দাঁড়াবার জায়গা/পর্ব-তিন
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
পাড়ার
ক্লাবে ঘাঁটি গেড়েছে এসএসবি জওয়ানরা। অনেকেই আড়ালে তাদের বলছে ‘গোঁফারু
পুলিশ’! তাদের সকলেরই যে নজরে পড়ার মতো গোঁফ আছে সেটা সত্য। তাদের কেউ কেউ
বাঁহাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে প্রায়ই সেই গোঁফের প্রান্ত মুচড়ে
মুচড়ে ধারালো করে ফেলেছে এবং তারপরও নিস্তার নেই, প্রতিদিন প্রতি
মুহূর্তেই তারা নিজেদের গোঁফ মুচড়ে চলেছে। কেন তারা এমন করে জানি না। এই
পরিণত বয়সেও অনেক দেখেছি, একাংশ নিরাপত্তা কর্মী এরকম করে থাকে। কিন্তু এটা
তো তাদের পেশার সঙ্গে বাধ্যতামূলক কোনো কাজ নয়। হতে পারে, গোঁফ মোচড়ানোর
প্রক্রিয়ায় এক ধরনের শক্তি প্রদর্শনের সম্পর্ক আছে। বলিউড এবং দক্ষিণের
কিছু ছবিতে সেটা দেখেছি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিজেদের আলাদা করতেই কি তারা
এমন করে? অথবা, গোঁফ মুচড়ে তারা সমাজের বাকি অংশটিকে কি প্রচ্ছন্ন হুমকি
দিতে আগ্রহী? হতে পারে, তাদের ওরকম করতে দেখে অপরাধীরা আতঙ্কিত হয়ে থাকে।
তবে, নিশ্চিত করে কে বলতে পারে! কিন্তু, সেই দূর শৈশবে দেখা ‘গোফারু পুলিশ’
আমাদের স্মৃতিতে চিরজাগরুক হয়ে থাকে। তাদের অনেকেই খুব হেসে হেসে আমাদের
সঙ্গে কথা বলতো। অনেকে আমাদের নামেই চিনতো। কেউ কেউ আমাদের বিদ্যেবুদ্ধির
বহর যাচাই করতে নানা প্রশ্ন করতো। আমরা খুব উপভোগ করতাম তাদের সঙ্গ। পাড়ার
ছেলেদের তারা নানা শারীরিক কসরত শেখাতো। পরে, কবে যেন তারা পাততাড়ি
গুটিয়ে চলে যায়। তখন ক্লাবের মাঠটা হঠাৎ শূন্য হয়ে পড়েছিলো। স্কুল থেকে
ফেরার পথে ক্লাবের সামনে দিয়ে আসতে বাধ্য হলেও সেদিকে তাকাতাম না। এসএসবি
জওয়ানদের চলে যাবার ঘটনা আমাদের কাছে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে যেন চিরবিচ্ছেদ।
ক্লাবের ফাঁকা মাঠের দিকে তাকাতে পারছিলাম না অনেকদিন। বুকটা কেমন হু হু
করে উঠত। কেন তারা কিছু না জানিয়ে চলে গেলো ভেবে খুব অভিমান হয়েছিল।
কিন্তু
এসএসবির তাঁবু যতদিন ছিল ততদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধও চলছিল,
স্পষ্ট মনে আছে। তবে, যুদ্ধ শেষেও তারা ক্লাবের মাঠে তাঁবুতে ছিলো কিনা মনে
পড়ে না। কিন্তু ভুলে যাবার প্রশ্নই নেই সেই মুহুর্মূহূ যুদ্ধ বিমানের নীল
আকাশ চিড়ে ফেলা। আকাশে তখন পাখি উড়তো না। গাছে কি নতুন পাতা গজাত? গাছে
গাছে রঙিন ফুল ফুটত কি? এতদিন পর সেকথা কে বলতে পারে! দেখতে দেখতে পাঁচটি
