সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
16-December,2022 - Friday ✍️ By- নীলাঞ্জন মিস্ত্রী 463

তিস্তাবাথান-৩

তিস্তা বাথান
 পর্ব : তিন
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
"""""""""""""""""""""

বাথানের আক্ষরিক অর্থ হল গোঠ, গোষ্ঠ, গো-শালা বা গবাদিপশু রাখবার স্থান। কিন্তু তিস্তাচরের এই বাথানগুলির সাথে মূলত মহিষের সম্পর্কই বিদ্যমান। তাই গোঠে বা বাথানে গরু কেন থাকে না সে প্রশ্ন  আজ উঠতেই পারে। আসলে গাভী বা গরুকে খোলা আকাশের নীচে সারারাত রাখা মুস্কিল। তাদের থাকবার জন্য ঘরের প্রয়োজন। যদি ধরা যায় বাথানে একশ’ গাভী বা গরু রাখা হবে এবং তার জন্য  বাথান  বাঁধতে হবে। এক্ষেত্রে কতগুলি ঘরের প্রয়োজন হবে সেকথা নিশ্চই পাঠকবর্গকে বলার অপেক্ষা রাখে না। ঠিক এ কারণেই তিস্তা চরের অস্থায়ী বাথানগুলিতে গাভী, গরু ও বাছুরের ঠাঁই হয়নি বলেই জানিয়েছেন মৈষাল বন্ধু ও বাথান মালিকেরা। আক্ষরিক অর্থে বাথান শব্দটি যা ব্যাখ্যা করে বাস্তবিকে তিস্তাচরের মহিষ বাথান ভিন্ন চরিত্রের।  যেটি বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে স্বাতন্ত্রের দাবি রাখে। এ বাথানের  মহিষের গলায় দড়ি থাকে না, এ মহিষ চড়ে বেড়ায় নদীর চরে, সারারাত কাটায় খোলা আকাশের নীচে, এ বাথানে মৈষাল থাকে, মৈষালের শোবার ঘর থাকে,  টংঘর থাকে, রান্নাঘর থাকে, মহিষ শাবকদের জন্য একটি আস্তানা থাকে আর থাকে বাথানের খুব কাছে নদীর জল। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো সুরক্ষার জন্য দুটি বা তিনটি বাথান সারিবদ্ধভাবে পাশাপাশি বাঁধা হলেও তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব রাখা হয়। তা না হলে বাথানে বাথানে মহিষের মধ্যে লড়াই বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সে লড়াই তুমুল লড়াই। মৈষাল বন্ধুদের থেকে জানা যায় - কোনো কোনো সময় সেই লড়াই চলত তিন-চার দিন ধরে।

পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের বাথান আর আজকের বাথানের মাঝে যে আকাশ-জমিন ফারাক রয়েছে সেকথা বলেছি আগেই। তিস্তার উজান নিকটবর্তী স্থানীয় মালিকদের বাথান ও ভাটি এলাকা থেকে আসা মালিকদের বাথানের কিছু মৌলিক চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে । দূরদেশ থেকে আসা মৈষালেরা বর্ষাশেষে আসতেন তিস্তাচরে আবার চলেও যেতেন বর্ষা শুরু হবার আগে আগেই। কিন্তু স্থানীয়  মৈষালেরা এক খুঁটেই প্রায় চার-পাঁচ বছর বাথান রেখে দিতেন সে সময়ে। হাতের নাগালেই তখন ছিল প্রচুর ঘাস। টোটুয়া, ঝাপসী, নেউসী, ক্যান্যা, বনুয়া নল, বনুয়া লঙ, নেউতি, হোগলা ,কাশিয়া(কাশ), মধুয়া, কোচলোত, ময়নায় ভরা ছিল চারপাশ। শ’য়ে শ’য়ে মহিষ দিন-রাত খেয়েও শেষ করতে পারত না এসব ঘাস। কিন্তু আজ আর দেখা নেই সেই সমস্ত চিরসবুজ ঐতিহ্যবাহী ঘাসের। বিলুপ্ত হয়েছে অধিকাংশই আর বাকি প্রজাতির ঘাসগুলিও বিলুপ্তপ্রায়। হোগলা পুড়িয়ে দেবার পর, কাশিয়া পুড়িয়ে দেবার পর তাদের গোড়া থেকে যে দু’একটি সবুজ পাতা নির্গত হয় তা খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে মহিষের দলকে। রুগ্ন থেকে রুগ্নতর, শীর্ণ থেকে শীর্ণকায় হয়ে হচ্ছে বাথানের মহিষেরা।  

বিগত কয়েক বছর থেকেই এলোমেলোভাবে বইছে তিস্তা। বর্তমান সময়ে তিস্তা তার গতিপথ বদলায় প্রতিনিয়ত। আজ এদিক দিয়ে বইছে তো কাল অন্যপ্রান্তে। কোনদিকে নদী ঢুকবে; কোন চরকে নদী ধাওয়া করবে আর কোন দিকে চর জাগবে সেটা মৈষাল বন্ধুরা তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারেন । একারণেই  তাদের প্রতিবছর বাথান সরাতে হয়। সেই এক খুঁটে পাঁচ বছর থাকার দিন শেষ। এছাড়াও তিস্তাবক্ষে আর এক প্রকার মহিষের দেখা মেলে,  তাকে বলে ‘থানবান্দা’ মহিষ। তাদের রক্ষনাবেক্ষণে থাকেন মালিক নিজেই। এমনি একটি খাটাল আজও রয়েছে তিস্তাচরে। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেই আঠারো-কুড়ি বছর থেকে অসীম শিকদার সামলে চলেছেন এই খাটাল । ‘থানবান্দা মহিষ’ বলার পেছনে কারণ হল এই যে, এই মহিষেরা চড়ে বেড়ায় না নদীর চরে চরে অথবা ঝোঁপ-ঝাড়-জঙ্গলে। পায়ে বেড়ি পড়িয়ে আটকে রাখা হয় তাদের দিন-রাত।

