চা -ডুবুরি : পর্ব-৩
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^
ডুয়ার্স : ঘরের ফেরার শৈশব
'ডুয়ার্স
বড় মোহময়ী সুবর্ণ। এর মোহ ছেড়ে কোথাও যাওয়া যায় না। মাত্র এগারো মাস
বয়সে ডুয়ার্সে আসি। সেই থেকে ডুয়ার্সেই রয়ে গেলাম। মৃত্যুর পর এই
মাটিতে মিশে যেতে পারলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে। '
বলতে বলতে সত্যপ্রিয় আনমনা হয়। চোখের বিষাদজলে ভেসে ওঠে মাটির প্রতি গভীর অব্যক্ত ভালবাসা ।
এমন দুর্বল মুহুর্তে স্মৃতি উস্কে দিয়ে আরো কিছু তথ্য জেনে নেওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করে না সুবর্ণ।
'জন্মের
পর যেদিন প্রথম ডুয়ার্সে এলেন সেদিনকার কথা কখনো শোনেননি মায়ের কাছে?
কিভাবে এলেন, কোন পথে? কেমন ছিল সেই দিনটা...' বলে সুবর্ণ মোবাইলের
রেকর্ডারটা অন করে ।
নিজেকে
কিছুটা সামলে নিয়ে সত্যপ্রিয় বলতে থাকেন,'হ্যাঁ, মা'র মুখে বেশ কয়েকবার
শুনেছি বটে। বাবা আমাদের আনতে যেতে পারেননি। গেছিলেন ছোট কাকা। কাকা
জটেশ্বরে থাকতেন। ছোটোখাটো ব্যাবসা করতেন। মাঝে মাঝেই চলে যেতেন দেশের
বাড়ি। মনে আছে পৌষ সংক্রান্তির আগে গামছায় বেঁধে যত্ন করে নিয়ে আসতেন
পাটালি গুড়, পিঠে তৈরীর ছাঁচ, কত কি! তো, সেই কাকার সাথেই মামাবাড়ী থেকে
আমাকে কোলে করে কোনো এক অঘ্রাণের সকালে রওনা দেন মা। কাজলিডাঙায় পৌঁছন
পরদিন বিকেলে। '
সত্যপ্রিয় বলে যেতে থাকে আর সুবর্ণর চোখের সামনে ভেসে ওঠে তিরিশের দশকে, অবিভক্ত বাংলার মধ্যরাতের একটি রেলস্টেশন।
অঘ্রাণের
হিমঝরা গভীর রাত। কুয়াশার পাতলা চাদর মুড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সুনসান
লালমণিরহাট স্টেশন। বেশ কিছুক্ষণ আগে পার্বতীপুরের দিক থেকে হাই তুলতে
তুলতে একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন মিটারগেজ লাইনের প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায়।
সিগন্যাল না পেয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অতিকায় কালো
সরিসৃপটারও যেন চোখ লেগে গেছিল। স্টিম ইঞ্জিনটা থেকে থেকে নাক ডাকার মতো
ফোঁসফাঁস শব্দ করছিল ধোঁয়া ছেড়ে । ছেঁড়া কাঁথাকানিতে আপাদমস্তক মুড়ে
শুয়ে থাকা দু'চারটে ভবঘুরে, ইতস্তত কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকা কিছু কুকুর
ছাড়া পুরো স্টেশন চত্বরটাই ফাঁকা। একটা মাত্র চায়ের দোকান। তাতেও ঝাঁপ
ফেলে দোকানি সাত তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেছে। প্ল্যাটফর্মে ইতস্তত গুটিকয়
টিমটিমে গ্যাসের আলো ছাড়া অদূরে স্টেশন মাস্টারের ঘরের আলোটাই কেবল চোখে
পড়ে। রেল লাইনের ধারে সিগন্যালের রক্তচক্ষু চোখ রাঙাচ্ছিল অন্ধকারকে। অনেক
দূরে দোতলা কেবিনঘরের ভেতর লন্ঠনের মড়া-হলুদ-রঙা আলো ভাঙা কাচের জানালায়
চোখ রেখে দেখে নিচ্ছিল কত রাত হলো।
ট্রেনের
কামরায় অধিকাংশ যাত্রীই তলিয়ে গেছিল গভীর ঘুমে। দু'একজন জেগে থাকা যাত্রী
ঘুমজড়ানো চোখে জানালা দিয়ে স্টেশনের নাম খোঁজার চেষ্টা করছিল। তেমনই
একজন,জানালার ঝাঁপ খুলতেই ভেতর থেকে নারীকন্ঠ শোনা যায়,
-' গাড়ি ছাড়ে না কেন ঠাউরপো? এইটা কোন স্টেশন...'
-' কি যেন্। আন্ধারে বুঝাও যায় না। মনে হয় লালমণির হাট।'
' রাত কত হ'লো? '
লোকটি ফতুয়ার পকেট থেকে ট্যাঁকঘড়িটা বার করে বলে,'দেড়টা...'
-"কা'ল কাজলিডাঙা পৌঁছাতে ঢের দেরি হবে মনে হয়..."
কথা শেষ হয় না তার আগেই শিশুর কান্না শোনা যায়। কান্না তীব্রতর হওয়ার আগেই তাকে স্তন পান করিয়ে শান্ত করার চেষ্টা চলে।
-'ক্ষিদা পাইছে মনে হয় তোমার ব্যাটার।'
-'কে জানে। সেই থিকে বারবার উঠে পড়তেসে।'
-"এই প্রথম ঘর থিকে বাইর হৈছে না! তার উপর গাড়িও চলতেছে যেন্ কাউঠ্যার নাহান্...'
কান্না থামতেই আবার মৃদু নারীকন্ঠ শোনা যায়, 'তুমি ঘুমাও নাই কেন?
-' রাতের ট্রেন আমার ঘুম আসে না। ভয় লাগে। তুমি বরং একডু হুইয়া নাও না ক্যান বৌঠান। '
কথোপকথন
থেমে যায়। ঘুমন্ত ছেলের পাশে আলগোছে শরীরটা এলিয়ে দেয় সুনয়নী। ঘুম
তারও আসে না। এই প্রথম স্বামীকে ছাড়া কোথাও যাচ্ছে সে। বিয়ের পর স্বামীর
পাশে বসে এরকমই রাতের ট্রেনে প্রথম কাজলিডাঙায় যাওয়া। মনে আছে সেদিনও
পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমেছিল। দলগাঁও স্টেশনে এই বিনোদ ঠাকুরপো-ই
বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল গরুর গাড়ি নিয়ে। জায়গাটা ফাঁকা। ইতস্তত
ঝোপঝাড়। কাছাকাছি একটাও বাড়িঘর নেই। কিছুটা দূরে আদিগন্ত বেঁটে বেঁটে
গাছের জঙ্গল। গাড়ি থেকে নেমে হাঁ করে সুনয়নীকে সেদিকে চেয়ে থাকতে দেখে
কুমুদ কানের কাছে মুখ এনে বলেছিল, 'কী দেখছো? ওগুলোই তো চায়ের গাছ।'
অবাক চোখে স্বামীর চোখে তাকিয়ে সুনয়নী বলেছিল, 'সত্যি! কই চা তো দেখি না গাছে ? '
কথা শুনে সকলে হেসে উঠলেও কুমুদ হাসে না। শান্ত স্বরে বলে,'চা, গাছে ধরে না নয়ন। পাতা তুলে নিয়ে গিয়ে কারখানায় চা তৈরি হয়। '
নিজের
অজ্ঞতায় লজ্জা পেয়েছিল সেদিন সুনয়নী। গাড়িতে জিনিস পত্তর চাপিয়ে
দুজনে উঠে বসতেই গরুর গাড়ি ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দে চলতে শুরু করে। সন্ধে গাঢ়
হয়ে ততক্ষণে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে । যতদূর গাড়ি এগোয় চারদিকে মাইলকে
মাইল জুড়ে শুধু চায়ের জঙ্গল। সামনে হ্যাজাক জ্বালিয়ে ছেলেরা চলেছে হৈ
হৈ করতে করতে । ওরা থামলেই কেবল ঝিঁঝিঁ র ডাক আর গরুর গলায় ঘন্টার টুং-টাং
শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। কোথাও আলো নেই। জনপ্রাণী নেই। কোন বনবাসে
চলেছে ভেবে বুক ঠেলে কান্না আসতে থাকে সুনয়নীর। পথ যেন ফুরোতেই চায় না।
একসময় ছেলেরা অনেকটা দূর এগিয়ে যায়। গরুর গাড়িটা যখন একটা ছোট্ট নালা
মত জলাশয় পেরোতে থাকে দূরে কোথাও ফে-উ-উ শব্দ করে কিছু একটা ডেকে ওঠে।
ভয়ে কুমুদকে জড়িয়ে ধরে সুনয়নী। কুমুদ অভয় দেয়, 'ভয় পেও না। ওটা
শেয়াল। বাঘের গন্ধ পেলেই ওরা ওরকম আওয়াজ করে মানুষকে সজাগ করে দেয়। '