দশক কোথা দিয়ে যেন চলে গেছে নিরুদ্দেশে। মনে পড়ে সেইসব দেশছাড়া, ঘরছাড়া,
অভুক্ত মানুষের কথা। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি সেই সব হতভাগ্য ভিখিরি
পরিবারগুলো, তাদের তিলে তিলে মরে যাওয়া। যুদ্ধ শেষে এক স্বাধীন দেশের জন্ম
কিংবদন্তির মতো। তবু, দেশছাড়া, ঘরছাড়া মানুষগুলোর কথা কেই বা ভেবেছে! সেই
সব মানুষের এক বিরাট সংখ্যক আটের দশকের মাঝামাঝি নাগাদও ভিখিরির জীবন
কাটাতে বাধ্য হয়েছে। তারপর আর তাদের দেখা যেত না।
যুদ্ধের
সেই সব দিন বা রাতের যখন তখন সাইরেনের তীক্ষ্ণ বেজে ওঠা বুকে কাঁপন ধরিয়ে
দিতো। কারো কারো বাড়িতে রেডিওতে যুদ্ধের রুদ্ধশ্বাস বিবরণ। আমাদের বাড়িতে
রেডিও ছিলো না। পাশের বাড়িতে ছিল। আমরা সেখানে কান পেতে বড়দের সঙ্গেই
খবর শুনতাম। মনে আছে, ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল
বন্দ্যোপাধ্যায়’। সেই বিরল কণ্ঠের জাদু আমাদের মোহিত করে রাখতো। বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রায় সমস্ত তথ্যপাতিই অনেক পরে বই-পত্রপত্রিকা পড়ে
জানতে পেরেছি। কিন্তু যুদ্ধ যখন চলছে তখন তার সামান্য আভাস পেলেও বাস্তবের
যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলো না, ওই বয়সে সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু,
যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত নানা ঘটনা, সত্য-মিথ্যা-গুজব আমাদের কানে আসত। আর,
প্রতিবেশী দেশে যুদ্ধের স্বাভাবিক পরিণাম উদ্বাস্তুর স্রোত আমরা দেখতাম।
অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরও দেখেছি। আমার দেখার দৌড় বাড়ি থেকে স্কুল ও তার
আশপাশের সামান্য কয়েক গজ। অথচ, ওই সামান্য অভিজ্ঞতাও ছিলো ভয়াবহ। কত মৃত্যু
দেখেছি সেই সময়টায়। ক্ষুধার কুৎসিত চেহারা সেই প্রথম দেখেছি। স্রেফ না
খেয়ে অনেক মানুষের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া দেখেছি। রাস্তায় অনেক মানুষকে
ডায়েরিয়ায় মরতে দেখেছি। তারা কেউ শিশু, কেউ বৃদ্ধ, কেউ যুবা, কেউ মধ্যবয়সী
বা যুবতী নারী। সেই শত শত মানুষের মৃত্যু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে দেখা
মস্তিষ্কে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
সেই
সময়ে আমাদের পাড়ায় একটিই মাত্র পাকাবাড়ি ছিলো। সেই বাড়িতে থাকতো
মহাদেবদা। ফরসা, সুস্বাস্থ্য, সুপুরুষ চেহারা। মহাদেবদা প্রায়ই আমাদের
সঙ্গে দাড়িয়াবান্ধা বা হাডুডু খেলায় অংশ নিতো। তখন মনেই হতো না সে আমাদের
