জলতরঙ্গে জলঢাকা
অমিত কুমার দে
+++++++++++++
মা-টি
এসে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল বাঁধানো পুকুরে। তারপর হঠাৎ আমাকে আর পুকুরের মালিককে
দেখে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল গাছগাছালির ওপারে। কিন্তু তার পেছনেই তার এগারটি
ছানাপোনা। ঠোঁট নাড়াতে নাড়াতে অনর্গল কিচমিচ! তারা পুকুরে নেমে বুঝবার
চেষ্টা করল দু-পেয়ে দুটো কেমন জন্তু! আস্তে আস্তে বোধহয় বিশ্বাস জন্মাল –
ক্ষতিকারক নয়। তাই নিশ্চিন্তে সাঁতার কাটা শুরু হল। শিশুরা তো সরলই হয়!
বুনো
সরালদের (Lesser whistling duck) এত কাছ থেকে, এত সময় নিয়ে আগে দেখা হয়নি।
কিংবা দেখবার সুযোগই হয়নি। ওরা জলে সাঁতার কাটতে লাগল, আমি আর সুদর্শন
ডাঙায় সাঁতার কাটতে লাগলাম! রোদ আমাদের ঘাম ঝরাতে লাগল। আবার বাতাস এসে ঘাম
মোছাতেও লাগল।
ছাব্বিশে
সেপ্টেম্বর একুশ অর্ধেক বেলা গেল কাজে কাজে। তারপর ছুট তাঁর ডাকে। আগে
মুখোমুখি দেখিনি। কিন্তু ডাকটা এত অকৃত্রিম, নির্ভেজাল যে যাবার জন্য ভেতরে
ভেতরে একটা ছটফটানি কাজ করছিলই। বেলা দুটোয় মুঠোফোনে জানিয়েই দিলাম –
“আসছি।”
সুদর্শন ব্রহ্মচারী। চেনা ছকের মানুষ নন। তাই
বড্ড টানছিলেন। জীবনের প্রান্তবেলায় একটি মানুষ জানলেন – তাঁকে লিখতে হবে।
কিংবা এই লিখবার জন্যই তাঁর এতদিনের চলাচল। পুরুলিয়ায় বেড়াতে গিয়ে
প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের আগামি সত্তাকে আবিষ্কার করলেন একজন মেধাবী
মানুষ। প্রেসিডেন্সী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলার। রীতিমতো
পদার্থবিজ্ঞানে! মেদিনীপুরে জন্ম ও ছোটবেলা। তারপর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ
মিশনে একটি বছর পরিসংখ্যানবিদ্যা পাঠ। তারপর প্রেসিডেন্সীতে পদার্থবিদ্যা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর। তারপর দীর্ঘ অনেকগুলি বছর ডাকসাইটে
ডব্লুউ.বি.সি.এস. অফিসার। নিজেকে নানান ভাবে ভাঙা গড়া। মধ্য পঞ্চাশে পৌঁছে
তিনি জানলেন – তাঁর অনেক কথা লিখবার আছে। এবং এই লিখবার জন্যই নিজেকে একা
হতে হবে। পাহাড় নদী জঙ্গল ঘুরে বেড়ালেন এই একা হবার ঠিকানার খোঁজে। খুঁজতে
খুঁজতে কীভাবে পৌঁছে গেলেন ডুয়ার্সের জলঢাকা নদীর গায়ে। সুখানি বস্তি।
চাপড়ামারির আগে জাতীয় সড়কের পাশে ভানু মোড়। সেখান থেকে নাগরাকাটার দিকে
প্রায় তিনশ মিটার এগোলেই ফরেস্ট বীট অফিস। শুধুমাত্র লেখার জন্য, একাকি
যাপনের জন্য একটা মানুষ ছ’বিঘে জমি কিনে ফেললেন! লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে
রাস্তা বানালেন, পাথুরে জমিতে দিনের পর দিন বুলডোজার চালিয়ে সবুজের প্লাবন
আনলেন, পাঁচিল দিলেন, পুকুর বানালেন, আলোয় ঘিরলেন সবদিক! দুখানা অট্টালিকা
বানিয়ে ফেললেন! কিন্তু দৃষ্টি রাখলেন, যেন কৃত্রিম না হয় কোনো কিছু।
বীট
অফিসের গা লেগেই একখানা বড়সড় লোহার গেট। ফোনে জেনে নিয়েছি গেটের সামনে
“প্রমোদ” বলে হাঁক দিলেই হাজির হবেন সদাহাস্যময় প্রমোদ শ্রেষ্ঠা! হলও তাই।
ঢুকে পড়লাম সুদর্শন ব্রহ্মচারীর একাকি হবার হদিসে। ঘুরে ঘুরে বড় বড়
ঘাস-ছাওয়া রাস্তা ঢুকে গেছে প্রাসাদের দিকে। বাঁদিকে বন-অফিসকে রেখে। একটা
বৃদ্ধ শিমূল বৃক্ষ স্বাগত জানাল। অন্যদিকে আরেকটি বুড়ো শিমূল পাতা নাড়িয়ে
বলল “এসো”। আমার গাড়ির শব্দে ঝটপট ডানা ঝাপটে উড়ে গেল অনেকগুলো টিয়েপাখি।
চোখের সামনে একটা পুরো কাশবন, হালকা হাওয়ায় দুলছে। এবং দোতলার সিঁড়ি ভেঙে
নেমে এলেন শুভ্র শ্মশ্রু, পক্ককেশ, কিন্তু তরতাজা তরুণ – সুদর্শন
ব্রহ্মচারী। কী আন্তরিকতায় হাত চেপে ধরে বললেন – “অনেক অপেক্ষা করালেন
কিন্তু। যেদিন থেকে রাজেশ্বরী পড়েছি, এই মানুষটাকে দেখবার জন্য উদগ্রীব হয়ে
আছি!” আমি বললাম – “এ কি করেছেন। একটা আস্ত কাশবনের মালিক হয়ে বসে আছেন?”