কথা
শুনে হাড় হিম হয়ে যায় সুনয়নীর। হাউ-হাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিয়ে
বলে,'কোন বনজঙ্গলে তুমি থাকো! আমি একদিনও এইখানে থাকতে পারব না।'
বাড়ির
গেট অবধি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না চলেছিল। গেটে শাশুড়ি ননদরা দাঁড়িয়েছিল
বরণের অপেক্ষায়। চোখ মুছে, মাথা নিচু করে সেই যে আলতায় পা ডুবিয়ে
সংসারে ঢুকেছিল সুনয়নী, এক যুগ পেরিয়েও কাজলিডাঙার বাসাবাড়ির সাথে তার
সম্পর্ক ঘুচলো না। বছরে একবার ফরিদপুরের বাপের বাড়িতে গিয়েও বেশিদিন মন
টেঁকে না। কাজলিডাঙার সংসারেই মনটা পড়ে থাকে।
এবারে
যদিও আরও ক'টা দিন বাপের বাড়িতে কাটিয়ে শীতকালটা পার করে আসবে ভেবেছিলে
সুনয়নী। শীতে কাজলিডাঙায় যা ঠান্ডা ! বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে না পড়ে।
কিন্তু কুমুদের চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই মনটা উচাটন হয়ে ওঠে। ছেলে
জন্মানোর পর একবার মাত্র দুদিনের জন্য আসতে পেরেছিল কুমুদ। তারপর আর আসা
হয়ে ওঠে নি। পুজোয় আসার কথা ছিল। সেটাও হলো না। কাজলিডাঙায় এবারে নাকি
প্রথম দুর্গাপুজো হয়েছে, যার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পড়েছিল কুমুদ মাস্টারের
ওপর। কাজলিডাঙা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক কুমুদরঞ্জন ঘোষকে বাগানের
ম্যানেজার থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই মানে। ভালবাসে। শ্রদ্ধা করে। দায়িত্ব
এড়িয়ে চলে আসতে তাই বিবেকে বাধে কুমুদের।
চোখ
বন্ধ করতেই বড়ছেলে বিশুর মুখটা মনে পড়ে যায় সুনয়নীর। ছেলেটা আসবে বলে
বায়না ধরেছিল। বলছিল বাবাকে দেখেই আবার ফিরে আসবে কাকার সাথে। পলাশপুর
হাইস্কুলে সদ্য ভর্তি হয়েছে ছেলেটা। বাগানের কাছাকাছি কোনও হাইস্কুল নেই
বলে ওকে ওখানেই ভর্তি করতে হয়েছে। সামনে পরীক্ষা। ওকে রেখে না এসে যে
উপায়ও ছিল না।
চিঠিতে সরাসরি যাওয়ার কথা না লিখলেও
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার বাচ্চাটার কথা জানতে চাইতো কুমুদ। সুনয়নী বুঝতে
পারে বাপের মন ছটফট করছে দেখার জন্য। তাছাড়া কাজের লোকটা না এলে শীতে
কুমুদের কষ্ট হয় হাত পুড়িয়ে খেতে । সেসব ভেবেই আর থাকতে পারে নি
সুনয়নী। ব্যাবসার কাজে বিনোদ দেশের বাড়ি যেতেই কোলের শিশুকে নিয়েই ওর
সাথে রওনা দিয়েছে সুনয়নী।
পলাশপুর ছেড়ে আসার
সময় সবাই দেখতে এসেছিল তাদের আদরের সতুকে। সত্যপ্রিয় নামটা কুমুদের
দেয়া। সত্যপ্রিয় থেকে সতু। শ্বশুর বাড়ির নিয়ম মতো মুখেভাতের দিন নামকরণ
হয় । অন্নপ্রাশনে আসতে পারবে না জেনে তাই কুমুদ চিঠিতে লিখে জানায়,
'বড়খোকা বিশ্বপ্রিয়র নামের সাথে মিল রাখিয়া ছোটখোকার নাম রাখিলাম
সত্যপ্রিয়। আশা করি সকলের পছন্দ হইবে।'