থেকে বয়সে অনেক, অনেক বড়। যতদূর মনে পড়ে, তার কোনো পেশা ছিল না। কিন্তু
তাই বলে তার জীবনযাপনে কোনো অভাবও ছিল না। সেই সময়ে আমাদের মাথায় এসব কিছুই
আসত না। অনেক পরে জেনেছি, সে পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে। তার পরিবারের
বাকি সকলেই তখনও পূর্ব পাকিস্তানেই আছে। তারপর, একদিন যুদ্ধ শুরু হলে ওপার
থেকে তাদের পুরো পরিবার এসে হাজির হল। মহাদেবদা যে বাড়িতে ভাড়া ছিলো
সেখানেই তারা এসে আশ্রয় নিল। বিরাট পরিবার। অন্তত দশ-বারোজন। পরিবারের
সকলেই আমাদের ‘বন্ধু’ হয়ে উঠল রাতারাতি। মহাদেবদার বোনেরা সব আমাদের থেকে
বেশ বড়। তারা আমাদের সঙ্গে খেলতো আবার আমার দিদিদের সঙ্গেও তাদের খুব
বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। এমন একটা পরিবেশ ছিলো তখন আমাদের সেই সময়ে যে
বন্ধুত্বের জন্য বয়স কোনো বাধা হয়ে থাকতো না। ফলে, মহাদেবদার পরিবারের
সকলেই আমাদের সকলের বন্ধু। তাদের মুখের ভাষা আমাদের খুব টানত। তারা সকলেই
খুব হাসিখুশি ছিল। কয়েক বছর আমরা তাদের পেয়েছিলাম। পরে, একটু একটু করে
তারাও হারিয়ে গেল। মহাদেবদার বোনগুলোর বিয়ে হয়ে গেল। তার আগে, শহরের
বাণিজ্যিক এলাকায় বিরাট একটা ওষুধের দোকান চালু করল ওরা। একদিন ওরা অন্য
কোথাও চলে গেলে আর যোগাযোগ ছিল না। অনেক বছর পরে, ম্যাগাজিন ছাপতে গিয়ে এক
প্রেসে হাজির হলে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলাম মহাদেবদার এক ভাই, কুটুদা,
রঞ্জিৎ দেবকে। মড়াপোড়া দীঘির পারে, ব্যাঙচাতরা রোডে সেই প্রেস। আমার
প্রথম কবিতার বই ‘যযাতি’ সেখানেই ছাপা। আটচল্লিশ পাতার বই ছাপতে দিয়েছিলাম।
ছাপা কতদূর, কেমন চলছে দেখতে গিয়ে শুনি কাজ হয়ে গেছে। বাকি আছে, প্রচ্ছদ
এবং বাঁধাই। খুব আগ্রহের সঙ্গে একটা একটা করে ছাপা পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
দেখতে থাকি। হঠাৎ আবিষ্কার করি, বানানের কোনো মা-বাপ নেই! আর, শেষের
পাতাগুলো হলুদ রঙে ছাপা! মাথায় তখন আগুন ছুটছে। ক্রোধে অন্ধ হয়ে রঞ্জিৎদার
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলি, তুমি তো সর্বনাশ করে ফেলেছো! রঞ্জিৎদা খ্যাক খ্যাক
করে হাসতে থাকে। বলে, ক্যান, কী হইছে? আমি বলি, প্রুফ দেখে দিলাম এত ভালো
করে, আর তুমি সংশোধন করালে না! রঞ্জিৎদার জবাব, অখন, তোমার কাছে বানান
শিখুম? আমি ক্ষিপ্ত হয়ে বলি, হলুদ রঙে ছেপেছো কেন? রঞ্জিৎদা বলে, ভালো
বইলাই তো করছি। কী সোন্দর হইছে, দ্যাখছো? আমি জানতে চাই, হঠাৎ হলুদ রং কেন?