সুদর্শন
চিনি-ছাড়া পাতিলেবুর রস মেশানো লিকার চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমায় জিজ্ঞেস
করলেন, “বলুন তো, অনেক জায়গা ঘুরে অবশেষে এটাকে পছন্দ করলাম কেন?” নিজেই
উত্তর দিলেন, “কান পাতুন, শুনতে পাচ্ছেন? হ্যাঁ, নদীর এই জলধারার শব্দের
জন্যই আমি এই জায়গাটিকে বেছেছি। নদীর ওই আওয়াজ যেন আমার বুকের ভেতর অনুভব
হয়!”
চায়ের কাপ নামিয়ে নেমে এলাম তাঁর ডুয়ার্সের
রাজ্যপাটে। আমাকে তখন ঘিরে রেখেছে পঞ্চাশটি জারুল গাছ, ষাটখানা ফলন্ত আমলকি
গাছ, তিনটি কুল, দশটি শিরিষ, আটটি চাঁপা, সাতটি সেগুন, বারোটি গামহার,
পঞ্চাশটি ঘোড়ানিম, তিনটি ছাতিম, দুটি কদম, তিনটি কৃষ্ণচূড়া এবং আরো আরো
আরো...! আমি কি ছাই সব গাছ চিনি! কত পাতাবাহার, শাকপাতা, ফুলের গাছ।
সন্ধে
গড়াচ্ছে রাত্রির দিকে। জলঢাকার গানের আওয়াজ ক্রমে বাড়ছে। সুদর্শন বললেন –
“রাজেশ্বরী পড়ুন।” আমি পাতা ওলটাচ্ছি। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে রাজেশ্বরী ঠিক
নদীর পাশে কোনো পাথরে বসে আছে, ওর পায়ের পাতা খরস্রোতা জলে ভিজছে, ও আমায়
ভাবছে! কিংবা আজ রাতে গোটা জলঢাকাই আমার রাজনন্দিনী!
সুদর্শন
ওঁর বোধের কথা বলছেন, ভাবনার কথা বলছেন, পাঠের কথা বলছেন, জীবনের কত
ঘাত-প্রতিঘাতের কথা বলছেন, নিকটজন দূরের জনের কথা বলছেন, ছোটবেলার কথা
হস্টেল জীবনের কথা, নাইট ক্লাবের কথা, ভেঙে যাওয়া রাশিয়ার অভাগী বেশ্যাদের
কথা, লোকশিল্পীদের কথা, নিজেকে ধ্বংস করার কথা, নিসর্গের দুর্নিবার টানের
কথা বলেই চলেছেন। শুনছি ব্যাসদেবকে খুঁজতে কীভাবে গোমুখে গিয়েছেন। কীভাবে
ভিনরাজ্যের দুর্গম পাহাড়ি গাঁয়ে মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। কীভাবে শেকড় খোঁজার
জন্য পানবাড়ি গ্রামের আরণ্যক প্রান্তে মানুষের কাছে পৌঁছেছেন এক টালমাটাল
সময়ে। কীভাবে নিসর্গ আর মানুষের কাছাকাছি গিয়ে তিনি উপন্যাস লিখছেন, লিখবেন
– সুদর্শন বলে চলেছেন। ঘন হয়ে আসছে তাঁর কন্ঠস্বর – “আমার যা কিছু
চাওয়াপাওয়া সে তো সুন্দরের পথে ঋণশোধ করে ছুটে চলা।” ... কন্ঠস্বর ছাপিয়ে
আমার ভেতর মাঝে মাঝেই ঢুকে যাচ্ছে জলঢাকা নদী!