গ্রামের
বাড়ি থেকে হেঁটে পলাশপুর রেল স্টেশন। সেখান থেকে কালুখালী পর্যন্ত সাটল
ট্রেনে এসে ফের অন্য ট্রেনে চাপা। ধকল কম যায় নি। কখন যেন ঘুমিয়ে
পড়েছিল। বিনোদের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে সুনয়নীর।
'বৌঠান উইঠা পড়ো। বিহান হইসে। লাটাগুড়ি আইসা পড়সি।'
চোখ
মেলে উঠে বসে সুনয়নী। জানালা দিয়ে তাকাতেই চোখে পড়ে চারদিকে ঘন জঙলের
মাঝে ছোট্ট একটা স্টেশন। ছিমছাম। লোকজন তেমন নেই। অঘ্রাণের মিষ্টি রোদ
গাছের ফাঁক দিয়ে এসে ছড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মের ওপর, স্টেশনের চালাঘরে
লতিয়ে ওঠা বোগেনভিলিয়া গাছের গায়ে। চারদিকে পাখির ডাকে ভরে আছে
জায়গাটা। একজন হকার "চায়-চায় " বলে চলে যাচ্ছিল জানালার পাশ দিয়ে।
বিনোদ ডাকে তাকে। সুনয়নীকে জিজ্ঞেস করে , 'চা খাবা নাকি ? '
সুনয়নী চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'এখান থেকে আর কদ্দূর ঠাউরপো? '
-'দুপুর হইবো মনে হয়। বাড়ি পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে হেই বিকাল। '
ট্রেন
চলতে থাকে। চারদিকে ঘন অরণ্যের আলোছায়া পেরোতেই চায়ের বাগান, দূরে
পাহাড়, জঙ্গল সব মিলিয়ে মন জুড়িয়ে যাওয়া দৃশ্যমালা। দুলকি চালে হুইসেল
দিতে দিতে এগিয়ে চলেছিল ট্রেন।
'সেদিন
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নাগাদ আমরা দলগাঁও স্টেশনে নামি। বাবা গাড়ি পাঠিয়ে
দিয়েছিলেন কাজলিডাঙা থেকে। গণশুর গরুর গাড়ি। গণশু ছিল আমাদের বাগানের
বাবুদের বাঁধা গাড়োয়ান। কাউকে স্টেশনে পৌঁছনো, শহরে আনা নেয়া করা সব ওর
গাড়িতেই। যেদিন কাজলিডাঙায় এলাম বাবা নাকি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন
আমার জন্য। পৌঁছতেই কোলে নিয়ে আমাকে অনেকক্ষণ আদর করেন। ছোটবেলায় বাবার
সাথেই তো ছিল আমার যত আবদার, আহ্লাদ। অথচ বড় হবার সাথে সাথে দেখতাম বাবা
কেমন যেন গুটিয়ে যাচ্ছেন। অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি হলো আমাদের ভেতর। সেসময়
মায়ের সাথেই আমার যত কথা হতো। মা, আমার মা...অমন শান্ত, বুদ্ধিমতী,
স্নেহপ্রবণ মা এখন চোখে পড়ে না সুবর্ণ। ইদানীং মাকে খুব মনে পড়ে। রাতে
মাকে স্বপ্ন দেখি। মা এসে মাথায় হাত রেখে বলছেন, 'তুই ভাল নেই, না রে
সতু...' মায়ের চোখে জল। '
সত্যপ্রিয়
চুপ করে যায়। স্তব্ধতা দেয়াল তোলে দুজনের ভেতর। মোবাইলের রেকর্ডারটা
বন্ধ করে সুবর্ণ বলে,' আজ তবে এই পর্যন্তই থাক কাকাবাবু। আমি উঠি। সন্ধে
হয়ে আসছে। অনেকটা পথ যেতে হবে। '
-'যাবে?'চশমার
ভেতর দিয়ে শূণ্য চোখে তাকিয়ে থাকে সত্যপ্রিয়। সুবর্ণ উঠে পড়ে বাইকে।
স্টার্ট দিয়ে উঠে আসে বড় রাস্তায় । সেখান থেকে নীলপাহাড়ি প্রায় চল্লিশ
কিলোমিটার। অ্যাকসিলেটারে চাপ বাড়ায় সুবর্ণ।