ঢোলসানাই-৩/সুবীর সরকার
ঢোলসানাই/তৃতীয় পর্ব
সুবীর সরকার
""""""""''"''""""""""""""""""""""""
৭.
তার দেশ ছিল মধুপুর বাকলা গ্রাম।
উলিপুর। বর্তমানে বাংলাদেশের
কুড়িগ্রাম জেলা। বৃহত্তর রংপুর।
এখন থাকেন কচুবন। মধুপুর অঞ্চল। জেলা কোচবিহার।
১৯৬৩ সালে দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু দেশ হারাননি।
তিনি সুধীর সরকার। বয়স ৭৯। কৃষিজীবী।
এখনো সক্ষম। শক্ত। প্রখর স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
বাড়ির পাশে ও কাছেই ছিল ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদী। এক মাইল দূরে বিশাল "বামনী বিল"।
পাঁচ মাইল হেঁটে বা গরুর গাড়িতে গেলেই চিলমারীর বন্দর।বিশাল হাট। পাইকার ব্যাপারী পাট ও তামাকের গুদাম।
বাচ্চাবয়সে আব্বাসউদ্দীনের গান শুনতে শুনতে গরম জিলিপি খাওয়া হত চিলমারীর বন্দরে।
তাদের ছিল পুবদুয়ারি ঘর। সূর্য দীঘল বাড়ি।
কত কত মানুষ আসত বাড়িতে।
দলবেঁধে কাসিম মন্ত্রীর ভোটের মিছিলের পিছে পিছে তারাও হাঁটতেন।
উলিপুর জমিদারবাড়ির রথের মেলা,হাজী সাহেবের ঈদের মেলা, কচিমুদ্দিনের ভাওয়াইয়া গান, মনভোলা ওস্তাদের রাবান গান,কালীপুজোর মেলায় কোহিনুর অপেরার যাত্রা,মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবর, চন্দ্রপুলি পিঠে সব সব উঠে আসে তার কথায়।
একটা সোনার দেশ, সোনার বরণ পাখির মতন জীবনের কোন এক গোপন সিন্দুকে জমিয়ে রেখেছেন তিনি।
আর আমি শুনছি। আবিষ্ট হচ্ছি।
আর আমার ও সুধীর জেঠুর চোখে জল।
আচ্ছা, চোখের জলের গল্পে কি লবণ মেশানো থাকে!
৮.
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু তার স্মৃতি।আবার মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার স্মৃতি। স্মৃতি আমাদের কাঁদায়,হাসায়,দূরাগত করে তোলে। ৫০ ছুঁয়ে ফেলবার পর আজকাল স্মৃতির ধূসর তাঁবুর ভেতর আমি ঢুকে পড়ি।কষ্ট হয়। আনন্দও হয়।কত কত স্মৃতি জড়িয়ে এই যে অন্তহীন বেঁচে আছি আমি! জীবনের মূল্যবান স্মৃতিগুলোকে নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবছি লিখবো।মনোবেদনার দহে ভাসিয়ে দেব কাগজের নৌকো। সেটা ১৯৯৬ সাল। অসমের গৌরীপুর শহর। গৌরীপুর মানে একশো বলির দুর্গাপুজো, রাজা প্রভাত বড়ুয়া, রাজকুমারী নীহারবালা বড়ুয়া, রাজকুমার প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া আর লালজি রাজার ছড়িয়ে থাকা মিথগুলির শরীরে হাত রাখি।আমার বন্ধ চোখের সামনে ছুটে আসে সেই কবেকার এক পৃথিবী থেকে হাতি মাহুত ফান্দি আর হাতি মাহুতের কত কত গান।ইতিমধ্যেই প্রমথেশের 'মুক্তি' ছবিতে দেখেছিলাম রাজকুমার পিসি বড়ুয়ার প্রিয় হাতি জংবাহাদুরকে।যাকে নিয়ে রচিত হয়েছিল গোয়ালপাড়ার লোকগান, কালী দাশগুপ্ত যা সংগ্রহ করে গেয়েছিলেন-
'বালাকুঠির ওরে টোকন ব্যাপরী
তেরশো টাকা দি য়া ব্যাপারী
কিনিয়া রে অনিছেন হাতি
আরে জংবাহাদুর হাতির নাম
তেরশো টাকা হাতির দাম
ওরে কামাই কাজে যেমন তেমন
মানুষ মারার যম'
গৌরীপুর মানে সরু ফিতের মতো গদাধর নদী। ছবির মতো সুন্দর নদীর বাঁক। আর রাজকুমারী প্রতিমা পান্ডে বড়ুয়া।গোয়ালপাড়ার লোকগানের রানী।লোকজীবন জুড়ে যাকে সবাই ডাকতো 'আজার বেটি' নামে। একসময় জড়িয়ে পড়লাম প্রতিমার সঙ্গে আত্মীয়ের মতন।শনিবার চলে যেতাম গৌরীপুর 'মাটিয়াবাগ প্রাসাদে'। মধ্যরাত পর্যন্ত লোকগানের ঢেউ।জীবনের গল্প শোনাতেন তিনি। শিল্পীর বা স্রষ্টার যাপনের যন্ত্রণার কথা। পাথারবাড়ির হাওয়া হাহাকার নিয়ে ঢুকে পড়ত সেই টিলার উপরের রাজবাড়ীর ভিতর। বিমল মালির কাঠি ঢোল, অনিলের দোতরা, সিতানন্দ বুড়োর সারিন্দা। সাথে দেশী মদ, নাসিরউদ্দিন বিড়ি আর চারমিনার সিগারেট।লাওখোয়ার বিশাল বিলের দিকে উড়ে যেত উড়ানি কৈতরের দল। আর গান গড়িয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ত গৌরীপুর শহরের আনাচে কানাচে-
'গদাধরের পারে পারে রে
ও তোর মাহুত চড়ায় হাতি"
ব্রহ্মপুত্রের চরে চরে কত ঘুরেছি প্রতিমার গানের দলের সাথে। দেখেছি কি অসামান্য জনপ্রিয়তা তার ভুমিলগ্ন জনমানুষের মধ্যে।প্রতিমা গান ধরলেই ফাঁকা গানবাড়িতে লহর উঠতো। মানুষ চোখে জল নিয়ে ডুবে যেতেন প্রতিমার গানে-
'হস্তীর কন্যা হস্তীর কন্যা বামনের নারী
মাথায় নিয়া তামকলসি ও
সখী হস্তে সোনার ঝাড়ি
খানিক দয়া নাই খানিক মায়া নাই
মাহুতর লাগিয়া রে'
আমৃত্যু সম্পর্ক ছিল প্রতিমা বড়ুয়ার সঙ্গে।আমার জীবনে প্রতিমা বড়ুয়া এক অসামান্য শিক্ষক। অসামান্য প্রাপ্তি। তার কাছ থেকেই লোকমানুষের যাপন ও গাননাচকে প্রবল ভালোবাসতে শিখেছি। আমার জীবন ও জীবনবোধ ধারালো হয়েছে ক্রমে ক্রমে। ভরে উঠেছি। পূর্ণ হতে পেরেছি।
প্রতিমাকে গৌরীপুরের চিতায় তোলা হচ্ছে আর একশো লোকশিল্পী একযোগে দোতরা বাজিয়ে গাইছেন-
'তোমরা গেইলে কি আসিবেন
ও মোর মাহুত বন্ধু রে'
এমত দৃশ্য ভাবা যায়! একজন লোকগানের রানীকে রাজকীয় বিদায় জানাচ্ছেন সহশিল্পীরা!
'ও জীবন রে জীবন ছাড়িয়া না যাইস মোকে
তুই জীবন ছাড়িয়া গেইলে আদর করিবে কায়
জীবন রে'
৯.