এবার আসি একটু অন্য প্রসঙ্গে। তিস্তা বাঁধ থেকে সেদিন বাইক নামিয়ে ঢুকে পড়ি তিস্তা বক্ষে। বাচ্চু মৈষালের বাথানের খোঁজে বেরিয়েছিলাম। একহাঁটু জলে ভরা তিস্তার একটি গতিধারা পেরিয়ে, হাজার হাজার একর ফসলের ক্ষেত পেরিয়ে, মাইলের পর মাইল চর পেরিয়ে অবশেষে বাইক থামাতে বাধ্য হলাম। সামনে তিস্তার আর একটি প্রবাহ। এ প্রবাহ বাইকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। গভীরতা ও দৈর্ঘ্য দু’টোই বেশি । কাছে পিঠে কোন নৌকাও নেই। নদী পেরিয়ে যাবার সাহস দেবার মতো লোকও নেই। চোরাবালির ভয় তো রয়েছেই। কিন্তু আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ - আজ দেখা করতেই হবে মৈষালবন্ধু বাচ্চু মূর্মুর সাথে। বাইক থামিয়ে কোথায় রাখব বুঝতে পারছিলাম না। চারিদিকেই বালি। তিস্তা ভাসা একটি কাঠ জোগার করে বালির উপর কোনমতে বাইক ষ্টান্ড করতে সক্ষম হলাম। পকেটের মানি ব্যাগ আর মোবাইল পিঠব্যাগে ভরে নিলাম। তিস্তাবুড়িকে প্রণাম করে আর খোয়াজ পীরকে সেলাম জানিয়ে নদীতে নেমে পড়ি। এই সংস্কার শিখেছি তিস্তাপারের মানুষদের কাছ থেকেই। নদী থেকে ধাধিনায় উঠেই রুক্ষ কাশিয়ার বন। সবুজের চিহ্নমাত্র নেই তাদের গায়ে। আধ কিলোমিটার এগোতেই মধ্যতিস্তার শন্ শন্ হাওয়া ভেদ করে কানে ভেসে এলো ঘন্টির আওয়াজ। বুঝতে বাকি রইল না যে একটু দূরেই মহিষের পাল চড়ে বেরাচ্ছে। মহিষের পালের সাথে যে একজন বা দু’জন মৈষালকে পাব-ই সে বিশ্বাস আমার ছিল। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে হাত থেকে। তাই এক মানুষ লম্বা শুষ্ক কাশবন সরিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করি। অবশেষে দেখা পাই দূরে এক মৈষাল বন্ধুর। জানিনা উনি বাচ্চু মূর্মু কিনা ? তবুও ‘ও-ও বাচ্চু দা, ও-ও বাচ্চু দা? থামো, থামো।’- বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকি । বেশ কয়েকবার ডাকবার পর উনি পেছন ফিরে তাকান। হাঁফাতে হাঁফাতে শেষ পর্যন্ত তার নাগাল পাই। না ভুল হয়নি। ভাগ্য সহায় ছিল। তিস্তাবুড়ি, খোয়াজ পীর নিরাশ করেনি বিন্দুমাত্র। মনে সংশয় কাটিয়ে বুঝতে পারি তিনিই বাচ্চু মূর্মু। তার সাথে বসে গল্প করার কোনো অবকাশ ছিল না। পায়ে চলতে চলতেই কথা চলতে লাগল। গল্পে মশগুল হওয়া বলতে আমরা যা বুঝি সেটা হচ্ছিল না মোটেই। চলমান এই সাক্ষাৎকারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাচ্চুদার তীক্ষ্ণ নজর কিন্তু ছিল মহিষের পালের দিকেই। এই বুঝি মহিষেরা ঢুকে পড়ে সারিবদ্ধ ফসলের ক্ষেতে।

বাচ্চুদার সাথে কিলোমিটার খানিক হেঁটে বর্তমানে কোথায় রয়েছি বুঝতে পারছিলাম না। বাইকের কাছে কি ভাবে পৌঁছাব সে চিন্তাটাও মাথায় ছিল না। এতটুকু হেঁটেই বুঝতে পারছিলাম কি অসাধারণ পরিশ্রম করতে হয় এখন মৈষাল ভাইদের। শুধুমাত্র ঘাসের জন্য মহিষদেরও হাঁটতে হয় মাইলের পর মাইল। অথচ বছর দশেক আগেও বাথানের উঠোনেই মিলে যেত প্রচুর ঘাস। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল। মহিষেরা এবার বাথানে ফিরবে। আমাকেও ফিরতে হবে ঘরে। ফিরে আসার আগে বাচ্চুদার কাছে কিছুটা আবদারের সুরেই একটি মৈষালী গান অথবা গানের দু-একটি লাইন শুনতে চাই। তিনি সে’রকম পাত্তা দিচ্ছিলেন না । দু-তিনবার একই কথা বলাতে বুঝলাম তিনি এবার বিরক্তবোধ করছেন। কিন্তু ঠিক তারপরই যে ঘটনাটুকু আমার চোখের সামনে সেদিন ঘটে গিয়েছিল, জানিনা কিভাবে তা অক্ষরে সাজিয়ে সবার সামনে তুলে ধরব।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri