধান বা ভাদোই। আহা! বিতিরি ধানের চিঁড়া দিয়ে মাছের কাঠখোলা! বড় বড় পুঁটি মাছের কাঠখোলার স্বাদই আলাদা! বিছনগুলো বের করে করে দেখতে থাকে বসমতী, এমন সময় পেছনে দিদি ডাক শুনে ঘুরে তাকায়। বিষাদুর মা।
"কেনে মাই, কোনো কবু? ছাওয়া একটা বুকুনি বান্দি নিয়া এইখান আস্তা আচ্চিস যে!"
বিষাদুর মা বিষাদুকে নামিয়ে উঠোনে দাঁড়ায়। তারপর একটু যেন থমকায়, ইতস্ততঃ করে বলে - "দুধকলমের বিছন থুসিস দি?" তারপর টেনে টেনে হতাশ গলায় বলে "মুইও না থুসুং, কিন্তুক মইদ্যতে কেমন আকাল খান গেইল, বাউর বাপক আমাশা ধরিল, কাজে করির না পায়, সেলা দুধকলম আর যশোয়া ধানকয়টা উসি দিলুং। তাও কুলায় না, ফাগুন-চৈত মাসখানোত মুই চিনা ঘাসের বিচি আনি খালুং।" একটু থেমে দুঃখী দুঃখী গলায় বলে, "ওই তো এলা বোলে মোরে দোষ, মাছ মারায় আর কি করিবে, খোলোই ধরায় হইল আসল।" বসমতী বিষাদুর মার দুঃখটা বুঝতে পারে। তারপর গলা তুলে বলে, "কেনে তে মন্তেশ্বর কোটে গেইল, বিছন নাগেতে উয়ায় উয়ার দাদাক কোবার না পাইল।" বিষাদুর মায়ের মুখে এবার হাসি ফোটে, বসমতীর কথায় বুঝতে পারে খালি হাতে ফিরতে হবে না। লাজুক হেসে বলে, "ওই তো দাদাক খানেক ভয় করে, সাকাল থাকি মোকে কয়, দিদিট্টে যা, দিদি এলায় না কবার পাবে না। কছে বোলে নয়া ধান উঠিলে সেলা দিয়া যাবে আসিয়া।" বসমতী হেসে বলে, "না নাগে দিবার, হামার যতলা বিছন ফেলামু অতলা নাগিবে না, ওঠে থাকিয়ায় তুলি নিগাইস।"
একটু বেলা করে হলেও হাল পেল কান্তেশ্বর। বুধেশ্বর কাজে গিয়ে ফিরে এসে বাড়িতেই পান্তা খেয়ে টেপাই বানাবে ঠিক করেছে। হাতের কাজ ভালো জানে বুধেশ্বর। টেপাই, ধোরকা, ঠুসি অনেক কিছু হাতেই বানিয়ে ভান্ডানি হাটে বিক্রি করে। এসব হাতের কাজ ও শিখেছে হ্যাবেশ্বর মৌসার কাছে। হ্যাবেশ্বর মৌসা হাতেই বাঁশ দিয়ে বসার চৌকি, আরো নানারকম সংসারী জিনিসপত্র বানায়। এ পাড়ায় হ্যাবেশ্বর মৌসা আর গোড়াই মৌসার বাঁশের কাজ কি দড়ি পাকানো সব থেকে ভালো। মনে মনে এসবই ভাবছে, এমন সময় কান্তেশ্বর গিয়ে হাজির। বুধেশ্বর আমতা আমতা করে, "এলানি হাল ধরি গেইলে তোর পোষাবে কাকা। সোগারে একটা করি কাণি বোওয়া হয়া গেইসে।" কান্তেশ্বর বলে, "মোর ধানের গাজা বড় হয়া গেইল বাপোই, আজি ফেলেবার নাগিবেকে। তুই ব্যাদেঙ্গের পুবত মোর জমিখানত হাল নাগা যায়া। মুই চাইট্টা খায়া তোর কাকিক কয়া আইসোছং।" হালের সমস্যা এক প্রকার মিটলে কান্তেশ্বর খুশিই হয়। ওই একটা জমিতেই ভাগে ভাগে দুধকলম, খারমা, পানাতি আর পাকিরি। আজকে এটা ফেলা হয়ে গেলে জমি তৈরি করে কালকে আর একটা জমি তৈরি করে ফেলবে। এর মধ্যেই আবার কবে যেন আমাতি লাগবে, তখন তো জমির কাজ সব বন্ধ। অবশ্য জমি আগে চাষ দিয়ে ফেলে রাখা আছে, আজকে ভালো করে মই টই দিয়ে বিছন ছিটাবে।
বাড়ির পথে দেখা হয়ে গেল নরেশ কাকার সঙ্গে, বুড়ো হলেও শরীরের বাঁধুনি ভালো। এখনও টান টান চেহারা। ওকে দেখেই থমকায়। "তোমারে বাড়ি যাছং বাপোই। তোর চাইট্টা অগনঢেপী আর কালা নুনিয়ার পোনোচ থাকিলে দে তো। তোর কাকি কছে কান্তেশ্বর কইচ্চে আরবার, বাউক কয়া চাইট্টা আনেক। ধান উঠিলে সেলা বেশিবাসায় দিমু। হামরা এইলা ধান করি না, এইবার আরো তোর কাকির কোটে থাকি শখ হইল, গারিবে।" কান্তেশ্বর না করে না। এই সময় হয় এরকম। অনেকেই প্রতিবছর যে ধান বোনে ওটাই করে, আবার কেউ কেউ পালটে পালটে করে। কারো বেশি জমি থাকলে সব ধানই বোনে বছর বছর বীজধান রেখে দেবার জন্য। যেটাকে ধানের পোনোচ বলে। ধান কি আর এক প্রকার! মাঠে গেলে বোঝা যায় কত রকমের ধান বোনা হয়। বন্নি, নুনিয়া, ভোগ ধান, পানাতি, পাকিরি, যশোয়া, বোছি, সাইলোন বা ঢেপী, অগনধেপী, খারমা আরো যে কতরকম ধান পৃথিবীতে আছে! কান্তেশ্বর ভাবে। এই তো ঘরে ঘরে বিতিরি ধান উঠবে আর কয়দিন পরে, সেও কি এক রকম? এক এক জন একেক রকম ধান বুনেছে। বিতিরি ধান অবশ্য জমিতে রোয়া করে বুনে না, জমির উপর ছিটায়। তা সে ধানও নানারকম। এরি, জয়া, কাতার, পুষা, পায়জাম, দেশি পায়জাম, ভাদোই। বোনাতেও রকমফের কত। বিতিরি ধানের মধ্যে একটু আগে ওঠে কালো ভাদোই, যেটাকে কালা ডুমরা বলে। একটু বেশি সময় নিয়ে যেটা ওটার আবার লোকমুখে নাম কাশিয়াবান্ধা। এরি ধান উঠতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে, প্রায় ছয় মাস। ধান বোনা এবং কাটার সময়েও অনেক হেরফের। পুরোনো মানুষেরা জানে ধানের জাত-বিচার। কান্তেশ্বর আর কতটুকু জানে! মুখে বলে, "ধান না আছে বাহে, চল তোমার বৌমাট্টে।"
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে নরেশকাকাকে জিজ্ঞেস করে, "কাকা নিচা জাগালা কি এইবারও নমলা গারিবেন বাহে, না দো গোছি করিবেন?" নরেশকাকা একটু জোরে কথা বলতে ভালোবাসে। বলে, "বাড়ির বগলেরগিলা নমলায় গারিম বাহে, আর দোলার গিলা দো গোছি গারির নাগিবে। ওঠে নমলা করিলে ওসুবিধা আছে, সোগারে ধান কাটা হয়া গেইলে মোরখানে পড়ি নবে নাতেন। আগা বতোরে তো গারায় যাবে না, যে জল ফান্দে। গছ পচি যাবে। আর বাড়ির বগলেরগিলা নমলা গারিম, ভাদোরের পোনোরো তারিক পোযোন্ত তো বতোর আছে। তার পাছোত বোলান গারিয়া এইবারকার মতোন শ্যাষ। দিবার নাইগবে গারাইয়াগিলাক একেনা হাত উঠানি খাওয়া, ওখিনায় আবদার করে এলা!"
উঠোনে দাঁড়িয়েই নরেশ হাঁক পাড়ে, "বৌমা, কোটে বারে, বুড়াটা আসিল। তোমার বেটিক দেও, ধরি যাং, মুই হাল ধরি যাইম, ভাত আন্দি দিবে, তোমার মাও আর না পায়।" বসমতী তাড়াতাড়ি পিঁড়ি পেতে দিয়ে বলে, "বোইসো বাবা। চা খাও।" নরেশ অবশ্য বসে না, বিছনের কথাটুকু বলেই বিদায় হয়। যাওয়ার আগে আর একবার বলতে বলতে যায়, এরপরের বার নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে, বৌমা যেন মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। বসমতী স্মিত্মুখে বুড়োটার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মাঠে গেলে এখন শুধু হালুয়ার গলার শব্দ আর জলের খলখল আওয়াজ। উঠ উঠ, বইস বইস, ডাইনে- ডাইনে তো আর একবার বাঁয়ে বাঁয়ে। কখনও আবার হালুয়ার গলায় মৃদু ধমক খেলা করে প্রশ্রয়ের ভঙ্গীতে। "কি! ঘুর ঘুর ঘুর!" মাঠের এক কোণে দাঁড়ালে গোটা মাঠটাই ভেসে ওঠে চোখে আর তার বহু বিচিত্র শব্দরাজি। যেন নতুন প্রাণের সাড়া পড়ে গেছে সবখানে। ভালো লাগে আবহমানের এই চেনা সুর, চেনা ছন্দে নিজেকে মেলাতে। এক আনন্দ ছুঁয়ে যায় অলক্ষ্যে।
-------------------------------------------------------------
বতোর - ধান বোনার উপযুক্ত সময়কালটিকে বতোর বলে।
লাউয়ের বস - শুকিয়ে নেওয়া লাউয়ের শক্ত খোল।
কাঠখোলা - আঁশসহ বড় বড় পুঁটি মাছ ভালো করে ধুয়ে গোটা অবস্থাতেই লোহার কড়াইয়ের শুকনো খোলায় এপিঠ ওপিঠ করে সেদ্ধ করে নেওয়া।
বুকুনি বান্দি - কাপড় দিয়ে বাচ্চাকে বুকে বেঁধে নেওয়া।
এলানি - এত দেরি তে।
আমাতি - অম্বুবাচী।
বাহে - বাবা হে -র সংক্ষিপ্ত রূপ।
নমোলা - একটু দেরিতে বোনা।
হাত উঠানি খাওয়া - এটা মূলত হাওয়ালি বা স্বেচ্ছা শ্রমের ক্ষেত্রে হলেও কোনো কোনো গৃহস্থ যাদের দিয়ে জমির সব ধান বুনে নেয় শেষদিন তাদের জন্য একটা মাংসভাত খাওয়ার আয়োজন করে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