দেওচড়াই হাটের গানের আসর থেকে হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিল সখীচরণ। হাতে ধরা ছিল সেই চিরপুরাতন বাঁশিটি। তরলা বাঁশের বাঁশি। ছয় ছিদ্রের। এই বাঁশির আওয়াজ শুনলে পাষানের বুকেও আবেগের উচ্ছাস জাগে।খুনীর চোখেও জল আসে। এমনই এই বাঁশির মহিমা। প্রায় তিন কুড়ির দু’চার বছরের কম সময় ধরে এই বাঁশি সখীচরণের সম্পদ। দেশ দুনিয়ায়, গা-গঞ্জের সকলেই সখীচরণের বাঁশির মহিমা জানে।হাটবারগুলিতে হাটের ভেতর এই কারণেই সখীচরণের অতিরিক্ত খাতিরদারী জোটে।শিঙ্গারা, জিলিপি, চা, সিগার সব মিলে যায়।খালি একটু বাঁশিতে ফুঁকে দেওয়া,আর কি।সখীচরণের বাবা ছিল এলাকার মস্ত গিদাল।তার ছিল গানের দল। পালাগানের দল।সবাই বলতো কালুচরণের দল। জোতদার জমিদার মাতব্বরের ঘর থেকে নিয়মিত বায়না আসতো। কালুচরণ ঘুরে বেড়াতেন গঞ্জের পর গঞ্জের পরিধি জুড়ে। মাঝে মাঝে সঙ্গে নিতেন ছোট্ট সখীচরণকে।তখন শুরু হয়েছে সখীর বাঁশি বাজানোর তালিমপর্ব। সেই সময় একবার সাহেবপোঁতার সুখেশ্বর দেউনিয়ার বাসায় গানের দল নিয়ে পালা গাইতে গিয়েছিলেন কালুচরণ তার দল নিয়ে।ছিল সখীও। বাচ্চা সখীচরণের বাঁশি শুনে দেউনিয়া সখীচরণকে উপহার দিয়েছিল এই বাঁশিটি। তারপর কত কত দিন পার হয়ে গেল।কালুচরণ মারা গেল। জোতদারী আইন পাশ হলে জোতদারীও চলে গেল। ভরভরন্ত নদীর বুকে জেওগে উঠলো বিরাট বিরাট সব চর।গানের দল ভেঙ্গে গেলেও সখীচরণ নুতন করে আবার দল বানালেন। এদিক সেদিক বায়নাও জুটতে লাগলো।এখন আবার ভোটের আগে ভোটের লোকেরা তাকে দিয়ে গাওয়াতে শুরু করলো ‘ভোটের গান’।সখীচরণের বয়স বাড়লো। দিনদুনিয়ায় কত কত বদল এল। কিন্তু সখীচরণের বাঁশিটি কিন্তু থেকেই গেল।বাঁশিটি ক্রমে মিথের মত,দুঃখসুখের গানের মত চিরকালীনতাই বুঝি বহন করতে থাকলো।তবে কি সখীচরণের এই বাঁশিটি ডাকাতিয়া বাঁশি!কিংবা ডাকাতি করতে এসে বাঁশি শুনেই পালিয়ে যেতে থাকা মোকাম্মেল ডাকাতের সেই কিসসাটি সখীচরণের বাঁশিবৃত্তান্তের চিরস্থায়ী অংশ হয়েই স্থির হয়ে বসে থাকে!এই প্রায় মধ্যরাতের চাঁদের আলোয় ভেসে যেতে থাকা গ্রামীন পথে বাড়ি ফিরবার এই সময়ে সব কিছুই তার প্রবীন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে থাকেন সখীচরণ। তার ভ্রম ও বিভ্রমের ভেতর দিয়ে সবকিছুকে অথবা বাঁশিটিকে মান্যতা দিতে গিয়েই হয়তো সখীচরণ নিজের অজান্তেই বাঁশিটিতে ফুঁ দেন। আর সমস্ত চরাচরে ছড়িয়ে পড়ে গান -
‘তরলা বাঁশের বাঁশি
ছিদ্র গোটা ছয়
অলৌকিক চরাচরের ভিতর এভাবেই নতুন এক অলৌকিকতার জন্ম হয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