প্রমোদ
এসে বেড়ে দিলেন রাতের খাবার। ওর বৌ মীনা আর মেয়ে প্রিয়াঙ্কা রেঁধেছে। সবজি
ডিমের কাড়ি স্কোয়াশের তরকারি আলুভাজা রুটি। যেন অমৃত ছোঁয়ানো!
ভোর
পাঁচটায় প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালাম। দিন জাগছে। পাখিরা জেগে উঠেছে। দিগন্তে
নীল পাহাড়রা জেগে উঠেছে। ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন
সুদর্শন। বললেন – “চলুন, গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে পড়ি।”
জলঢাকা
ব্রিজে দাঁড়াতেই দেখলাম – পাহাড় ঝুঁকে নদীকে দেখছে! চাপড়ামারিও দেখছে।
আমিও তাদের অনুসরণ করলাম। নদীর বুকে একফালি দ্বীপ, বেশ একটা মাটির
স্থাপত্যের মতো। ব্রিজে দাঁড়িয়ে এক নেপালি ভদ্রলোককে সুদর্শন জিজ্ঞেস করছেন
– “আমায় রুদ্রাক্ষের চারা দিলেন না তো? কবে পাব?” তিনি জানিয়ে দিলেন আজই
পৌঁছে যাবে রুদ্রাক্ষ, চা-বাগান থেকে আনিয়ে রেখেছেন।
আমরা
ঢুকে পড়লাম মূর্তির জঙ্গুলে রাস্তায়। ভোরবেলাকার রোদ গাছেদের জাগিয়েছে।
অদ্ভুত স্নিগ্ধ আলোছায়া। একটা বুনো ঝোরার পাশে গাড়ি থামালাম। কালভার্টে
বসলাম। চোখে এল দুটো লম্বা লেজ কাঠবেড়ালি। প্রেমিক-প্রেমিকাই হবে। তাদের
আদর খুনসুটি আমাদের মন ভালো করে দিতে থাকল। কী অনায়াসে এক গাছ থেকে আরেক
গাছে তারা লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছিল!
মূর্তি নদীর সেতুর
কাছে পৌঁছতেই উচ্ছ্বাস সুদর্শনের গলায় – “আহা, কাঞ্চনজঙ্ঘা!!” দিগন্তে সাদা
ঝকঝকে সেই কাঙ্ক্ষিত চূড়া। পাগলের মতো ধরে রাখতে চাইছেন সুদর্শন। বন্ধের
দিনেও আমি খুঁজে বের করলাম একটা চায়ের দোকান, বাড়তি পাওনা সবজি-মোমো।
জঙ্গলকে
সারা শরীরে মেখে আমরা যখন ফিরলাম, আগুনের মতো রোদ। হাওয়া দিয়েছে বেশ।
প্রমোদ জানিয়ে গেল কাল রাতে হাতি এসে পাঁচিলের একটা অংশ ভেঙে দিয়ে গেছে।
দেখলাম গোদা গোদা পায়ের ছাপ। কাশবনে মায়াবী দোলা। আমরা সেদিকেই চললাম।
আর
সেখানেই আমাদের সরাল উপাখ্যান। এগারটি সরালছানা তরঙ্গ তৈরি করে করে সাঁতার
কাটছে। সুদর্শনের ক্যামেরায় ক্লিকের পর ক্লিক। মা সরাল মাথার ওপর চক্কর
দিচ্ছে। আমি চক্কর খাচ্ছি সুদর্শনের স্বপ্নপূরণের সাম্রাজ্যে!
সন্ধেয়
ফিরে এলাম আমার খাঁচায়। আকাশে বিদ্যুৎ চমক। বৃষ্টি আসবে। হঠাৎ তখুনি
সুদর্শনের এস.এম.এস. এল – “টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। বাজ পড়ছে। গুরুগুরু আওয়াজ
ছড়িয়ে পড়ছে। জোনাকিরা ভিজে ভিজে আড়ালে চলে গেছে। মাটির গন্ধ উঠে আসছে।
বিচিত্র ক্যানভাসে আমি ছুটোছুটি করছি। শূন্যতা রঙিন ফাঁদের মতো হাঁ করে
আছে। পা বাড়ালেই আমাকে গিলে খাবে। হাওয়া বাড়ছে কমছে, আসছে যাচ্ছেও, সশব্দে
কিংবা নীরবে গায়ে কিংবা মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। কাশবন ভিজে ভিজে ভেজা শাড়ির
মতো কালো কালো কাঠি আঁকড়ে ভিজছে। শরকাঠিদের এখন দারুণ উত্তাপ চাই। আগুন
চাই। ... আমারও আগুন চাই। পুড়ে খাক হয়ে যেতে চাই।”
আমার
ভেতরেও একটা ঝড় তখন। এভাবে একটা ভুবন যদি আমার একার হত। একাকি হওয়ার হত।
আমি আর নদী অনেক কথা বলতাম। আমার যে নদীকে অনেক কিছু বলবার ছিল!