সে বলে, বিয়ার চিঠি ছাপছিলাম তো। প্লেট পরিষ্কার করা হয় নাই। করা যাইতো,
কিন্তু কত লস হইতো, জানো? সব কালি ধুইয়া ফ্যালাইয়া তারপর করন লাগতো। তা,
আমি ভাবলাম, হলুদ কালিতে কইরা দেই, খুব সোন্দর হইবো’। আমার চোখে তখন গাঢ়
অন্ধকার। কী করবো বুঝতে পারছি না। কম্পোজিটার মেয়েটা জুলজুলে চোখে তাকিয়ে
তামাশা দেখছে। বাধ্য হয়ে বলি, যা করেছো তারপর আর বলার কিছু নেই। বাঁধাইয়ের
সময় শুধু কালো কালিতে ছাপাগুলোই রাখবে। একথা বলেও, আর ভরসা হচ্ছিল না। ফলে,
হলুদ কালিতে ছাপা কুড়ি পাতা নিজে হাতে তুলে নিয়ে চলে আসি। আমার প্রথম
কাব্যগ্রন্থের জন্মের এই দুঃখজনক ঘটনাটি মনে পড়লে এখন হাসিই পায়। মানুষ
কীরকম নির্বোধ হতে পারে ভেবে বরং শঙ্কিত হয়ে উঠি। নিজের লেখালিখি, প্রকাশ
আর বইপত্র নিয়ে অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা অনেক পরবর্তী ঘটনা বলেই পরেই বলা যাবে।
বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরের বছরই যদুবাবুর স্কুল থেকে বরাবরের মতো চলে আসি,
সেটা ১৯৭২ সাল। কিন্তু শিক্ষা জীবনের সূচনার সেই চার বছর আমার জীবনে স্থায়ী
ছাপ রেখে গেছে। কত আনন্দ-বেদনা, কত অশ্রু, কত সুখ, কত দুঃখ। ক্লাস ফোরে
পড়াকালেই একদিন লিখে ফেলেছিলাম প্রথম পদ্য! কবিতা নয়, পদ্য। কিন্তু ঘনিষ্ঠ
সকলের প্রশ্ন, নির্ভুল ছন্দে এমন পদ্য কী করে লেখা সম্ভব হলো? পরবর্তী
জীবনে কথাটা নিজেও বহুবার ভেবেছি। কেউ আমাকে সরাসরি কিছুই শেখায়নি এই তুচ্ছ
জীবনে। আমার সমস্ত দোষত্রুটি এবং কোনো গুণ যদি থেকে থাকে তার সমস্ত দায়
আমারই। আমার জীবনে বাস্তবিকই কোনো শিক্ষাগুরু বলে কিছু ছিলো না। তবে,
শিখেছি যা কিছু, সবই সেই পৌরাণিক চরিত্র একলব্যের মতো। নিজেই নিজের মতো
করে। ফলে, প্রচুর ভুল করেছি। রাস্তা চিনতে অনেক সময় লেগেছে। তবে, শেষ অবধি
পথ হারিয়ে ফেলিনি। অনন্ত কৌতূহলেই দিনরাত খুঁজে গেছি জীবন সম্পর্কিত সহস্র
প্রশ্ন। রাক্ষসের মতো সব ধরনের অক্ষর গিলে ফেলতে ফেলতে একদিন হাতে পেলাম
‘বিবর’। হাইস্কুলে যাবার আগেই পড়ে ফেলি সেই বই! কিছুই বুঝিনি এ যেমন সত্য,
তেমনিই কিছু অবশ্যই বুঝতে পেরেছি। বুঝতে পারিনি যা সেটা বয়সের দোষে, আর যা
কিছু বুঝেছি সেটা বয়সের তুলনায় অবশ্যই অনেক পরিণত করে দিয়েছে। কারণ,
স্কুলের শুরু থেকেই যেখানে যা পেয়েছি, নির্বিচারে গিলেছি। আর, এই গোগ্রাসী
পাঠের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল জীবনের সব ধরনের নিঃস্বতা। এখানে একটা কথা
বলে রাখি, পাড়ার ক্লাবে কিছু বই ছিল এবং সেখানে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল।
ক্লাস ফোরে থাকতেই তুলে নিয়েছিলাম ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’। এবং দীর্ঘদিন ধরে
পড়ে শেষও করেছি। মনে আছে একটা লাইন খুব ভালো লেগেছিলো, ‘চা বাগানের
কুলিদের রক্ত চা’! শৈশবেই পরিবারের সকলের সঙ্গে আমারও চায়ের অভ্যাস ছিল।
কিন্তু বিমল মিত্রের এই লেখার একটি বাক্য মাথায় এমন গেঁথে গিয়েছিল যে,
তারপর দীর্ঘকাল আর চা খাইনি। চা দেখলেই আমার রক্তের কথা মনে পড়ত।